মায়াডোর পর্ব-১৬+১৭

মায়াডোর (১৬ পর্ব)
.
বিরতির জন্য বাস থামিয়েছে। এখন সন্ধ্যা ছুঁইছুঁই। ইতির কথাগুলো না শোনার ভান করতে যেয়ে কল্প সত্যিই ঘুমিয়ে পড়েছিল। পুরো রাস্তা পরম মমতায় ইতি ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়েছে। একা জেগে থাকলেও খারাপ লাগেনি, সবকিছু অসম্ভব ভালো লাগছিল। বাইরে তাকালেই রাস্তার পাশে সবুজ মাঠ, ধানক্ষেত, বাড়ি-ঘর, ব্যস্ত মানুষদের ছুটে চলা। সবই মুগ্ধ হয়ে দেখেছে ইতি। একসময় গোধূলি পেরিয়ে সন্ধ্যা হয়ে আসে। কল্প তখনও ঘুমে। ইতির হাতে, কাঁধে ব্যথা হয়ে যাচ্ছে। তবুও সে নড়েনি। মানুষটা ঘুমাচ্ছে, ঘুমাক। কিন্তু বিরতির জন্য বাস থামিয়েছে। কিছু একটা খাওয়া দরকার। তাই না ডেকে এখন আর উপায় নেই। ইতি মাথায় হাত রেখে ডাকলো,

– ‘আর কত ঘুমাবেন উঠুন।’

দু’বার ডাকতেই কল্প উঠে গেল। লাল টকটকে চোখে চারদিকে তাকিয়ে বললো,

– ‘বাসের মানুষ কই?’

– ‘বিরতি এখন। নাশতা করতে হবে না বুঝি, উঠুন।’

– ‘বাবা সন্ধ্যা হয়ে গেছে।’

– ‘হ্যাঁ, এত ঘুমাতে পারেন আপনি। আমার হাত অবশ হয়ে যেত আরও কিছুক্ষণ পর।’

– ‘তুমি ডাকতে পারতে। স্যরি। কখন ঘুমিয়ে গেলাম বুঝতেই পারিনি।’

– ‘স্যরি বলার কিছু নাই। নামুন।’

দু’জন বাস থেকে নামে। বাইরে সন্ধ্যার ফুরফুরে হাওয়া বইছে। ইতি হাত ফোটাতে গিয়ে বলল ‘উফ নাড়ানো যাচ্ছে না।’
কল্প হাই তুলে বললো, ‘এতক্ষণ তোমার কাঁধেই ছিলাম?’

– ‘জি জনাব।’

– ‘ইশ তাহলে তো তোমার কষ্ট হইছে অনেক। এতক্ষণ কিভাবে পারলে ধৈর্য ধরে বসতে?’

– ‘আপনার ঘুম ভাঙবে বলে ধৈর্য ধরে থেকেছি।’

কল্পের বুকটা আবার শিরশির করে উঠে। এই মেয়েটা তাকে এত ভালোবাসে কেন? কিভাবে উপেক্ষা করবে সে। কল্প ওর গালে হাত দিয়ে ঝাপসা চোখে তাকিয়ে বললো,

– ‘ইতি মাঝে মাঝে তোমাকে অনেক কষ্ট দেই তাই না?’

ইতি তন্ময় হয়ে কল্পের চোখের দিকে তাকিয়ে রইল। কল্প নিজেকে সঙ্গে সঙ্গে সামলে নিয়ে ওর হাত ধরে বললো,

– ‘চলো নাশতা করি। হাতে বেশি ব্যথা করছে তোমার? তুমি অন্যভাবে না নিলে নাশতা করে এসে আমি ম্যাসেজ করে দেবো।’

ইতি হাঁটতে হাঁটতে বললো, ‘অন্যভাবে মানে কি?’

– ‘তুমি যদি আবার আমাদের প্রেম হয়ে গেছে ভাবো তাহলে তো সমস্যা।’

ইতি আর কিছু বললো না। চুপ হয়ে গেল। সরাসরি কিছু জিজ্ঞেস করলে যদি না করে দেয়? তাহলে ভীষণ কষ্ট পাবে ইতি। আরও দিন যাক। ধীরে ধীরে মনে হচ্ছে কল্প ভাইয়াও দূর্বল হয়ে পড়ছে। রেস্টুরেন্টে ঝলমলে আলো। চোখে লাগছে ভীষণ। ইতিকে বসিয়ে রেখে কল্প হাত-মুখ ধুয়ে এসে চেয়ার টেনে বসে ফিসফিস করে বললো, ‘আরও অনেক সময় বাসে থাকতে হবে তো। বাথরুমে যেতে পারো।’

ইতি লজ্জা পেয়ে মুখ ঢেকে বললো ‘ধ্যাৎ।’

ওর হাতের নীল চুড়িগুলো চিকচিক করছে। হাতে কি সুন্দর মানিয়েছে চুড়ি। ইতি তাকিয়ে থাকতে দেখে বললো, ‘কি দেখছেন?’

– ‘কিছু দেখছি না, বাথরুমের কথায় এত লজ্জা পাওয়ার কি আছে। তোমরা মেয়েদের অকারণ সবকিছু নিয়ে লজ্জা। এগুলো নিয়ে লজ্জার কি আছে বুঝি না।’

– ‘এসব কথা বন্ধ করুন তো। কি খাবেন, অর্ডার দিন।’

দু’জন নাশতা করে বাসে ফিরে এসেছে। কল্প বসতে বসতে বললো, ‘নিজের কাছে এখন খারাপ লাগছে।’

ইতি বসে কপাল থেকে চুল সরিয়ে বললো, ‘কেন?’

– ‘নাশতা করতে যেয়ে তুমি বললে হাত তুলে মুখে নিতে ব্যথা করছে।’

– ‘এগুলো ঠিক হয়ে যাবে।’

কল্প ম্লানমুখে বাইরে তাকিয়ে বসে রইল। ইতি তার হাতে আলগোছে একটা চিমটি দিয়ে বললো, ‘অন্যভাবে নেব না ম্যাসেজ করে দিন।’

কল্প মুচকি হেঁসে বাসের দিকে তাকায়। বাতি বন্ধ। ফ্যান চলছে। মানুষ ইয়ারফোন কানে গুঁজে চোখবুজে আছে। কেউ মোবাইল টিপছে। কল্প আস্তে-আস্তে ইতির কাঁধে হাত রাখে৷ কাঁধ থেকে টিপে টিপে আসে পেশিতে৷ তারপর ফিসফিস করে বললো, ‘হাত তোলা দাও এভাবে।’

ইতি তাই করে। খানিক পর কল্পের কাঁধে মাথা রেখে ওর হাতটা কোলে এনে ধরে বসে ইতি বললো, ‘একটা প্রশ্নের উত্তর দেবেন?’

ইতির গালে এক হাত রেখে কাতর গলায় কল্প বললো, ‘ইতি আমি যেভাবে তোমার সঙ্গে যাচ্ছি। এমনিতেই নিজেকে কন্ট্রোল করা কঠিন হয়ে যাচ্ছে। প্লিজ তুমি একটু বুঝতে চেষ্টা করো। ইমোশনাল হয়ে তোমার সঙ্গে যদি একটা সম্পর্কে যাই পরে পস্তাতে হবে।’

ইতি চোখে চোখ রেখে বললো ‘আপনিও আমাকে পছন্দ করেন তাই না? তাহলে এমন করছেন কেন?’

– ‘সরাসরি কোনো প্রশ্নই আমাকে করবে না ইতি। আমি জবাব দেয়ার কিছুই খুঁজে পাব না।’

– ‘আপনার ভয়টা কিসের বলুন তো।’

– ‘আমি প্রেমে জড়াতে চাই না।’

– ‘আপনি আমাকে পছন্দ করেন না?’

– ‘এই প্রশ্ন আসছে কেন? আমি প্রেমে জড়াতে চাই না। এটাই শুধু জেনে রাখো।’

– ‘তাহলে বিয়ে করে নিন।’

– ‘আমি মাত্র অনার্সে পড়ি।’

– ‘আপনি চাইলেই চাকরি পাবেন এখনও।’

– ‘এত কম বয়সে বিয়ে করবো? আর তোমারই বা এখন কত বয়স যে বিয়ে করবে?’

– ‘তাহলে প্রেমে সমস্যা কি? আমার পরিবার আপনাকে মেনে নিবে আমি জানি।’

– ‘আমার মনে হয় না৷ তুমি কিছুই জানো না। আমাদের দুই পরিবারে ঝামেলা কি নিয়ে জানো? তোমার বড় ফুপুকে বড়ো মামা পছন্দ করতেন। বিয়ের প্রস্তাবও দিয়েছিলেন। তোমাদের পরিবার দেয়নি বিয়ে। এসব নিয়ে মনোমালিন্য এখনও আছে।’

– ‘তাই না-কি, জানতাম না তো। তাহলে ওরা নীলা আন্টিকে কিভাবে মেনে নিল। আমার ধারণা আপনাকেও নেবে।’

– ‘ইতি প্লিজ আমি আজকাল এলোমেলো হয়ে যাচ্ছি। তুমি একটু ছাড় দাও আমাকে। এরকম করলে আমি ইমোশনাল হয়ে যাচ্ছি।’

ইতি ফিক করে হেঁসে বললো ‘ভাবের দোকানদারের অবস্থা তাহলে এই?’

– ‘দুষ্টামি করো না ইতি। আমি সুপ্তি আপুকেও তোমার কথা বলেছি। আপু খুবই সাবধান করে দিয়েছেন।’

– ‘ওমা আপনি কি বলেছেন? বলতে গেলেন কেন?’

– ‘আমি কি করবো বলো? তুমিই বলো আমারও তো বয়স কম। তুমি এরকম করলে আমি কিভাবে ঠিক থাকতে পারি? আপুও বললেন কোনোভাবে যেন প্রেমে না জড়াই। খুবই ঝামেলা হবে। তোমাদের পরিবারও কষ্ট পাবে। মামার মুখও ছোট হবে।’

– ‘এসব চিন্তা করার কিছু নাই। এতকিছু ভেবে কি প্রেম হয়?’

– ‘ইতি প্লিজ, পাগলামি করো না। আমি তোমাকে একটা কথা বলি। আমি অনার্স শেষ করে চাকরি নিয়ে বিয়ের প্রস্তাব না হয় দেবো। আপাতত আমাদের বাড়াবাড়ির দরকার নেই।’

– ‘কিন্তু যদি না দেন?’

– ‘আমি তোমাকে কোনো কথা দিতে চাই না। আমার মামা-মামী আছেন। চাচারা আছেন। ওরা মানলে এবং তোমার পরিবার মানলে বিয়ে হবে।’

– ‘আপনার নিজের কোনো ইচ্ছার মূল্য নেই?’

– ‘আমার কাছে বিশ্রী লাগছে ব্যাপারটা। তোমার পরিবার এত বিশ্বাস করে…।’

ইতি মুখ ধরে ফেললো।

– ‘এসব শুনতে চাই না। আপনিও আমাকে ভালোবাসেন আমি জানি।’

কল্প হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বললো,

– ‘এসব শুনতে না চাইলে আমি তোমাদের বাসা থেকে চলে যাব।’

ইতি তাকে ছেড়ে দিয়ে থমথমে মুখে বসে রইল। কল্প আবার বললো, ‘ভালো হয় তোমাকে আর টিউশনি না করালে। সময় এলে বিয়ের প্রস্তাব দেবো৷ সব মিলিয়ে যদি পাই তাহলে পেলাম। আর না হয় দু’জনই পরিবারের মতো বিয়ে করবো। ওকে?’

ইতি তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বললো, ‘আপনি একটা কাপুরুষ। এভাবে প্রেম হয় না।’

– ‘আমি তো প্রেম করতে চাইও না ইতি। আমি প্রথম থেকেই প্রস্তুত ছিলাম কোনোভাবে প্রেমে জড়ানো যাবে না৷ তোমার পরিবার আমাকে কত বিশ্বাস করে। তোমার দাদাভাই জানো আমাকে কত পছন্দ করেন? যদি এসব শুনেন কত কষ্ট পাবেন।’

– ‘কিন্তু আপনি তো আমাকে ভালোবাসেন।’

– ‘তুমি কি ভালো না বাসার মতো কেউ? না চাইলেও প্রেমে পড়তে বাধ্য হবে মানুষ।’

– ‘তাহলে কাপুরুষের মতো পিছিয়ে যান কেন?’

– ‘ইতি আমি আট-দশটা ছেলের মতো তোমার রূপের মোহে পড়ে ভ্রমরের মতো ফুলে বসতে চাচ্ছি না। অন্যরা ভাবে যা হওয়ার হবে আগে মজাটা করে নিই৷ কিন্তু আমি এরকম না। সবদিক ভাবছি।’

– ‘যাইহোক আমি আর আপনাকে বিরক্ত করবো না। আপনি নিজের মতো থাকুন। আমাদের বাসায়ই থেকে পড়ালেখা করুন। আপনার কাছে আর পড়বোও না।’

কল্প জানালার বাইরে তাকায়। তার চোখ জলে ভরে গেছে৷ প্রেমে কোনোভাবেই জড়ানো যাবে না। সে ভেজা গলায় বললো, ‘ইতি নিজেকে শক্ত করে নাও। এভাবেই থাকো। আমি একটু এরকমই। আমি সবকিছু নিয়ে অগ্রিম ভেবে রাখি। কোনোদিনই আমার অগ্রিম ভাবনা বিফলে যায় না। আমি জানি প্রেমে জড়ালে সমস্যা হবে। তুমি একবার ভাবো যদি প্রেম করি। তারপর একে অন্যকে না পাই? তাহলে কেমন কষ্ট হবে?’

ইতি তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বললো ‘আপনি একটা মানসিক রোগী। অতিরিক্ত ভাবনা, অগ্রিম ভাবনা এগুলো কোনো গর্বের কথা নয়। পৃথিবীতে কোনোকিছু ছক এঁকে হয় না। এখনও আমাকে ছাড়তে আপনার কষ্ট হচ্ছে, হচ্ছে না? আমারও হচ্ছে। তাহলে প্রেম করলে কি সমস্যা? শেষে পেলে পেলাম। না পেলে এখন যে কষ্ট পাচ্ছি সেটা তখন পাব।’

কল্প কোনো জবাব দিল না। ইতি পুনরায় হেঁসে বললো, ‘পৃথিবীতে আজ এক অদ্ভুত ঘটনা ঘটে গেল। প্রেম করার আগেই ছ্যাঁকা খাওয়ার ভয়ে দু’জন প্রেমিক-প্রেমিকা অগ্রিম ছ্যাঁকা খেয়ে নিল। ভাবেন আপনি কত বড়ো উন্মাদ। এরকম কাপুরুষ ছেলে পৃথিবীতে থাকতে পারে জানতাম না। অবশ্য আমিও পৃথিবীতে নারী জাতির জন্য কলংক। এরকম কাউকে কেউ এত নির্লজ্জের মতো ভালোবাসেছে কি-না আমার সন্দেহ আছে।’

– ‘প্লিজ ইতি শান্ত হও।’

– ‘নীলা আন্টির মোবাইল দিয়ে ফেইসবুকে আপনার ওই জবরুল ইসলামকে বের করে ছিলাম। একটা লেখা পড়েছিলাম টাইমলাইম ঘুরে। ওই লেখাটাও জানেন আমার নিজের সঙ্গে মিলে গিয়েছে। লেখাটা শুনবে কি? ইতি বিড়বিড় করে বললো,
“প্রতিটি মানুষের আত্মসম্মানবোধ থাকে, অহমিকা থাকে, কেউ তাকে ছোট করে কথা বললে তার প্রচণ্ড রাগ হয়৷ সেই মানুষই আবার কাউকে এতটাই ভালোবেসে ফেলতে পারে যে, নিজেকে একেবারে সস্তাভাবে ওর কাছে বিলিয়ে দিতে চায়, ওর সকল যত্নের দায়িত্ব নিতে চায়, আদর করে আদর করতে চায়, দেহে প্রাণ থাকা পর্যন্ত পাশে থাকতে চায়। দুঃখের ব্যাপার হলো একেবারে সস্তাভাবে নিজেকে দিয়ে দিতে চাইলেও প্রায়ই ভালোবাসার মানুষটি আমাদের নেয় না।”

আমার হয়েছে এই অবস্থা৷ নিজেকে কত সস্তা বানিয়েছি। সব সময় বেহায়ার মতো লেগে থেকেছি। কিন্তু আপনি বারবার ফিরিয়ে দিয়েছেন।”

কল্প কোনো জবাব দিল না। চুপচাপ বসে রইল। ইতিও খানিক নীরব হয়ে গেল৷ রাত নয়টার দিকে তারা এলো ফুপুর বাসায়। মহাখালী বাস স্টেশন থেকে তাহিদ তাদের রিসিভ করে এনেছে। তাহিদ ডাক্তার। পড়ালেখা শেষ করে নতুন চেম্বার দিয়েছে৷ বাসায় মানুষ তাদের খুবই কম। তার বাবা ব্যবসা করেন। মরিয়ম বেগম বাসায় একা। একটা কাজের মেয়ে আছে। তাহিদকে বিয়ে দিতে চাচ্ছেন। কিন্তু সে আরও বছর দুয়েক পর বিয়ে করতে চায়। মরিয়ম বেগম কল্পকে আলাদা একটা রুমে দিলেন। সে ফ্রেশ হয়ে বের হতেই খাবার টেবিলে ডাকলেন। ইতিও ফ্রেশ হয়ে এসে বসেছে। সবাই এক সঙ্গে খেতে বসেছেন। মরিয়ম বেগম প্রথমেই বললেন,

– ‘তোমার নাম কল্প?’

– ‘হ্যাঁ।’

– ‘ভাইয়ার মুখে তুমি আসছো শুনে আমি তো অবাক৷ তাহিদ চিনতে পেরেছিস ওকে? মুনিয়া আপুর ছেলে। ওইযে শপিংমলে দেখা হয়েছিল৷ তারপর আমাদের বাসায় আসতে দাওয়াত দিয়েছিলাম।’

ইতি বিস্মিত হয়ে তাকাচ্ছে কল্পের দিকে। কল্প মাথা নিচু করে খাবার খাচ্ছে। সে জানে তার মায়ের বাসা ঢাকায়। কখনও আসেনি সে৷ মা বছর কয়েক পরে নানাবাড়ি গেলে দেখা হয়। উনার স্বামী ছাড়া তেমন কেউই জানে না আগের একটা সন্তান আছে৷ মরিয়ম বেগম বললেন,

– ‘তোমার মায়ের সঙ্গে আমার যোগাযোগ হয় মাঝে মাঝে।’

কল্প ‘ও আচ্ছা’ বলে আবার মাথা নুইয়ে ফেললো। তাহিদ বললো,

– ‘তুমি কখনও এসেছিলে ওই বাসায়? খালা তো অসুস্থ ছিলেন। উনার কিডনিতে প্রব্লেম ছিল।’

– ‘শুনেছিলাম, কখনও আসিনি।’

– ‘এটা কেমন কথা মা’কে দেখবে না এসে?’

মরিয়ম বেগম ধমক দিয়ে বললেন, ‘আরে বোকা, তাকে আড়াল রেখে মুনিয়া আপুর বিয়ে দেওয়া হইছিল। এরপর তো দুলাভাই জেনে ফেলেছিল। অবশ্য শেষে ঝামেলা হয়নি, শুধু বলেছিল ছেলে সে গ্রহণ করবে না। আর তার আত্মীয়-স্বজন যাতে কেউ না জানে। তাই যোগাযোগ ছিন্ন করে ফেলে। এখন সে কিভাবে বাসায় এসে দেখবে?’

মালিক সাহেব রূঢ় গলায় বললেন, ‘মরিয়ম তুমি এই অনর্গল কথা বলার অভ্যাসটা ছাড়ো। তুমি যাকে নিয়ে কথা বলো তার প্রতিক্রিয়া কি তা খেয়াল করো না। ছেলেটা খেতে বসেছে খেতে দাও।’

মরিয়ম বেগম রেগে গিয়ে বললেন ‘তুমি নাক গলাবে না একদম। ও আমার বোনের ছেলে। ওর সঙ্গে আমি কিসের এত হিসাব-নিকাশ করে কথা বলবো?’

মালিক সাহেব আর কোনো কথা বললেন না। মরিয়ম বেগম পুনরায় বললেন,

– ‘কল্প তোমাকে না-কি তোমার বাপ-চাচারা নিতে চায়। তুমি যাও না? তোমার মা বলেছিল এই কথা।’

– ‘জি, ওরা বলে, আমি যাই না।’

– ‘তোমার না-কি ওইখানে সম্পদের অভাব নাই। চাচা একজনও ফ্যামিলি সহ ইংল্যান্ড। তাহলে যাও না কেন?’

– ‘বাবাকে তো ছোটবেলায়ই হারিয়েছিলাম। দাদা-দাদিও নেই। নানাবাড়ি এসে নানা-নানি পেয়েছি। ওরা মারা যাওয়ার পর। সুপ্তি আপুও আছেন। ওখানেই আমি ভালো থাকি। তাদের ছেড়ে যেতে চাইনি৷’

– ‘তোমার মা’কে আমি কল দিয়ে বলেছি তোমার কথা। সে বলেছে আসবে আমার বাসায়। তোমাকে নিয়ে যেন না যাই।’

কল্প কোনো কথা বললো না। মালিক সাহেব বিরক্ত হয়ে বললেন, ‘তোমার সবকিছুতে বাড়াবাড়ি মরিয়ম। ছেলেটা কি বলেছে মায়ের সঙ্গে দেখা করবে? সে এসেছে ইতি মা’কে নিয়ে। তুমি ওর মা’কে কল দিতে গেলে কেন?’

– ‘তুমি চুপ থাকো। সবকিছু বলতে হয় না-কি৷ এত কাছ থেকে এসে চলে যাবে এটা হয়? মা-ছেলের দেখা করিয়ে দিলে ক্ষতি কি? মুনিয়া আপু আমার মামাতো বোন, দুরের কেউ না। বাসায় আসার জন্য বলতে পারি না?’

– ‘তোমাদের দুই ফ্যামিলির সম্পর্ক ভালো না আমি জানি।’

– ‘তাহলে কল্প আমাদের বাড়িতে থেকে পড়ালেখা করছে কিভাবে? বাজে কথা না বলে চুপ থাকো।’

ইতির এসব শুনে হঠাৎ কষ্ট হচ্ছে। কখনও কল্পের এই বিষয়গুলো নিয়ে সে মাথা ঘামায়নি। ওর মায়ের ব্যাপারে কিছুই জিজ্ঞেস করেনি। কল্পের কষ্ট হয় কি-না কে জানে। এই মুহূর্তেই বা তার কেমন লাগছে? খাবার শেষে কল্প নিঃশব্দে ওর রুমে চলে গেল। ইতিও খানিক পরেই ওর রুমে গেল। কল্প বিছানায় শুয়ে সিলিং এর দিকে তাকিয়ে আছে।
ইতি বিছানায় গিয়ে বসে বললো, ‘আপনার আম্মুর সাথে দেখা হবে, আপনার হয়তো অনেক ভালো লাগছে, তাই না?’

কল্প ওর দিকে না তাকিয়ে বললো, ‘বাসে কিন্তু বলেছি ইতি। আমাদের বাড়াবাড়ি কমিয়ে আনতে হবে৷ অপ্রয়োজনীয় সবকিছু বাদ। টিউশনি অবধি বাদ। তুমি এখন একটা নতুন বাসায় বেড়াতে এসে আমার রুমে ঢুকে বিছানায় বসে আছো কেন?’

– ‘সবকিছু বাদই তো। এখন আমি এমনিতেই এসেছিলাম।’

– ‘আসার দরকার নেই, তুমি এখন বের হয়ে গেলে খুশি হব। আমাদের কোনো সম্পর্ক নেই। এটা মাথায় রেখো।’

ইতি মন খারাপ করে উঠে চলে গেল৷ সিটিং রুমে মরিয়ম বেগম আর তাহিদ বসে আছে৷ ইতি তাদের কাছে গিয়ে সোফায় বসলো। তাহিদ ওর দিকে তাকিয়ে বললো, ‘কিরে তুই না-কি এখন ফেইল টেইল মারিস না। এসএসসিতে না-কি ভালো রেজাল্ট করেছিস?’

– ‘আজাইরা কথা বলবে না ভাইয়া৷ আমি শুধু একবারই এইটে ফেইল করেছিলাম।’

– ‘তা এসএসসি পাস করেছিস। এখনও তোর মোবাইল নেই৷ কল্পের মোবাইলে যোগাযোগ করতে হইছে। এটা কেমন কথা।’

– ‘তোমার মামা আর নানা টাকা না দিলে আমি কিভাবে কিনবো। ওরা বলে এইচএসসি পর দেবে। মা তো বলেন মোবাইল দিয়ে কি হবে৷ বিয়ের পর জামাই দিলে ইউজ করবি।’

– ‘ওরা দিতে হবে কেন? তুই চু*রি করবি টাকা। নানার পকেট মারতে পারিস না?’

– ‘একদিন মেরেছিলাম। বাড়িতে বাটি চালান হয়েছে।’

তাহিদ আর মরিয়ম বেগম হেঁসে উঠলেন। তাহিদ তারপর বললো, ‘তোরা পাগলের গোষ্ঠী।’

মরিয়ম বেগম পায়ের জুতা দেখিয়ে বললেন, ‘জুতা খুলে মারতে শুরু করবো আজেবাজে কথা বললে।’

তাহিদ হাসতে হাসতে খানিক পর বললো,

– ‘ইতি তুই যেহেতু পরীক্ষায় ভালো রেজাল্ট করেছিস। তাই আমিই তোকে একটা মোবাইল কিনে দেবো।’

ইতি বিস্মিত হয়ে বললো ‘সত্যিই?’

– ‘হ্যাঁ।’

তারপর ইতির আবার মুখটা মলিন হয়ে গেল।

– ‘কিন্তু তুমি দিলেও আব্বু-আম্মু রাগারাগি করবে।’

– ‘সেটাও আমি ম্যানেজ করবো। রাগারাগি করে তুই পড়িস না তাই।’

মরিয়ম বেগম ইতির মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, ‘তুই বড়ো হয়ে গেছিসরে মা। তোদের জন্য কত টানে ফুপুর। যেতে পারি না। এইযে গরু, বলতে বলতেও নিয়ে যায় না৷ বাপের মতো খাটাশ হয়েছে।’

– ‘থাক ফুপু আমি কিছু না বলি। কিছু বললে আবার মোবাইল হাত ছাড়া হতে পারে।’

মরিয়ম বেগম হেঁসে উঠলেন। তাহিদের কল এসেছে। সে উঠে চলে গেল।

___চলবে…..
লেখা: জবরুল ইসলামমায়াডোর (১৭ পর্ব)
.
কল্পের পুরো সময়টা কাটছে একরকম অস্থিরতায়৷ মায়ের সঙ্গে দেখা হবে৷ কত বছর পর দেখা। মা অসুস্থ ছিলেন। খবরটা শুনে তার ভেতরে ভেতরে ভীষণ পুড়ছিল। কিন্তু চাইলেই দেখা করা যায় না৷ সে সত্যি বোধহয় কাপুরুষ। গর্জে উঠতে পারে না৷ দ্বিধা, শঙ্কার দুয়ার লাত্থি মে*রে ভাঙার মতো বিদ্রোহী, প্রতিবাদী সত্তা তার ভেতরে নেই৷ সে সবকিছু সয়ে যাওয়া লোক৷ প্রবল ধৈর্যশক্তি দিয়ে তাকে এই পৃথিবীতে পাঠানো হয়েছে। এই পৃথিবীও একটা উপন্যাসের মতো। একেকজন মানুষের চরিত্র একেক রকম। যে যার যার জায়গায় অভিনয় করবে। এটাই স্রষ্টার নিয়ম। তাইতো এই পৃথিবী বৈচিত্র্যময় হয়ে উঠেছে। তাকে দেয়া হয়েছে সয়ে যাওয়ার চরিত্র। নিজের সঙ্গে সংগ্রাম করার চরিত্র। পৃথিবীর সকল যুদ্ধের থেকে এই যুদ্ধ কঠিন। নিজের সঙ্গে যুদ্ধের অসহ্যকর যন্ত্রণা তার মতো আর কাকে সইতে হয় কে জানে? তার মা কি এমন? মায়েরও কি এমন হয়? বিরহবিধুর মনকে বিড়ালের মতো আদর করে ঘুম পাড়িয়ে কি তিনিও রোজ নিদ্রায় যান? হয়তো যান। অথবা না। এই বিশাল বিস্তৃত বিশ্বচরাচরে কত মানুষ, সবার আলাদা আলাদা বৈশিষ্ট্য আছে৷ কে কিসে কষ্ট পায় সে তার কি জানে? মা হয়তো তাকে ছাড়া ভালোই আছেন। বড়োলোক স্বামী। স্রষ্টার দেয়া মাতৃত্বের প্রবল মমতা ঢেলে দেওয়ার মতো সে ছাড়াও সন্তান আছে৷ তার শুধু মা নেই, উনার তাকে ছাড়াও সন্তান আছে। তার জন্যই কেবল এই বিষাদ। সেই শিশুকাল থেকে আজও মায়ের বিরহ যন্ত্রণা গিলে নিয়ে কবি হেলাল হাফিজের মতো বেদনার মাথায় হাত বুলিয়ে সান্ত্বনা দিয়ে বলতে হয়েছে ‘কেঁদো না’।

সকাল সাড়ে আটটায় সিদ্দিক সাহেব পত্রিকা হাতে সোফায় বসে আছেন৷ মুনিয়া চা এনে দিয়ে বললেন, ‘আজ আমার একটু বাইরে যেতে হবে।’

সিদ্দিক সাহেব ভ্রু-কুচকে তাকিয়ে বললেন, ‘কোথায়?’

– ‘বলেছিলাম না আমার এক মামাতো বোন আছে ঢাকায়। ওর বাসায়।’

– ‘আচ্ছা, যাও।’

– ‘শ্রেয়াকে নিয়ে যাব।’

– ‘ওর স্কুল আছে না?’

– ‘আজ না হয় না গেল৷’

– ‘এভাবে যাওয়ার জন্য উথলা হওয়ার কারণ কি?’

– ‘ও বলছিল তাই। বাবার বাড়িও যাই না কত বছর হলো। ওর সঙ্গে দেখা হলে একটু ভালো লাগতো।’

– ‘ঠিক আছে যাও।’

মুনিয়া বেগম ফিরে এলেন। শ্রেয়া আড়াল থেকে শুনে অসম্ভব খুশি হয়েছে। মা রুমে ঢুকতেই আত্মহারা হয়ে জড়িয়ে ধরলো। তারপর কানের কাছে ফিসফিস করে বললো ‘আগে তো জানতাম না উনি আমার ভাই হয়, এবার জানি, ভাইয়ার সঙ্গে অনেক কথা বলবো মা।’

মুনিয়া বেগম চারদিকে তাকিয়ে তাকে সাবধান করে দিয়ে বললেন ‘চুপ, কোনোভাবে যদি তোর বাবা জানেন তুই জেনে গেছিস এগুলো। তাহলে কিন্তু সর্বনাশ হয়ে যাবে।’

– ‘না মা জানবে না। কখন বের হব আমরা?’

– ‘তোর বাবা অফিসে চলে যাক।’

মা-মেয়ে বারোটার দিকে এসে তাহিদদের কলিংবেলটা চাপলেন। ইতি গোসল করে রুমে এসেছে৷ চুল মুছতে মুছতে গিয়ে দরজা খুলে দিল। মধ্যবয়সী রূপবতী মহিলাকে দেখেই বুকটা ধক করে উঠলো ইতির। চেহারা দেখে বুঝতে অসুবিধা হলো না উনিই কল্পের মা। পেছনে একটা বারো-তেরো বছরের মেয়ে। ইতি সালাম করে বললো ‘আসুন।’

তারা সিটিং রুমে এসে বসলেন। তাহিদ আর মালিক সাহেব বাইরে। মরিয়ম বেগম ততক্ষণে বের হয়ে এসেছেন। দেখেই খুশি হয়ে ছুটে গিয়ে জড়িয়ে ধরলেন।

– ‘তুমি এসে গেছো আপা।’

– ‘তুই কেমন আছিসরে?’

– ‘ভালো আছি, তোমার শরীরের অবস্থা কেমন এখন?’

– ‘ভালো।’

– ‘এই মেয়েটা কে?’

– ‘মুজিবের মেয়ে।’

– ‘বাহ তাই না-কি?’

মুনিয়া বেগম ইতিকে টেনে কাছে বসালেন।

– ‘তোমাদের বাড়ির সবাই কেমন?’

– ‘ভালো আন্টি।’

– ‘বাহ তুমি তো অনেক মিষ্টি দেখতে৷ আচ্ছা মুজিব কি এখনও নাক টানে?’

ইতি হেঁসে ফেললো। মরিয়ম বেগম ফিসফিস করে বললেন, ‘তোমার ছেলেটাও মাশাল্লাহ, অনেক সুন্দর হয়েছে। দাঁড়াও আমি ডেকে আনি।’

কল্প রুমের ভেতরে পায়চারি করছে। বুঝতে পারছে মা এসে গেছেন। কিন্তু সামনে যেতে কেমন সংকোচবোধ করছে। আগেও এমন হতো। তার মা বছর কয়েক পর গ্রামে যেতেন। সৎ বাবার ভয়ে প্রথমদিন মায়ের সঙ্গে দেখা করিয়েই নানা-নানি মামাকে দিয়ে তাকে চাচার বাড়ি পাঠিয়ে দিতেন৷ ওরা চলে গেলে আবার নিয়ে আসতেন মামা৷ দেখা করাটা তার ভীষণ আরাধ্য হলেও, মায়ের সামনে যেতে বরাবরই ভীষণ লজ্জা লাগতো। মা’কে গিয়ে প্রথমে কি বলবে কখনও ভেবে পায় না সে৷ ‘আপনি’ করে কথা বলবে না-কি ‘তুমি’ করে? অন্যরা মা’কে ‘তুমি’ বলে জানে। কিন্তু সেও কি তুমি বলবে? সামনে গেলে তো অচেনা লাগে মানুষটিকে। মুনিরা বেগম এসে বললেন ‘কল্প আসো, তোমার মা এসেছেন।’

কল্প বিব্রত বিধ্বস্ত ভঙ্গিতে হেঁটে গেল। মুনিয়া বেগম তাকে সোফায় বসতে বললেন। সে মায়ের দিকে একবার তাকিয়ে বসে গেল। কিছুই বললো না৷ খানিক পর মনে হলো সালাম করা দরকার ছিল৷ এখন সালাম করলে কি অসুবিধা হবে? না-কি বেশি দেরি হয়ে গেছে। চারপাশে এক অস্বস্তিকর নীরবতা বিরাজ করছে। মুনিয়া বেগম মুচকি হেঁসে বললেন, ‘শ্রেয়া তোমার কথা সব জানে। কি যে পাগল তোমার সাথে দেখা করার জন্য। বাবার ভয়ে বলে না কিছু।’

কল্প মাথা তুলে বললো ‘ও আচ্ছা।’

– ‘ওর জন্যই আমাকে সিলেট যেতে দেয় না ওর বাবা। তার কথা হলো মেয়ে যেন কোনোভাবে তোমার কথা জানতে না পারে। অথচ দেখো সব জানে। তোমার সঙ্গে অনেক কথাও বলবে বলেছিল।’

কল্প চোখ তুলে বোনকে দেখে। শ্রেয়া অন্যদিকে তাকিয়ে আছে। চোখের পানি মুছলো মনে হচ্ছে। হ্যাঁ তাইতো, কাঁদছে। আশ্চর্য ব্যাপার, কাঁদবে কেন! কাঁদার কি আছে? সে তো তার আপন বোন নয়। কিন্তু ওকে তো কিছু বলা দরকার। কি বলবে সে? কিভাবে শুরু করবে। ওর নাম জানে। শ্রেয়া। সুন্দর নাম। এটা কি বলবে? তোমার নামটা সুন্দর? তুমি না-কি তুই করে বলবে? না এটা আরও পরে বলতে হয়। ‘শ্রেয়া তুমি কেমন আছো’ বলে শুরু করা যায়।
ইতি আর মরিয়ম বেগম ‘হা’ করে তাকিয়ে আছেন। এরা একটু চলে গেলে ভালো হতো। কিন্তু তারা যাবে কেন? মা-ছেলের সম্পর্ক তো গোপন কোনো ব্যাপার নয় যে একান্তে কথা বলার সুযোগ করে দিয়ে চলে যাবে। ইতি বোধহয় ব্যাপারটা বুঝে ফেলেছে। কিছু কিছু মেয়েরা অন্যদের মানসিক অবস্থা ভালো বুঝতে পারে। ইতি মরিয়ম বেগমকে ইশারা করে বললো, ‘তারা কথা বলুক ফুপু, আমরা চলে যাই।’

মরিয়ম বেগম আগ্রহ নিয়ে বসেছিলেন। তবুও চলে গেলেন উঠে। আরও খানিক অস্বস্তিকর নীরবতা। কল্প চারদিকে তাকাচ্ছে। যেন জরুরি কিছু খুঁজছে সে। মুনিয়া বেগম নীরবতা ভেঙে বললেন, ‘শ্রেয়ার সাথে তো তোমার পরিচয় আছে, তাই না?’

– ‘জ্বি আছে।’

– ‘কিরে শ্রেয়া তুই না ভাইয়ার সাথে অনেক কথা বলবি বল।’

শ্রেয়া ফুফিয়ে ফুফিয়ে কাঁদতে শুরু করলো। কল্পের চোখও ঝাপসা হয়ে এসেছে৷ মুনিয়া বেগম মেয়ের কান্নার দিকে নজর দিলেন না কেন কে জানে। তিনি স্বাভাবিকভাবে বললেন,

– ‘তোমার পড়ালেখা কেমন চলছে কল্প?’

নামটা যেন বাক্যে তিনি জোর করে ঢোকালেন। কল্প মাথা তুলে বললো,

– ‘জ্বি ভালো।’

– ‘তোমার এইচএসসি রেজাল্ট শুনেছিলাম। অনেক খুশি হয়েছি। এখন না-কি ভালো ভার্সিটিতে পড়ো।’

– ‘জ্বি।’

– ‘আমার অসুখের খবর শুনেছিলে?’

– ‘জ্বি শুনেছি।’

– ‘আমাকে দেখতে ইচ্ছা করেনি?’

কল্প আহত চোখ তুলে তাকালো। মুনিয়া বেগম দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, ‘ইচ্ছা নাও করতে পারে। আমি জানি তুমি আমাকে পছন্দ করো না। তুমি হয়তো ভুলে গেছো। তুমি একটা সময় প্রতিদিন আমার কাছে আসার জন্য কাঁদতে। মা তোমাকে খুবই কষ্টে সামলে রাখতেন।’

কল্পের ইচ্ছা হলো বলতে যে সে অপছন্দ করে না তাকে। তিনিই চান না সে আসুক। তবুও বলতো পারলো না। অনেক কথা এক সঙ্গে গলার কাছে যেন আঁটকে আছে। অনেক কিছু বলতে গেলে মানুষ কেন যেন কিছুই বলতে পারে না। নির্বাক হয়ে যায়। মুনিয়া বেগম আবার বললেন,

– ‘এবার অসুস্থ হওয়ার পর তোমাকে দেখতে ভীষণ ইচ্ছা করছিল। তখন শ্রেয়াকে সব বলে ফেলেছিলাম। গভীর কষ্ট মানুষ কাউকে বলতে চায়। না বলে পারা যায় না…।’

মুনিয়া বেগম চোখের পানি মুছলেন। তারপর আবার বললেন,

– ‘যত বয়স হচ্ছে বাবা। ততই আমি অনুশোচনায় ভুগছি। মাঝে মাঝে মনে হয় তোমার কাছে আমি খুবই অপরাধী।’

কল্পের কান্না গলায় দলা পাকিয়ে এসেছে৷ কপালের রগগুলো আকাশের তারার মতো দপদপ করছে। মুনিয়া বেগম আবার বললেন,

– ‘তুমি তোমার বাবার মতো হয়েছো। তোমার বাবা পৃথিবীর অসাধারণ একজন মানুষ ছিলেন। তিনি গভীর রাগেও বকতেন না৷ কিন্তু ঠিকই কষ্ট দিতেন। তুমি তার মতো ইচ্ছা করে কষ্ট দেওয়া এই বয়সেই শিখে গেছো..।’

মুনিয়া বেগম আবার চোখ মুছলেন। কল্প রক্তাভ বিকৃত চেহারায় তাকালো। সে কান্না আঁটকে রাখতে পারছে না। মুনিয়া বেগম আবার বললেন, ‘কিভাবে তুমি আমাকে কষ্ট দাও জানো? আমি বিয়ের পর বাপের বাড়ি যেতে পারতাম না৷ অনেক ঝামেলার ব্যাপার ছিল৷ তো বছর কয়েক পর গেলে তুমি আমাকে ‘আপনি’ করে বলতে৷ অচেনা মানুষের মতো আচরণ করতে, লজ্জা পেতে। এগুলো আমার কলিজা এফোঁড়ওফোঁড় করে দিত। দুনিয়ায় এমন পাপ করলাম যে নিজের ছেলের কাছে আমি অচেনা…।’

থামলেন তিনি, গলা ধরে এলো। মুনিয়া বেগম আবার চোখ মুছলেন। শ্রেয়া দুইহাতে মুখ ঢেকে কান্নায় কেঁপে কেঁপে উঠছে। তিনি খানিক পর আবার বললেন, ‘তুমি হয়তো জানো না বাবা। আমি প্রথমে তোমাকে রেখে বিয়ে বসতে চাইনি। বয়স কম ছিল। সবাই বুঝিয়ে বিয়ে দিয়েছেন। বাবা বলতেন ছেলের জন্য চিন্তা করো না৷ আমরা আছি। তার কোনো অসুবিধা হবে না। তোমার জীবন তোমার। দীর্ঘ একটা জীবন পড়ে আছে। নিজের মতো করে শুরু করো। বাপের বাড়ি কতদিন থাকবে? কল্প ছেলে মানুষ। চোখের পলকে বড়ো হয়ে যাবে। দুনিয়ায় কুকুরও বেঁচে থাকে৷ সে তো ছেলে মানুষ। পুরুষ মানুষ যেখানে লাথ মা’রে সেখানে ভাত, যেখানে কাত হয় সেখানে রাত। তার চিন্তা বাদ দাও। এরকম সবাই কতকিছু বুঝাইতো। এক সময় রাজি হয়েছি। বিয়ের শুরুর দিকে ভাবতাম দিন গেলে ধীরে ধীরে শ্রেয়ার বাবা তোমাকে মেনে নিবে৷ কিন্তু সে ঠিকই মেনে নেয়নি। উল্টো এমনভাবে সাবধান থেকেছে। যেন তার পরিচিত কেউই তোমার কথা না জানে। সেসব আরও কত ইতিহাস৷ এগুলো বলতেও চাই না। পৃথিবী দুঃখ-কষ্টের জায়গা৷ দুঃখ-কষ্ট বলে বলে চর্চা করার মতো কিছু নয়। তবুও মানুষ বলে। আমার আজকাল বলতে ইচ্ছা করে। শ্রেয়াকে বলি। মেয়েটা শুনে শুধু কাঁদে। ওর মন অনেক নরম। শেষ বয়সে এসে তোমাকেও কত কথা বলতে ইচ্ছা করে। বলার সুযোগ হয় না৷ শুধু এটুকু বলি বাবা, এই অভাগী দুখিনী মা’কে তুমি ক্ষমা করে দিয়ো।’

কল্প দুইহাতে মুখ ডেকে নিল। সে কোনো কথাই বলতে পারছে না। এই মহিলা না এলেও বরং ভালো হতো। অন্যের বাসার সিটিং রুমে বসে কাঁদার মতো ছেলে সে নয়। তবুও কেঁদে ফেললো কল্প। মুনিয়া বেগম এসে তার পাশে বসে মাথায় হাত রাখলেন। কল্প মায়ের কোলে মাথা রেখে কেঁপে কেঁপে উঠলো কান্নায়। তখনই মোবাইল বেজে উঠলো। শ্রেয়ার বাবার কল। মুনিয়া বেগম চোখের জল মুছে বললেন, ‘হ্যালো।’

– ‘তুমি কোথায়?’

– ‘সকালে বললাম না আমার এক বোনের বাসায় আসবো?’

– ‘তো বললেই কি দুনিয়ার সব ফেলে চলে যেতে হবে? যাওয়ার আগে কি একবারও বাবার রুমে গিয়ে উঁকি দিয়েছো?’

– ‘তাতে এখন কি হয়েছে?’

– ‘মালা কল দিয়ে বললো উনি অশান্তি করছেন। তুমি তাড়াতাড়ি বাসায় যাও। ডাক্তার লাগলে ডাক্তার নিয়ো।’

– ‘এত অস্থির হওয়ার তো কিছু নাই। উনার যা বয়স একটু তো অসুখ করবেই। আমি এখন মাত্র এসেছি।’

– ‘আশ্চর্য আমার অসুস্থ বাবার খবর শুনেও তুমি বলছো অসুখ তো করবেই! এইমাত্র এসেছি! উনার অবস্থা তুমি জানো না। যদি মারা যায় একা বাসায়?’

– ‘আচ্ছা ঠিক আছে আমি যাচ্ছি।’

– ‘তোমার কাছে কাঁদে কে?’

মুনিয়া বেগম থমকে গেলেন। শুকনো ঢোক গিললেন। তারপর আমতা-আমতা করে বললেন, ‘বাসার একটা বাচ্চা কাঁদছে।’

– ‘ওকে তাড়াতাড়ি যাও৷ রাখছি।’

মুনিয়া বেগম ফোন রেখে দিলেন। ভ্যানিটিব্যাগ হাতে নিয়ে বললেন, ‘মরিয়ম কোথায় তুমি? আমাদের যেতে হবে।’

মরিয়ম বেগম এসে অবাক হয়ে বললেন ‘আরে কি বলো? নাশতা দিচ্ছি৷ এখনই চলে যাবে কেন?’

– ‘আমার শ্বশুর অসুস্থ। প্রচুর বয়স্ক আর অসুস্থ। অনেকদিন থেকে যখন-তখন অবস্থা৷ কল এসেছে যাওয়া লাগবে। আমি বাইরে আর এই অবস্থায় কিছু হলে ননদরা দুনিয়া উল্টিয়ে ফেলবে।’

– ‘কি বলো এসব?’

মুনিয়া বেগম ফিরে কল্পের মাথা হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন, ‘যাচ্ছি বাবা।’

কল্প ‘হা’ করে তাকিয়ে রইল। শ্রেয়া আর মুনিয়া বেগম চলে যাচ্ছেন। কল্প বসে আছে। মরিয়ম বেগম বললেন, ‘যাও, তাদের এগিয়ে দিয়ে আসো।’

কল্প উঠে দাঁড়াল। পিছু পিছু এলো গেইটের বাইরে। মুনিয়া বেগম রিকশা দাঁড় করালেন হাত তুলে। তারপর পিছু ফিরে কল্পের দিকে তাকিয়ে ভেঙে পড়লেন কান্নায়৷ গেইটের রট ধরলেন শক্ত করে। কোনোভাবে নিজেকে সামলাতে পারছেন না। রিকশাওয়ালা ফ্যালফ্যাল করে তাকাচ্ছে। কল্প অন্যদিকে মুখ ফুরিয়ে আছে তার ঠোঁট কাঁপছে।
একটা কাক মাথার উপর দিয়ে ‘কা-কা’ করে এই বিষণ্ণ দুপুরকে আরও বিষাদময় করে উড়ে গেল। কল্প গেইটের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা নিরীহ গাছের পাতা টান দিয়ে এনে ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করছে। শ্রেয়া আচমকা এসে তাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বললো, ‘ভাইয়া তুমি চলো আমাদের সঙ্গে।’
__চলবে….
লেখা: জবরুল ইসলাম

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here