মায়াডোর পর্ব-১৮+১৯

মায়াডোর (১৮ পর্ব)
.
কল্প গেইট থেকে তাদের বিদায় দিয়ে বাসায় ফিরে আসে৷ শ্রেয়ার আবেগকে প্রশ্রয় দিলেন না মুনিয়া বেগম। তাকে বুঝিয়ে কল্পের থেকে বিদায় নিয়ে চলে গেলেন। তাহিদ রাতে সত্যি সত্যিই স্মার্টফোন নিয়ে এলো ইতির জন্য৷ সিম ঢুকিয়ে সবকিছু সেটিং করে দিল সে নিজেই৷ ইতি মোবাইল পেয়ে বিস্মিত, অভিভূত। বাড়িতে ফোন করেও জানিয়েছে। ওরা প্রথমে খানিক রাগারাগি করলেও তাহিদ সবকিছু সামলে নিল। কেরিয়ারে সফল ছেলেদের আত্মীয়-স্বজন সমীহ করেন। তাহিদের ক্ষেত্রেও ব্যতিক্রম নয়। ফুপুর বাসায় ইতির দিনকাল ভালো কাটলেও চরম বিরক্তিতে কাটছে কল্পের। মায়ের সঙ্গে এখন যুক্ত হয়েছে শ্রেয়া। ওর ‘ফ্যাসফ্যাস’ করে কান্না তার হৃদয়টাকে ভিজিয়ে দিয়ে গেছে৷ হঠাৎ করে মনে হতে শুরু করেছে পৃথিবীতে তারও একটা বোন আছে। ব্যাপারটা যেমন আনন্দের, তেমনই তার জন্য কষ্টের। পরেরদিন ভোরে তাহিদ বাইরে যাওয়ার আগে এলো তার রুমে।

– ‘কল্প খালা এসেছিলেন শুনেছি। মন খারাপ করো না।’

– ‘না না ঠিক আছি আমি।’

– ‘তোমার তো মনে হয় বোরিং লাগছে বাড়িতে। চাইলে আম্মুকে নিয়ে ইতি আর তুমি বেড়াতে যেতে পারো। আম্মু সবকিছু চিনে।’

– ‘না আমার বেড়াতেও ভালো লাগে না।’

তাহিদ ঘড়ি হাতে লাগাতে লাগাতে হাসলো।

– ‘হ্যাঁ কিছু মানুষ আছে তাদের বেড়াতেও বিরক্ত লাগে। অথচ কেউ বিরক্তি কাটাতে বেড়াতে যায়৷ মানুষ কি অদ্ভুত। আচ্ছা তুমি কি বই পড়ো?’

– ‘হ্যাঁ পড়ি। তাহলে আমার রুমে যেয়ে বই এনে পড়তে পারো। আমি প্রচুর বই পড়ি।’

– ‘বাহ ভালো তো।’

– ‘মানুষ ভাবে ডাক্তাররা বেরসিক হয়। এরা শিল্প-সাহিত্য পছন্দ করবে না। কেন রে ভাই? আমাদের কি মন বলতে কিছু নাই? একদিন এক নবীন লেখক আমার কাছে তার বই দেখে বললো আশ্চর্য আপনি কবিতার বই পড়েন? ভাবো একবার! তুমি জানো সবচেয়ে সাহিত্যের বই কারা বেশি পড়ে?’

– ‘মেয়েরা, পুরো পৃথিবীতেই এটা স্বীকৃত সত্য।’

– ‘ছেলেদের মাঝে কারা পড়ে জানো?’

– ‘এটা নিয়ে ভাবিনি।’

– ‘পাব্লিক ভার্সিটির ছেলেরা এবং মাদ্রাসা ছাত্ররা।’

– ‘তাই না-কি?’

– ‘হ্যাঁ, তুমি এটা খেয়াল করলে বুঝতে পারবে। আচ্ছা যাই এখন। হঠাৎ মনে হলো তুমি বাসায় একা একা দিন কাটাচ্ছ।’

তাহিদ চলে গেল বাইরে। কল্প উঠে ওর রুমে গিয়ে দেখে বইয়ের বিশাল সংগ্রহ। বিছানায় বালিশের পাশে একটা বই রাখা শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের ‘কাগজের বউ’।

নামটা শুনে মোটেও ভালো বই মনে হলো না তার। তবুও নিয়ে এলো। কিন্তু পড়তে শুরু করতেই ডুবে গেল বইয়ে। অসম্ভব ভালো লাগলো বইটা। ভেবেছিল আজই ইতিকে ডেকে বলবে চলে যাওয়ার কথা। কিন্তু তাহিদের ঘরে তাকভর্তি বইয়ের সংগ্রহ তাকে আঁটকে দিল৷ একের পর এক বই পড়ছিল। কিন্তু দু’দিন যেতেই সে লক্ষ্য করলো ইতি তার রুমে আসে না। তাদের মধ্য কথাও হয়নি। ব্যাপারটা আশ্চর্যের হলেও কল্প এটাই চেয়েছিল। তবুও তার বুকের ভেতর কেমন খচখচানি বেড়ে গেল। রাতে খেতে বসে জানলো দিনে একবার মরিয়ম বেগম এবং ইতি বাইরে বেড়াতেও গিয়েছিলেন। সব মিলিয়ে কেমন কষ্ট হচ্ছিল কল্পের। ইতির ভালোবাসার সঙ্গে সে পরিচিত, উপেক্ষার সঙ্গে নয়। পরেরদিন দুপুরে কল্প তাকে ডেকে বললো, ‘আমার তো ক্লাস আছে, টিউশনি আছে। আর কয়দিন থাকবে। যাওয়া দরকার না?’

ইতি আমতা-আমতা করে বললো, ‘আচ্ছা কাল চলে যাব তাহলে। আমি ফুপুর সঙ্গে কথা বলে নিব।’

কল্প সম্মতি দিল। ইতি চলে গেল তার রুম থেকে। সবকিছুই কল্পের কাছে অবিশ্বাস্য লাগছিল।

পরেরদিন দুপুরে তারা বের হয়। তাহিদ বাস স্টেশনে এনে দিয়েছে। বিদায়ের সময় বললো, ‘ইতি পড়ালেখা ভালোভাবে করবি। সারাক্ষণ মোবাইল নিয়ে পড়ে থাকিস না। শেষে মামা-মামী আমাকে বকবেন।’

ইতি ফিক করে হেঁসে বললো, ‘আচ্ছা, ঠিক আছে।’

কল্পের সঙ্গে কথা বলে বিদায় নিয়ে চলে গেল সে৷ ইতি আর কল্প পাশাপাশিই বসেছে ওইদিনের মতো। বাস চলছে। ইতি কানে ইয়ারফোন গুঁজে বুকে হাত বেঁধে চোখবুজে বসে রইল। তার প্রতি বিশেষ কোনো আগ্রহ আছে ইতির মনেই যেন হচ্ছে না। এই ব্যাপারটা কল্পকে যেন স্বাভাবিক থাকতেই দিচ্ছে না। একপর্যায়ে সে বলেই ফেললো, ‘ইতি।’

ইয়ারফোন খুলে সে বললো ‘কিছু বলবেন?’

– ‘হ্যাঁ।’

– ‘কোনো সমস্যা? মাত্র এক সপ্তাহ এই বাসায় থেকেছি আমরা। তুমি অনেক পালটে গিয়েছো মনে হচ্ছে।’

ইতি ফ্যাকাসে মুখে হেঁসে বললো, ‘আপনি তাইই চাইছিলেন।’

– ‘তা অবশ্য ঠিক। তবে অবাক লাগছে আমার।’

– ‘কষ্টও লাগতে পারে। শুনেছি চেনা মানুষের অচেনা রূপ অনেক পীড়াদায়ক।’

– ‘তাহলে তুমি কি আমাকে পীড়া দেওয়ার চেষ্টা করছো?’

– ‘মোটেও না। আমি শুধুমাত্র একটা স্বাভাবিক মেয়ের মতো আচরণ করছি৷ এতদিন করিনি৷ আর এখন করছি কারণ আপনিই চেয়েছিলেন।’

– ‘তা ভালো, দেখবে খুব দ্রুত তুমি ভুলে যাবে আমাকে৷ তোমার বয়সটাই এমন।’

– ‘আপনি কিন্তু বারবার ভুলে যান আপনি আমার মাত্র দুই বছরের বড়ো।’

কল্প হেঁসে বললো ‘তা অবশ্য ঠিক।’

– ‘শুনুন ভুলে যাব বা আপনাকে কষ্ট দেওয়ার চেষ্টা করছি এরকম কিছুই না৷ আমার বয়স কম, এই বয়সে এরকম হয়ই, মোহ কেটে যাবে এসব বুঝদারি চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলুন। আমি শুধু অন্যের বিরক্তিকর কারণ হতে আর চাইছি না৷ আরেকটা কথা মনে রাখুন। অনেক জ্ঞানী জ্ঞানী কথা তো বলেন। এটা বুঝেন কি-না কে জানে। দু’জন একেবারে চুপ হয়ে গেলে কেউ কাউকে ভুলতে পারবো না। এর চাইতে স্বাভাবিকভাবে থাকাই ভালো। আমরা পরিচিত মানুষ। আমি আপনার কাছে পড়েছি। এই হিসাবে যতটুকু সম্পর্ক থাকে সেটা থাকাই ভালো। না হয় আরও বেশি কষ্ট হবে দুজনেরই। আপনার জন্য আমার দুয়ার খোলা। কিছু বলতে চাইলে বলবেন। সব সময় পাশে পাবেন আমাকে। আমিও চাই নিজের মতো পড়ালেখা শেষ করে বিয়ের প্রস্তাব দিন।’

কল্প আমতা-আমতা করে বললো, ‘তা অবশ্য দেবো, কিন্তু সেটাও আট-দশটা বিয়ের প্রস্তাবের মতো। দুই পরিবার মানলেই তবে বিয়ে হবে। এর ভেতরে ধরো তোমার কোনো ভালো বিয়ের সম্মন্ধ এলো। তুমি বিয়ে বসে যেও। ভুলেও বলতে যেও না আমার কথা। আমাদের মাঝে সেরকম কোনো প্রণয়ের সম্পর্ক নেই।’

ইতি তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে ইয়ারফোন কানে গুঁজে দিল। কল্পও ফেইসবুকে যায় সময় কাটাতে, গিয়ে দেখে ইতির ফ্রেন্ড রিকুয়েস্ট। গ্রহণ করে নিল সে। দু’জনের মাঝে আর কোনো কথা হলো না। ইতি নজরুল সংগীত শুনছে ‘আলগা করো গো খোপার বাঁধন..।’
বাইরে তাকিয়ে আছে। একটা ব্রিজে উঠেছে বাস। নিচে বয়ে গেছে আঁকাবাঁকা নদী। আকাশে ঝকঝকে রোদ। পাশে কে? তার অসম্ভব প্রিয় একজন মানুষ। যার জন্য এরকম কয়েকটা নদীর থেকেও বেশি ভালোবাসা ছোট্ট বুকটিতে পুষে রাখে ইতি। এত ভালোবাসা এখন থেকে গোপন রাখতে হবে। চোখের ভেতরে নদীটা ফুসে উঠলো বোধহয়, চোখ ছলছল করছে।
পুনরায় গানটিতে মনযোগ দেয়ার চেষ্টা করলো ইতি ”বিনোদ বেনির জরিন ফিতায়
আন্ধা ইশক মেরা কাস গায়ি॥
আলগা করো গো খোপার বাঁধন
দিল ওহি মেরা ফাস গায়ি…।”

বাড়িতে ফিরে এলো তারা সন্ধ্যার সময়। এরপর ক্রমশই ইতি পালটে যেতে শুরু করলো। পড়ালেখা, মোবাইল, বন্ধু-বান্ধবী নিয়ে আলাদা একটা ভুবন তৈরি করে নিল সে। মাঝে মাঝে কল্পের অচেনা মনে হতো ইতিকে। হঠাৎ করে যেন বড়োও হয়ে গেছে অনেকটা। তার জীবনও স্বাভাবিকভাবেই যাচ্ছিল। পড়ালেখা, টিউশনি। সমস্যাটা শুরু হলো বছর খানেক পর। যখন তার চাচা ফ্যামিলি সহ দেশে এলেন। ইতি যেটুকু আশার আলো বুকে নিয়ে দিন কাটাচ্ছিল। সেই আশাও ভেঙে যেতে দেখছিল চোখের সামনে।
__চলবে…
লেখা: জবরুল ইসলামমায়াডোর (১৯ পর্ব)
.
ইতি ঘটনাটা জানতে পারে কলেজ থেকে আসার পর। ইন্টার সেকেন্ড ইয়ারে এখন পড়ে সে। শরীরে-মননে তুমুল পরিবর্তনের সময়। ইতিরও হয়েছে, হচ্ছে। কিন্তু মানসপটে কল্পকে নিয়ে যে ভালোবাসার রঙিন জগত তৈরি করে রেখেছিল৷ সেটা একই রকম আছে৷ ধূলো জমেনি একটুও। এখনও রঙিন প্রজাপতি উড়ে সেখানে। এখনও সেই রাজ্যের রাজা কল্প নামের মানুষটাই। রোজই ইতি ঘুমোতে যায় কল্পকে একদিন সে পাবে এই আশা নিয়ে। আবার ঘুম থেকে উঠেছে এই বিশ্বাস নিয়েই৷ আজ সে কি দেখছে এসব? ইতি নিচের কাঁপা কাঁপা ঠোঁট কামড়ে ধরে চিলেকোঠার দেয়ালে হেলান দিয়ে বসে পড়ে। বাইরে প্রবল বৃষ্টি হচ্ছে৷ আসমান ডাকছে৷ চিলেকোঠার চালে ঘোর লাগা শব্দ হচ্ছে। নাকে আসছে এক অদ্ভুত, অলিক, অচেনা ঘ্রাণ। কল্প তাকে অনেক লম্বা মেসেজ পাঠিয়েছে। কিছুদিন আগে তার চাচা এসেছেন বলে বাড়িতে গিয়েছিল৷ স্বাভাবিক ব্যাপার। যেতেই পারে৷ কিন্তু এরকম কিছু হতে পারে ইতি ভাবেনি কখনও। অবিশ্বাস্য লাগছে সবকিছু। ঝাপসা চোখে পুনরায় মেসেজ পড়ে,

“ইতি তোমাকে কিছু কথা বলার জন্য মেসেজ দিয়েছি। আমার ধারণা না বললেও কোনো সমস্যা নেই৷ কারণ আমাদের মধ্যে কিন্তু প্রণয়ের সেরকম কোনো স্লোগান আদান-প্রদান হয়নি৷ এটা ভেবে ভীষণ হালকা লাগছে আমার। যদি সেই দিনগুলোতে আমি তোমার পাগলামিতে সাড়া দিতাম, তাহলে আজ কি হতো বলো তো? বিষয়টা ভাবতে গিয়ে আমার গা বারবার শিউরে উঠে। তবে একটা কথা আমি স্বীকার করছি। তোমাকেও আমার ভালো লাগে। তোমাকেও আমি পছন্দ করি। তবে আমাদের পছন্দ-অপছন্দকে প্রাধান্য দিয়ে জীবনের সকল ঘটনা ঘটে না। সেটাই প্রমাণ পেলাম আবার। ইতি আমার বিয়ে ঠিক হয়েছে৷ গোষ্ঠী সুদ্ধা সেই বিয়েতে রাজি, খুশি। সুপ্তি আপু তো কেঁদে ফেলেছে গলা জড়িয়ে। প্রিয় মানুষরা তো আমাদের নিশ্চিত-সুন্দর একটা জীবন চায়৷ মামার অবস্থা হয়েছে দেখার মতো। আমার নিজেকে কেমন মেয়ে-মেয়ে লাগছে। কারণ মেয়েদের এরকম ভালো জায়গায় বিয়ে ঠিক হলে অভিভাবকরা বাচ্চামো শুরু করে। আরেকটা ঘটনা ঘটেছে ইতি। তোমার সঙ্গে কথা হয় না বলে বলিনি। আমার বোন শ্রেয়া আছে না? ওইযে মরিয়ম ফুপুর বাসায় দেখেছিলে। সারাক্ষণ ফ্যাসফ্যাস করে কাঁদেছিল মিষ্টি একটা মেয়ে। সে এরপর থেকে প্রায়ই আমাকে কল দিতো। ভাইয়া ভাইয়া করে কত গল্প যে করে। সে এবার পড়ে নাইনে। মা কিন্তু আমাকে সেরকম কল দিয়ে কথা বলতেন না৷ এবার কথা বলেছেন। এই বিয়ে ঠিক হওয়ায় তিনি প্রচণ্ড খুশি। আমাকে কত উপদেশ দিলেন। যেন চাচাদের সঙ্গে সুন্দরভাবে কথা বলি। বিদেশি মেয়ে। তাদের কালচারই আলাদা। একটুতে তাদের ঘ্যা*ড়ত্যা*ড়া হয়ে যায়। যেন খুবই সাবধানে চলাফেরা করি। এখন নিয়মিত তাদের সঙ্গে আমার কথা হয়। আমার সৎ বাবাও না-কি একটু নরম হয়েছেন আমার প্রতি। তুমি ভাবতে পারছো ব্যাপারটা? আশপাশের মানুষ, পরিবেশ, সমাজ আমাকে আঙুল দিয়ে বুঝিয়ে দিচ্ছে আমার জীবনে সবচেয়ে বড়ো ঘটনা বিলেতি স্ত্রী পাওয়া। তোমার কি মনে হয় এটা যৌক্তিক ইতি? আমি পাব্লিক ভার্সিটিতে চান্স পাওয়া থেকে কি এটা বড়ো ঘটনা? আমি বুঝতে পারছি না বিষয়টা৷ তবে আনন্দ-দুঃখ এগুলো সংক্রামিত হয়। এখন সবার আনন্দ দেখে আমারও আনন্দ হচ্ছে। আমি অতি ক্ষুদ্র একজন মানুষ৷ আমার দ্বারা আপনজন সবাই খুশি হচ্ছে। এটা তো আমার অনেক বড়ো পাওয়া। ইতি আমি তোমাকে আর ছোট করতে চাই না৷ বলতে চাই না আমাকে ভুলে যেও। আমি বিশ্বাস করি আমার মতো কাপুরুষকে তুমি ইতোমধ্যে ভুলে গিয়েছো। আমি এখন আরেকটা স্বপ্ন দেখি ইতি। ছোটবেলা থেকেও দেখতাম। একদিন আমি অনেক বড়ো হব, যতটুকু বড়ো হলে আমার মা এসে আমার কাছে থাকবেন৷ আমার আলাদা একটা বাড়ি হবে। সেখানে আমার সংসার হবে৷ সেই সংসারে আমার মা থাকবেন। কেউ মা’কে আঁটকে রাখতে পারবে না৷ কারণ উনার একটা আশ্রয় আছে। তার ছেলে আছে। এখন শ্রেয়াকে নিয়েও ভাবি। সে তো আমারই বোন। মায়ের পেটের বোন। আমি ওর বড়ো ভাই৷ ওর প্রতি আমার কত দায়িত্ব আছে তাই না? মরিয়ম ফুপুর বাসায় দেখা হওয়ার পর থেকে এই অচেনা অদ্ভুত এক অনুভূতি হচ্ছে আমার। আমার একটা বোনও আছে এটা ভাবলেই অন্য রকম লাগে। এখন মাঝে মাঝে ভাবি আমরা সবাই যদি একসঙ্গে থাকতে পারতাম…।
সেই স্বপ্ন বোধহয় এখন পূরণ হবে। আমি ইংল্যান্ড গিয়ে দুইহাতে টাকা কামাবো৷ জানো তো ইংল্যান্ড রেস্টুরেন্টে হাড়ি-পাতিল মাজলেও মাস শেষে লক্ষ লক্ষ টাকা ইনকাম৷ তখন মা’কে আর শ্রেয়াকে ইংল্যান্ড নিয়ে যাব। শ্রেয়া স্টুডেন্ট ভালো। তাকে স্টুডেন্ট ভিসায় নেয়া যাবে। এই দেখো কত অগ্রীম ভাবনা আমি শুরু করেছি। আমার এই এক সমস্যা। অগ্রিম ভাবি৷ অবশ্য এটা ভাবনা না, স্বপ্নও বলতে পারো। মানুষ মাত্রই স্বপ্নবিলাসী। ইতি আমার ভীষণ ইচ্ছা করছে তোমাকে সান্ত্বনা দেই কিছু একটা বলে৷ কিন্তু এগুলো বলে তোমাকে ছোট করা হবে। বিশ্বাস করো তোমাকেও আমি পছন্দ করি। তুমি আমার জীবনে এক আক্ষেপের নাম হয়ে থাকবে। তোমার ঠোঁটের কোণে তাচ্ছিল্যের হাসি ফুটে উঠেছে তাই না? ভাবছো এত পছন্দ করলে কেন পিছিয়ে গেলাম? চাইলেই যেখানে পেতাম তোমাকে। মোটেও এটা ভেবো না। পৃথিবীতে সব মানুষ সূদুর প্রসারী চিন্তা করতে পারে না৷ বেশিরভাগ মানুষ পরিস্থিতির ভেতর দিয়ে যাওয়ার পর বুঝতে পারে৷ কেউ কেউ শুধু আগে বুঝতে পারে। তারা যে ওলী-আউলিয়া লেভেলের মানুষ তা কিন্তু না। আমাদের রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও বোধহয় সুদূর প্রসারী চিন্তা করতে পারতেন। তাই তিনি এভাবে কবিতা লিখেছিলেন ‘আজি হতে শতবর্ষ পরে….।’
আমারও বোধহয় কিঞ্চিৎ সুদূর প্রসারী চিন্তা করার ক্ষমতা আছে। এখন যদি আমি এই বিয়ে করতে না চাই। আমার মামা, মা, চাচা সকলেই প্রচণ্ড বিস্মিত হবেন। এরপর রেগে যাবেন। পরিস্থিতি খুবই জটিল হবে৷ এরপর ভাবো তোমার পরিবারের ব্যাপারটা। এগুলো ভাবলে তুমিও বুঝতে পারবে যতটা সহজ ভাবছো, সেরকম সহজ না৷ ভাগ্য ভালো আমরা আগেই সতর্ক ছিলাম৷ নিজেদের সামলে নিয়ে চলাফেরা করেছি। না হলে এতদিনে দু’জন মায়াডোরে বাঁধা পড়ে যেতাম। এই বাঁধন খুবই জটিল ইতি। এই জটিল পৃথিবীকেও তোমার কাছে তখন তুচ্ছ মনে হবে। সব নিয়ম-কানুন লা’ত্থি মেরে ভেঙে ফেলার স্পর্ধা হয়ে যাবে। পরিবারের মুখে চুনকালি লাগাতে দ্বিতীয়বার ভাববে না। আমরা ভাগ্যিস সেদিকে যাওয়ার আগেই সাবধান হয়ে গিয়েছিলাম। ইতি তুমি পড়ালেখা করো। খুবই ভালোভাবে মনযোগ দিয়ে করো৷ আমার এখন শুধু বিয়ের কথা পাকা হবে। হয়তো এনগেজমেন্টও হয়ে যাবে। সবকিছু এখনও ঠিক জানি না। বিয়ে হলেও আমি এখনই ইংল্যান্ড যাচ্ছি না। ওরা চলে যাবে। আমি পড়ালেখাই করবো। এর ভেতরে প্রসেসিং হবে আমাকে ইউরোপ নেয়ার। যদি চলেও যাই। তোমার বিয়ের আগে আমি আসবো। দেখবে তুমি রাজপুত্রের মতো বর পাবে৷ তুমি কি যে মিষ্টি একটা মেয়ে তুমি জানো না। তোমার জন্য অবশ্যই মিষ্টি একটা জীবন অপেক্ষা করছে৷ তুমি শুধু ঠিকঠাক মতো পড়ালেখায় মনযোগ দাও। এতদিন তো দেখেছি, খেয়াল করেছি, তুমি বেশ সামলে নিয়েছো নিজেকে। তাই একটু সাহস পাচ্ছি৷ হয়তো তুমি তেমন কষ্ট পাবে না। দেখবে বয়স যত বাড়বে। এসব ভুলে যাবে তুমি। এরপর এই ঘটনাগুলো স্বরণ হলে নিজেই হাসবে। এটাই জীবন। অনেক বেশি বকবক করছি তাই না? নিজেই বুঝতে পারছি না। অনর্গল কথা বলার স্বভাব আবার আমার কবে থেকে হলো। মেসেজ যেন শেষই করতে পারছি না৷ যাইহোক তুমি ভালো থেকো। ওরা ইংল্যান্ড চলে যাওয়ার পর আর আমি তোমাদের ওখানে আসবো। কতদিন থাকবেন তারা কে জানে! মাস কয়েকও থাকতে পারেন। তুমি কিন্তু একটুও কষ্ট পেও না ইতি। আমিও পাচ্ছি না৷ আমি সেই এতটুকু বয়সে মা’কে ছাড়া থেকেছি। আমি জানি আমার মা আছেন৷ কিন্তু বড়দের কিসব জটিল নিয়ম-কানুন আর বাঁধার কারণে যেতে পারছি না। মায়ের সঙ্গে ঘুমোতে পারছি না৷ সে যে কি ছটফটানির বিষাদময় দিন ছিল তুমি বুঝবে না ইতি। আমি শিশুকালে মায়ের বিরহ ব্যথা সহ্য করেছি। সে তুলনায় তুমি কিছুই না৷ শুধু ভাবছি তোমার কথা, তুমি কষ্ট পাবে কি-না। তুমি এতদিন যেভাবে থেকেছো। সেভাবে থাকবে। ভালো থেকো।”

ইতির পুরো শরীর কাঁপছে। চোখ ফেটে যেন পানি আসছে। সে নিজেকে ধোঁকা দেয়ার জন্য চিলেকোঠার চার দেয়ালের দিকে তাকালো। দরজার কাছে গিয়ে বৃষ্টি দেখার চেষ্টা করলো। না, শরীর ক্রমশই অবশ হয়ে আসছে। চোখ ভরে আছে জলে। কিছুই দেখা যাচ্ছে না। গলা ছেড়ে কাঁদতে ইচ্ছা করছে। দুইহাতে মুখ ঢেকে নিল ইতি। কেঁপে কেঁপে উঠলো পুরো শরীর। তাড়াতাড়ি নিজেকে সামলে নিতে হবে। গলা দিয়ে একটু শব্দ হলেই মা রান্নাঘর থেকে এসে উঁকি দিয়ে বলবেন ‘এই এখানে কাঁদে কে?’
বিশ্রী হয়ে যাবে ব্যাপারটা। ইতি মোবাইলটা দেয়ালের পাশে রাখলো। নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরলো। মাথার রগগুলো ‘দপদপ’ করছে। কল্প কেন ভাবে তাকে ভুলে যাবে ইতি? কেন ভাবে বয়স বাড়লেই সে এগুলো নিয়ে হাসবে। তার আবেগ-ভালোবাসাকে কেন সে এত যুক্তি দিয়ে বিশ্লেষণ করে। কি করবে এখন ইতি? বুক ফেটে যাচ্ছে। সে তাড়াতাড়ি ছাদে বের হয়ে আসে। মানুষের উপস্থিতি টের পেয়ে একটা বৃষ্টিভেজা শালিক উড়ে গেল পিলার থেকে। ঝিরিঝিরি জলের ফোঁটা অনবরত মাথায় পড়ছে ইতির৷ এবার মনখুলে চোখের পানি ফেলা যায়। বৃষ্টির সঙ্গে মিশে যাক তার কান্না। কেউ বুঝবে না, কেউ জানবে না। বিশাল আকাশের জলের সঙ্গে অতি ক্ষুদ্র এক প্রণয়িনীর বিষাদমাখা চোখের অশ্রু মিশে যাচ্ছে আজ। ইতি এতটা দিন কেবল নিজের প্রকাশের লাগাম টেনে ধরেছিল। নিজের অনুভূতি, ইচ্ছা আকাঙ্খা গোপন রেখেছিল। ভুলে যায়নি সে, কল্পকে ভুলে যেতেও পারবে না কোনোদিন। রোজ রাতেই সে কল্পের ছবিগুলো দেখতো ফেইসবুকে গিয়ে। হাতে-গোনা এই ছবিগুলো কত সহস্রবার যে দেখেছে। কল্প কেন বুঝে না তার ভালোবাসা কম-বয়সের কোনো মোহ না। তার ভালোবাসার গভীরতা মাপার মতো ফিতা এই বিশ্ব ভ্রম্মান্ডে নেই। এই ক’দিন সে শুধু নিজেকে আড়াল করে রেখেছিল। অথচ কল্প উঠোন দিয়ে বাইরে যাওয়ার সময় দু’টি চোখ নিরাপদ দূরত্ব থেকে চেয়ে থাকতো। খাওয়ার টেবিলে চোরা চাহনিতে দেখতো। বারবার মনে হতো মানুষটাকে যদি নিজ হাতে কোনোদিন খাইয়ে দিতে পারতাম। ঘুমোতে গেলে কোলবালিশটা বুকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে মনে হতো যদি বালিশটা হঠাৎ প্রাণ ফিরে পেত। যদি কল্প হয়ে যেত? নিজে নিজেই লজ্জা পেত ভীষণ। তবুও সামনে যায়নি৷ পাগলামি করেনি৷ নিজেকে সামলে রাখতে পেরেছে। কারণ সে বিশ্বাস করতো মানুষটা তো তারই। কেবল সময়ের ব্যাপার। কল্প তো নিজেই বলেছিল সেও ভালোবাসে। তাকে ভালো না বেসে পারা যায় না। তবে হঠাৎ এ কি ঘটে গেল তার জীবনে। এই মানুষটাকে ছাড়া সে এই দীর্ঘ জীবন একা একা কাটাবে কি করে? ইতির কান্নার তোড় আরও বেড়ে যায়। নিজের চুল খামচে ধরে। হাউমাউ করে কাঁদে সে। হাঁটু অবশ হয়ে আসে। বসে যায় মেঝেতে। খোলা আকাশ আর বৃষ্টি তাকে রক্ষা করতে পারেনি৷ কান্নার শব্দে ঠিকই ছাদে চলে আসেন হুস্না বেগম। দৌড়ে এসে ধরেন মেয়েকে। বিস্মিত হয়ে টেনে তুলে বলেন ‘আরে তোর কি হয়েছে? বৃষ্টিতে ভিজে কাঁদছিস কেন?’
__চলবে….
লেখা: জবরুল ইসলাম

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here