মায়াডোর পর্ব-২০+২১

মায়াডোর (২০ পর্ব)
.
কল্প ড্রাইভারের পাশে বসেছে৷ গাড়িতে মৃদুস্বরে বিদেশি গান বাজছে৷ আরবি না-কি অন্য কোনো ভাষার গান সে ঠিক বুঝতে পারছে না। পেছনে তার চাচা-চাচি সঙ্গে নিহা আর নিপা আছে। নামগুলোতে বাঙালি ছাপ স্পষ্ট। বড়ো হয়ে এরা হয়তো নিজেদের আরও কত নাম রেখেছে। সেসব নামে বিদেশি বন্ধু-বান্ধবীদের কাছে পরিচিত। নিহা ইংলিশ উচ্চারণে অদ্ভুত বাংলায় বললো, ‘কল্প ভাইয়া ড্রিংক লাগবে।’

কল্প মাথা নেড়ে বললো, ‘আচ্ছা ঠিক আছে, কুদ্দুস ভাই তুমি গাড়িটা একপাশে রাখো।’

ড্রাইভার গাড়ি থামায়৷ সে ড্রিংক নিয়ে আসে। দুজনের মাঝে নিহা ছোট। নিপা বড়ো। নিপার সঙ্গেই তার বিয়ে ঠিক হয়েছে। মেয়েটাকে চুপচাপ দেখা যায়। চোখ দেখে স্পষ্ট বুঝা যায় সে এতটাও শান্ত নয়৷ চোখ ঠিকরে ওর সজাগ মন বের হয়ে আসছে। দেশে নিয়ে আসার আগে হয়তো মা-বাবা বাংলাদেশের মানুষ সম্পর্কে বুঝিয়ে শিখিয়ে এনেছেন। পোশাক-আশাকেও যথেষ্ট শালিন দেখা যাচ্ছে। শুধু যা দেখে ক্যামেরা হাতে নিয়ে ছবি তোলার স্বভাবটা বিদেশ রেখে আসতে পারেনি৷ বাড়িতে ওইদিন মাছ নিয়ে একজন দোকানদার এলো। কাঁধে শার্ট। শরীরে সাদা লোম। বুকে কেঁচোর মতো হাড়। প্রথমে দু’বোন গিয়ে ভীষণ আগ্রহ নিয়ে মাছের ছবি তুলেছে। এরপর নিহা মাছওয়ালাকে বললো, ‘এক্সকিউজ মি, আপনার কি একটা ছবি তুলতে পারি?’

লোকটা সুপারির নি*র্যাতনে লাল হয়ে যাওয়া দাঁত বের করে হেঁসে ‘তুলেন মা’
বলে আগ্রহ নিয়ে গুটানো লুঙ্গি ছেড়ে দিয়ে দাঁড়াল। নিপা পলকে কয়েকটি ক্লিক মেরে ছবি তুলে নিল। এভাবেই তাদের খুবই ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বিষয় নিয়ে মাতামাতি করে দিন যাচ্ছে। কল্পের সঙ্গে নিপা তেমন কথা বলে না৷ অবশ্য সেও যে বলার জন্য মুখিয়ে আছে তাও না৷ তার দিনকাল যাচ্ছে একরম ঘোরের ভেতর দিয়ে। সেটা আবার আশেপাশের মানুষও কিভাবে যেন বুঝে যাচ্ছে। গতকাল বাড়ির পুকুর ঘাটে ঘণ্টা দুয়েক সিঁড়িতে বসে রইল সে। পুকুরের জলের দিকে তাকিয়ে এতক্ষণ সে বসে আছে নিজেই যেন বুঝতে পারেনি। চাচি এলেন তার কাছে। ফরসা স্বাস্থবতী নারী। হাতে, গলায় সোনার চুড়ি, হার চিকচিক করছে। চেহারায় আভিজাত্যের ছাপ। কয়েক হাত দূর থেকেও নাকে ঘ্রাণ আসে। সেই মানুষটি অনেক্ষণ তার পেছনে এসে দাঁড়িয়ে ছিল সে টেরই পায়নি৷ হঠাৎ তিনি কাঁধে হাত দিতেই সে কেঁপে উঠলো। তিনি অবাক হয়ে বললেন, ‘একা একা বসে কি এতো ভাবছো বাবা?’

এরকম ঘটনা বারবার পুনরাবৃত্তি হচ্ছে তার। কিছুতেই সে নিজেকে স্বাভাবিক করতে পারছে না৷ খানিক পর পর ইতির ইনবক্সে যায়৷ সে ওই মেসেজ পেয়ে কিছু বললো কি-না দেখে। ইতি কিছুই বলে না৷ মেসেজ সিন করে কোনো প্রতিক্রিয়া দেখায়নি সে। কল্প জানে এটাই তার জন্য ভালো। তবুও বুকের ভেতর কেন এত ‘খচখচ’ করে তার? ইতিকে ওই মেসেজ পাঠানোর পর থেকে কেন তার অদ্ভুত অসহ্য এক অনুভুতি হচ্ছে। গতকাল বাজারে একটা সেলুনের দোকানের বেঞ্চে বসে আছে। বাস এসে থামে কিছুটা দূরে। আশ্চর্য, বারবার বাস এলে তার কেন যেন মনে হয় ইতি আসতে পারে ওই বাসে। সে সত্যিই খানিক এগিয়ে গিয়ে দেখে আসে। না ইতি আসে না। আসার কথাও নয়। ওইদিন চাঁদনি রাত। নিহা আর নিপা বললো তারা বিলের পাড়ে যাবে। বাবাকে বলে এসেছে৷ বিলে চাঁদ দেখবে তারা। কল্প তাদের নিয়ে গেল। বাড়ির উত্তর দিকে এই বিশাল বিল। টলটলে জলে চাঁদের আলো পড়েছে। বেশ অপূর্ব দৃশ্য। বিলের একপাশে অনেকটা জায়গাজুড়ে গোড়ালি অবধি সাদা ধবধবে ধূলো। চাঁদের আলোয় অন্যরকম লাগছে। চিকচিক করছে ধুলো-বালি আর বিলের জল। নিহা বললো, ‘কল্প ভাইয়া আমরা এদিকে হাঁটবো। তুমি গিয়ে মা’কে বলবে না।’

কল্প মাথা নেড়ে সম্মতি জানিয়ে হেলান দিয়ে বসে পড়ে একটা গাছের গোড়ায়। চোখের সামনে একটা লাটিম গাছ। আনমনে সে তাকিয়ে রইল সেদিকে। ক্ষীণ সময় পর আচমকা গাছটিকে সে স্পষ্ট দেখতে পেল ইতির অবয়ব। খিলখিল করে হাসছে ইতি। মুহূর্তেই আবার ঠিক হয়ে গেল সে। ওরা দুই-বোন হাসতে হাসতে ফিরে এসেছে।
রাতে সে ঘুমোতে পারে না। ঘুমের ভেতর ইতিকে নিয়ে নানান স্বপ্নে বিভোর হয়ে থাকে৷ অন্ধকার রুমে প্রায়ই ইতির ঘ্রাণ পায়। স্পষ্ট সেই চেনা ঘ্রাণ। এটা ইতির শরীরের মৌলিক গন্ধ। মাঝরাতে ঘুম ভেঙে গেলে মনে হয়, ইতি নিশ্চয় কোনো মেসেজ দিয়েছে। তাড়াতাড়ি চ্যাক করে সে। না ইতির কোনো মেসেজ আসে না৷ এরকম তো তার কখনও হয়নি। ইতিকে কত উপেক্ষা করেছে৷ তাছাড়া প্রায় এক বছর ইতিও কোনো বাড়াবাড়ি করেনি। সে তাতে খুশিও হয়েছে। তাহলে এখন তার এমন লাগছে কেন? ইতিটার জন্য বুকের ভেতর এত তোলপাড় হয় কেন? মস্তিষ্কটা কেন সে দখল করে নিয়েছে? কেন তাকে ছাড়া কিছুই ভাবতে পারছে না কল্প? এতদিন ইতি যতসব পাগলামি করেছিল সবকিছু ছবির মতো চোখে ভেসে বেড়ায়। বাসে একসঙ্গে ঢাকা যাওয়া-আসা৷ ওকে পড়ানোর দিনগুলো। ওর জোর করে জড়িয়ে ধরা…।
সব, সবকিছু ভীষণ মনে পড়ে কল্পের। মাঝে মাঝে গান শুনে। তখনও আরও বেশি ইতির কথা মনে পড়ে। স্পষ্ট শুনে ওর খিলখিল হাসি। স্পষ্ট দেখে ওর অভিমানী মুখ। এতদিন তো এমন হয়নি। তাহলে কি তার অবচেতন মন তখন বিশ্বাস করতো ইতি তো তার আছেই। এখন হারিয়ে ফেলতে যাচ্ছে বলে মন বিদ্রোহ করে বসেছে?
কল্প ড্রিংক নিয়ে এলো। বাড়িয়ে দিল নিহার দিকে। গাড়ি আবার চলতে শুরু করেছে। তারা জাফলং বেড়াতে গিয়েছিল৷ এখন সিলেট শহরে ফিরছে। হোটেলে থাকা হবে আজ। আগামীকাল অন্য কোথাও যাওয়া হবে। কল্প ভাবছে শহরে যেহেতু আছে ইতিদের বাসায় যাবে সে। ইতি কি করছে, কি ভাবছে বড়ো জানতে ইচ্ছা করে। ওর কি একটুও খারাপ লাগেনি? কিছুই বলবে না সে? তাকে তো ভালোবাসতো মেয়েটা। তাহলে এত শান্ত থাকবে কেন? সবকিছু কল্পের অসহ্য লাগছে। পাগল হয়ে যাবে মনে হচ্ছে। হোটেলে ফিরে রাতটা ছটফট করে কাটিয়ে নিল সে। ভোর পাঁচটায় দুঃস্বপ্ন দেখে ভেঙে গেল ঘুম। সে দেখতে পেল একটা সবুজ খোলা মাঠ, একপাল সাদা হাসের পিছু পিছু যাচ্ছে ইতি। হাসগুলো গিয়ে একটা বিলে নেমে গেল। ইতিও হাসের সঙ্গে নেমে গেছে বিলে। সে ক্রমশই তলিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু উঠার কোনো চেষ্টা করছে না৷ সাঁতার কাটছে না৷ সে লাফ দিয়ে উঠে গেল ঘুম থেকে। এই স্বপ্নের কোনো মানে হয়? সে সাঁতার জানে। গিয়ে ইতিকে উদ্ধার করতে পারে৷ ইতি নিজেও সাঁতার জানে৷ তবুও তলিয়ে যাবে কেন? এরকম অযুক্তিক স্বপ্নের মানে কি? তবুও তার ভীষণ মন খারাপ হয়ে রইল।
সবাই যার যার রুমে তখনও ঘুমোচ্ছে৷ সে কাউকে কিছু না বলে অদ্ভুত এক অদৃশ্য হেঁচকা টানে যেন ঘোরগ্রস্ত হয়ে হোটেল থেকে বেরিয়ে পড়লো। রিকশা একটা নিয়ে উপস্থিত হলো ইতিদের বাড়িতে। এই বাড়িটা যেন কত আপন তার। আশপাশের গাছ, প্রতিটি পাখি, প্রতিটি মানুষ, প্রতিটি দোকানই যেন তার বড়ো আপন। বারান্দার গ্রিলের দরজা খুলে বারান্দায় গেল। দাদাভাই করুণ সুরে ‘গুনগুন’ করে দোয়া-দরুদ পড়ছেন। করিডরে ঝাড়ু হাতে লতিফা। কল্প বিব্রত চেহারায় হাসি হাসি মুখ করে বললো ‘কি খবর লতিফা আপু, বাড়ির সবাই ভালো তো?’

লতিফা চারদিকে তাকিয়ে কাছে এসে ফিসফিস করে বললো, ‘ইয়াল্লা ভাইজান আপনে আইছেন। বাড়ির যে কি অবস্থা ভাইজান জানেন না। গেল রবিবারে কলেজ থাইকা ইতিরে ভূ*তে ধরছে। বাড়িতে আইসা হঠাৎ কইরা ছাদে গিয়া বৃষ্টিতে ভিইজা কান্নাকাটি করে নাজেহাল৷ বুঝেন অবস্থাটা ভাইজান। চাচি গিয়া পরে টেনে আনলেন। কেন কান্দে জিগাইলে কিচ্ছু কয় না। কলেজে যায় না। বিছানায় আন্দার ঘরে বইসা থাকে। হঠাৎ কান্দে হঠাৎ কইরা হাসে বুঝেন অবস্থা। আর সারাক্ষণ গায়ে জ্বর থাকে৷ আগুনপোড়া শরীর। এত গরম। দাদাভাই মসজিদের হুজুর আনছিলেন। ডেইলি হুজুর আইসা ফুঁ দিয়া যান। কিন্তু কাজের কাজ কিচ্ছু হয় না ভাইজান।’

কল্প বিস্মিত হয়ে বললো, ‘কি বলো এসব?’

তাদের কথাবার্তা শুনে ফরিদ সাহেব হাঁক ছেড়ে বললেন ‘কে কথা কয়? কে আইছেরে লতিফা?’

– ‘কল্প ভাইয়া আইছে দাদাজান।’

তিনি রুম থেকে বের হয়ে এলেন।

– ‘কল্প তুমি এসেছো? আহা তুমি নাই তাই ভোরে আর বের হওয়া হয় না। তোমার খবর শুনলাম। বিদেশি মাইয়া না-কি বিয়ে করতেছো?’

– ‘হ্যাঁ নানাভাই।’

– ‘ভালো, খুব ভালো। তা আসো আমার রুমে। গল্প-টল্প করি৷ অনেকদিন পর আসছো।’

– ‘আচ্ছা আসছি। আগে ইতিকে দেখে আসি। ও না-কি অসুস্থ।’

– ‘ও কিছু না। ওই কলেজের টয়লেট মনে হয় দোষী। ভূ*ত-পে*ত্নী লগ নিয়েছে। হুজুরের ঝাড়ফুঁক চলছে। কয়েকদিন পর সব ঠিকঠাক হয়ে যাবে।’

কথাটা বলে তিনি নিজের রুমে চলে গেলেন। কল্প এসে লতিফার সঙ্গে ঢুকলো নীলার রুমে। নীলা রান্নাঘরে৷ লতিফা বাতি জ্বালিয়ে দিল রুমের। পাতলা নীল কম্বল গায়ে জড়িয়ে শুয়ে আছে ইতি। রান্নাঘর থেকে ডাক পড়ায় লতিফা সেদিকে ছুটে চলে গেল। কল্প এক অদ্ভুত ঘোর লাগা অবস্থায় গিয়ে বিছানায় বসে। তারপর কাঁপা কাঁপা হাত নিয়ে রাখে ইতির কপালে। প্রচণ্ড গরম শরীর। তার বুকে ‘চিনচিনে’ এক ব্যথা ক্রমশই তীব্র হতে শুরু করে। তার ইতিটার এ কেমন অবস্থা হয়েছে? চোখের নিচে কালি পড়ে গেছে। কলেজে যাচ্ছে না৷ অসুখ ছাড়ছে না৷ গত রোববারে বৃষ্টিতে ভিজে কেঁদেছে ইতি৷ সেদিনই তো সে মেসেজ পাঠিয়েছিল। তারমানে তার জন্য এই অবস্থা মেয়েটার। এত কষ্ট পেয়েছে ইতি? এত কষ্ট! এই কষ্ট সে কিভাবে দূর করবে? সে আনমনেই মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছিল। নীলা এসে ঢুকলো, ‘কল্প এসেছো?’

কল্প হঠাৎ করে কেঁপে উঠলো, ‘হ্যাঁ আন্টি।’

– ‘তোমার বিয়ে কবে তারিখ কি পড়েছে?’

– ‘কথাবার্তা হচ্ছে। মা ও আসবেন। নিজের মাঝে তো তাই এত চিন্তা করছেন না৷ হুট করে বিয়ে হয়ে যাবে।’

– ‘এত ভোরে কোত্থেকে এলে?’

– ‘টাউনেই ছিলাম। চাচা-চাচিদের নিয়ে বেড়াতে এসেছি। একটা হোটেলে উঠেছি। ঘুম থেকে উঠে ভাবলাম দেখে যাই আপনাদের।’

– ‘আচ্ছা বসো, তোমার জন্য নাশতা আনি। দেখো ইতির কি অবস্থা হয়েছে। তাকে নিয়ে সবাই কত টেনশনে। কিন্তু মেয়েটা কিছুই বলে না কি হয়েছে।’

কল্প কোনো জবাব দিল না। নীলা চলে গেল। তাদের কথাবার্তা শুনে ইতির ঘুম ভেঙে গেছে। সে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে কল্পের পিঠে। নীলা চলে যেতেই কল্প ওর দিকে ফিরে তাকায়। চোখাচোখি হয় তাদের। ইতি অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নেয় পলকেই। কল্প পুনরায় ওর কপালে হাত দিয়ে বলে, ‘এ কি অবস্থা তোমার ইতি? কি হয়েছে?’

ইতি কোনো জবাব দিল না। কল্প পুনরায় মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো, ‘জ্বর তো এতদিনে কমার কথা, তুমি ওষুধ খাচ্ছ তো ঠিকঠাক।’

ইতি তবুও জবাব দিল না। কল্প ভেজা গলায় বললো, ‘তুমি আমার দিকে তাকাবে না?’

ইতি মুখ ফিরিয়ে এনে ছলছল চোখে বললো, ‘তাকানোর কি আছে?’

– ‘জবাব দিচ্ছ না কেন ইতি? তোমার এই অবস্থা কেন? ওষুধ-টষুধ খাচ্ছ তো ঠিকমতো?’

‘তা দিয়ে আপনি কি করবেন?’ কথাটি বলে ইতি পুনরায় মুখ ফিরিয়ে নিল। নীলা তারজন্য নাশতা নিয়ে এলো। কল্পের সামনে ট্রে রেখে ইতিকে বললো, ‘ইতি চলো হাত-মুখ ধুয়ে নাশতা করবে।’

ইতি কাশতে কাশতে বললো, ‘আমার কিছু খেতে ইচ্ছা করছে না আন্টি।’

– ‘কি শুরু করেছো তুমি ইতি? তোমার যন্ত্রণায় বাড়ির সবাই শেষ। এভাবে না খেয়ে বিছানায় পড়ে থাকবে না-কি।’

ইতি তবুও চুপচাপ শুয়ে রইল। কল্পের গলা দিয়ে কিছুই গেল না আর। কিছু না খেয়ে চলে যেতেও পারছে না। গরম গরম চা টেনে খেয়ে উঠে গেল৷ ফরিদ সাহেবকে গিয়ে মিথ্যে বললো, ‘বসে গল্প করার ইচ্ছা ছিল নানাভাই৷ কিন্তু চাচা কল দিয়েছেন এখনই যেতে হবে।’

কথাটি বলেই আর দাঁড়ায় না। হাঁটা শুরু করে। তার বুকে চাপা একটা কষ্ট হচ্ছে৷ ওদের সামনে হঠাৎ চোখে পানি চলে এলে কি ভাববে ওরা? তাই তাড়াতাড়ি চলে এলো সে। ইতি কি শুরু করেছে এসব? কেন এমন করছে? এখন তারই বা কি করার আছে? একটা রিকশা ডাকলো সে। রিকশাওয়ালা বললো, ‘কোথায় যাইবেন ভাইসাব?’

কল্প জবাব না দিয়ে উঠে বসে বললো, ‘যেদিকে ইচ্ছা যান।’

___চলবে……
লেখা: জবরুল ইসলামমায়াডোর (২১ পর্ব)
.
রিকশাওয়ালা বিভ্রান্ত হয়ে খানিকক্ষণ তাকিয়ে রইল তার দিকে। কল্পের চোখ জলে ঝাপসা। তবুও আকাশ দেখার চেষ্টা করছে সে। নীল আকাশে ঝকঝকে রোদ। শিমুল তুলোর মতো টুকরো টুকরো শুভ্র মেঘ চারদিকে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। রিকশাচালক ইতি-উতি করে সিটে উঠে বসে। নিতম্ব দুলিয়ে প্যাডেল দিতে থাকে। কিছুদূর যেয়ে বলে, ‘ভাইসাহেব এইদিকে যাই?’

কল্প মাথা নাড়ে। রিকশাচালক পুনরায় প্যাডল চাপে। ইতির জন্য ভীষণ কষ্ট হচ্ছে তার। মেয়েটা ভালো নেই। আর সে? সে কি ভালো আছে? তার ওইসব যুক্তি, ধৈর্য, নিজেকে সামলে চলার বুকভরা গর্ব সবই যেন ম্লান হয়ে যাচ্ছে। কোনোকিছুই আর মাথায় আসছে না৷ সবকিছু এখন তার বিরুদ্ধাচারণ শুরু করেছে। ইতিকে স্বাগত জানাচ্ছে। তারও ভালো লাগে ওকে। মেয়েটার এই বেপরোয়া ভালোবাসায় কোনো ক্লেদ নেই সে জানে৷ তবুও ওর ভালোবাসা উপেক্ষা করে সে আরেকজনকে গ্রহণ করতে যাচ্ছে। এটা কি ঠিক হচ্ছে? সে নিজেও তো ভালোবাসে ইতিকে। নিজের সঙ্গেই কি সে জোর-জবরদস্তি করছে? আসলে তার এখন কি করা উচিত?

রিকশাচালক আরও খানিকটা দূরে এসে বললো, ‘ভাই সাহেব এইদিকে যাই?’

সে মাথা নেড়ে সম্মতি দেয়। পুনরায় প্যাডেল চাপে রিকশাচালক। কল্প ডুবে থাকে ইতির ভাবনায়। আরও মিনিট তিরিশেক পর একটা মানসিক ডাক্তারের চেম্বারের সামনে এসে গামছা দিয়ে ঘাম মুছতে মুছতে রিকশাওয়ালা বলে, ‘ভাই সাহেব দুইদিন আগে এক যাত্রী আমারে নিয়া এই ডাক্তারের কাছে আইছিল। আপনি কি যাইবেন?’

কল্প আনমনে ‘হ্যাঁ’ বলতে যেয়েই আবার থেমে গেল। রিকশাচালকের রসিকতা টের পেয়ে রাগ না করে হেঁসে ফেললো সে। তারপর দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো, ‘আপনি কি বিরক্ত?’

– ‘না হয়ে উপায় আছে ভাই আপনিই কন। ভোরে রিকশা নিয়া আইসাই আপনার পাল্লায় পড়লাম। কোথায় যাইবেন না যাইবেন কিছুই কইতেছেন না। হুদাই ঘুরাইতেছেন। এগুলো কি ভালো লাগে?’

কল্প হেলান দিয়ে বসে বললো, ‘হ্যাঁ বুঝতে পারছি কাজটা ঠিক হয়নি। চলুন একটা রেস্টুরেন্টে যাওয়া যাক। দুজনে নাশতা করি।’

রিকশাচালক পুনরায় উঠে। দু’জন একটা রেস্তোরাঁয় যায়। টেবিলে নাশতা আসে। রিকশাচালক রুটি ছিঁড়ে ডালভাজি মিশিয়ে আয়েশ করে মুখে দিয়ে বললো, ‘ভাইসাহেব দেশের হাল-অবস্থা বুঝতাছেন কিছু? সবকিছুর দাম বাইড়া যাইতেছে। খরচাপাতির বাজারে আগুন।’

কল্প মাথা নাড়ে কেবল। লোকটি আরেক টুকরো রুটি মুখে দিয়ে বলে, ‘তয় ভাইজান এইবার মনেহয় নব্বই এর গ*ণঅ*ভ্যুত্থান হইয়া যাইব। বিরোধীদল দেখতেছেন কিরকম চ্যাতছে।’

কল্প বিস্মিত হয়ে লোকটির মুখের দিকে তাকায়।

– ‘আপনি রিকশা চালিয়েও এত খবর রাখেন?’

– ‘আগ্রহ ভাইসাহেব, রাজনৈতিক আলাপ-সালাপ বড়োই ভালো লাগে। যেখানে আলাপ পাই, বইসা বইসা শুনি।’

– ‘ও আচ্ছা।’

– ‘আপনের অসুবিধা কি ভাইসাহেব। মনে তো হয় কোনো কিছু নিয়া বিরাট চিন্তায় আছেন।’

কল্প লোকটির দিকে তাকিয়ে স্মিত হাসে।

– ‘আপনি জেনেই বা কি করবেন?’

– ‘কিছুই না ভাইসাহেব৷ ইচ্ছা হইলে বলবেন। না হইলে নাই। স্বাধীন বাংলাদেশ।’

কল্পের লোকটিকে ভালো লাগছে। মনখোলা নিশ্চিন্ত মানুষ৷ সে এক টুকরো রুটি মুখে দিয়ে বললো, ‘ভয়ের কারণে খুবই পছন্দের কিছু ত্যাগ করতে চলেছি৷ এটা নিয়েই চিন্তিত।’

রিকশাচালক কিছুই বুঝতে পারে না। তবুও চিন্তিত হয়ে যায়। গ্লাসে পানি ঢেলে দুই চুমুক দিয়ে বলে, ‘ভাইসাহেব ভয়ে পছন্দের কিছু ত্যাগ করতাছেন মানে কি? দুনিয়াটা কাঁপা-কাঁপির জায়গা না ভাইসাহেব৷ দুনিয়া হইল গিয়া দাপা-দাপির জায়গা। কোনোকিছুতে ভয় পাইয়েন না।’
কল্প কিছু বলার আগেই পকেটে মোবাইলটা চিৎকার শুরু করে। বের করে দেখে মামা কল দিয়েছেন। সে রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে ক্রোধান্বিত গলায় বললেন, ‘এই বেকুবের বাচ্চা? তুই শুরু করেছিসটা কি, হ্যাঁ? তুই এখন কোথায়? তোর চাচা আমার কাছে কল দিয়েছে। হোটেলের নাশতার কার্ড তোর কাছে। টাইমের ভেতরে তারা না-কি নাশতা দেয়। এরপর বন্ধ। তুই সেই কার্ড নিয়ে ভোরে উধাও হয়ে গেলি তাদের কিছু না বলে, তুই শুরু করেছিসটা কি?’

– ‘ও হ্যাঁ, আমার মনে ছিল না মামা। আমি এখনই যাচ্ছি।’

– ‘তোর মন কোথায় থাকে? আরও অনেক অভিযোগ তোর নামে আছে। তুই না-কি সারাক্ষণ ধ্যান ধরে থাকিস৷ কারও সঙ্গে কোনো কথা বলিস না। একা একা বসে সারাক্ষণ কিসব ভাবিস। কি শুনি এগুলো?’

কল্প এই প্রথম জীবনে একটা উল্লেখযোগ্য কাজ করলো। ভালো লাগেনি তাই মামার কল কেটে দিল। এরকম কাজ সে কখনও করে না। কোনোদিন রে’গে গিয়ে কোনোকিছু ছুড়ে মা’রেনি৷ ভে’ঙে ফেলেনি। রে’গে গিয়ে কোথাও ঘু’সি মা’রেনি। না খেয়ে থাকেনি। ক্লাসে দেরিতে যায়নি। বাড়ির কাজ না করে গিয়ে স্যারের মা’র খায়নি। তার জীবনে অনিয়ম, অঘটন বলতে তেমন কিছুই যেন নেই। কল্প চেয়ার থেকে উঠে বললো, ‘একটু তাড়াতাড়ি শেষ করেন নাশতা, যেতে হবে আমার।’

কল্প উঠে গিয়ে নাশতার বিল দিয়ে বাইরে এসে দাঁড়ায়। মাথায় একটা কথা কেমন বারবার খেলে যাচ্ছে। ‘দুনিয়াটা কাঁপা-কাঁপির জায়গা না, দাপা-দাপির জায়গা’ কথাটা কতটুকু যৌক্তিক? কল্প বুঝতে পারছে না। তবুও যেন তার উপর কেমন প্রভাব ফেলতে শুরু করেছে। রিকশাচালক খানিক পর এলো। সে উঠে বসে সিটে৷ হোটেলের নাম বলে লোকটিকে৷ রিকশা পুনরায় চলছে। তখনই আবার মোবাইল বেজে উঠে। পকেট থেকে বের করে দেখে মায়ের কল। এই নাম্বার থেকে কল এলে তার ভেতরে যেন একফালি শীতল হাওয়া বয়ে যায়। রিসিভ করে সালাম করে সে। তিনি ওপাশ থেকে বলেন,

– ‘কল্প তুমি এখন কোথায়?’

– ‘বাইরে আছি।’

– ‘তোমার মামা কল দিয়েছিলেন। তুমি না-কি কল কেটে দিয়েছো?’

– ‘না তো, আমি তো ভেবেছিলাম উনি কেটে দিছে।’

– ‘ও তাই না-কি, কিন্তু সে অনেক রেগে আছে। তোমার চাচা না-কি তাকে কল দিয়েছিল। তুমি কেমন অস্বাভাবিকভাবে চলাফেরা করছো। সে তো নিজেই স্ত্রী-সন্তানদের কাছে তোমার অনেক প্রশংসা করেছিল বাবা। তাইতো সবাই রাজি হয়েছে। এখন তোমার চাচার মুখ ছোটো করো না।’

– ‘আচ্ছা মা।’

– ‘ওদের সঙ্গে হাসি-খুশি হয়ে কথা বলবে, মিশবে। ওরা তো সব সময় আনন্দ-ফূর্তিই পছন্দ করে।’

– ‘হ্যাঁ মা বুঝেছি।’

– ‘নিপার সঙ্গে কথা হয় তোমার?’

– ‘না মা।’

– ‘সে কি বাবা? সিলেট তো তুমি নিজেই থাকো। তোমার ভার্সিটিও আছে। তাকে নিয়ে বের হও। আড্ডা দাও। একজন আরেকজনকে এভাবে বুঝতে হবে তো।’

– ‘আচ্ছা মা।’

– ‘শুধু ‘আচ্ছা আচ্ছা’ করো না। তোমার চাচা রেগে আছেন। তাই তোমাকে কল দেননি।’

– ‘ও আচ্ছা।’

– ‘এখন তাড়াতাড়ি যাও, ওরা অপেক্ষা করছে।’

– ‘হ্যাঁ যাচ্ছি।’

কল রেখে দিলেন তিনি। কল্প হোটেলে ফিরে এলো প্রায় এগারোটার দিকে। তার চাচা প্রচণ্ড রেগে আছেন৷ কিন্তু কিছুই বলছেন না তাকে। সে চুপচাপ নিজের রুমে চলে গেল। খানিক পর চাচি এসে দরজায় নক করলেন। সে খুলে দিল। তিনি স্বাভাবিকভাবে বললেন, ‘কোথাও গিয়েছিলে না-কি?’

– ‘হ্যাঁ চাচি, আমার লজিং বাড়িতে গিয়েছিলাম।’

– ‘ও আচ্ছা। নাশতা করেছো?’

– ‘জ্বি করেছি। আপনারা করেছেন তো?’

– ‘হ্যাঁ বাইরে গিয়ে করে এলাম।’

– ‘ও আচ্ছা।’

উনি চলে গেলেন। কল্প এসি ছেড়ে শুয়ে রইল দীর্ঘ সময়। তারপর মনে হলো ইতিকে কিছু বলা দরকার। কিন্তু কি বলবে সে? তবুও মোবাইল হাতে নিয়ে ইনবক্সে গেল। খানিক ভেবে মেসেজ দিল, ‘ইতি প্লিজ কোনো রকম পাগলামি করো না। তুমি কি সকালের নাশতা করেছো? নাশতা করো। সহজ-স্বাভাবিক হও। আর জ্বর ছাড়ছে না কেন? আমার কেন যেন মনে হচ্ছে তুমি ওষুধও খাচ্ছ না।’
মেসেজ সিন হলো না। কল্প মোবাইল পাশে রেখে দুইহাত নিচে দিয়ে আবার শুয়ে রইল।
খানিক পর দরজায় পুনরায় কারও নক পায়। উঠে দরজা খুলে দেখে নিপা। সাদা গেঞ্জি পরে আছে। মাথা ডান পাশে সামান্য কাত। মিষ্টি হেঁসে বললো,

– ‘আসতে পারি?’

– ‘হ্যাঁ আসো।’

নিপা সোফায় বসলো। তারপর চারদিকে তাকিয়ে কপালের চুল সরিয়ে নিয়ে বললো, ‘চলো আজ আমরা দু’জন কোথাও ঘুরতে যাই।’

কল্প আমতা-আমতা করে বললো, ‘কোথায়?’

– ‘যেখানে নিয়ে যাবে তুমি। আমি তো চিনি না তেমন।’

– ‘আচ্ছা ঠিক আছে৷ কখন বের হবে?’

– ‘গোসল করে রেডি হয়ে যাও, এখনই বের হয়ে যাব।’

– ‘ও আচ্ছা।’

নিপা ডান পাশে মাথা সামান্য কাত রেখে মিষ্টি হেঁসে উঠে চলে গেল। কিছু কিছু মেয়েরা একপাশে মাথা খানিক কাত রাখে কেন কে জানে৷ কল্প উঠে বাথরুমে চলে গেল৷ নিপা আর সে প্রায় সম-বয়সী। ওইদিন তার মা বললেন তিন মাসের ছোট নিপা। তবুও মেয়েটিকে তার কাছে বড়োই মনে হয়।

ইতি বিছানায় উঠে বসে আছে। নীল কম্বল দিয়ে কোমর অবধি ডাকা। এখনও সে কিছুই খায়নি৷ হুস্না বেগম রাগারাগি করে চলে গেছেন। নীলা রান্নাঘরের সব কাজ শেষ করে এসে ইতির পাশে বসে। তারপর ওর কাঁধে হাত রেখে বলে, ‘ইতি সারাক্ষণ শুয়ে না থেকে উঠে বসো তো।’
ইতি উঠে বসে নীলার হাত মুঠোয় নেয়। তারপর জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে বলে, ‘ওই গানটা একটু গাও তো আন্টি ‘বরষার প্রথম দিনে’।’

– ‘ঢং করো না তো ইতি, এই ভর-দুপুরে কিসের গান? আমি খাবার এনে দিচ্ছি খাও আগে।’

– ‘খাব তুমি গানটা গাও।’

– ‘খাবে তো?’

– ‘হ্যাঁ।’

ইতি বিছানা থেকে রুমের জানালা দিয়ে জল ডুবুডুবু চোখে আমগাছের দিকে তাকিয়ে আছে। নীলা ওর এক হাত কোলে নিয়ে গুনগুন করছে,

“বরষার প্রথম দিনে ঘন কালো মেঘ দেখে
আনন্দে যদি কাঁপে তোমার হৃদয়
সেদিন তাহার সাথে করো পরিচয়
কাছে কাছে থেকেও যে কভু কাছে নয়..।

জীবনের সব ভুল যদি ফুল হয়ে যায়
জীবনের সব ভুল যদি ফুল হয়ে যায়
যদি কোনো দিন আসে জোছোনার আঁচলে ঢাকা মধুর সময়
তখন কাছে এসো, তাহাকে ভালোবেসো
সেদিন তাহার সাথে করো পরিচয়
কাছে কাছে থেকেও যে কভু কাছে নয়
বরষার প্রথম দিনে…..।”

___চলবে…
লেখা: জবরুল ইসলাম

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here