মাইন্ডগার্ড,পর্ব:৫

অরিত্রার হাত থেকে চিঠিটা নিচে পড়ে গেলো। জানালার পাশে বিছানার এক কোণায় স্তম্ভিত হয়ে বসে পড়লো সে। অরিত্রা অনুপমের অসুস্থতা নিয়ে একেবারেই মাথা ঘামায়নি, এতকিছু হতে পারে সে একবারও ভাবেওনি। আচমকা ইলেক্ট্রিসিটি চলে গেলো। আকাশে কালো মেঘের ঘনঘটা। বাড়ির পাশের বড় বড় গাছগুলো ঝড়ের ঝাপটায় দুলতে শুরু করেছে। ঝড়ো হাওয়ায় জানালার পাল্লাদুটো অরিত্রার নিরবতা ভাঙ্গার বৃথা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। অরিত্রা ঝাপসা চোখ মেলে আকাশভাঙ্গা বৃষ্টি দেখছে। বৃষ্টির বড় বড় ফোঁটা অরিত্রার মুখে পড়ে তার নেত্রের কোনার জলকে আড়াল করছে। অচেনা এক মায়া তাকে ঘিরে মায়াঘোর সৃষ্টি করেছে যেনো।

এরপরে বেশকটাদিন চলে গেলো।
অনুপমের চিঠিটা পাওয়ার পরেও অরিত্রা অনুপমের সাথে কোনো যোগাযোগ করেনি। অনুপমও আর যোগাযোগ করেনি। অরিত্রার হবু বরের বড় ভাই দেশের বাইরে কাজে আটকা পড়ায় বিয়ের ব্যাপারে কোনো কথা এখনো হয়নি। এক-দুমাস ছেলে সময় চেয়েছে মেয়েকে ভালোভাবে চেনার জন্য। অরিত্রার সাথে সে কয়েকদিন বাইরে দেখা করবে বলেছিলো। প্রথমদিন সে গিয়েছিলো। কিন্তু তারপর কোনো একটা অজানা কারণে অরিত্রা ব্যস্ততা দেখিয়ে এড়িয়ে গেছে। শুভ ছেলেটা আসলেই চমৎকার। কথা বলা, হাঁটাবসা, চালচলন সবকিছু অত্যন্ত ভদ্র, মার্জিত। পড়নের কাপড় থেকে খাওয়ার ধরণ সবকিছুই পরিপাটি। অরিত্রার তেমন ভালো লাগেনি। তার বারবার মনে হয়েছে, তার মতোন আনমনা স্বভাবের একটা মেয়ের সাথে এত গোছালো একটা ছেলের যায়না। অনুপমও অবশ্য বেশ গোছালো স্বভাবের। কিন্তু অনুপমের মাঝে এমন কিছু একটা রয়েছে যেটা শুভর মধ্যে একেবারেই নেই। অরিতৃরা ধরতে পারছেনা এই “এমন কিছু” টা আসলে কি।

দেখতে দেখতে দু সপ্তাহ কেটে গেলো। বিকেলবেলা অরিত্রা চায়ের কাপ নিয়ে ছাদে বসে আছে। ছাদের পুরোটা জুড়ে নানান ধরণের গাছগাছালিতে পরিপূর্ণ। এককোণায় খড়ের ছাউনির নিচে একটা মাঝারি কাঠের গোল টেবিল, আর তার দুপাশে কাঠের উপর খোদাই করে নকশা করা দুটো চেয়ার। তার পাশেই পাখির খাঁচা। খাঁচায় দুটো ধবধবে সাদা ময়ূরপঙ্খী কবুতর পাখা মেলে বসে আছে। ছাদের অপর প্রান্তে একটা দোলনা। অরিত্রা নিজে শখ করে ছাদটা সাজিয়েছে। এবাড়ির মধ্যে ওর সবচেয়ে পছন্দের স্থান এটা। গন্ধরাজ, বেলি, শেফালি ফুলের মিষ্টি গন্ধে চারিদিক মৌ মৌ করছে। অরিত্রা সন্ধ্যে হওয়া পর্যন্ত ছাদেই থাকলো। হঠাত আকাশের দিকে তাকিয়ে অস্থির হয়ে উঠলো। ভাবার চেষ্টা করলো আজ কি বার! আজ শুক্রবার মনে পড়তেই ছুটে নিচে নেমে এলো। মাসুদকে ফোন দিলো গাড়ি বের করার জন্য। মাসুদের ফোন অফ পেয়ে একাই বাইরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলো। অরিত্রা আজ অনেক সুন্দর করে সাজবে। মনের মাধুরী নামক প্রসাধনী দিয়ে নিজেকে রাঙাবে। মায়ের পুরোনো ট্রাঙ্ক ঘেটে লাল রঙের শাড়িটা বের করলো সে। চোখে হালকা কাজলের ছোঁয়ায় অপূর্ব লাগছে তাকে।

অরিত্রা ধীরু পায়ে মোতাহার আহমেদের ঘরে গিয়ে দেখলো তিনি এ অসময়ে রকিং চেয়ারে বসে ঘুমাচ্ছেন। অরিত্রা বাবাকে জাগালোনা। নিঃশব্দে বাসা থেকে বেড়িয়ে আসলো।

তার নিজেকে আজ স্বাধীন মনে হচ্ছে। একটা রিক্সা নিয়ে সে অনুপমের বিশাল বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ালো। দাঁড়োয়ান তাকে আটকালোনা। দরজা খুলে দিলো। আগেও দুদিন এসেছিলো সে, অনুপমের অসুস্থতার সময়ে। তখন থেকেই দারোয়ানকে বলা ছিলো হয়তো, সে আসলে যেন না আটকানো হয়!
অরিত্রা ভিতরে ঢুকে মিনুকে বাগানে দেখে এগিয়ে গেলো।

“মিনু, তোমার ভাইয়া বাসায় আছে?”

মিনু চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে বললো,
“অরিত্রা আপু, তুমি? ভাইয়া ঘরেই আছে।”

“তুমি কেমন আছো? আন্টির শরীর ভালো?”

“হ্যাঁ। কিন্তু তুমি…..”

অরিত্রা মিনুর কথার অপেক্ষায় রইলোনা। অনুপমের ঘরের দিকে ছুটে গেলো। দোতলার কর্ণারের ঘরটা অনুপমের।

অনুপমের ঘর অন্ধকার। অরিত্রা ঘরে ঢুকে বাতি জ্বেলে দিলো। অনুপম শুয়ে ছিলো, তাকে দেখে উঠে বসলো। চোখে চশমা দিয়ে হাঁ করে তাকিয়ে রইলো তার দিকে।

“তাড়াতাড়ি উঠুন। একটা জায়গায় যাবো।”
অনুপম এখনো মুখ হাঁ করেই বসে আছে।

“আরে উঠুন, উঠুন”

অরিত্রা অনুপমের হাত ধরে প্রায় টেনে ছাদে উঠা শুরু করলো।

ছাদে এসে রেলিংয়ে হেলান দিয়ে দাঁড়ালো।

“আমায় এখানে কেনো আনলে, অরিত্রা?”

“কি সুন্দর জ্যোৎস্না আকাশে আজ! আর আপনি ঘরে বসে আছেন?”

অনুপম আকাশের দিকে এক পলক তাকিয়েই চোখ নামিয়ে নিলো। তার দুচোখ রক্তবর্ণ ধারণ করেছে।

“দেখুন তো আমাকে কেমন লাগছে?”
অনুপম এতক্ষণে ভালো করে অরিত্রার দিকে তাকালো। অনুপমের চোখের কাঠিন্য সরল হতে শুরু করেছে। সে মুগ্ধ চাহনি নিয়ে তাকিয়ে রইলো! অরিত্রা হঠাত হাত বাড়িয়ে বললো, “Please hold my hand & take myself as yours…”

অনুপমের মুখ আবার কঠিন হতে শুরু করলো।

“কি ভাবছেন? আমি আপনাকে দয়া করছি? মোটেও না। আমি ভাবলাম, এনগেজমেন্টের আংটি ফেরত দেয়ার চেয়ে আপনাকে গলায় ঝুলিয়ে ঘোরাটা বেশি ভালো!”

অরিত্রা মিটিমিটি হাসছে। অনুপমের চোখ কপালে উঠে গেছে। সে এমন কিছু আশা করেনি।

এক সেকেন্ড…দু সেকেন্ড…অরিত্রা মনে মনে গুনছে। তিন সেকেন্ড হওয়ার আগেই অনুপম হেসে দিলো। ছেলেটা কি সুন্দর করে হাসছে! কোন বইয়ে যেনো পড়েছিলো, যারা খুব কম হাসে, তাদের হাসি নাকি অসম্ভব সুন্দর হয়।

এখন অনুপমের দিকে অরিত্রা মুগ্ধ চাহনি আর হাঁ করা মুখ নিয়ে তাকিয়ে আছে। অনুপম হাসতে হাসতে হঠাত চুপ করে গেলো। অরিত্রা জ্যোৎস্নার আলোয় স্পষ্ট দেখলো অনুপমের চোখের কোণায় জল।
অনুপমের দুহাত নিজের দুহাতের মাঝে নিয়ে অরিত্রা বললো,
“অনুপম…. খুব ছোটবেলায় আমি আমার মা কে হারিয়েছি। মার চেহারাটাও আমার মনে নেই। মা কিভাবে ভালোবাসে আমি জানিনা। তাই ভালোবাসার তেষ্টা কেমন হয় আমি জানি। অনুপম, আমি জানিনা আমি তোমায় সত্যিই ভালো রাখতে পারবো কিনা। তবে তোমার হৃদয়ের সব অপূর্ণতা ভাগ করে নেবো আমি কথা দিলাম। দেখো, সৃষ্টিকর্তা প্রত্যেকের জন্য নির্দিষ্ট কিছু সময় রাখেন। সেটা আমাদের মেনে নিতে হবে। তিনি কাউকে পুরোপুরি পূর্ণ করেননা, আবার শূন্যও রাখেন না। মনে করো না যে তোমার শূণ্যতা খানিকটা হলেও পূরণ করতে তিনি আমাকে পাঠিয়েছেন..”
অরিত্রা থামলো।
সুনসান নিরবতা বিরাজ করছে দুজনের মাঝে।

“অনুপম, আমি তোমাকে ভালোবাসি। তোমার হাত ধরেই আরো হাজারো বছর জ্যোৎস্নাবিলাস করতে চাই। আমাকে ফিরিয়ে দিওনা আজ, প্লিজ।”

অনুপম হেসে কিছু একটা বলতে গিয়েও থেমে গিয়ে অরিত্রার থেকে নিজের হাতটা সরিয়ে নিলো।

“কিন্তু, আমি তো কোনো চশমা চোরকে বিয়ে করবোনা।” রাগের ভান করে বললো অনুপম।

“তার মানে তুমি চশমা ছাড়াও চোখে দেখো?” কাঁচুমাচু মুখ করে প্রশ্ন করলো অরিত্রা।

“নাতো! আমি তো চশমা ছাড়া কিছুই দেখিনা!”

“তাহলে জানলে কিভাবে তোমার চশমা আমিই নিয়েছি?”

“মনের চোখ দিয়ে তোমার মন পড়ে ফেলেছি,” রহস্যঘন চোখে তাকিয়ে বললো অনুপম।

“মনের চোখ হয়?” অভিমানী সুরে অরিত্রা বললো!

“হয়না বুঝি? তাহলে তোমার মনের সবকিছু আমি বুঝি কিভাবে বলোতো?”

“তাইতো! কিভাবে বলোতো?”
অনুপম কিছু বললোনা। মুচকি হেসে হাঁটু গেড়ে বসে হাত বাড়িয়ে বললো, “I want to be your Mindgruard for our whole life… Aritra, will you give me a chance?”

অরিত্রা কয়েক সেকেন্ড চমকে তাকিয়ে রইলো। তারপর চোখ টিপে বললো, “সুযোগ দিতে হয়না, স্যার; করে নিতে হয়।”

((সমাপ্ত))

অপূর্ণতা নিয়েই জীবনটা ঘেরা। সম্পর্ক এমন একটা শব্দ যা, দুজন মানুষের অপূর্ণতাকে ভাগ করে দেয়, দুজনকে দুজনাতে পূর্ণ হতে শেখায়। 💜

Mindguard~মাইন্ডগার্ড
লেখিকাঃ জান্নাতুল মীম (নবনীতা)
#মাইন্ডগার্ড
#Mindguard
#পঞ্চম_ও_শেষপর্ব
তারিখ: ১৭ জুন, ২০১৮

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here