মায়াডোর পর্ব-২২+২৩

মায়াডোর (২২ পর্ব)
.
কল্প সবাইকে নিয়ে সন্ধ্যার দিকে হোটেলে ফিরে আসে। শেষপর্যন্ত শুধু নিপা আর সে একা বাইরে যেতে পারেনি। নিহা ড্রিমল্যান্ড পার্কে যাওয়ার জন্য সবাইকে অস্থির করে ফেলেছে। সেটাই হলো। সবাই মিলে ড্রিমল্যান্ড গিয়ে ঘুরে এসেছেন। কল্প পুরোটা দিনই অন্যমনস্ক ছিল। সুযোগ পেলেই ইনবক্সে গিয়ে দেখেছে ইতি মেসেজ সিন করলো কি-না। একবার মনে হয় ওর ফোনে হয়তো মেগাবাইট নেই। আবার মনে পড়ে যায় মেসেঞ্জার তো ফ্রি। তাহলে কেন মেসেজ সিন করবে না? হোটেলে ফিরে এসে এখন ভাবছে কল দেবে। সবাই যার যার রুমে চলে গেছেন। সে হাত-মুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে বিছানায় এসে বসেছে। মোবাইল হাতে নিয়ে কল দিতে গিয়ে অবাক হয়ে যায়। ইতির নাম্বার তার কাছে নেই৷ কি আশ্চর্য! ওর নাম্বারটা অবধি তার কাছে থাকবে না? এই বিষয়টা কেন যেন তার বুকের ভেতর তীরের মতো বিঁধে গেল৷ মেয়েটাকে সে এত উপেক্ষা করে কেন? কত কষ্টই না পেয়েছে ইতি এতটা দিন। কিন্তু তখন সে এগুলো বুঝতে পারেনি কেন? না-কি সে এতদিন প্রেমে পড়েনি ইতির? ছেড়ে চলে যাবে মনে হতেই এই পরিবর্তন? কল্প কিছুই যেন বুঝতে পারে না৷ পুরো চিন্তার জগত এলোমেলো হয়ে গেছে। এখন ভেবে পাচ্ছে না এত উপেক্ষা সে এতদিন কিভাবে করেছিল? নিজের কাছেই অবিশ্বাস্য লাগছে। এই মুহূর্তে ইতির সঙ্গে কথা বলতে ভীষণ ইচ্ছা করছে তার। কিন্তু যোগাযোগ করবে কিভাবে? ইতি ঠিকঠাক মতো খাওয়া-দাওয়া করছে কি-না কে জানে। হঠাৎ মনে হলো নানাভাইয়ের নাম্বার তার কাছে আছে। কিন্তু উনার সঙ্গে কথা বলে বড়জোর ইতির কথা জিজ্ঞেস করা যাবে। ওর কাছে ফোন নিয়ে দিতে কিভাবে বলবে? কল্প জানালার পর্দা সরিয়ে বাইরে তাকায়। আকাশে চাঁদ দেখা যাচ্ছে। রুমের বাতি বন্ধ করে দেয় সে। গ্লাস ভেদ করে চাঁদের নরম আলোয় আলোকিত হয়ে যায় কামরা। কল্পের কি যে হলো। সঙ্গে সঙ্গে আবার পর্দা টেনে দিল সে। কেন হোটেলে বসে আছে? এই শহরেই তো তার ইতি আছে৷ তারজন্যই তো অভিমান করে খাওয়া-দাওয়া বাদ দিয়ে বসে আছে মেয়েটা৷ গেঞ্জিটা গায়ে দেয়৷ চুলে আঙুল চালায়। মানিব্যাগ পকেটে নিয়ে বেরিয়ে পড়ে হোটেল থেকে। বাইরে এসে রিকশায় উঠে মনে পড়ে কাউকে বলে আসা দরকার ছিল। চাচাকে কল দিয়ে জানায় বাইরে এসেছে। ফিরতে একটু দেরি হবে৷ উনি কোনো প্রতিক্রিয়া দেখালেন না। ইতিদের বারান্দার গ্রিল ভেতর থেকে লাগানো। কলিংবেল চাপলো সে। খুলে দিলো এসে নীলা।

– ‘আরে কল্প এসেছো।’

– ‘হ্যাঁ, শহরেই তো আছি তাই ভাবলাম দেখে যাই।’

– ‘ভালো করেছো।’

ফরিদ সাহেব হাঁক ছেড়ে রুম থেকে বললেন, ‘কে এসেছে বউমা?’

– ‘কল্প এসেছে বাবা।’

তিনি রুম থেকে বের হয়ে বললেন, ‘আরে কল্প এসেছো, আসো আমার রুমে গল্প-টল্প করি।’

কল্প আমতা-আমতা করে বললো, ‘আসছি নানা, ইতিকে দেখে আসি।’

– ‘ওকে, ওকে যাওয়ার আগে আইসো।’

নীলার সঙ্গে কল্প ওর রুমে গেল। অন্ধকার ঘর। বাতি জ্বলতেই দেখা গেল ইতি গুটি-শুটি মে’রে কম্বল গায়ে দিয়ে শুয়ে আছে। বিছানায় বসে গিয়ে সে। হুস্না বেগম খানিক পর এসে বললেন, ‘কল্প দেখো তো বাবা ওর সঙ্গে কথা বলে। কেন এমন করছে। কিছুই তো বলে না। সবাই বলতেছে ভূ*তে ধরছে। আমার তো তাও মনে হয় না।’

কল্প মাথা নেড়ে বললো, ‘আচ্ছা মামী আমি দেখছি।’

তিনি রান্নাঘরে চলে গেলেন। কল্প নীলাকে আমতা-আমতা করে বললো, ‘ওকে ডেকে তুলে নিয়ে আমি ছাদে যাই? আজ তো চাঁদনি রাত। আপনিও হাতের কাজ সেরে আসুন। ওর মন ভালো হবে।’

– ‘ইতি গেলে তো ঠিক আছে। আমিও ডেকেছি একটু আগে যায়নি।’

– ‘আচ্ছা আমি ট্রাই করি।’

কল্প ওর কপালে হাত রাখে। এখনও প্রচণ্ড গরম। সে আস্তে-আস্তে কয়েকবার ডাকে। চোখ মেলে অবাক হয়ে উঠে বসে বললো, ‘আপনি?’

কল্প মুচকি হেঁসে বললো, ‘হ্যাঁ আমি, তবে যেভাবে খাওয়া-দাওয়া বাদ দিয়ে পড়ে আছো। আমার জায়গায় আজরাইলও আসতে পারেন।’

ইতি অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নিল। নীলা মাদুর এনে কল্পের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললো, ‘যাও নিয়ে আমি আসছি একটু পর, ওকে বুঝাও, ভাত না খেলে, ওষুধ না খেলে জ্বর ছাড়বে কি করে? ভাইয়াও রাতে দোকান থেকে ফিরে গালাগাল করে খাওয়াতে পারেন না। একবেলা খেলে আরও দুইবেলা নাই। এভাবে কতদিন? কলেজ পড়ালেখা সব গোল্লায় যাচ্ছে।’

কল্প মাদুর হাতে নিয়ে বললো, ‘ইতি কম্বল এভাবে গায়ে জড়ানো থাকুক। চলো ছাদে।’

– ‘না আমি কোথাও যাব না।’

– ‘স্যারের কথা শুনে না। বেয়াদব ভূ*ত ধরছে তাহলে।’

ইতি তবুও অন্যদিকে তাকিয়ে রইল। কল্প নীলাকে বললো, ‘আন্টি আপনি এক কাজ করুন। প্রথমে চা দিবেন। এরপর ওকে কোনো খাবার দিন ছাদে। আমি একেবারে ওষুধ খাইয়ে দিয়ে যাব।’

– ‘আরে আগে ছাদে তো নিয়ে যাও। ওর যা ঘ্যা*ড়ত্যা*ড়া জানো না তো।’

– ‘আমারও ঘা*ড়ত্যা*ড়া আন্টি আপনি গিয়ে চা বানান। আমি দেখছি।’

নীলা চলে যায়। কল্প দরজার কাছ থেকে দেখে এসে ইতির মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে ফিসফিস করে বললো, ‘বাবা, আমার অভিমানী পাখিটার এত অভিমান?’

ইতি দুই হাটুর মাঝখানে মাথা গুঁজে দিল। কল্প কপাল ধরে টেনে তুলে মাথা। দু’গাল বেয়ে পানি পড়ছে ইতির। কল্প তাড়াতাড়ি মুছে দিল হাত দিয়ে। তারপর আবার দরজার কাছে যায় কেউ আসছে কি-না দেখতে। ফিরে বিছানায় বসে ইতির মাথা বুকে টেনে এনে মাথায় চুমু খেয়ে বললো, ‘সব ঠিক হয়ে যাবে ম্যাডাম, প্লিজ ছাদে আসো। অনেক কথা আছে।’

ইতি ভেজা গলায় বললো, ‘আর কি কথা বলার আছে আপনার।’

কল্প মুচকি হেঁসে ওর চোখে চোখ রেখে বললো, ‘এখানে এত প্রশ্ন করো না৷ কে কখন দেখবে তার ঠিক আছে? ছাদে চলো।’

ইতি আস্তে-আস্তে বিছানা থেকে নামে। ছাদে চলে আসে তারা। মাদুর বিছিয়ে মুখোমুখি বসে দু’জন। চাঁদের আলোয় চারপাশে আবছা আলো-ছায়া। নীলা এলো খানিক পর। চা দিয়ে বললো, ‘ইতি মুগ ডাল আছে। জাউ বানিয়ে দেই?’

কল্প ভ্রু-কুঁচকে বললো, ‘শুধু মুগ ডাল দিয়েও আরেকটা জাউ খিচুড়ি আছে না-কি?’

নীলা হেঁসে বললো, ‘আরে না, চালও থাকবে।’

– ‘ও আচ্ছা৷ তাহলে ভালো। খাবে না ইতি?’

ইতি মাথা নেড়ে সম্মতি দিল। চলে গেল নীলা। ইতি অন্যদিকে তাকিয়ে বললো, ‘কি বলবেন বলুন।’

কল্প দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে হাঁটুতে কনুই ঠেকিয়ে কপাল আঙুল দিয়ে কপাল ঘষতে ঘষতে বললো, ‘আসলে এখনই বলার মতো কিছু নাই। তবে বুঝতে পারছি তোমাকে ছাড়া আমারও থাকা সম্ভব না।’

ইতি অবাক হয়ে সরাসরি কল্পের দিকে তাকায়। কল্প চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বলে, ‘চা ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে খাও।’
ইতিও চা নিল। ক্ষীণ সময় দু’জন চুপচাপ থাকে৷ ইতি তারপর বলে, ‘তো এখন কি করতে চাচ্ছেন?’

– ‘এটাই তো বুঝতে পারছি না।’

– ‘তো আসছেন কেন? এটা এসে বলার মতো কি হলো?’

– ‘অস্থির হবে না তো ইতি। এখন আমি বুঝতে পারছি আমাদের সম্পর্ক নিয়ে সিরিয়াস হতে হবে। আমিও থাকতে পারবো না৷ আর তোমার অবস্থা তো দেখতেই পাচ্ছি।’

– ‘তো এগুলো তো হওয়ারই ছিল। এটা নতুন করে বুঝার মতো তো কিছু নাই। আপনি কি এখন কষ্টকে উপভোগ করতে ছাদে নিয়ে এসেছেন? মানে ইতি আমরা দু’জন কষ্ট পাচ্ছি। চলো ছাদে একটু আড্ডা মা’রি। এরকম কিছু?’

– ‘তা না, এখন আপাতত কি করতে হবে এটা বলতে এসেছি। এখন তোমার খাওয়া-দাওয়া সবকিছু ঠিকঠাক মতো করতে হবে। ওষুধ খেয়ে সুস্থ হয়ে কলেজে যাও। স্বাভাবিক হও।’

– ‘মানে কেন স্বাভাবিক হব?’

– ‘পাগল না-কি, স্বাভাবিক নেই কেন তুমি? আমি বিয়ে করতে যাচ্ছি এই জন্য তো? এখন তো এসে বললামই আমারও কষ্ট হচ্ছে। কি করা যায় দেখি৷’

– ‘তাহলে কি তুমি ওই বিয়ে না করার কথা ভাবছো?’

– ‘হ্যাঁ, কিন্তু কিভাবে কি করবো বুঝতে পারছি না।’

– ‘বুঝতে পারবেন না কেন৷ ওই মেয়ে তো আপনার চাচাতো বোন। তাকে বুঝিয়ে বলুন। সেইই বিয়ে ভেঙে দিবে।’

– ‘যাইই করি করবো। আপাতত তুমি পাগলামি বন্ধ করো। সুস্থ-স্বাভাবিক হও।’

ইতি কল্পের থেকে চোখ সরিয়ে চাঁদের দিকে তাকায়। আনন্দ অশ্রুতে আঁখি ছলছল। ইতি ডান হাত বাড়িয়ে দিয়ে ভেজা গলায় বলে, ‘গায়ে এখন জ্বর কেমন একটু দেখুন তো আমার হাতটা ধরে।’

কল্প ওর হাতটা আলগোছে ধরে। শিমুল তুলোর মতো নরম হাত। সে গালের সঙ্গে চেপে ধরে চুমু খেয়ে বললো, ‘ইতি মেসেঞ্জারে তোমার নাম্বার দিয়ো৷ আর এখন থেকে রোজ কথা বলবে, ওকে?’

ইতির চোখ বেয়ে জল পড়ছে। নিচের ঠোঁট কাপছে। মুখ দিয়ে কোনো কথা বেরুচ্ছে না। সে মাথা নেড়ে কেবল সম্মতি দেয়। কল্প পুনরায় বলে, ‘খাওয়া-ঘুম কোনো কিছুর যেন অনিয়ম না হয়। চোখের নিচের কালো দাগ আমি এসে পরেরবার দেখতে চাই না। তুমি আগের মতো সবার সেই চঞ্চল ইতি হয়ে যাবে, ওকে?’

ইতি মাথা নাড়ে। কল্প আবার বলে, ‘নিজেকে এত পালটাতে হবে না ইতি। তুমি যেমন ছিলে তেমনই ভালো। এখন চোখের জল মুছে ফেল। কেউ এলে দেখে ফেলবে।’

ইতি চোখের জল মুছতে গিয়েও আবার কেঁপে-কেঁপে উঠে। কল্প চিলেকোঠা থেকে দেখে আসে কেউ আসছে কি-না। ফিরে এসে ইতিকে বুকে জড়িয়ে ধরে চোখ মুছিয়ে দিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে বললো, ‘প্লিজ শান্ত হও, আমি আছি তো। বেশি ইমোশনাল হলে বিপদ আছে। এইযে দেখা করতে পারছি। কেউ সন্দেহ করছে না। এই সুযোগগুলোও পাব না শেষে।’

ইতি চোখ মুছে শান্তি হয়ে বসে। কল্প আকাশের দিকে তাকিয়ে বললো, ‘তুমি কি গান পারো?’

ইতি মাথা নেড়ে না করে। কল্প দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো, ‘আমিও পারি না। তবে কবিতা পড়ে শুনাতে পারি।’

ইতি খুশি হয়ে বললো, ‘আচ্ছা আপনি আগে বলুন তারপর আমিও কবিতা পড়ে শুনাবো।’

কল্প মুচকি হাঁসে। তারপর রবীন্দ্রনাথের ‘অনন্ত প্রেম’ কবিতাটি পড়তে শুরু করে।

“তোমারেই যেন ভালোবাসিয়াছি শত রূপে শতবার
জনমে জনমে যুগে যুগে অনিবার।
চিরকাল ধরে মুগ্ধ হৃদয় গাঁথিয়াছে৷ গীতহার–
কত রূপ ধরে পরেছ গলায়, নিয়েছ সে উপহার
জনমে জনমে, যুগে যুগে অনিবার।
যত শুনি সেই অতীত কাহিনী, প্রাচীন প্রেমের ব্যথা,
অতি পুরাতন বিরহমিলন কথা,
অসীম অতীতে চাহিতে চাহিতে দেখা দেয় অবশেষে
কালের তিমিররজনী ভেদিয়া তোমারি মুরতি এসে
চিরস্মৃতিময়ী ধ্রুবতারকার বেশে।
আমরা দুজনে ভাসিয়া এসেছি যুগলপ্রেমের স্রোতে
অনাদি কালের হৃদয়-উৎস হতে।
আমরা দুজনে করিয়াছি খেলা কোটি প্রেমিকের মাঝে
বিরহবিধুর নয়নসলিলে, মিলনমধুর লাজে–
পুরাতন প্রেম নিত্যনূতন সাজে।
আজি সেই চির-দিবসের প্রেম অবসান লভিয়াছে,
রাশি রাশি হয়ে তোমার পায়ের কাছে।
নিখিলের সুখ, নিখিলের দুখ, নিখিল প্রাণের প্রীতি,
একটি প্রেমের মাঝারে মিশেছে সকল প্রেমের স্মৃতি–
সকল কালের সকল কবির গীতি।”

নীলা দু’জনের জন্য খিচুড়ি নিয়ে এলো। কল্প অবাক হয়ে বললো, ‘আমি খাব না। হোটেলে ওরা আমার জন্য অপেক্ষা করবে।’

নীলা বসতে বসতে বললো ‘এনেছি যেহেতু খেয়ে নাও।’

– ‘এগুলো ইতির মতো অসুস্থ আর বুড়া-বুড়িদের খাবার।’

ইতি দাঁত কটমট করে তাকায়। কল্প প্লেট নীলার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললো, ‘নানাকে দিয়ে আসেন এই প্লেট।’

– ‘না উনি তো ভাত খাবেন রাতে।’

– ‘দেন, দেরিতে না হয় খাবেন ভাত।’

নীলা উঠে চলে যায়। কল্প আরেকটু নিবিড় হয়ে মুখোমুখি বসে প্লেট হাতে নিয়ে বললো ‘হা করো আমি আগে ম্যাডামের অনশন ভাঙিয়ে দেই।’

ইতি ফিক করে হাসলো। তারপর বললো ‘আপনার মুখে ‘অভিমানী পাখি’ শুনে কিযে ভালো লেগেছিল। আরেকবার ডাকবেন?’

কল্প স্মিত হেঁসে বললো, ‘আমার অভিমানী পাখিটি ‘হা’ করো।’

ইতি ‘হা’ করে। কল্প এক চামচ ওর মুখে দেয়। ইতি খেয়ে বললো, ‘আমার না হয় চেহারা ছবির অবস্থা খারাপ হইছে আপনার বিরহে৷ কিন্তু আপনি ইংলিশ ম্যাম পেয়েও এই অবস্থা কেন? আদর যত্ন করে না?’

কল্প ডান হাতে ইতির মাথায় গাঁট্টা মে’রে বললো,

– ‘বাজে কথা বলো না। সারাক্ষণ তোমার কথাই ভেবেছি।’

– ‘কেন? হঠাৎ এই পরিবর্তনের কারণ কি?’

– ‘বাঁধ ভেঙে গেছে ম্যাডাম। জল দেখেছো তাকে স্বাভাবিকভাবে চলতে দিলে ধীরে ধীরে নামে। কিন্তু বাঁধ দিয়ে রাখলে যখন ঠেলে ছুটে তখন স্রোত প্রবল থাকে। আমার হইছে মনে হয় এই অবস্থা।’

– ‘কিন্তু বাঁধ ভাঙলো কিভাবে বলুন।’

– ‘তোমাকে মেসেজ দিয়ে বিয়ের কথা জানিয়েছিলাম না? এরপর থেকে অদ্ভুত এক অসুখ হয়েছে। বুঝতে পারলাম আমার এই অসুখ ইতি ম্যাডাম ছাড়া সারবে না।’

ইতি মুখে হাত দিয়ে হেঁসে ফেলে। কল্প তাড়া দিয়ে বললো, ‘তাড়াতাড়ি খাও, সবটুকু খাবে।’

– ‘কিন্তু আপনি অন্যদিকে তাকান। কেউ হা করে তাকিয়ে থাকলে আমার খেতে অস্বস্তি লাগে।’

– ‘তাই না-কি?’

– ‘হ্যাঁ জনাব, তাছাড়া একটু আগে চামচ দিয়ে খাইয়ে দিতে ঢং করলেন না? এভাবে হা করতেও মেয়েদের লজ্জা লাগে। কারণ হা করলে নিজের কাছে মনে হয় বিশ্রী লাগছে চেহারা। আমরা বিশ্রী লাগে এমন কিছুই করতে চাই না।’

– ‘আমরা চাই?’

– ‘হ্যাঁ ছেলেরা চায় বলে আমার ধারণা। আপনারা নিজের আরাম, শান্তির জন্য খালি গায়ে হাঁটবেন, বিশ্রী লাগছে জেনেও হাঁটবেন। কে কি বললো এসব দেখার টাইম নাই আপনাদের। নিজের আরাম আর মনের শান্তিই প্রাধান্য পায়।’

– ‘ওরে বাবা তাই না-কি? সত্যিই তো অসুস্থ অবস্থায় মানুষ দার্শনিক হয়ে যায়।’

ইতি হাসলো৷ কল্প অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে বললো, ‘ঠিক আছে খাও।’

ইতি দ্রুত খেয়ে নিল। খানিক পর নীলা উপরে এলো ওষুধ আর পানি নিয়ে। কল্প তাকে ওষুধ খুলে দিয়ে বললো, ‘এই নাও খাও।’
ইতি বাধ্য মেয়ের মতো ওষুধ খেয়ে নিল৷ নীলার কল এলো তখনই। সে রিসিভ করে ছাদের কার্নিশের কাছে চলে যায়। কল্প আমতা-আমতা করে বললো, ‘এখন আমার যেতে হবে ইতি। ওরা অপেক্ষা করবে। দেশি কেউ ছাড়া ওরা বাইরে খেতে যেতেও ভয় পায়।’

ইতি জল ছলছল চোখে তাকিয়ে বললো, ‘এখনই চলে যাবেন?’

– ‘হ্যাঁ, নানার সঙ্গেও দেখা করে যেতে হবে। এমনিতেই দেরি হবে।’

– ‘কবিতা শুনবেন না?’

– ‘ফোনে শুনে নিব। এখন যাই।’

কল্প উঠে চিলেকোঠায় চলে এলো। নীলাকে কলে ব্যস্ত দেখে ইতিও কম্বল গা থেকে ফেলে পিছু পিছু আসে। সিঁড়ি থেকে দেখে থামে কল্প। তারপর ফিরে আসে ইতির কাছে। ফিসফিস করে বলে ‘নীলা আন্টি কই?’

– ‘কলে ব্যস্ত।’

কল্প ইতির গালে হাত রেখে বলে, ‘একবার ভীষণ শক্ত করে কি জড়িয়ে ধরতে পারি আমার অভিমানী পাখিকে?’

ইতি থুতনি বুকের সঙ্গে লাগিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। কল্প উঁকি দিয়ে চারদিকে তাকিয়ে ইতিকে বুকের সঙ্গে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। কপালে আলতো করে চুমু খায়। ইতির পুরো শরীর কাঁপছে৷ অবশ হয়ে আসছে অন্যরকম এক সুখের ব্যথায়৷ কল্পকে ছাড়িয়ে ইতি দেয়ালে গিয়ে হেলান দিয়ে দাঁড়ায়। চোখবুজে বড়ো বড়ো শ্বাস ছেড়ে শুকনো ঢোক গিলছে সে। কল্প এগিয়ে গিয়ে গালে গাল চেপে ধরে বললো, ‘যেতে ইচ্ছা করছে না ইতি। তবুও হঠাৎ কেউ টের পেলে সমস্যা। তোমার শরীরেও এখনও জ্বর। আমি যাই?’

ইতি আবার কল্পকে জড়িয়ে ধরে পুরো মুখে চুমু খেয়ে বলে ‘আপনি পালটে যাবেন না তো? আজকের এই সন্ধ্যা মিথ্যে না তো?’

– ‘না মিথ্যে না, সবই সত্য। এবার আমাকে বিদায় দাও।’

ইতি ছেড়ে দেয়। কল্প পেছনে আর তাকায় না। তাড়াতাড়ি নেমে যায় সিঁড়ি দিয়ে।

__চলবে….
লেখা: জবরুল ইসলামমায়াডোর (২৩ পর্ব)
.
নিপা ভার্সিটির রাস্তায় ঢুকেই মুগ্ধ হয়ে যায়। কল্পের সঙ্গে হেঁটে-হেঁটে সবকিছু দেখে এখন এসেছে শহিদ মিনারের কাছে। টিলা বেয়ে আঁকাবাকা লাল দীর্ঘ সিঁড়ি উঠেছে। সেদিকে তাকিয়ে নিপা অবাক হয়ে বললো, ‘এত উঁচুতে?’

কল্প মুচকি হেঁসে বলে, ‘হ্যাঁ টিলার ওপর এই শহিদ মিনার। এখান থেকে সকল সিঁড়ি দেখা যাচ্ছে না। ১০১টি সিঁড়ি পেরিয়ে উঠতে হবে। মোট তিনটি ধাপে ভাগ করা।’

– ‘মাইগড! আমি কি উঠতে পারবো?’

– ‘বাদ দাও, উঠতে হবে না, ফুচকা খাবে?’

নিপা মাথা কাত করে সম্মতি দিল। টিলার পাশেই ফুচকাওয়ালা। কল্প গিয়ে ফুচকার অর্ডার দেয়। নিপা আনমনে কিছু একটা ভেবে বললো, ‘পার্সেল নাও, উপরে গিয়ে খাব।’

– ‘উপরে যাবে?’

– ‘হ্যাঁ।’

কল্প ফুচকা নিয়ে আসে। নিপা তার বাঁ হাত ধরে বলে, ‘চলো দেখে আসি।’

কল্প হাঁটতে থাকে। নিপা তার দিকে তাকিয়ে বললো, ‘চারপাশে প্রচুর সবুজ গাছ। আচ্ছা এত মিষ্টি করে পাখি কোথায় ডাকছে? পাখিটার নাম কি?’

কল্প ঠোঁট উলটে বললো, ‘বুঝতে পারছি না। জঙ্গলের মতো তো এই জায়গা। কত পাখি আছে। না দেখে নাম বলতে পারবো না।’

– ‘ও আচ্ছা, এই ভার্সিটির নাম কি যেন?’

– ‘হজরত শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।’

– ‘দারুণ, তোমার ভার্সিটি আমার খুব পছন্দ হয়েছে।’

– ‘ধন্যবাদ।’

সিঁড়ি পেরিয়ে খানিকটা উপরে উঠতেই চোখে পড়ে বৃত্তাকার লাল দেয়াল। এর পরেই মূল বেদিতে ওঠার জন্য আরও সাত ধাপের ছোট সিঁড়ি পার হয় তারা। নিপা ইতোমধ্যে হাঁপিয়ে গেছে। কিন্তু উপরে আসতেই ওর সকল ক্লান্তি দূর হয়ে যায়। প্রকৃতির সৌন্দর্য তাকে মুগ্ধ করে মুখ থেকে ‘ওয়াও’ শব্দটি বের করে নিয়েছে। পেছনে তাকিয়ে পুরো ক্যাম্পাস দেখে নিপা। চারপাশে বৃত্তাকার লাল দেয়াল। ছেলে-মেয়েরা বসে আছে। অথচ নিচ থেকে বুঝাই যায়নি উপরে মানুষ আছে। একেবারে নিরিবিলি পরিবেশ। যেদিকে চোখ যায় ঘন সবুজ গাছগাছালি৷ পাখির কলরব।

আরেকটু সামনে যেতে যেতে দৃশ্যমান হয় পুরো শহীদ মিনার। সবুজের সমারোহে নানা প্রজাতির বৃক্ষরাজি দ্বারা আচ্ছাদিত হয়ে আছে। সবুজের মাঝখানে এক টুকরো লাল এই প্রাঙ্গণটি যেন বাংলার লাল সবুজের পতাকা। নিপা মুগ্ধ বিস্ময়ে তাকাচ্ছে। এসব দেখে কল্পের আচমকাই মনটা খারাপ হয়ে গেল। ইতি বছর দেড়েক আগে তার ভার্সিটিতে আসতে চেয়েছিল। সে নিয়ে আসেনি। ইতিও বোধহয় এরকম উচ্ছ্বসিত হয়ে যেত দেখে। কল্প দেয়ালে বসে পড়ে। নিপাও এলো পাশে।

– ‘ফুচকা বের করো।’

কল্প তাকে বের করে দেয়। নিপা একটা ফুচকা মুখে দিয়ে আচমকা প্রশ্ন করলো, ‘এবার বলো তোমার সমস্যাটা কি?’

কল্প অবাক নয়নে নিপার দিকে তাকায়। ওর মুখ পুরোপুরি স্বাভাবিক৷ কল্প ভ্রু-কুঁচকে বললো, ‘কিসের সমস্যার কথা বলবো?’

– ‘তোমার যে সমস্যা আছে সেটা।’

– ‘আমার আবার কিসের সমস্যা?’

– ‘শোনো কল্প, আমাদের নতুন একটা সম্পর্ক হতে যাচ্ছে। এটা ছাড়াও কিন্তু আমি তোমার চাচাতো বোন। আমরা সম-বয়সীও। আমাকে তুমি নির্দ্বিধায় যেকোনো কিছু বলতে পারো।’

– ‘কিন্তু বলবো কি?’

– ‘বাবা এবার ইংল্যান্ড গিয়ে তোমার অনেক বেশি প্রশংসা করেছিলেন। দেশে এসে কিন্তু তোমার চলাফেরা দেখে তিনি নিজেও খুশি না৷ তুমি কেমন আনমনা হয়ে থাকো। আমার সঙ্গে যে তোমার বিয়ে হতে যাচ্ছে সেটা যেন জানোই না।’

কল্প মুচকি হেঁসে বললো, ‘সেরকম কিছু না। আমরা বাঙালি ছেলে-মেয়েরা এরকমই। বিয়ের আগে হবু বর-কনের আলাদা করে কথাবার্তা হয় না।’

নিপা হেঁসে উঠে বললো, ‘তোমরা দেশি মানুষরা ভাবো আমরা বাংলাদেশ সম্পর্কে কিছুই জানি না৷ তুমি জানো আমরা ইংল্যান্ড যে টাউনে থাকি বের হলেই বাঙালির সঙ্গে দেখা হয়। আমাদের আশেপাশে সকল বাসায় বাঙালি থাকে। না হলে আমরা বাংলায় কথা বলি কিভাবে? ইংলিশ শেখার আগে আমরা বাংলা শিখে ফেলি। তোমাদের সম্পর্কে আমার জানা আছে। এইযে ছেলে-মেয়েরা দেয়ালে একে অন্যের হাত ধরে বসে আছে এগুলো কি? বাঙালি ছেলে-মেয়েরা বলে এড়িয়ে যেও না। তোমার চোখে আমাকে নিয়ে আলাদা কোনো আগ্রহ নেই। যেমন উঁচুতে শহিদ মিনার তাই তুমি সঙ্গে সঙ্গে বললে থাক বাদ দাও, উঠতে হবে না। বাঙালি ছেলেরা কিন্তু এরকম করবে না৷ কোলে করে নিয়ে উঠে যাবে। আসল কথা হলো তোমার আমার প্রতি কোনো আগ্রহ নেই। তাই বলছি সোজাসুজি বলো সমস্যাটা কি।’

– ‘কিছুই না বললাম তো।’

– ‘তাহলে কি তুমি আমাকে বিয়ে করতে চাচ্ছ? আচ্ছা ধরলাম বিয়ে করবে। তাহলে কেন বিয়ে করতে চাচ্ছ বলো তো?’

কল্প কোনো জবাব দিল না। নিপা পুনরায় বললো, ‘ইংল্যান্ড যাওয়ার জন্য না-কি? দেশে তো আবার ইংল্যান্ড এর বৃদ্ধ পুরুষের সঙ্গেও যুবতী মেয়ে বিয়ে দিয়ে দেয়।’

কল্প আহত চোখে নিপার দিকে তাকায়। নিপা হেঁসে বললো, ‘নিজের সঙ্গে জোরাজুরি করে আমাকে বিয়ে করতে যেও না। আমাকে বিয়ে না করলেও সব সময় পাশে পাবে। তুমি আমার চাচাতো ভাই। এটা মনে রেখো। টাকা-পয়সা যখনই দরকার হয় বলবে। আমি পাঠাবো।’

– ‘কোনো কারণে কি তুমি নিজেই আমাকে বিয়ে করতে চাও না?’

নিপা ফিক করে হাসে। তারপর আমতা-আমতা করে বলে, ‘সত্যিই ধরেছো। আমার দেশে বিয়ে করার ইচ্ছা নেই৷ কিন্তু বাবা তোমাকে নিয়ে অনেক ভাবেন। তোমার জন্য কিছু করতে চান। চাচা অনেক কিছু করেছেন এই পরিবারের জন্য।’

– ‘তুমি বিয়ে করতে না চাইলে না করছো না কেন?’

– ‘চাই না মানে, চাইতাম না আগে। বাবার মুখে তোমার কথা শুনে। দেশে এসেও প্রথমে দেখে মনে হলো ভালোই। তাই রাজি হয়েছি। কিন্তু তোমার চালচলন দেখে দিন দিন কনফিউজড হয়ে যাচ্ছি। তাই বাবাকে বিয়ের পাকা কথায় যেতে আমিই না করেছি। আরও কিছুদিন বুঝতে চেয়েছি।’

– ‘কি বুঝলে?’

– ‘কিছুই বুঝতে পারছি না। মনে হচ্ছে আমাকে যে বিয়ে করবে তুমি। সেটা জানোই না। বিশেষ কোনো খেয়ালই করছো না আমাকে। যাইহোক ক্লিয়ার করে বলো। কারণ আমার তোমাকে বিয়ে করতেও সমস্যা নেই, না করতেও সমস্যা নেই। বুঝতে পারছো?’

কল্প খানিক ভেবে বললো, ‘বিয়ের পাকা কথা যেহেতু আঁটকে রেখেছো। না করে দাও চাচাকে।’

– ‘তা কেন করবো?’

– ‘ধরো আমি তোমাকে বিয়ে করতে চাচ্ছি না।’

– ‘তাহলে তুমি না করবে। আমি কেন?’

কল্প হেঁসে বললো, ‘তুমি না আমার চাচাতো বোন, একটু হেল্প করবে না?’

– ‘কিসের হেল্প?’

– ‘আমি না করলে সবাই বকা দিবে। আমার মামা, মা, চাচাও। আমার জন্য অনেক অসুবিধা হয়ে যাবে।’

– ‘মাই গড! তুমি কি সত্যিই বিয়ে করতে চাচ্ছ না? আর যদি না চাও, তাহলে বলে দিচ্ছ না কেন?’

– ‘আমি না করতে চাচ্ছিলাম না।’

– ‘না করলে কি হবে?’

– ‘আছে অনেক কিছু।’

– ‘আর আমি না করলে কি হবে জানো? বাবা আরও বেশি কষ্ট পাবেন। ভাববেন ভাতিজার জন্য কিছুই করতে পারলাম না। এর থেকে তুমিই না করো। আমি পাশে আছি।’

কল্প দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো, ‘একটা কিছু তো করতেই হবে।’

– ‘কেন বিয়ে করতে চাচ্ছ না আমি কি জানতে পারি?’

– ‘আমি একজনকে ভালোবাসি নিপা। মেয়েটাও আমাকে পাগলের মতো ভালোবাসে। তোমার সঙ্গে আমার বিয়ের খবর শুনে খাওয়া-দাওয়া ছেড়ে অসুস্থ হয়ে গেছে।’

– ‘ওয়াও, কি কিউট। সত্যি বলছো এসব? কে মেয়েটা? আমি দেখতে চাই।’

– ‘আচ্ছা দেখা যাবে৷ কিন্তু আমি অনেক ভয়ে আছি। অনেক রকমের ভয়।’

– ‘কিসের ভয়।’

– ‘তোমাকে বিয়ে করবো না শুনলেই সবাই রেগে যাবে। এরপর যদি ইতির বাড়িতে জানাজানি হয় আমার থাকারও অসুবিধা হবে। আগে একটা চাকরি ম্যানেজ করা লাগবে না হলে পড়ালেখা করাও প্রব্লেম হবে।’

– ‘এসব নিয়ে চিন্তা করো না। আমি ইংল্যান্ড গিয়ে তোমার সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখবো। টাকার দরকার হলেও জানাবে। তুমি কি ওকে বিয়ে করতে চাচ্ছ?’

– ‘হ্যাঁ, তবে বছর খানেক লাগবে। আগে চাকরি দেখতে হবে।’

– ‘এখন আমাদের ব্যাপারে কি করবে?’

কল্প ওর হাত ধরে বললো, ‘তুমি প্লিজ না করে দাও।’

– ‘না, এই কাজ আমি করলে বাবার ভেতরে কষ্ট থেকে যাবে৷ ভাববে তোমাকে আশা দিয়ে কথা রাখতে পারেনি। আর তুমি নিজ থেকে না করলে তার এই কষ্ট থাকবে না। তুমি বলবে পড়ালেখা করে দেশে কিছু করতে চাও।’

কল্প চিন্তিত মুখে মাথা নেড়ে বললো, ‘আচ্ছা দেখি। এখন চলো হোটেলে ফিরে যাই।’

দু’জন বাসায় ফিরে আসে। রাতে ইতিকে মেসেজ দিয়ে সবকিছু জানায় কল্প। ইতি খুশিতে আত্মহারা হয়ে ছাদে গিয়ে কল দেয়। রিসিভ করে সে।

– ‘হ্যালো।’

– ‘কি করেন জনাব?’

– ‘এখন কোথা থেকে কল দিয়েছো?’

– ‘ছাদে এসেছি।’

– ‘এখন ছাদে গিয়েছ কেন? জ্বর কি কমেছে?’

– ‘হ্যাঁ অনেকটাই কমেছে, সকালে একটু ছিল। পরে পুরোদিনই ভালো লাগছে।’

– ‘ওষুধ খেও ঠিকঠাক।’

– ‘তা তো খেতেই হবে।’

– ‘খুব ফুরফুরে মেজাজে আছো মনে হচ্ছে। এদিকে আমি টেনশনে শেষ। কি যে হবে ভেবে পাচ্ছি না।’

– ‘ধ্যাৎ এত ভয় পাবেন না তো। যা হওয়ার হবে। আপনি এক কাজ করুন। ওদের নিয়ে বাড়ি ফিরে যাওয়ার পর বলে দিবেন বিয়ে করতে চান না।’

– ‘না প্রথমে মামাকে বলে দেবো। এরপর উনিই চাচাকে বলবে।’

– ‘হ্যাঁ এরকম সোজা বলে দেন। এরপর দেখবেন কিছুই হবে না।’

কল্প পাশ ফিরে কোল বালিশ জড়িয়ে ধরে বললো, ‘আচ্ছা ওইদিন না কবিতা শুনাতে চাইছিলে। আজ শোনাও।’

– ‘এহ চু’রি করে ছাদে এসেছি আর উনাকে এখন কবিতাও শুনাতে হবে।’

– ‘তাহলে থাক, আমার এখন কবিতা রেখে, তোমাকে দেখতেই ইচ্ছা করছে।’

– ‘তাহলে চলে আসুন প্লিজ। ভীষণ মিস করেছি সারাদিন। আপনি তো ইংলিশ ম্যাম নিয়ে ঘুরেছেন।’

– ‘ঘুরতে গিয়েও মিস করেছি ইতি। শহিদ মিনারে গিয়ে আচমকা মনে পড়ে গেল তুমি একদিনে যেতে চেয়েছিলে।’

– ‘তখন তো ভাবের দোকানদার ছিলেন আপনি। কত ইচ্ছা করতো এক সঙ্গে ঘুরতে।’

– ‘জানো, কাল রাতে ফিরে একটুও ঘুমাতে পারিনি৷ জীবনে প্রথম কাউকে জড়িয়ে ধরেছিলাম। শিমুল তুলোর মতো নরম তুমি। হোটেলে ফিরে এগুলো ভাবতেই অন্যরকম অনুভূতি হচ্ছিল।’

ইতি ফিক করে হেঁসে বললো, ‘প্রথম কই, একদিন আপনার রুমে গিয়ে জোর করে জড়িয়ে ধরেছিলাম৷ বাসেও ঢাকা যাওয়ার পথে আমার কাঁধে ঘুমিয়ে গেলেন।’

– ‘ও হ্যাঁ তাইতো। তবুও গতকালের জড়িয়ে ধরা প্রথম মনে হচ্ছে।’

– ‘আচ্ছা এখন চলে আসুন না।’

– ‘আমারও ইচ্ছা করছে যেতে।’

– ‘আচ্ছা আরেকটা কথা। আপনি ফেইসবুকে ছবি দেন না কেন? কয়েকটা দিয়ে রেখেছেন এগুলো প্রতিদিন দেখি।’

কল্প হাসতে হাসতে বললো, ‘তুমি ফেইসবুকে গিয়ে ছবি দেখো প্রতিদিন?’

– ‘হ্যাঁ জনাব, এখন আসুন প্লিজ।’

– ‘আমারও তো আরেকবার শক্ত করে জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছা করছে ম্যাডাম। কিন্তু এরকম বারবার গেলে কি ভাববে ওরা?’

– ‘কিছুই ভাববে না। আপনি এমন ভাব করবেন যেন আপনার রুম থেকে কিছু নিতে এসেছেন।’

– ‘না থাক ইতি। আমি তো শিগগিরই ফিরবো৷ এখন বাড়াবাড়ির দরকার নেই।’

ইতি দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। কল্পের বুকের ভেতর শিরশির করে উঠে।

– ‘আচ্ছা আমি আপনার ঘ্রাণ পাই কেন সারাক্ষণ? এইযে এখন পাচ্ছি৷ আর আজ সারাদিন গেইটে একটু শব্দ হলেই মনে হয়েছে আপনি আসছেন। আপনার কি এমন লাগে?’

– ‘হ্যাঁ, তোমাকে বিয়ের কথা জানানোর পর এমন হয়েছিল। আর এতক্ষণ ঘ্রাণ পাইনি। এখন তুমি বলার পর পাচ্ছি।’

ইতি খিলখিল করে হেঁসে উঠে। তারপর আবার অকারণ মন খারাপ হয়ে যায়। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে, ‘আপনাকে কি আমি সত্যিই পেয়ে পাব কল্প ভাইয়া? যদি কোনোভাবে পেয়ে যেতাম। পাব তো?’

কল্পের বুকে ‘চিনচিনে’ এক ব্যথা হয়। চোখটা ভিজে আসে। ভেজা গলায় বলে, ‘পেতে তো হবেই ইতি। আমার অভিমানী পাখিটাকে আমার লাগবেই। এতদিন একা একা অনেক কষ্ট পেয়েছো। আমি নিজেই কষ্ট দিয়েছি। এখন আমি সবকিছু করবো। তুমি নিশ্চিন্তে থাকবে, ওকে?’

– ‘ইশ, আপনি আমাকে এত ভালোবাসবেন ভাবিনি কখনও। আপনি একটু আদর করে কথা বললেই চোখে পানি চলে আসে।’

– ‘আচ্ছা এখন ছাদ থেকে যাও। পরশু কলেজে যাবে। আরও একদিন রেস্ট নাও। খাওয়া-দাওয়া ঠিকঠাক মতো করো। এখন রাখি।’

– ‘এই দাঁড়ান।’

– ‘কি?’

– ‘একটা আদর দিয়ে ফোন রাখেন।’

– ‘মোবাইলে এসব ভালো লাগে না ইতি। মোবাইল আমার বউ না। আর তোমার সতিন না।’

‘আপনি শুধু ভাবের দোকানদার না, খা’টাশও’ কথাটা বলেই ইতি কল কেটে দিয়ে একা একা হাসতে শুরু করে।

শহর থেকে দু’দিন পর তারা গ্রামে ফিরে। কল্পের পুরো সময়টা অস্থিরতার ভেতর দিয়ে যাচ্ছে। এখানে এসে পরেরদিনই সে চাচার থেকে বিদায় নিয়ে নানাবাড়ি আসে। মামা বাজারে। রাতে আর দেখা হয় না তার। সুপ্তি আপু বা মামীকে কিছুই বলে না। একা একা আনমনে দিন সময় কাটে। পরেরদিন ভোরে উঠে মোস্তাক সাহেবের রুমে যায়।

– ‘মামা আমি কি আসবো?’

– ‘আয়।’

– ‘কিছু কথা ছিল।’

তিনি বিছানায় উঠে বসে বললেন, ‘কি বলবি বল।’

– ‘মামা আমি নিপাকে বিয়ে করতে পারবো না।’

মোস্তাক সাহেব বিস্মিত হয়ে তাকিয়ে বললেন, ‘বেকুবের বাচ্চা তুই কি বললি?’

– ‘আমি এই বিয়েটা করতে চাচ্ছি না।’

– ‘কেন?’

– ‘আমি পড়ালেখা করে দেশেই কিছু করবো।’

– ‘মানে কি এসবের? তুই দেশে কি করবি?’

– ‘দেশে কি করবো মানে। সব মানুষ কি ইউরোপ চলে গেছে না-কি মামা? আমি একটা ভালো ভার্সিটিতে পড়ি…।’

কথাটা আর শেষ করতে পারে না সে। মোস্তাক সাহেব ধমক দিয়ে উঠেন, ‘বেকুবের বাচ্চা আমার সামনে তোর ভার্সিটির আলাপ করবি না৷ কোনো খবর রাখিস দুনিয়ার? মানুষ বর্ডার পাস হয়ে, সাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপ যাচ্ছে৷ কন্ট্রাক্ট ম্যারেজ করে ইংল্যান্ড যাচ্ছে৷ কত অনার্স মাস্টার্স পাস করা ছেলে ইউরোপ গিয়ে ল্যাট্রিন পরিষ্কার করতেও একপায়ে রাজি৷ মানুষ এসব সুযোগ পায় না। তুই পণ্ডিত হইছিস। পড়ালেখা দেখাচ্ছিস। পড়ালেখা করে কি করবি? চাকরি পাবি কি-না তার নাই ঠিক। ইংল্যান্ড গেলে সপ্তাহে কামাবি লক্ষ টাকা৷ দেশে আছে কি?’

– ‘মামা বাংলাদেশ কোনো যু*দ্ধ-বি*ধ্বস্ত দেশ না যে একটা পাব্লিক ভার্সিটির স্টুডেন্ট পড়া ছেড়ে রেস্টুরেন্টে কাজ করার জন্য ইংল্যান্ড চলে যাবে।’

– ‘হায়রে বেকুবের বাচ্চা, সোনাই গাজির ছেলে মনির তো কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তো। সেটাও পাব্লিক ভার্সিটি। সে কেন পড়া শেষ না করেই দুবাই, মাল্টা হয়ে ফ্রান্স চলে গেল? আর তুই তো বিয়ে করে ডায়রেক্ট ইংল্যান্ড যাচ্ছিস৷ একেবারে লিগ্যাল। কোনো ঝামেলা নাই।’

– যাইহোক মামা। আমি বিয়ে করতে চাচ্ছি না, তুমি না করে দিয়ো চাচাকে৷ আমি নিপাকেও না করে দিয়েছি।’

মোস্তাক সাহেব রাগে কাঁপছেন। তিনি উঠে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে ক্রোধান্বিত গলায় বললেন,

– ‘তুই আমার বাড়ি থেকে বের হ। রাস্তায় রাস্তায় ঘুরলে এরপর পন্ডিতি বাইর হয়ে যাবে। তুই এই মূহুূর্তে বের হয়ে যাবি এই বাড়ি থেকে।’

সুপ্তি চেয়ার ঠেলতে ঠেলতে রুমে ঢুকে বললো, ‘কি হয়েছে বাবা, তুমি ওর সঙ্গে এত চেঁচামেচি শুরু করেছো কেন?’

যে মোস্তাক সাহেব সুপ্তির কথার উপরে কথাই বলেন না। সচেতনভাবে প্রশ্রয় দিয়ে দিয়ে যিনি সুপ্তিকে নিজেই কাঁধে তুলে রেখেছেন৷ তাকে আচমকা গালে ঠাস করে চ*ড় দিয়ে বললেন, ‘তোকে মাতব্বরি করার জন্য ডাকিনি। চোখের সামনে থেকে যা। তুই ওকে প্রশ্রয় দিয়ে এরকম করেছিস৷ এই বেকুবের বাচ্চাকে আমার বাড়িতে দেখতে চাই না। যে ওর হয়ে ওকালতি করবে তাকেও ঘাড় ধরে বের করে দেবো।’

কল্প মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে রইল। মোস্তাক সাহেব জুতো হাতে নিয়ে বললেন, ‘তুই যাবি না-কি জুতা দিয়ে মারতে মারতে বের করে দিব?’

কল্প বাড়ি থেকে বের হয়ে এসে একটা ব্রিজে বসে৷ খানিক পর খবর পেয়ে তার মা কল দিলেন। কল্পকে বোঝালেন এমন পাগলামি না করতে৷ এত উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ নিজের হাতেই যেন নষ্ট না করে দেয়। মানুষ এমন সুযোগ পায় না। ঘণ্টা খানেক দু’জনের যুক্তিতর্ক হয়। এক সময় কোনোভাবে তাকে বুঝাতে না পেরে তিনিও রাগা-রাগি থেকে গালাগালি করে কল কেটে দিলেন। কল্প কোনো উপায় না দেখে ব্যাগ-প্যাক নিয়ে বের হয়ে যায় বাড়ি থেকে। মেইন রাস্তায় আসতেই তুমুল বৃষ্টি শুরু হয়ে যায়। আসমান ডেকে ঝুম বৃষ্টি। আশেপাশে কোনো রিকশা নেই। কল্প বৃষ্টিতে ভিজে হাঁটতে শুরু করে।
___চলবে……
লেখা: জবরুল ইসলাম

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here