মায়াডোর (১৪ পর্ব)
.
ইতি চলে যাওয়ার পর কল্প দরজা বন্ধ করে আরও এক গ্লাস পানি খায়। তার শ্বাস-প্রশ্বাস উষ্ণ, ঘন। চেয়ার টেনে কনুই টেবিলে ঠেকিয়ে বসে বসে দুই আঙুল দিয়ে কপাল ঘষতে থাকে। ভেবে পাচ্ছে না কি করবে সে। নিজেকে সামলে চলা যেন একটা সংগ্রামের মতো হয়ে দাঁড়িয়েছে। এমনিতে তার অনেক ধৈর্য, বয়সের তুলনায় যথেষ্ট পরিমিতিবোধও আছে৷ নিজের এই গুণগুলো সম্পর্কে সে এতদিন অবগত ছিল। তাই একটা সময় তার প্রতি ইতির ব্যাকুলতা টের পেলেও স্বতঃস্ফূর্তভাবে ইতিকে পড়িয়ে গেছে। ভেবেছিল ছাত্রী-শিক্ষকের সম্পর্কের ভারসাম্য সে অবশ্যই রক্ষা করতে পারবে৷ কিন্তু দিন যত যাচ্ছে যেন ক্রমশই নিজেকে হারিয়ে ফেলতে শুরু করেছে৷ এমনটা হবার কথা নয়। জন্মের পর থেকে সে অসম্ভব দুঃখ-কষ্টের ভেতর দিয়ে বেড়ে উঠেছে। সামান্য হাওয়ায় নড়ে যাওয়ার মতো মানুষ সে নয়। কিন্তু মেয়েটা তার মনের এইসব শক্তির অহম ভেঙে ঘুরিয়ে দিচ্ছে। শুরু থেকেই মোটামুটি প্রস্তুত ছিল কোনোভাবেই এই মেয়ের সঙ্গে প্রেমে জড়াবে না৷ একটা পরিবার কতটুকু বিশ্বাস করে যুবক ছেলেকে বাড়িতে থাকতে দেয় সে জানে৷ এই বিশ্বাস সে ভাঙতে চায় না। সম্পর্কে জড়ালে তো একদিন সবাই জানবে, তখন মামার কাছেই বা কি জবাব দেবে সে? এই বাড়ির লোকগুলো কি মনে করবে? বিশ্বাস করে থাকতে দিয়েছে, পরিবারের একজন সদস্যের মতো দেখেছে। এই অবস্থায় তাদের মেয়ের সঙ্গেই প্রেম? এ হতেই পারে না। এরকম একটা প্রস্তুতি তার ছিল। কিন্তু ইতি মেয়েটা এমন যে তাকে উপেক্ষা করা যায় না৷ আজকাল তাকে দেখলেই ভেতর তোলপাড় করে। ইচ্ছে করে নিজের গড়া সকল প্রস্তুতি নিজেই ভেঙে-ছুড়ে খানখান করে ফেলতে। যখন জড়িয়ে ধরলো ইতি। পৃথিবী যেন থমকে গিয়েছিল। পৃথিবীর নিয়ম-নীতি, দ্বিধা, শঙ্কা সকল কিছু তুচ্ছ মনে হচ্ছিল। এই বিশ্বচরাচরে যেন ইতির এই জড়িয়ে ধরা থেকে সুন্দর আর কোনকিছুই নেই৷ ওকে বুকে টেনে নেওয়া থেকে তার জীবনেরও যেন দ্বিতীয় কোনো লক্ষ্য নেই। আদুরে বিড়াল ছানার মতো বুকটায় যখন মিশে গেল ইতি। পুরো শরীর যেন তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করলো। রক্ত টগবগ করতে শুরু করলো। অনূভুতিগুলো ইতির পক্ষে আন্দোলন শুরু করলো। বারবার চোখবুজে এসেছিল অন্যরকম এক ভালো লাগায়। ইতির শরীরের থেকে এক অদ্ভুত বুনো ঘ্রাণ নাক দিয়ে মস্তিষ্কে গিয়ে পৃথিবীর, সমাজের, শিক্ষা-দীক্ষার যে সকল প্রভাব ছিল। সবকিছু খসে পড়ে যায় নিমিষেই৷ সে যেন কেবলই একজন মানুষ। বুনো আদিম মানুষ। যাদের ওপর এই উন্নত পৃথিবীর কোনো প্রভাব পড়েনি। তার হাতটা অবশ হয়ে এসেছিল। কিভাবে এই মেয়েটিকে জোর করে ছাড়াতে পারে সে? এই সাধ্য তার ছিল না। ইতি তখন বুকে নাক ঘষছে। তার ঘাড়ের পেছনের চুলগুলোতে আঙুল চালাচ্ছে। কল্প অসহায় হয়ে পড়ে। নিজের কাছে নিজে পরাজিত হয়ে যায়৷ কাতর হয়ে ইতিকে ছাড়তে বলা ছাড়া তার আর কিছুই করার নেই৷ ইতি যেন দয়া করে ছেড়ে তাকে বাঁচিয়ে দিয়েছে৷ না হলে ইতির ভালোবাসার উত্তাপে সে আজ মোমের মতো গলে যেত। কিন্তু কতদিন এভাবে নিজেকে সামলে রাখবে? ইতির প্রণয়ের আহবান কতদিন সে উপেক্ষা করতে পারবে? ওর খিলখিল করে হাসিই যেন একটা মৌলিক সংগীত। হাঁটা-চলা সবকিছুতেই কবিতার ছন্দ। এইসব ছন্দে সে যখন-তখন মুগ্ধ হয়ে অন্ধ হয়ে যেতে পারে। আত্মবিশ্বাস এখন শূন্যের ঘরে চলে এসেছে। এই অসম্ভব রূপবতী, মায়াবতী মেয়েটিকে তার উপেক্ষা করার সাধ্য আর সত্যিই নেই। আজ ছাদে যখন গেল সে। গিয়েই মনে হয়েছিল এই ছাদটা পৃথিবীর অদ্ভুত এক মায়ার জগত। একটা গানের সুর আসছে। আকাশে ফুটফুটে একটা চাঁদ। তার কোমল আলোয় ভেসে যাচ্ছে পৃথিবী। অপূর্ব এক নৈসর্গিক সৌন্দর্য। সেই সৌন্দর্যকে অন্য এক মাত্রায় নিয়ে গেছে ইতি নামক অলিক কিশোরী। যাকে দেখে মানুষ বলে ভ্রম হলেও, সে আসলে এই অপূর্ব সুন্দর রাতেরই যেন একটা অংশ। এক পা ভাজ করে আরেক পায়ের হাঁটুতে দুইহাত রেখে বসে আছে যেন এক অপ্সরা। চুলগুলো পিঠে ছড়ানো। ছিপছিপে হাতটি দেখতে মোমের মতো ফরসা, মসৃণ, কোমল। কল্পের ভেতরের প্রেমিক সত্তা বিদ্রোহ করে উঠে। মন্ত্র-মুগ্ধের মতো পাশে গিয়ে দাঁড়ায় সে। পদশব্দে গান বন্ধ হয়ে যায়। নিজের অজান্তেই এক সময় কবিতার মতো খুবই গহিন থেকে ইতির প্রতি প্রশংসা ঠোঁট দিয়ে বেরিয়ে পড়ে তার। শেষদিকে অবশ্য কোনোভাবে সামলে নিয়ে চলে আসে সে। কিন্তু এভাবে কতদিন? এই সংগ্রামে, নিজের সঙ্গে যুদ্ধ যুদ্ধ খেলায় সে হারবে। নিশ্চিত হারবে। ইতি একটুও বুঝতে চায় না কেন? এই প্রেম হবে না। সে প্রেমে পড়তে চায় না। প্রেম কেন তার ওপর এসে এমন বাজেভাবে পড়ে যাচ্ছে? যদি সে এই সম্পর্কে জড়িয়ে যায়, এরপর কি হবে? বিষয়গুলো ভেবে তার গা শিউরে উঠে। মামা-মামী কি বলবেন? এই পরিবার কি বলবে? বিছানায় গিয়ে পাশ ফিরে শুয়ে পড়ে কল্প। চোখ থেকে সরানোই যাচ্ছে না ইতির মিষ্টি মুখটা। গালের ঠিক মাঝখানে ছোট্ট একটা তিল। পাতলা গোলাপি দুটো ঠোঁট। ভাসা ভাসা চোখগুলো থেকে চঞ্চলতা উপচে পড়ছে৷ ভাবতে ভাবতে এক সময় গভীর ঘুমে তলিয়ে যায় কল্প।
ভোর পাঁচটায় ঘুম থেকে ধড়ফড় করে বিছানায় উঠে বসে সে। একটা খুবই বিশ্রী স্বপ্ন দেখেছে ইতিকে নিয়ে। নিজের কাছেই নিজের ভীষণ লজ্জা হচ্ছে। এমন বাজে স্বপ্ন কিভাবে দেখতে পারলো! ইতিকে নিয়ে এমন বিশ্রী ভাবনা তো সে কখনও ভাবেনি। মিষ্টি একটা ছোট্ট মেয়ে। তার কাছে পড়েও। হয়তো তারও ভালো লাগে, ইচ্ছা করে খুব করে ভালোবাসতে, আদর করতে। তাই বলে এমন স্বপ্ন? কল্প খানিকক্ষণ দুইহাতে মুখ ঢেকে বসে রইল। নিজেকে খুবই অপরাধী মনে হচ্ছে৷ গোসল করতে হবে। এরকম অঘটনের পর সে সঙ্গে সঙ্গে গোসল না করে থাকতে পারে না৷ সারাক্ষণ নিজেকে কেমন অপবিত্র, নোংরা মনে হয়। কেউ হয়তো এখনও জাগেনি। আলগোছে বাথরুমে গিয়ে গোসল করে নিতে হবে৷ তারপর চুপিচুপি ছাদে গিয়ে থ্রি-কোয়ার্টার শুকোতে দিয়ে আসবে। এতকিছু কেউ খেয়ালই করবে না।
ইতি রাতে কল্পের কথা ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে যায়। ফজরের আজানের সময় হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল। আর ঘুমই এলো না৷ এপাশ-ওপাশ করে দীর্ঘ সময় কাটিয়েছে। বিরক্ত হয়ে বিছানা থেকে উঠে সে। আলগোছে নীলার মোবাইল নিয়ে ছাদে চলে যায়। মাদুরিতে বসে কল দেয় তানিয়ার ফোনে। সে নানাবাড়ি থাকতে দেখেছে রাতে মামীর ফোন ওর কাছেই থাকে। কয়েকবার রিং হতেই ঘুম ঘুম গলায় তানিয়া বললো,
– ‘হ্যালো।’
– ‘কিরে কি করছিস?’
– ‘মেজাজটা খারাপ করবি না ইতি।’
– ‘ওমা আমি আবার কি করলাম।’
– ‘কল রিসিভ করেছি জরুরি কিছু ভেবে। মনে হইছিল কেউ মারা-টারা গেছে। আর তুই এই ভোরবেলা কল দিয়েছিস ‘কি করছি’ জানতে।’
– ‘জরুরি কিছু কথা আছে৷ তাইতো কল দিয়েছি।’
– ‘তাড়াতাড়ি বল কি জরুরি কথা।’
– ‘কল্পের সঙ্গে কাল কি হয়েছে জানিস?’
– ‘হ্যাঁ জানি, আমি তোদের বাড়ির সিসি ক্যামেরা। বইন এগুলো জরুরি কোনো ঘটনা না যে তুই পাঁচটায় কল দিয়ে বলতেই হবে। ফোন রাখ।’
তখনই ছাদে কল্পকে দেখে চমকে গেল ইতি। কল্পের পরনে লুঙ্গি, গায়ে কালো সেন্টু গেঞ্জি। ছাদের দরজা খোলা দেখে কল্প ভেবেছিল রাতে ভুলে লাগানো হয়নি। ইতি কল কেটে দিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বললো,
– ‘ভোরবেলা গোসল করলেন না-কি?’
কল্প ‘হ্যাঁ’ বলে পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছিল। ইতি নাছোরবান্দা হয়ে পিছু পিছু গিয়ে বললো, ‘কেন?’
কল্প প্যান্ট ঝেড়ে মেলে দিয়ে বললো,
– ‘তুমি এই সময়ে ছাদে কি করো?’
– ‘প্রেমিকের সঙ্গে গোপনে ফোনে কথা বলছিলাম।’
– ‘ডিস্টার্ব দিলাম এসে যাও কথা বলো। আমি চলে যাচ্ছি।’
– ‘কিন্তু আপনি সকালে গোসল করলেন কেন? আমি না পিচ্চি আর আপনি অনেক বড়ো। তাহলে পিচ্চিদের মতো বিছানায়…।’
কল্প ওর মুখটা চেপে ধরলো৷ ইতির চোখ পিটপিট করছে৷ ছাদের কার্নিশে দুইহাতে চেপে ধরে আছে৷ কল্প চারদিকে তাকিয়ে বললো,
– ‘এত কথা বলো কেন? তুমি পিচ্চি বলেই তো জানো না হিসু ছাড়াও ছেলেদের সকালে গোসল করার অন্য কোনো কারণ থাকতে পারে। এসব নিয়ে কোনো আলাপই হবে না। কাউকে বলবেও না। আমি প্যান্ট চিলেকোঠার একপাশের কার্নিশে মেলে দিচ্ছি কেউ দেখবে না।’
কথাগুলো বলেই কল্প ছেড়ে চলে যাচ্ছিল। ইতি ফিক করে হেঁসে বলে,
– ‘এহ খুব ভয় পাইছি৷ ছাড়লেন কেন ভালোই তো লেগেছিল।’
কল্প এগিয়ে এসে দাঁত কটমট করে তাকিয়ে মাথায় গাট্টা মে’রে চলে গেল।
ইতি গিয়ে আবার মাদুরে বসে। গোসলের ব্যাপারটা কিছুতেই সে বুঝতে পারছে না। ক্লাসও নেই যে গিয়ে বান্ধবী কাউকে জিজ্ঞেস করবে। মালিহা আপুকে কল দিতে হবে। কিন্তু এখন ভালো লাগছে না। নিচে নেমে এলো সে। দাদাভাই সুর দিয়ে কোরআন তেলাওয়াত করছেন। নীলা এখনও ঘুমোচ্ছে। ইতি মোবাইল রেখে বিছানায় শুয়ে খানিকক্ষণ যেতেই কল্পের দরজার সামনে শুনলো দাদাভাইয়ের ডাক। ইতি কৌতূহলী হয়ে বিছানা থেকে নেমে বারান্দায় যায়। ফরিদ সাহেব সু-জুতা পরে কল্পের দরজার সামনে। কল্প ও খানিক পর বের হলো। ওর পায়ে কেডস, পরনে কালো ট্রাউজার আর হাফহাতা গেঞ্জি। ইতি এগিয়ে গিয়ে বললো,
– ‘দাদাভাই তোমরা কোথায় যাচ্ছ?’
– ‘তুই তো বাড়িতে ছিলি না। আমরা নানা-নাতি তিন-চার দিন থেকে ভোরে হাঁটতে বের হই। বুঝলি ভোরে হাঁটলে শরীর ভালো থাকে। তুই যাবি না-কি?’
ইতির আগেই কল্প ব্যস্ত হয়ে বললো,
– ‘না না, ইতি দরকার নেই যাওয়ার।’
– ‘আশ্চর্য আমি গেলে আপনার অসুবিধা কি? আমি অবশ্যই যাব।’
ফরিদ সাহেব কল্পের দিকে তাকিয়ে বললেন,
– ‘নিবে না-কি?’
– ‘ও তো উঠানেই হাঁটাহাঁটি করতে পারবে। ছাদও আছে। মাইয়া মানুষ এতদূর গিয়ে কি করবে।’
ইতি প্রতিবাদ করে বললো,
– ‘তাহলে আপনারা উঠান আর ছাদ রেখে বাইরে যাচ্ছেন কেন?’
– ‘আমরা মাইয়া না-কি!’
– ‘মাইয়া মানুষের কি শরীর শুধু তুলতুলে থাকতে হবে? আমাদের কি রোগ-বালাই হতে পারে না? হাঁটা-চলা ব্যায়াম সবারই দরকার।’
কল্প বিরক্ত হয়ে বললো,
– ‘নানা হাঁটেন তো। ও এখনও পিচ্চি ওর আবার জগিং কি? রাস্তায় গিয়েই দুষ্টামি শুরু করবে।’
ফরিদ সাহেব মাথা নেড়ে হাঁটতে শুরু করলেন। ইতির রাগে শরীর জ্বলছে। পিছু থেকে দাঁত কটমট করে তাকিয়ে আছে কল্পের দিকে। তারা উঠান পেরিয়ে চলে গেছেন। ইতি হঠাৎ মনে পড়েছে এরকম ভাব করে ডাক দিল, ‘কল্প ভাইয়া এদিকে শুনে যান, আমার জন্য একটা জিনিস আনতে হবে।’
ফরিদ সাহেব গেইট খুলে বাইরে গেলেন। কল্প বিরক্ত মনে ফিরে এলো। কাছাকাছি আসতেই ইতি ফিসফিস করে বললো, ‘কাল সন্ধ্যায় কি টের পান নাই আমি পিচ্চি না এতদিনে নারী হয়ে উঠেছি? আমি এখন শরীরে-মননে, অনুভূতিতে টইটম্বুর এক যুবতী মেয়ে, এটা মাথায় ঢুকিয়ে নেন।”
কল্প কোমরে হাত দিয়ে তাকিয়ে থেকে বললো,
‘এই কথা বলার জন্য ডেকেছো?’ তারপর বিরক্তিতে ‘ধুর’ বলে আবার চলে গেল সে। ইতি পিছু থেকে তাকিয়ে হাসছে। মানুষটাকে পানির সঙ্গে গুলে খেয়ে ফেলতে পারলে ভালো হতো৷ অসহ্য রকমের ভালো লাগে। খানিক পর ধীরে ধীরে কল্পের রুমের দিকে গেল সে। আলনার এলোমেলো একেকটা কাপড় ভাজ করে রাখার আগে চোখবুজে বুক জড়িয়ে ধররে, চুমু খায়, গালে চেপে ধরে থাকে। সবকিছুতে কি এক অদ্ভুত অনুভূতি হয় ইতির। এই রুমটাই অন্য রকম এক ভালো লাগার। এই চার দেয়ালের ভেতরের সবকিছু আপন, ভীষণ প্রিয়। বিছানার দিকে তাকায় গিয়ে। এলোমেলো বিছানা টেনে ঠিক না করে শুয়ে যায়। বালিশে নাক টেনে এনে ঠোঁট নাক ডুবিয়ে দেয়। গায়ের লোম নড়েচড়ে উঠে। হৃৎস্পন্দন ক্রমশই বাড়ছে। এই বালিশে কল্প মাথা পেতে ঘুমায়? কি বিস্ময়কর ব্যাপার। বালিশটা তার হাতের কাছে। ইতি বালিশ বুকের সঙ্গে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে মিনিট খানেক চোখবুজে থাকে৷ ইশ কল্প যদি কোনোভাবে তার হয়ে যেত। একান্ত ব্যক্তিগত পুরুষ। কবে হবে? আদৌও কি হবে? মানুষটা কেন এখনও ভালোবেসে বুকে টেনে নিচ্ছে না? হঠাৎ করে ইতির ভীষণ মন খারাপ হয়ে গেল৷ ভীষণ কান্না পাচ্ছে। কেন যেন মনে হয় কল্প তাকে পছন্দ করে না, করবেও না৷ মানুষটা মেয়েদের প্রতি উদাসীন কি-না কে জানে। পড়ালেখা ছাড়া হয়তো আর কিছুই বুঝে না সে। না-কি গোপন কোনো প্রণয়িনী আছে? ইতির আরও মন খারাপ হয়ে গেল। কাউকে সে ওর পাশে সহ্য করতে পারবে না৷ ভেজা চোখে বালিশে চুমু খেয়ে বিছানা থেকে নেমে গেল। তারপর চাদর টেনে-টুনে ঠিক করে চলে যায় রান্নাঘরে। আজ সে নিজেই নাশতা বানাবে। কল্প এ বাড়িতে থাকে, অথচ তার রান্না খাবে না? তা কি করে হয়। ছুটির দিনগুলোতে সে ধীরে ধীরে সবকিছু রান্না শিখে ফেলবে।
__চলবে…..
লেখা: জবরুল ইসলামমায়াডোর (১৫ পর্ব)
.
কল্প আজ শুধুমাত্র ফরিদ সাহেবের জন্য হাঁটতে বেরিয়েছে। অন্যদিন সে খানিকটা হলেও দৌড়ায়। আজ পাশাপাশি ধীরগতিতে হাঁটছে। সামনে মসজিদ। ফরিদ সাহেব বললেন,
– ‘চলো মসজিদের ঘাটে গিয়ে জিরান লই।’
কল্প সম্মতি জানিয়ে উনার সঙ্গে যায়। ফরিদ সাহেন বসতে বসতে বললেন,
– ‘তা বলো, ওইদিন যে জিজ্ঞেস করলাম বৃদ্ধদের শেষ জীবন নিয়ে তোমার ভাবনা কি? কিছু কি ভেবেছো?’
কল্প মুচকি হেঁসে বললো,
– ‘অন্য বৃদ্ধদের নিয়ে কোনো ভাবনা নেই। আপনাকে নিয়ে অবশ্য ভেবেছি।’
– ‘তাই না-কি? তা কি ভাবলে?’
– ‘আপনি প্রচণ্ড একাকীত্বে ভুগছেন৷ নানিকে বোধহয় অনেক বেশি ভালোবাসতেন।’
তিনি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, ‘তা ঠিক বলেছো, এই কারণে তোমাকে আমার এত পছন্দ। আচ্ছা এই অসুখের চিকিৎসাটা কি বলো তো।’
– ‘এখন থেকে আপনি দিনের নামাজগুলো মসজিদে এসে পড়বেন। ফজর এশা বাড়িতে পড়তে পারেন সমস্যা নেই।’
– ‘তাতে ফায়দাটা কি এক্সারসাইজ?’
গল্প প্রশ্নের ধরন দেখে হেঁসে ফেললো।
– ‘তা না, মসজিদে এলে আপনার সমবয়সীদের সঙ্গে একটা বন্ধন হবে।তাদের সঙ্গে খাতির জমাবেন। মাঝে মাঝে দাওয়াত দিয়ে বাসায় নিবেন। এখন মনে হচ্ছে ব্যাপারটা বিরক্তিকর৷ কিন্তু মিশলে দেখবেন ভালো লাগছে।’
– ‘মানে কি এসবের? বেকার ছেলেদের সঙ্গে বেকার বৃদ্ধদের মিলাতে চাচ্ছ না-কি?’
– ‘অনেকটা সেরকমই।’
– ‘আচ্ছা, তারপর।’
– ‘আপনি অবসরে আছেন এই ভাবনা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলতে হবে।’
– ‘তাহলে কি ভাববো আমি একটা বেকার যুবক?’
– ‘তাও না, আপনি আরও বেশি নিজেকে ঝামেলায় জড়িয়ে রাখুন। সাংসারিক ঝামেলায়। যেমন ছেলের ব্যাবসা কেমন চলছে। কোনো ঝামেলা আছে কি-না। পরিবারে কেউ অসুখ হলে এটা নিয়ে মাথা ঘামাবেন, কেউ ঠিকমতো পড়ছে কি-না দেখবেন। মেয়ের শ্বশুরবাড়ির খবর নিবেন। ওদের সমস্যার কথা শুনবেন। এভাবে নিজেকে সবকিছুর সঙ্গে জড়িয়ে রাখুন।’
– ‘তা কেন? মানুষ তো সমস্যা থেকে দূরে থাকতে চায়।’
– ‘কিন্তু আপনি থাকবেন না। নিজেকে দরকারি করে তুলুন। আরও বেশি সাংসারিক করে তুলুন। একেবারে বিছানায় পড়ে যাওয়ার আগপর্যন্ত এভাবে থাকবেন।’
– ‘তোমার কি মনে হয়, তাহলে আমার সব সমস্যা দূর হয়ে যাবে?’
– ‘আপনার তো কোনো সমস্যা নেই৷ আপনি একটা তুমুল ব্যস্ত জীবন কাটিয়েছেন। শিক্ষকতা করেছেন। অবসরের ঠিক আগে স্ত্রী মারা গেলেন। প্রচণ্ড ভালোবাসতেন তাকে। তাই যখন অবসর পেলেন। একেবারেই বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছেন আপনি। একাকীত্বে ভুগতে শুরু করেছেন। হঠাৎ রাগারাগি করছেন। মনে অস্থিরতা বিরাজ করছে। আগেকার সুন্দর দিনগুলোর কথা ভেবে গাইছেন ‘আগের বাহাদুরি এখন গেল কই’। শিক্ষিত হওয়ায় পাড়ার আট-দশজন বয়স্কদের সঙ্গেও মিশতে পারেন না। এটুকুই। আর আরেকটা সমস্যা হচ্ছে দুই ছেলে আছে, দু’জন ভালো বউ আছে। যার কারণে আপনার কোনো কিছু নিয়েই ভাবতে হচ্ছে না৷ সবকিছু মিলিয়ে আপনি অপ্রয়োজনীয় হয়ে পড়েছেন। বসে বসে মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করা ছাড়া কিছু করার নেই আপনার। অবশ্য এখন নানি থাকলে খুবই হতো না। একজন সঙ্গী থাকতো।’
– ‘ঠিকই বলেছো তুমি।’
– ‘চলুন বাড়ি যাই এবার।’
– ‘হ্যাঁ চলো।’
বাড়িতে ফিরতে তাদের আটটা বেজে গেল। কল্প হাত-মুখ ধুয়ে বিছানায় বসতেই মুজিব উদ্দিন এসে ঢুকলেন। তারপর চেয়ার টেনে বসে খানিক ইতস্তত করে নাক টান দিয়ে বললেন,
– ‘ভাগনা কল্প, তুমি আমাকে একটা বিপদ থেকে উদ্ধার করতে পারবে?’
কল্পের বুকটা কেঁপে উঠলো। উনি আবার কিছু টের পাননি তো? সে ভয়ার্ত গলায় বললো,
– ‘কি করতে হবে মামা?’
– ‘আর বলো না বাবা। আমার ছোটবোন পাগল হয়ে গেছে ইতিকে তাদের বাড়িতে নেয়ার জন্য। ডেইলিই কল দিয়ে এক ঘ্যানঘ্যানানি চলে। ওরা ঢাকায় থাকে। তাই যাওয়া-আসা কম হয়। ইতি ছুটি তো, তাই বেশি জোরাজুরি করছে। আমি দোকান ফেলে এসবের টাইম আছে বলো? একা মানুষ। হুস্নাও বুঝতে চাচ্ছে না।’
কল্প শুকনো ঢোক গিলে বললো,
– ‘তুমি একটু ওকে নিয়ে যাও না ভাগনা৷’
– ‘কি বলেন মামা আমার ক্লাস আছে।’
– ‘আরে এগুলো অল্প কিছুদিনে সমস্যা হবে না৷ এই বয়সে কোথাও বেড়াতেও তো যাও না। শুধু পড়ালেখা করলে কি চলবো? ঢাকা তো মনে হয় যাওনি। একটু বেড়ানোও হয়ে গেল।’
– ‘না মামা…।’
– ‘না না করো না তো বাবা। মানুষ হয়ে জন্মাইছো শুধু চেয়ার টেবিলে বসে পড়ালেখা করে ২০-৩০ বছর কাটানোর জন্য না।’
কল্প ‘হা’ করে তাকিয়ে রইল। খানিক পর ইতি নাশতার ট্রে হাতে নিয়ে ঢুকে। কল্পকে চিন্তিত মুখে বসে থাকতে দেখে ট্রে টেবিলে রেখে বললো,
– ‘কি হলো কোনো সমস্যা?’
কল্প স্বাভাবিক হয়ে বিছানা থেকে উঠে চেয়ার টেনে বসে বললো,
– ‘না ঠিক আছি।’
– ‘আমার হাতে আপনার জন্য নাশতা বানিয়েছি জনাব। কিন্তু আমি সব পারি না। শুধু নুডলস সহজ লাগে তাই বানিয়েছি।’
কল্পের মন-মেজাজ এমনিতেই খারাপ। সে রূঢ় গলায় বলে উঠে,
– ‘তুমি প্লিজ বকবক না করে এখন যাও তো।’
ইতির মুখ মলিন হয়ে যায়। ভেবেছিল কল্প খুশি হবে। অথচ সে উল্টো রেগে গেল। সে রুম থেকে বের হয়ে এলো রান্নাঘরে৷ মুজিব উদ্দিন এসে বললেন,
– ‘হুস্না ইতিকে নিয়ে কল্প ঢাকায় যাবে।’
ইতি অবাক চোখে তাকিয়ে বললো,
– ‘আমাকে নিয়ে ঢাকায় মানে?’
– ‘তোর ছোট ফুপুর বাসায়। উনি ডেইলি বলে। যা বেড়িয়ে আয়।’
– ‘আমাকে আগে তো বলোনি কেউ। কখন যাব? আর কল্প ভাইয়া কি রাজি হইছে?’
– ‘হ্যাঁ খুশিই হইছে উল্টো৷ ঢাকা যায়নি তো। বেড়ানো হবে তার।’
ইতি খুশিতে আত্মহারা হতে গিয়ে আবার দমে গেল। কল্প যদি খুশিই হবে তাহলে একটু আগে এমন করলো কেন? লোকে অকারণ বলে মেয়ে মানুষের মন বুঝা মুশকিল, অথচ পুরুষ মানুষের মন বুঝার জন্য স্কুল থাকা উচিত। ইতি নাশতা করতে বসে বললো,
– ‘কখন বের হব বাবা?’
– ‘তোদের ইচ্ছামতো বের হ। আমি কল্পের কাছে তোর ফুপুর নাম্বার দিয়ে যাচ্ছি। আর টাকা তোর মায়ের কাছে আছে।’
– ‘আচ্ছা।’
ইতির খুশিতে দম-বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। কল্পকে বলবে ট্রেনে যাওয়ার জন্য। দু’জন কি সুন্দর মনোরম দৃশ্য দেখতে দেখতে যাবে। নাশতা শেষেই সে গোসল করে নিল। যাওয়ার কাপড় পড়বে একেবারে খেয়ে-দেয়ে। এখন আপাতত পাতলা ফিনফিনে একটা ড্রেস পরে চুল মুছতে মুছতে সে কল্পের রুমে গেল। কল্প দুইহাত মাথার নিচে দিয়ে সিলিংয়ের দিকে তাকিয়ে শুয়ে আছে। ইতি বিছানায় এসে বসলো। কল্প তাকায়। সদ্য স্নান করা ইতির মুখটা ভীষণ স্নিগ্ধ লাগছে। মুখ ফিরিয়ে নিয়ে আবার তোয়ালে দিয়ে চুল মুছতে শুরু করেছে। ওর চুল মোছার কি আর জায়গা নেই? সুডৌল কোমরে বারংবার চোখ চলে যাচ্ছে। ইতি খানিক পর কনুই বিছানায় ঠেকিয়ে নিজের থুতনি হাতের তালুতে রেখে তাকিয়ে থেকে বললো,
– ‘নাশতা কেমন হয়েছে?’
সে অন্যদিকে তাকিয়ে বললো, ‘জঘন্য, আমি বিড়ালকে খাইয়ে দিয়েছি।’
– ‘মিথ্যে কথা বলবেন না তো। সবারই ভালো লেগেছে।’
কল্প কোনো জবাব দিল না। ইতি পুনরায় ব্যগ্র গলায় বললো,
– ‘কেন আমার সঙ্গে এমন করেন?’
কল্পের বুকটা শিরশির করে উঠে। ইতি চলে যাচ্ছে না কেন? সে রূঢ় গলায় বললো,
– ‘গোসল করে এসে এখানে এভাবে এসে বসে আছো কেন? যাও, কেউ দেখলে কি বলবে?’
– ‘কিভাবে বসেছি? বউদের মতো না-কি? তাহলে টেনে বুকে নেন।’
কল্প কপট রাগ দেখিয়ে বললো,
– ‘তুমি কি যাবে? না আমিই বের হয়ে চলে যাব?’
– ‘আপনি আমার এই এক দূর্বলতা পাইছেন তাই না? শুধু চলে যাব, চলে যাব।’
– ‘যেতেই হবে তুমি যা শুরু করছো।’
ইতি বিছানা থেকে উঠে বললো,
– ‘আপনি না আমাকে নিয়ে ঢাকা যাবেন। তো শুয়ে আছেন কেন। গোসলে যান।’
– ‘তুমি আগে বের হও। আমি যখন ইচ্ছা গোসল করবো।’
– ‘যাবেন কখন?’
– ‘যখন ইচ্ছা।’
ইতি দাঁত কটমট করে তাকিয়ে থেকে বের হয়ে চলে গেল। কল্প শুয়ে রইল এভাবে। ইতি রেডি হয়ে কাপড় পরে হাঁটছে। কল্পের গোসলেরই নাম নেই। জোহরের পর হুস্না বেগম নিজেই এসে বললেন,
– ‘কল্প কখন যাবে বাবা? গোসল করে নাও।’
– ‘মাথা ব্যথা করছিল তো তাই শুয়ে রইছিলাম মামী। এখনই গোসল করছি।’
গোসল করে খেয়ে-দেয়ে বের হলো তারা বিকেল তিনটার দিকে। কল্পের পায়ে কেডস, পরনে জিন্স প্যান্ট আর ব্লেজারের নিচে ভি গলার কালো গেঞ্জি। ইতি সুন্দর করে সেজেছে। সবকিছুই ঠিক আছে। কেবল মনটা ভীষণ খারাপ। কল্পের প্রতি প্রচণ্ড রাগও আছে। রেডি হয়েছিল সকালে। এখন বের হয়েছে তারা৷ কল্প একবারও বলেনি কখন বের হবে। বললে সেজে-গুজে বাড়িতে এভাবে সারাদিন বসে থাকতে হতো না। কল্প রিকশা ডেকে উঠে বসেছে। ইতি একা একাই উঠে পাশে বসে। তারপর অন্যদিকে তাকিয়ে জল ছলছল চোখে বললো,
– ‘আপনি এরকম না করলেও পারতেন।’
– ‘এসব আজাইরা কথা রাখো তোমার। এখন কিভাবে যাবে বলো। রিকশা কোথায় যেতে বলবো। বাস স্টেশনে না-কি রেলস্টেশনে?’
ইতি চোখের জল আড়াল করে বললো,
– ‘রেলস্টেশনে।’
শখ দেখে কল্পের মেজাজ যেন আরও খারাপ হলো। জেদ মেটানোর জন্য বললো, ‘রিকশা বাস স্টেশনে যান।’
ইতি আহত নয়নে ওর দিকে তাকায়। কল্প অন্যদিকে তাকিয়ে আছে। ইতি আর কিছু বললো না। চুপচাপ বসে রইল। রিকশা চলে গেল বাস স্টেশনে। টিকিট কেটে দু’জন সিট পেয়েছে মাঝখানে। ইতি জানালার কাছে বসেছে। কল্প তার পাশে। বাস চলতে শুরু করেছে। ম্লানমুখে দুইহাত বুকে বেঁধে ইতি বাইরে তাকিয়ে আছে। দীর্ঘ সময় এভাবে চুপচাপ বসে রইল সে। কল্পের ধীরে ধীরে মনটা কেমন হতে শুরু করেছে। অকারণ রাগারাগি করছে সে। যেতেই যখন হচ্ছে, মেয়েটাকে কষ্ট দিয়ে লাভ কি? কল্প আস্তে-আস্তে বললো, ‘ইতি।’
ইতি তাকালো না। যেন সে ঘুমিয়ে আছে।
সে হাঁটু দিয়ে হাঁটুতে মৃদু ধাক্কা দিল। তবুও ইতির কোনো প্রতিক্রিয়া নেই। কল্প অসতর্কভাবে ওর উরুতে হাত রেখে বললো, ‘কি হয়েছে এদিকে তাকাও।’
সঙ্গে সঙ্গে ইতি তার দিকে তাকালো। দুই গাল বেয়ে জল পড়ছে৷ কল্প সতর্ক হয়ে বাসের চারদিকে তাকায়৷ তারপর হাত বাড়িয়ে চোখের পানি মুছে দিয়ে বললো, ‘আরে কাঁদছো কেন? কেউ দেখলে কি বলবে?’
– ‘আপনি জানেন না কেন কাঁদছি?’
কল্প ওর এক হাত মুঠোয় নিয়ে বললো,
– ‘প্লিজ আস্তে কথা বলো। মানুষ শুনবে। কেন কাঁদছো বলো তো।’
– ‘আপনি আমার সঙ্গে এমন করছেন কেন? আর কত অপমান, অবহেলা করবেন?’
কল্প এক হাত পিঠের দিকে নিয়ে ওকে জড়িয়ে ধরে গালে হাত রেখে বললো,
– ‘কানে কানে সব অভিযোগ বলো। আস্তে কথা বলবে। লোকে শুনলে কি থেকে কি ভাববে।’
ইতি ফিক করে হেঁসে উঠলো।
– ‘লোকে কিছু বললে বলবেন আপনার বউ আমি।’
– ‘ধ্যাৎ, সব সময় ফাজলামো। এখন বলো তো এত কষ্ট পাওয়ার কারণ কি?’
– ‘আমাকে বললেই হতো দেরিতে বের হবেন। আমি সকাল থেকে রেডি হয়ে বসে রইলাম আর আপনি এটা কি করলেন?’
কল্প কোনো সদুত্তর দিতে পারলো না। ইতি পুনরায় বললো, ‘আর আপনি নিজেই বললেন ট্রেনে না বাসে যাব। আমি ট্রেন বলতেই আপনি রিকশাওয়ালাকে বললেন বাস স্টেশনে যেতে। কেন সব সময় আমার সঙ্গে এমন করেন বলুন তো?’
কথাটা বলে ইতি ফ্যাসফ্যাস করে আবার কেঁদে দিল। একটুও কাঁদতে চায়নি সে। তবুও কান্না এসে গেল। একটু আগেই মন ভীষণ খারাপ ছিল। এখন আশ্চর্য এক ভালো লাগায় ছেয়ে গেছে মন। কল্প মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললো,
– ‘প্লিজ ইতি। বাসে মানুষ ফলো করবে। তুমি একটু শান্ত হও। আর সবকিছুর জন্য আমি স্যরি। ওকে?’
কল্পের কানে নাক ঠোঁট ঘষে ইতি উষ্ণ শ্বাস ছেড়ে বললো, ‘আচ্ছা জান।’
কল্পের দম-বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল। ইতিকে কখনও প্রেমের প্রস্তাব দেয়ার সুযোগ দিতে চায় না সে। সে হেঁসে ওর কোমল গাল টিপে দিয়ে বললো, ‘সারাক্ষণ শুধু দুষ্টামির চিন্তা কেন? আমি জড়িয়ে ধরেছি না? এবার ঘুমিয়ে যাও। মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছি।’
ইতি আরেকটু ঘনিষ্ঠ হয়ে ওর গলায় মুখ গুঁজে উষ্ণ শ্বাস ছেড়ে ‘ওম-ওম’ গলায় বললো, ‘ঠিকই বলেছেন। আপনাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমানোর শখটাও মিটে যাবে…।’ এটুকু বলে থামে সে। তারপর বুক ভরে শ্বাস নিয়ে পুনরায় বলে, ‘আচ্ছা আপনার শরীরে কি যেন একটা ঘ্রাণ আছে৷ আমাকে ঘোর লাগিয়ে দেয় বারবার। মাতাল হয়ে যাব মনে হচ্ছে।’
কল্পের শরীর বারবার কাঁটা দিয়ে উঠছে। উষ্ণ একটা স্রোত পুরো শরীরে বয়ে যাচ্ছে৷ এ কেমন বিপদে পড়েছে সে? একটা পরিবার তাকে কোন মর্যাদার আসনে বসালে এভাবে মেয়েকে তার সঙ্গে দেয়? সে এই বিশ্বাসের মূল্য কিভাবে দেবে? ইতি পুনরায় উষ্ণ শ্বাস ছেড়ে ফিসফিস করে বললো, ‘ইশ এত শান্তি লাগছে কেন বলুন তো। আপনাকে আমার এত্ত ভালো লাগে কেন কল্প ভাইয়া?’
কল্প দাঁতে দাঁত চেপে চোখ বন্ধ করে আছে। পুরো শরীর কেমন অবশ হয়ে আসছে তার। ইতি এক হাতে তার গালে হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো, ‘ভুলেও ভাববেন না আমি নির্লজ্জ বেহায়া মেয়ে। আমার পেছনে একশো ছেলে ঘুরলেও আমি ফিরে তাকানোর মতো ছিলাম না। কিন্তু আপনার মাঝে যে কি আছে আল্লাহই জানেন। প্রথমদিন দেখেই নির্লজ্জ বেহায়া মেয়ে হয়ে গেছি।’
কল্পের ভয় বেড়ে যাচ্ছে। ইতি মনে হয় সব কথা বলে ফেলবে। এখন কি করবে সে? হঠাৎ মাথায় এলো কিছুই শুনেনি এরকম একটা ভাব ধরে থাকতে হবে। সে আলগোছে চোখবুজে ইতির মাথায় নিজের মাথা ফেলে দিল।
তাইই হলো। ইতি সত্যিই ভেবেছে কল্প ঘুমিয়ে গেছে। সে নিজের মাথাটা আলগোছে সরিয়ে কল্পকে কাঁধে জায়গা করে দিয়ে ওর ঘন কালো চুলে আঙুল ডুবিয়ে দিল।
__চলবে….
লেখা: জবরুল ইসলাম