মায়ন্তী পর্ব -০৯

#মায়ন্তী
#রাইদাহ_উলফাত_আনিতা
#পর্ব_০৯

মায়ন্তী হ্যাঁ বলেই সোজা নিজের রুমে চলে যায়। আর পিছনে তাকায় না। জোড়ে শব্দ করে দরজা লাগিয়ে দেয়।

মায়ন্তী রুমে এসে নিজের বিছানায় নুইয়ে পড়ে দু-চোখ বেয়ে অঝরে পানি ঝরছে। বুকের ভিতরে দাউদাউ করে আগুন চলছে। মনে হচ্ছে পুরো পৃথিবীটা মায়ন্তীর আজ একা লাগছে। কেউ নেই মায়ন্তীর।

মায়ন্তী আজ সেই পুরনো অতিত চার বছর আগের কথা ভাবছে। ————————-

মায়াঙ্ক মায়ন্তী’দের গ্রামের বাসায় যায়। মায়ন্তী তখন ক্লাস টেনে পড়ে। আর মায়াঙ্ক মায়ন্তীর থেকে ৭ বছরের বড়। মীনাক্ষী ও মায়াঙ্কের সমবয়সী।

মায়ন্তী’র জন্য মায়াঙ্ক অনেক চকলেট ও পুতুল নিয়ে যায়। যা মায়ন্তীর পছন্দের। আগে কখনো মায়াঙ্ক নিজে তো দূরে থাক মায়ন্তীর উপরে কাউকে কথা বলতে দিতো না।

মায়াঙ্ক,মায়ন্তী ও মীনাক্ষী বসে বসে গল্প করছিল। এমন সময় মায়ন্তীর বাবা-র ফোনে কল আসে—

মায়ন্তীর বাবা- হ্যালো আসসালামু আলাইকুম! কে বলছেন?

ওয়ালাইকুমুস সালাম। মিস্টার. আরিফ সাহেব আজ থেকে আরএস কোম্পানিতে আপনি আপনার পদ হারিয়ে ফেলছেন। অফিসে এসে দেখা করবেন?

হ্যালো হ্যালো স্যার শুনুন। মায়ন্তীর বাবা বেশ চিন্তায় পড়ে যান। মায়াঙ্কদের তুলনায় মায়ন্তী’দের আর্থিক সামর্থ্য অসচল। আরিফ সাহেব কাউকে কিছু না বলে ঘর থেকে বেরিয়ে বারান্দায় আসেন। বেশ চিন্তায় পড়ে যান। দু’টো মেয়ের কি হবে? ওনার চাকরিটা না থাকলে।

হার্টের রোগী হওয়ায় আরিফ সাহেব অসুস্থ হয়ে মাটিতে পড়ে যান। মায়ন্তী গল্প করার ফাঁকে নিজের বাবা-র দিকে দেখছিল এভাবে পড়ে যেতে দেখে বাবাহ বলে চিল্লিয়ে দৌড়ে গিয়ে ওনাকে ধরে সাথে সাথে মায়াঙ্ক-মীনাক্ষীও ওখানে যায়।

বেশ ভয়ানক অবস্থার মধ্যে দিয়ে যেতে হয় মায়ন্তী’দের। তখন অব্ধি ওরা জানে না আসলে কি কারণে মায়ন্তীর বাবা অসুস্থ হয়ে পড়লেন!

হসপিটালে তিনদিন বাদে সুস্থ হোন আরিফ সাহেব। পাশেই বসে আছেন নিজাম রহমান আর মায়াঙ্ক মায়ন্তী ও মীনাক্ষী দাঁড়িয়ে আছে দরজার কাছে। রানু রহমান রেহেনা বেগমকে সামলাচ্ছেন।

কি হয়েছে তোর? বলছিস না কেন? কিসের এত চিন্তা করছিস বলতো? আমি তোর বড় ভাই ছোট বেলা থেকে আমিই তোকে মানুষ করেছি সেই তুই কিনা আমার থেকেও লুকিয়ে যাচ্ছিস।

তুই অসুস্থ মায়াঙ্ক আমাকে খবর দেওয়ার সাথে সাথেই আমি চলে এসেছি দীর্ঘ ৩টা দিন আমার কেমন কাটলো বলতো। তুই আমার ছোট আর তুই কিনা!

বল এবার কি হয়েছে।

ভাইয়া আমার চাকরিটা বলেই আরিফ সাহেব কেঁদে দিলেন। আমার মেয়েদের কি হবে?

ছিঃ কাকু কি হবে তোমার মেয়েদের আমি থাকতে কারো কিছু হবেনা। মীনাক্ষী,মায়ন্তীর দায়িত্ব আজ থেকে আমি নিলাম।

আরিফ সাহেবের চাকরির কথা শুনে হুট করে এসে মায়াঙ্ক ওনার হাত ধরে কথা গুলো বলল।

আরিফ তুই কিনা এসব চিন্তা করছিস? তোর মেয়ে আমার মেয়ে না? তোর চাকরি গিয়েছে তো কি হয়েছে? আমি আছি,মায়াঙ্কের পড়াশোনাও তো শেষের পথে আর কথা তো ছিল মীনাক্ষী, মায়ন্তীর মধ্যে যেকোনো একজনের সাথে মায়াঙ্কের বিয়ে দিবো। তারপরেও তুই কিসের চিন্তা করতেছিস?

ভাইয়া তুমি কি বলছ এসব। আমি ওদের বাবা আমারও তো কিছু দায়িত্ব আছে?

শোন একদম চুপ থাক। আর নিঃসন্দেহে চিন্তা মুক্ত থাক আজ থেকে একবছরের মাথায় মায়াঙ্কের সাথে মীনাক্ষী যেহেতু সমবয়সী। তাই ওর সাথে না মায়ন্তীর সাথে মায়াঙ্কের বিয়ে হবে।

কাকু মনি তুমি কি বলছ এসব মীনাক্ষী বলে উঠল। আর বাবা তোমার মেয়ে কি ছোট বাচ্চা নিজের দায়িত্ব নিতে পারবোনা আমরা। আমি তোমাদের দায়িত্ব নিবো। তাই বলে মায়ন্তীর সাথে মায়াঙ্কের বিয়ে।

মায়ন্তী দেখ মা এত বুঝাতে পারবোনা। তোর বাবা-র সাথে আগেই কথা হয়েছিল আমাদের যে তোদের দু’জনের একজনের সাথে আজ না হয় কাল মায়াঙ্কের বিয়ে দিবো।

মায়াঙ্ক বলে উঠে বাবা বিয়ে কোন কিছুর সমাধান না। মায়ন্তী ছোট মানুষ। আর যাই হোক এসব নিয়ে এখন কথা থাক। আর মীনাক্ষী, মায়ন্তী,কাকিমা -মা তোমরা বাসায় যাও। আর মা সবার সব কিছু প্যাক করে নিতে বলো আজ থেকে আমরা দুই পরিবার একসাথে থাকবো। আমাদের সাথে সবাই শহরে যাবে আজকেই। আর একটা কথাও শুনতে চাইনা আমি।

নিজাম রহমান বলছে হ্যাঁ মায়াঙ্ক তুই ঠিক বলেছিস।

না মায়াঙ্ক তা হয়’না।

কাকু মনি তুমি না বলো আমি তোমার ছেলের মতো? তোমার ছেলে যদি বলতো তুমি শুনতে না?

তুই তো আমার ছেলের মতোই কিন্তু?

কিন্তু কিছুনা এখন সুস্থ হও পুরোপুরি।

সেদিনের পরই মায়াঙ্ক মায়ন্তীর পুরো পরিবার’কে সাথে নিয়ে নিজেদের বাসায় আসে। দুই পরিবার এক পরিবার হিসেবে বেড়ে উঠে।

মায়ন্তী এসএসসি পরিক্ষা দেওয়ার পর মায়াঙ্ক ওকে নাম করা কলেজে ভর্তি করিয়ে দেয়। মায়ন্তীর সব দেখা শোনা মায়াঙ্ক করে। কলেজে দিয়ে আসা নিয়ে আসাও সব মায়াঙ্ক করে।

একদিন ভাইয়া ভাইয়া শুনোনা আমার না ঐযে দেখো তোমার ঐ বন্ধু’টা রাজিব ভাইয়া ওকে না ভালো লাগে। ভাইয়া না রোজ আমার জন্য রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকে আমাকে চকলেট দেয়।

মায়াঙ্ক মায়ন্তীর কথায় বেশ রাগ হয়। তুই কি বললি? আর একবার বল? আর তুই ওর চকলেট নিস কেন? আমি বুঝি তোকে এনে দিই না। আর ভুল করেও যেন এসব না শুনি।

ওমা তুমি রাগ করো কেন হ্যাঁ এমন ভাবে বলছ যেন আমাকে তুমি ভালোবাসো আমার কথায় কষ্ট পেয়ে রাগ দেখাচ্ছ হুঁহ।

কি বললি রে পাঁকা মেয়ে? খুব বড় হয়ে গেছিস তাইনা বলে মায়াঙ্ক মায়ন্তীর নাক টেনে দেয়। চুপচাপ বাসায় চল। মায়াঙ্ক মায়ন্তীর কথায় বেশ মুসকি মুসকি হাসছে মনে মনে বলছে পাগলি’টা।

বাসায় ফিরেই মীনাক্ষী মায়াঙ্কের সামনে আসে মায়াঙ্ক তোর সাথে আমার কথা আছে শোন এদিকে আয়।

স্যরিরে মায়াঙ্ক আমি তোকে মায়ন্তীর কাছে না আসার জন্য আগে অনেক ধমকিয়েছি। আমি আগে জানতাম কাকুমনি আমার সাথে তোর বিয়ে ঠিক করেছেন। তাই আমি তোর সাথে মায়ন্তীকে সহ্য করতে পারতাম না। আমি মায়ন্তীকে ছোট ছোট ব্যপারেও কথা শুনাতাম।

হ্যাঁ সেটা আমি জানি। আর আমি ছোট বেলা থেকেই তোকে আমার বন্ধু আর বোনই ভেবে এসেছি। তুই আমাকে নানান ভাবে এই ব্যপারে কথা বলেছিস আমি শুনিনি। কারণ টা হয়তো মায়ন্তী।

তুই জানিস যখন বাবা-কাকুমনি বলেন তোদের দু’জনের মধ্যে একজনের সাথে আমার বিয়ে হবে। তখন আমার চোখের সামনে শুধু মায়ন্তীর মুখ’টাই আসে। ওর বাচ্চামো স্বভাব হৃদয় ভরা ভালোবাসাই হয়তো আমার দূর্বলতা। তবে আমি কখনো তোকে নিয়ে এসব ভাবিনি । আমি মায়ন্তী’কে ভালোবাসি হ্যাঁ আমি মায়ন্তী’কে ভালোবাসি। আর আমি ওকেই বিয়ে করবো।

তাই হয় যেন। আর শোন আমার না আয়ুষ্মানের সাথে অ্যাফেয়ার আছে তোকে বলা হয়নি। আর শোন রাজিবের থেকে একটু সাবধানে।

তাই নাকি আয়ুষ্মান তো তোর জন্য আমাকে পাগল করে ছাড়তো আমি তোকে বলার সাহস পাইনি। না জানি তুই আবার কি ভেবে বসিস। আর রাজিব ওর কথা ছাড় ওএমনই মেয়ে নিয়ে ছেলে খেলা ওর স্বভাব আমি মায়ন্তীর ধারের কাছেও ওকে আসতে দিবো না।

মীনাক্ষী বলে আচ্ছারে আমি যাই এখন।

—————————_—–

আজ মায়ন্তীর জন্মদিন উপলক্ষে বাড়িতে পার্টির আয়োজন করা হয়েছে। মায়ন্তী,মীনাক্ষী ও মায়াঙ্কের বন্ধু’রা পার্টিতে এসেছে। আজ এনাউন্স করা হয়েছে মায়ন্তী ও মায়াঙ্কের বিয়ের কথা।

মায়ন্তী অবুঝের মতো বলছে ইয়েহ ভাইয়া আমার বর হবে মায়াঙ্ক চুপ কি বলছিস কি? পাগল হয়ে গেছিস?

মায়ন্তী এদিকে একটু আসবি তোর সাথে আমার একটা কথা আছে। হ্যাঁ ভাইয়া বলো। আচ্ছা বলতো তোর আমাকে কেমন লাগে? তুই আমাকে ভালোবাসিস?

ভাইয়া উমম তুমি আমার ভাইয়া তোমাকে আমি এত্তো এত্তো ভালোবাসি।

পাগলি আমি তোর ভাইয়া? তুই ভালোবাসা মানে বুঝিস?

উহু না আমিতো বুঝিনা।

শোন তোর সাথে আমার বিয়ে শুনেছিস তো?

আমাকে বিয়ে করবি?

ভাইয়া একটা সিরিয়াস কথা বলব। তুমি আমাকে যতটা বাচ্চা ভাবো আমি ততটাও বাচ্চা নই। আমি তোমাকে সত্যিই ভালোবাসি।

মায়াঙ্ক-মায়ন্তীর দিন গুলো খুব ভালোই কাটছিল।

ইতোমধ্যে মায়াঙ্কের বন্ধুরা বেশ কয়েকবার ওদের বাসায় এসেছে। রাজিব সবসময়ই মায়ন্তীর কাছে যাওয়ার চেষ্টা করেছে। মায়াঙ্ক সবসময়ই রুখে দাঁড়িয়েছে।

মীনাক্ষী ও আয়ুষ্মানের প্রেম ভালোই চলছে। মুলত আয়ুষ্মান মীনাক্ষীর জন্যই একটু কিছু হলেই মায়াঙ্কের বাসায় চলে আসে,সাথে রাজিব ও।

আজ মায়ন্তী ও মায়াঙ্কের এনগেজমেন্ট। মায়ন্তী বেশ খুশী ওর ভাইয়া ওর বর হবে। মায়াঙ্কের মনেও আজ অন্যরকম অনুভূতি কাজ করছে।

সবাই কত আনন্দ করছে। বাড়ি ভর্তি লোক। একসময় রাজিব ও আয়ুষ্মান পার্টিতে উপস্থিত হয়।
কি ব্যপার কিউটি পাই তোমাকে তো ভীষণ সুন্দর লাগছে। ক্রাশ খেয়ে গেলাম তো।

মায়ন্তী হেসে হেসে সবার সাথেই কথা বলে। মায়াঙ্কের ফোনে জানি কার কল আসে। মায়াঙ্ক একটু বাইরে যায়।

হঠাৎ মায়ন্তীর মাথা ঘুরতে থাকে। মায়ন্তী মাটিতে পড়ে যায়।

মায়ন্তীর প্রায় ঘুম ভাঙে সকালবেলা। মায়ন্তীর রুমে সবাই দাঁড়িয়ে নিঃস্তব্ধতা পালন করে কেউ কোন কথা বলেনা।

মায়ন্তী বলে আমার কি হয়েছে? আর তোমরা সবাই আছো ভাইয়া কোথায়?

কিছু হয়নি মায়ন্তী। তুই শান্ত হ। রেস্ট নে ভাইয়া একটু কাজে বাইরে গেছেন।

——————————+————–

হুট করে মায়ন্তী ভাবনার জগৎ থেকে বাইরে আসে।

বলে ভাইয়া কেন আপনি সেদিন চলে গিয়েছিলেন। কেন? কেন?

ফিরে এসেও কেন আপনি এমন করছেন আমার সাথে?

কি অপরাধ আমার। আমার কি বা বয়স ছিল তখন আমি কি বা বুঝতাম। আপনি তো আমাকে ভালোবাসতে শিখিয়েছিলেন। সেই আপনি এনগেজমেন্টের দিনই আমাকে ছেড়ে বিদেশে চলে যান। কেন কেন ভাইয়া?

কত খুঁজেছি আপনাকে তবুও পাইনি। ফিরে এলেন তবুও আমার না হয়ে!!

চলবে………………………………………….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here