মায়াডোর পর্ব-২৬+২৭

মায়াডোর (২৬ পর্ব)
.
ইতি অনলাইন থেকে চলে যায়। রুদ্রের সঙ্গে একই বিছানায় রাতে থাকে কল্প।
পরের পুরোটা দিন মেস খুঁজতে খুঁজতে কাটে তার৷ সন্ধ্যার দিকে একটা মেস পায়। আলাদা রুম। খাবে অন্যদের সঙ্গে। সবকিছু মিলিয়ে ভালো। তবে এখানে উঠবে কি-না দ্বিধায় পড়ে যায়। এই মেসটা পড়েছে ইতির কলেজের রাস্তায়। অনেক ভেবে-চিন্তে ঠিক করে উঠবে। এখান থেকে তার ভার্সিটিও কাছে৷ এত ব্যস্ত শহরে কে কোথায় থাকে তা দেখার সময় কার আছে? কনফার্ম করে চলে যায় সে৷ পরেরদিন রুদ্রদের মেসে থেকে এসে উঠে এই মেসে। নিচতলায় বাসার মালিক থাকে। মাঝখানে ফ্যামিলি ভাড়া দেয়। উপরে মেস। কয়েকটা ফ্ল্যাট। একেকটা ফ্ল্যাট একেকজন নিয়ে মেসে লোক তুলছে তার দায়িত্বে। কল্পের রুমটা তার ভালোই লেগেছে। মেসের ম্যানেজার বলেছে সে চাইলে অন্য কাউকে তার রুমে আনতে পারবে, তাতে টাকা কম পড়বে। কল্পের রুম শেয়ার করতে ইচ্ছা করছে না। একপাশে ছোট্ট বেলকনি আছে। তবে এটাচ বাথরুম নেই। ভাড়া মোটামুটি। ওয়াইফাই আছে। রাতের খাবার খেয়েও মনে হলো চলার মতো। বিছানায় শুয়ে মোবাইল হাতে নেয়। আনমনে চলে যায় ইতির ইনবক্সে৷ আবার বের হয়ে যায়। ফেইসবুকে নিউজফিডে ঘুরাঘুরি করে। একটা গল্প সামনে আসে। রোমান্টিক গল্প। পড়তে পড়তে ইতিকে মিস করতে শুরু করে। অর্ধেক পড়েই ওর ইনবক্সে যায়। মেসেজ দেয়, ‘হ্যালো।’

সঙ্গে সঙ্গে ইতি মেসেজ সিন করে ফেলে। কল্প রাগ করবে না-কি খুশি হবে বুঝতে পারে না।

– ‘তোমাকে না বলেছিলাম মোবাইল হাতে না নিতে। এখন মেসেজ দিতেই সিন করে ফেলেছো, কি করছিলে অনলাইনে?’

– ‘বিশ্বাস করেন, আমি অনলাইনে ছিলাম না। মিস করছিলাম আপনাকে। হঠাৎ মনে হয় দেখি ডাটা অন করে মেসেজ দিয়েছেন কি-না। তখনই আপনার মেসেজ।’

– ‘মিথ্যে কথা বলবে না।’

– ‘মোটেও মিথ্যে না। বিশ্বাস করেন না আমাকে?’

কল্প আনমনে ভাবে তাহলে কি টেলিপ্যাথি ব্যাপারটা সত্য? ইতির সঙ্গে কি তার সেরকম কিছু হচ্ছে৷ কে জানে হতেও পারে৷ রিপ্লাই দেয়, ‘আচ্ছা বিশ্বাস করলাম।’

– ‘কি করছেন আপনি? সারাদিন আমার কিভাবে গেছে আপনি জানেন? একবারও মেসেজ দিতে পারেন না?’

– ‘সারাদিন মেস খুঁজে খুঁজেই চলে গেছে ম্যাডাম। এখন নতুন মেসে উঠেছি।’

– ‘মেসটা কোথায়?’

– ‘মদিনা মার্কেটের কিছুটা আগে। তোমার কলেজের কাছে অনেকটা।’

– ‘তাই না-কি। তাহলে তো দেখা করতে পারবো।’

– ‘দেখা করার চিন্তা না একদম।’

– ‘যান করবো না দেখা আপনার সঙ্গে।’

– ‘ইস আমার অভিমানী পাখিটা। কিন্তু দেখা করবো কিভাবে? এটা মেস তো।’

– ‘নিচে আসবেন তাতেই হয়।’

– ‘একটা কাজ অবশ্য করা যায়৷ সারাজীবন ছেলেরা মেয়েদের ছাদে তাকিয়ে থেকেছে, জানালায় তাকিয়ে থেকেছে৷ তুমি উল্টো করতে হবে আরকি।’

– ‘কি করতে হব?’

– ‘তুমি কলেজে একটু আগে এলে রাস্তায় এসে কল দিলে আমি বেলকনিতে যাব। এভাবে দেখা করা যাবে।’

– ‘আপনি নিচে এলে কি হবে?’

– ‘কেউ দু’জনকে দেখে ফেলবে তো ম্যাডাম।’

– ‘আচ্ছা তাই করবো। বাসাটা কোথায়?’

– ‘পুরো এড্রেস পরে দেবো। বাসা নাম্বার সহ। এখন শুধু বাসার নাম মনে আছে৷ ‘মুনা মঞ্জিল’ নাম।’

– ‘কি! মুনা মঞ্জিল?’

– ‘হ্যাঁ।’

– ‘আমাদের রাস্তার একেবারে পয়েন্টে না? অপর পাশে ফার্নিচারের দোকান।’

– ‘বাবা, চিনেই ফেলেছো।’

– ‘আরে ওইটা তো মুনাদের বাসা৷ ও আমার ক্লাসমেট৷’

– ‘কি বলো, তোমার ক্লাসমেট! তাহলে কি কোনো সমস্যা হবে?’

– ‘তা হবে না। ও তো আপনার সম্পর্কে সবকিছু জানে। দেখেছেও।’

– ‘তাই না-কি? কিন্তু এখানে আমি উঠেছি মেস ম্যানেজারের সঙ্গে কথা বলে।’

– ‘ভালোই হয়েছে। মুনার সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানবেন?’

– ‘কি?’

– ‘ও হচ্ছে আমাদের সেই বান্ধবী৷ যার কাছ থেকে দুনিয়ার সকল গোপন বিষয়ে আমরা শিখেছি৷’

– ‘মানে কি?’

– ‘মানে আমাদের ক্লাসের কারও যখন মোবাইল ছিল না। ওর ছিল। ক্লাসে কোনো স্যার না থাকলে গোল হয়ে সবাই ওর কাছে বসতাম। গল্প শুনতাম। ডেইলি ওর কাছে নতুন নতুন কিছু তথ্য থাকবেই।’

– ‘আর সেই নতুন সবকিছুই ছিল খারাপ বিষয়।’

ইতি হাসির রিয়েক্ট দেয়। কল্প যেন এপাশ থেকে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে ইতির খিলখিল করে হাসি৷ কল্প পুনরায় বললো,

– ‘কি সত্য বলেছি না।’

– ‘আংশিক সত্য। সে আমাদেরকে অবাক করার মতো বিষয় বলতো এসে। যেমন লেসবিয়ান সম্পর্কে ওর কাছ থেকে প্রথম শুনেছি। তাছাড়া পৃথিবীতে চিকিৎসাররা পুরুষ মানুষকে নারী বানিয়ে ফেলে। নারীকে পুরুষ। এইসবও ওর কাছ থেকে। এরকম আরকি। আমরা চমকে উঠতাম এসব শুনে।’

– ‘এগুলো ছাড়াও খারাপ যা শিখেছো ওর কাছ থেকেই৷ ছি, ক্লাসে গিয়ে!’

– ‘বাজে কথা বলবেন না।’

– ‘আচ্ছা তুমি কবে আমাকে ‘তুমি’ করে বলবে, সেটা বলো।’

– ‘কখনও না।’

– ‘কেন?’

– ‘আপনি বলতেই ভালো লাগে।’

– ‘এভাবে সম্পর্কে গাম্ভীর্যতা চলে আসে ইতি। তুমি বলাই ভালো।’

– ‘আমার তো সমস্যা হয় না। আপনি বললেও আপনার সঙ্গে আমি মনখুলে কথা বলতে পারি।’

– ‘অনেক কিছুই আছে অস্বস্তি লাগবে।’

– ‘লাগবে না। আপনাকে জড়িয়ে ধরেছি তাতে কি অস্বস্তি লেগেছিল?’

– ‘এগুলো তো স্বাভাবিক বিষয়। কিস খেতে ঠিকই লজ্জা লাগবে।’

ইতি দুইহাতে মুখ ঢেকে নেয়ার ইমুজি দিয়ে বললো,

– ‘না তো। আমি আজ সন্ধ্যায়ও আপনার ছবি দেখে ঠোঁটের দিকে তাকিয়ে থেকেছি। জানেন? আপনার ঠোঁট অনেক মায়াবি? সিগারেট খান না বলে এখনও লাল আছে। ছেলেরা তো সিগারেট খেয়ে ঠোঁটের বারোটা বাজিয়ে ফেলে। আপনি একদম এসব ধরবেন না।’

– ‘টপিক চেঞ্জ করো তো ইতি। এমনিতেই ভীষণ মিস করছিলাম। এসব বলে ঘুম নষ্ট করবে।’

– ‘মিস করছিলেন কেন?’

– ‘ফেইসবুকে একটা গল্প পড়তে গিয়ে নায়িকাকে একদম তোমার মতো মনে হলো।’

– ‘তাই না-কি? লিঙ্ক দেন পড়ে দেখি।’

– ‘ওই লেখকেরই। জবরুল ইসলামের। যে উপন্যাসের কথা বলছি। সেটা ঘাসফড়িং। শ্রেয়াকে তোমার মতো মনে হয়েছে।’

– ‘ও আচ্ছা, উনার আমিও একটা উপন্যাস পড়েছি “বাঁক” নাম। অন্য উপন্যাসগুলোর লিঙ্ক সেভ করে রেখেছি। কিন্তু পড়িনি আর।’

– ‘উনার বই ছাড়া আমি সবগুলোই পড়েছি। আগন্তুক, সেই মেয়েটি আমি নই, আরাধনায় বিহঙ্গ জীবন, দেশলাই, তবু মনে রেখো। সব উপন্যাসের নাম মুখস্থ।’

– ‘উনার কি বইও আছে?’

– ‘হ্যাঁ ‘বিষাদিনীর বসুন্ধরা’ নাম। পড়বে না-কি? রকমারি থেকে অর্ডার দিলে হোম ডেলিভারি দেবে।’

– ‘না এখন এমনিতেই বাসায় ভয়ে ভয়ে থাকি।’

– ‘ও হ্যাঁ, তাও ঠিক৷ আচ্ছা “বাঁক” উপন্যাস কেমন লেগেছিল?’

– ‘ভালোই কিন্তু ফিনিশিং ভালো লাগেনি। মানহার জন্য কষ্ট লেগেছে। ওদের মিল দিলে ভালো হতো।’

– ‘মিলই তো হবে৷ মৃদুল মানহার জন্য বেরিয়ে পড়েছে। এখন মানহা গ্রহণ করলেই তো মিল।’

– ‘তো গ্রহণ করার পর শেষ করতো।’

– ‘লেখক পিঠ বাঁচিয়েছে মনে হয়। মানহা গ্রহণ করলে কেউ কেউ বলতো মৃদুলের মতো স্বার্থপরকে মেনে নিল? না নিলে আবার কেউ কেউ বলতো মৃদুল তো পরিস্থিতির শিকার৷ তাছাড়া ভুল বুঝে যেহেতু মানহার কাছে এসেছে। তাহলে মিল দিলে কি এমন হতো? এই কারণে লেখক এভাবে সমাপ্ত দিয়েছে হয়তো।’

– ‘হুম হতে পারে।’

– ‘আচ্ছা আপনার কি আজ মন খুব ভালো?’

– ‘হ্যাঁ, কিন্তু তুমি বুঝলে কিভাবে?’

– ‘এভাবে কি মনখুলে কথা বলেন কখনও? সব সময়ই তো শাসান আমাকে।’

– ‘তাই? শুধু শাসাই, ভালোবাসি না?’

– ‘উহু।’

– ‘আচ্ছা এখন থেকে বাসবো, গল্পটা গিয়ে পড়ি। তুমি মোবাইল রেখে ঘুমাও।’

– ‘আচ্ছা, কিন্তু ঘুম আসবে কি-না জানি না। চোখবন্ধ করলেই আপনি সামনে চলে আসেন। আর শ্বাস নিলে আপনার ঘ্রাণ পাই।’

– ‘তুমি এত ভালোবাসো কেন বলো তো ইতি।’

– ‘জানি না।’

– ‘আচ্ছা জানতে হবে না। শুভ রাত্রি।’

ইতি অফলাইনে চলে গেল। কল্প গল্প পড়তে চলে যায়। আগে প্রচুর বই পড়তো। এখন ফেইসবুকেও পড়ার নেশা এসে গেছে। সারারাতই গল্প-উপন্যাস পড়তে পারবে সে৷ অথচ গেইম খেলতে ভালো লাগে না৷ ছেলেরা কত পছন্দ করে খেলা দেখে। তার খেলা দেখতেও খুব একটা ভালো লাগে না৷ খেলা দেখতে গেলে টিভির দিকে তাকিয়ে থাকলেও মন অন্য কোথাও যেন চলে যায়। বিশ্বকাপ এলে ফুটবল খেলা দেখতো। কিন্তু গেলবার খেয়াল করেছে বিশেষ কয়েকটা টিমের ছাড়া আর খেলা দেখতে আগ্রহও পায়নি সে। বই পড়ার নেশাটা শুরু হয়েছিল জাফর ইকবালের ‘আমি তপু’ পড়ে। ক্লাস এইটে পড়ে তখন। ক্লাসে বাংলা স্যার মাসে একটা ব্যক্তিগত প্রতিযোগিতা দিতেন৷ সেখানে সাধারণ জ্ঞানের প্রশ্ন করা হতো। যে বিজয়ী হয় তাকে একটা বই উপহার দিতেন। সব সময় সেইই পুরুষ্কার পেয়েছে। প্রথমবারই “আমি তপু” বইটা পায়। তপু ছেলেটার কষ্টের সঙ্গে তার ভীষণ মিল ছিল। কেমন চেনা-জানা কষ্ট। ছোট্ট তপু তার মতোই নিঃসঙ্গ ছিল। মা তাকে বিশেষ একটা কারণে পছন্দ করতো না৷ ভাই-বোন সবার থেকে সে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। সেই উপন্যাস পড়ে লুকিয়ে লুকিয়ে অনেক কেঁদেছিল কল্প। তপুর কষ্টগুলো যেন তারই কষ্ট। এরপর থেকে ক্রমশই বইয়ের প্রতি নেশা বড়তে থাকে। এখন “ঘাসফড়িং” পড়তে পড়তে বারবার শ্রেয়ার জায়গায় ইতিকে ভাবছে সে। বারবার প্রণয় দৃশ্য পড়তে গিয়ে চোখবুজে আসছে। ইতিকে কিভাবে কাছে পাবে? একান্তে, নিভৃতে ভীষণ কাছে পেতে চাইছে মন৷ গল্পটা পড়তে পড়তে ঘুমিয়ে যায় কল্প। ঘুম থেকে উঠে সকাল আটটায় গোসল করে নেয়। নয়টার দিকে সিরিয়াল লেগে যেতে পারে। ইতির মেসেজ পেল তখনই।

– ‘আমি সাড়ে নয়টার দিকে ফার্নিচারের দোকানের সামনে আসবো। এসে কল দিব।’

কল্প মুচকি হাসে। এত পাগল মেয়েটা।

– ‘আচ্ছা ঠিক আছে।’

– ‘আর শুনুন। আজ কলেজে আমি মুনাকে সবকিছু বলবো। সে হয়তো দেখেনি আপনাকে। আমি বলবো ওকে। তাহলে দেখা করতে পারবো হয়তো।’

– ‘পারবে না। আমি মেসে থাকি। আরও ছেলে আছে এখানে।’

– ‘ওর বাসা যেহেতু আমরা অনেক বুদ্ধি বের করবো, আপনার চিন্তা করতে হবে না।’

– ‘আচ্ছা ঠিক আছে।’

– ‘এখন রেডি হই। আপনারও তো ভার্সিটি আছে।’

– ‘হ্যাঁ আমি রেডি হয়ে খাব একটু পর। খালা সবেমাত্র রাঁধতে এসেছে।’

– ‘আচ্ছা বাই।’

কল্প রেডি হয়ে খেয়ে নিল। ইতি আসতে দেরি করছে৷ তার অস্থিরতায় সময় কাটে। ঠিক নয়টা পঞ্চাশে কল দেয় ইতি। সে মোবাইল কানে নিয়ে বেলকনিতে যায়।

– ‘হ্যালো ইতি, তুমি কোথায়?’

– ‘এইতো রিকশা থেকে নামতেছি।’

– ‘হ্যাঁ দেখতে পাচ্ছি। কলেজ ড্রেসে আমার বউটাকে পিচ্চি লাগছে।’

ইতি যেন শুনতে পেল না৷ সে চারদিকে তাকিয়ে বললো,

– ‘স্যরি লেট হয়ে গেল তাই না?’

– ‘সমস্যা নেই, অস্থির হইয়ো না।’

ইতি ফার্নিচারের দোকানের সামনে থেকে সতর্কভাবে মাথা তুলে তাকায়। কল্পকে খুবই রোগা লাগে ইতির কাছে। বুকটায় ‘চিনচিনে’ ব্যথা হয়। পরম মমতা নিয়ে তাকিয়ে থাকে। ধরে আসা গলায় বলে,

– ‘আপনি অনেক শুকিয়ে গেছেন। প্লিজ নিজের খেয়াল রাখবেন। জ্বর কমেছে তো?’

– ‘হ্যাঁ ইতি কমেছে। তোমাকে দেখতে ভীষণ মায়া লাগছে। কাছে চলে যেতে ইচ্ছা করছে।’

– ‘এসে কি করতেন?’

– ‘শক্ত করে জড়িয়ে ধরতাম।’

ইতি চারদিকে তাকিয়ে বললো, ‘আর?’

– ‘চুমু খেতাম?’

– ‘কোথায়?’

– ‘কপালে।’

– ‘ইস।’

– ‘ইতি, এখন রোদ অনেক। চলে যাও। মানুষও যাচ্ছে-আসছে।’

– ‘আচ্ছা খেয়েছেন আপনি?’

– ‘হ্যাঁ।’

– ‘মেসের খাবার শুনেছি ভালো না। আমার কারণে এতকিছু হলো।’

– ‘এই বলেছিলাম না এসব না ভাবতে। পেছনের চিন্তা বাদ দাও। আর এখন মাঝ রাস্তায় এত ইমোশনাল হলে চলে বলো? যাও এখন।’

– ‘আপনাকে দেখেই ইমোশনাল হয়েছি।’

– ‘ইতি, একটু কষ্ট করো জান। দেখবে সব ঠিক হয়ে যাবে। আর এত অস্থির হলে পড়ালেখায় মনযোগ দিতে পারবো না আমরা। এখন তুমি গিয়ে ক্লাসে আনমনে বসে থাকবে। এসব হতে দেয়া যায় না।’

– ‘আচ্ছা আপনি আমাকে ‘জান’ বললেন না?’

– ‘হ্যাঁ।’

– ‘জানের জায়গায় ‘বউ’ বলবেন।’

কল্প হাসতে হাসতে বলে,

– ‘আচ্ছা ঠিক আছে। আমার মিষ্টি বউটা এবার যাও। হঠাৎ কেউ বুঝে ফেলবে। রিকশা ডেকে চলে যাও।’

– ‘হ্যাঁ যাচ্ছি৷’

কল রেখে দেয় ইতি। চলে যেতে ভীষণ কষ্ট হয়। দমবন্ধ লাগে৷ এতদিন নিজের বাড়িতেই ছিল মানুষটা। তবুও কাছাকাছি যেতে কত প্রতিবন্ধকতা ছিল। আর এখন সামান্য চোখে দেখতেও কত সমস্যা।
ইতি রিকশা একটা নিয়ে কলেজে চলে আসে। রুমকি আগেই এসেছে। ওকে গিয়ে সবকিছু বলে। রুমকি অবাক হয়ে বললো, ‘মুনাদের বাসায়?’

– ‘হ্যাঁ।’

– ‘পুরো শহর থাকতে মুনাদের বাসায়। যা ভাগ্য ভালো। মুনাকে বললে তোকে বাসায় দেখা করিয়ে দিতে পারবে।’

– ‘কিন্তু কিভাবে?’

– ‘তা জানি না। কিন্তু পারবে। ওদের ফ্যামিলি কিছুটা ভিন্নরকম। মা-মেয়ে ফ্রি।’

– ‘আচ্ছা মুনা এলে শুধু ওকে কল্পের কথা বলবো। দেখা করানোর কথা বলবো না।’

মুনা এলো মিনিট দশেক পর। ইতি দেখেই উচ্ছ্বসিত হয়ে গেল। যেন মুনাই কল্প। হঠাৎ করে যেন মুনাকে আরও বেশি আপন লাগছে ইতির।

– ‘মুনা এখানে আয়।’

মুনা একটা বেঞ্চে ব্যাগ রেখেছিল। বিভ্রান্ত হয়ে বললো, ‘কি?’

রুমকি দাঁড়িয়ে বলে ‘আমাদের কাছে বসবি।’

মুনা এগিয়ে গিয়ে বললো, ‘তোদের কাছে বসবো? তোরা আমাকে পছন্দ করিস না তো জানি।’

ইতি মুনার হাত ধরে টেনে বসায়। ইতির বুকভরা প্রেম-প্রীতি। চোখে-মুখেও এর ছাপ স্পষ্ট। মন ভীষণ কোমল। এরকম মন নিয়ে পৃথিবীর সবাইকে ভালোবাসতে ইচ্ছা করে। ইতি কোমল গলায় বলে,

– ‘এ কথা কেন বললি মুনা? আমরা সেই সিক্স থেকে এক সঙ্গে পড়ি।’

– ‘হ্যাঁ তা ঠিক। কিন্তু তোরা কয়েকজন তো কয়েকদিন থেকে আমাদের সঙ্গে মিশতে চাস না। তোরা কেমন আলাদা।’

– ‘কি যে বলিস মুনা। তুই সেই নাইনে থাকতে যখন গল্প করতি। কি মনযোগ দিয়ে শুনতাম। এখনও মনে আছে আমার।’

– ‘তোর কি হয়েছে ইতি? এত ইমোশনাল লাগছে কেন?’

– ‘কিছু না, তুই আজ থেকে আমার সঙ্গে বসবি।’

– ‘আচ্ছা বসবো। কিন্তু কি হয়েছে বল।’

– ‘না এখন বলতে ইচ্ছা করছে না।’

মুনা বেঞ্চে কনুই ঠেকিয়ে হাতের তালুতে গাল রেখে ইতির দিকে তাকায়। মুনা খানিকটা মোটা, এবং খাটো। কিন্তু চোখ দু’টা ভীষণ সুন্দর। সে ভ্রু নাচিয়ে বললো, ‘তোর সেই কল্প ভাইয়ার খবর কি?’

ইতি আবাক হয়৷ কল্পকে মুনা তাদের বাসায় দেখে ফেলেছে না-কি? আগেই সবকিছু বলে দেওয়াই ভালো। ইতি ম্লানমুখে বললো,

– ‘আমাদের ব্যাপারটা বাড়িতে জানাজানি হওয়ায় চলে গেছে।’

– ‘ও, এই কারণে তোর মন খারাপ?’

ইতি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে, ‘হ্যাঁ অনেক বেশি মন খারাপ ছিল। কিন্তু আজ ভোরে ভালো হয়ে গেছে।’

– ‘কেন?’

ইতি মুনার এক হাত ধরে বললো, ‘কারণ ও তোদের বাসায় উঠেছে মেসে।’

মুনা অবাক হয়ে বলে, ‘কি বলিস তাই না-কি? আমি তো দেখিনি।’

– ‘খেয়াল করিসনি হয়তো।’

– ‘ভালোই তো। দুলাভাইকে কাছে পাইলাম।’

রুমকি মুচকি হেঁসে বলে, ‘কিন্তু আমাদের বোন তো পাচ্ছে না।’

মুনা হেঁসে বললো, ‘আমাদের বাসায় আছে যেহেতু মাঝে মাঝে গিয়ে দেখা করতে পারবি, সমস্যা কি?’

– ‘কিভাবে? ওর মেসে ছেলে আছে না আরও?’

– ‘ছাদে যাবি দু’জন। না হয় আমার রুমে। এগুলো কোনো সমস্যা না। আমি ব্যবস্থা করে দিব।’

ইতি প্রচণ্ড খুশি হয়ে বললো,

– ‘সত্যিই?

‘সত্যি, কিন্তু আমার বাসায় গিয়ে ইয়ে টিয়ে করে পাপী বানাবি না আমাকে।’

রুমকি খিলখিল করে হেঁসে উঠে। ইতি মুনাকে চিমটি দিয়ে বললো, ‘কল্পকে চিনিস না, ও এসব করবেও না।’

– ‘তোর কল্প ভাইয়াকে নিয়ে বাজে কথা বলতে চাইছি না। তুই বলাবি না। ছেলে মানুষ করবে না তোকে বলছে। তোরা না প্রেমে পড়লে একেবারে গলে গিয়ে প্রেমিককে ফেরেশতা ভাবতে শুরু করিস। এই কারণে বিয়ের পর টিকে না…।’

ইতি মুনার মুখ চেপে ধরে বলে, ‘প্লিজ, ওকে নিয়ে বাজে কিছু বলিস না।’

মুনা হাত সরিয়ে বললো, ‘বললে কি হবে?’

– ‘ওর প্রতি আমার আলাদা রেস্পেক্টও আছে। এখনও আপনি করে বলি।’

– ‘এহ আজ বিয়ে করলে রাতেই…।’

ইতি আবার ওর মুখ চেপে ধরে বলে, ‘প্লিজ মুনা।’

‘বাবা এত প্রেম’ বলে মুনা খিলখিল করে হেঁসে উঠে। ক্লাসে স্যার চলে আসেন খানিক পর। আর কথা হয় না তাদের।

এরপর কল্পের সঙ্গে ইতির কেবল মেসেঞ্জারে কথা হয়। ফার্নিচারের দোকানের সামনে থেকে দু’চোখ ভরে খানিক্ষণ দেখা হয়। সপ্তাহখানেক পর মুনা নিজ থেকেই ইতিকে কলেজ ছুটির পর বাসায় নিতে চায়। ইতি আমতা-আমতা করে বলে, ‘কিন্তু ও তো মনে হয় ভার্সিটি থেকে ফিরেনি মুনা।’

মুনা রহস্য করে হাসে।

– ‘এই চিন্তা তোর করতে হবে না৷ উনার সঙ্গে আমার কথা হইছে।’

– ‘কি কথা হইছে?’

– ‘তোর ক্লাসমেট এটা বলেছি। এসব কথা আরকি। আর আজ ছুটির পর তোকে নিয়ে যাব বলেছি।’

– ‘আমাকে তো কিছু বলেনি।’

– ‘কলেজে আসার সময় গেইটে পেয়ে বললাম মাত্র। উনিও তখন ভার্সিটি যাচ্ছিল।’

– ‘ও আচ্ছে।’

ইতি ভয়ে ভয়ে ওর সঙ্গে গিয়ে রিকশায় উঠে। তারপর মেসেজ দেয় কল্পকে, ‘মুনাদের বাসায় যাচ্ছি। তুমি কোথায়?’

– ‘আমি ভার্সিটি থেকে ফেরার পথে, আসো তুমি।’

– ‘ওকে।’

বাসায় এসে মুনার রুমে গিয়ে বসে ইতি। ওর আলাদা রুম। চোখের সামনে দেয়ালে ক্রিশ্চিয়ান রোনালদোর ছবি। মুনার মা এলেন খানিক পর, ‘আসসালামু আলাইকুম আন্টি।’

– ‘তোমার নাম ইতি?’

– ‘হ্যাঁ আন্টি।’

– ‘তোমরা আসো না কেন কখনও বলো তো মা? মাঝে মাঝে আসতে পারো না। কলেজের কাছেই তো।’

ইতি কিছুই বলে না, শুধু হাসে। খানিক পর তিনি চলে যান। মুনা এসে বললো, ‘কল্প ভাইয়া উপরে গেছে।’

– ‘আমরা কোথায় দেখা করবো?’

– ‘ছাদেই ভালো হবে।’

ইতি কল্পকে মেসেজ দিল, ‘ছাদে যান আপনি।’

কল্প সঙ্গে সঙ্গে মেসেজ দিল, ‘ছাদে?’

– ‘হ্যাঁ।’

– ‘আচ্ছা একটু পর আসো। আমি মেসেজ দিচ্ছি।’

– ‘ওকে।’

ইতি মুনার দিকে তাকিয়ে বললো, ‘একটু পর যেতে বলেছে।’

– ‘আচ্ছা ঠিক আছে। আর শোন, আমাদের বাসার ছাদ কিন্তু অন্য উঁচু বাসা থেকে দেখা যায়। তবে চিলেকোঠার দেয়াল আছে না? এর একটু সামনে পানির ট্যাংক আছে। ট্যাংকের উত্তর দিকে থাকলে কেউ দেখবে না৷ ওইদিকে বাসা নেই। আমি চিলেকোঠা থেকে দেখবো নিচ থেকে কেউ সিঁড়ি দিয়ে আসে কি-না।’

ইতি মাথা কাত করে। কল্প ফ্রেশ হয়ে হাত-মুখ মুছে খানিক পর মেসেজ দেয়, ‘আসো।’

মেসেজ দেখেই ইতির বুকটা কেঁপে উঠে। কেমন ভয় লাগছে।

– ‘মুনা মেসেজ দিয়েছে।’

– ‘যেতে বলেছে?’

– ‘হ্যাঁ।’

– ‘চল।’

ইতি দাঁড়িয়ে মুনার হাতটা ধরে, ‘ধন্যবাদ মুনা। তুই এতকিছু করবে ভাবিনি।’

– ‘ভাববি কিভাবে? আমাকে তো মন থেকে পছন্দ করিস না জানি।’

– ‘কি যে বলিস তুই।’

– ‘হয়েছে আমাকে প্রেম না দেখিয়ে ছাদে গিয়ে দেখা। আমি লে*সবিয়ান না।’

– ‘তুই হইছিস আমার মালিহা আপুর মতো। সারাক্ষণ মুখে এসব থাকে।’

– ‘এজন্যই তো আমারে পছন্দ করিস না।’

– ‘এরকম বলবি না মুনা।’

– ‘তাড়াতাড়ি চল তো।’

দু’জন সিঁড়ি দিয়ে আসে। মুনা চিলেকোঠার সিঁড়িতে মোবাইল হাতে নিয়ে বসে বললো, ‘দরজা ভেজিয়ে যা। আমি আছি এখানে।’

ইতি পা টিপে টিপে ছাদে যায়। কল্প ছাদের কার্ণিশ ধরে দাঁড়িয়ে আছে। একটা কালো ট্রাউজার আর টি-শার্ট ওর পরনে। ইতি আসতেই এগিয়ে গিয়ে বললো, ‘ছাদে তো অনেক রোদ।’

– ‘পানির ট্যাংক কই?’

– ‘কেন? ওইদিকে মনে হয়।’

– ‘চলুন।’

কল্প ইতির হাতটা ধরে পশ্চিম দিকে চলে গেল। এদিকে চিলেকোঠার দেয়ালের ছায়া। গিয়ে দাঁড়াতেই সামনের ট্যাংক তাদেরকে সবকিছু থেকে আড়াল করে দেয়। কল্প ইতির মুখটা দুইহাতে আঁজলা করে ধরে বলে,

– ‘বাহ তুমি সবকিছু জেনেই এসেছো তাহলে।’

চোখে চোখে তাকাতে গিয়ে হুট করে ইতির কেমন যেন লজ্জা লাগে। ওর বুকের দিকে তাকিয়ে বলে, ‘ হ্যাঁ।
কল্প ওর কপালে চুমু খায়। চোখবুজে আসে ইতির।
কল্প পুনরায় বলে, ‘আমরা কিন্তু শুধু দেখা করতে চাইলে বাইরে কোনো রেস্তোরাঁয় গিয়েও পারবো। এখানে যেহেতু এসেছি। একবার জড়িয়ে ধরি?’

ইতি ওর বুকের দিকে তাকিয়ে বললো, ‘আমি কি না করবো আপনাকে?’

কল্প আলগোছে জড়িয়ে ধরে ইতিকে। বুক শিরশির করে তার। শরীরের লোমগুলো নাড়া দিয়ে উঠে। শরীরে গরম স্রোত বয়ে যায়। ইচ্ছা করে ইতিকে বুকের ভেতর ঢুকিয়ে নিতে। ইতির গালে তার গাল চেপে ধরে থাকে খানিকক্ষণ। তারপর আবার আঁজলা করে মুখটা ধরে চোখের দিকে তাকায়। ইতির লজ্জা লাগে। চোখ নামিয়ে নেয়। কল্প ওর ফুলের পাপড়ির মতো গোলাপি ঠোঁটের দিকে তাকিয়ে থাকে। ইতির লজ্জায় মুখ লাল হয়ে যায়। কল্প তাকে ছেড়ে দিয়ে দেয়ালে হেলান দিয়ে আসন পেতে বসে পড়ে বলে,

– ‘তুমি নিচে বসলে ড্রেসে ময়লা লাগবে। আমার কোলেই বসো।’

ইতি ওর কোলে বসে। কল্প বাহুডোর বেঁধে বসে ওর চুলে নাক ডোবায়। তারপর ঘোর লাগা গলায় বলে, ‘ইতি।’

– ‘বলুন।’

– ‘বিয়ে করে ফেলতে ইচ্ছা করে।’

– ‘ইস। ভাবলেই আমার গা কাটা দিয়ে উঠে। আপনাকে সব সময় কাছে পাবো। আপনি একান্ত আমার হয়ে যাবেন। এগুলো ভাবলেই আমার চোখে পানি চলে আসে৷’

কল্প চুল সরিয়ে ওর নগ্ন ঘাড়ে আলতো করে চুমু খায়। ইতি হেঁসে উঠে বলে,

– ‘ইস সুড়সুড়ি লাগে তো।’

– ‘তাই?’

– ‘হুম।’

– ‘আমার কিন্তু অনেক প্রশ্ন আছে। এখন এসব আলাপ করে সময় নষ্ট করতে চাইছি না।’

– ‘কি প্রশ্ন?’

– ‘এইযে এখানে অবাধ সুযোগ পেলাম এগুলো নিয়ে।’

– ‘মুনাই করে দিয়েছে।’

– ‘তা বুঝেছি, তবুও এখন চলে যাও। এরকম এসো না। এগুলো রিস্ক তো। আমারও ইচ্ছা করে। এইযে এখন ছাড়তে ইচ্ছা করছে না।’

ইতি উঠে দাঁড়িয়ে বললো,

– ‘আচ্ছা আরেকবার জড়িয়ে ধরুন। আপনার বুকে কি যেন আছে। এত শান্তি পাই মাথা রাখলে।’

কল্প আবার জড়িয়ে ধরে৷ শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। ইতি মিশে থাকে বুকে৷ কল্প ফিসফিস করে বলে, ‘ইতি তুমি এত কোমল কেন? শিমুল তুলোর মতো নরম।’

ইতি চোখবুজে থাকে। জবাব দিতে ভালো লাগে না। কল্প ওর গলায় একটা চুমু দেয়, তারপর গালে। ইতি চোখ খুলে না। খুলতে ইচ্ছা করে না। চোখবুজে সে পরম শান্তির একটা জগতে হারিয়ে গেছে। এই জটিল পৃথিবী দেখতে আর ইচ্ছা করে না। কল্প মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলে, ‘ইতি এখন যাও।’
আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলে ইতি। কল্প আঁজলা করে ওর মুখ তুলে চোখ মুছিয়ে দিয়ে বললো, ‘কাঁদার কি আছে বলো তো?’

– ‘আপনাকে পাব তো?’

– ‘পাবে, চিন্তা করো না।’

– ‘বিশ্বাস করেন আমি মরে যাব কিছু হলে। আপনি প্লিজ সব সময় এরকম থাকবেন।’

– ‘হ্যাঁ থাকবো সোনা বউটা আমার। আমি সবকিছু গুছিয়ে নিয়েই বিয়ের প্রস্তাব পাঠাবো। বেশি হলে এক বছর সময় লাগবে।’

– ‘এক বছর!’

– ‘এক বছর চোখের পলকে চলে যাবে ইতি। আর আমাদের বয়সই বা কত।’

– ‘শুনুন, আমি যে কোনোভাবেই আপনাকে পেতে চাই। বিয়ের প্রস্তাব দিয়েও যদি না দেয় আপনি ঘাবড়ে যাবেন না প্লিজ। আমি পালিয়ে আসবো দরকার হয়। বিশ্বাস করুন, আমার ভালোবাসাটা অন্যরকম। আমি থাকতে পারবো না আপনাকে ছাড়া।’

– ‘বুঝেছি আমি। আমাকে নিয়ে ভেবো না ইতি। আগে এড়িয়ে চলেছি সেটা ভিন্ন বিষয়। এখন তো কথা দিয়েছি। আমরা একে অন্যকে ভালোবাসি তাই না? আমি তোমাকে পাওয়ার জন্য সবকিছু করতে পারি। আমার লক্ষী বউটা, এখন যাও। বেশি রিস্ক নিয়ে নিচ্ছি।’

– ‘আচ্ছা যাচ্ছি।’

কল্প আবার ওর কপালে চুমু দিয়ে বলে, ‘তুমি আগে চলে যাও।’

ইতি চোখ-মুখ মুছে চিলেকোঠায় আসে। মুনা বসে মোবাইল টিপছে। ইতিকে দেখেই উঠে দাঁড়ায়, ‘বাবা এত সময়।’
ইতি গিয়ে মুনাকে জড়িয়ে ধরে, ‘তুই এত ভালো কেন রে?’

– ‘হইছে পাম্প মারতে হবে না।’

– ‘সত্যি বলছি মুনা। তুই আজ যে হেল্প করেছিস আমি সারাজীবন মনে রাখবো।’

– ‘কিন্তু আমি একটা ব্যাপার লক্ষ্য করেছি। তুই এত ভালোবাসিস উনাকে। আমি জীবনে কাউকে দেখিনি এরকম।’

– ‘তুই কিভাবে বুঝলি?’

– ‘ক্লাসে ওইদিন বুঝেছি। কিন্তু কল্প ভাইয়া কি সেরকম ভালোবাসে?’

– ‘ওর তো চাচাতো বোনের সঙ্গে বিয়ে ঠিক ছিল। ইংল্যান্ড থেকে ওরা চলেও এসেছিল। সে বিয়ে করেনি আমার জন্য।’

– ‘বাবা, এরকম ভালোবাসা দেখতেও ভালো লাগে রে। এখন ভয় হচ্ছে। তোর পরিবার যেভাবে উনাকে বের করে দিছে। যদি বিয়ে না দেয় তাহলে তো সমস্যা।’
দু’জন এসব নিয়ে কথা বলতে বলতে নিচে নেমে যায়।

__চলবে…
লেখা: জবরুল ইসলামমায়াডোর (২৭ পর্ব)
.
ইতি চলে যাওয়ার পর কল্প রুমে ফিরে আসে। তাড়াতাড়ি খাবার খেয়ে টিউশনিতে যায়। মেসে রাত করে ফিরে। ঘুমানোর আগে ইতির সঙ্গে চ্যাটে কথা হয়। এরকম বাসায় আসতে নিষেধ করে দেয় ইতিকে। এরপর মাঝে মাঝে কেবল বেলকনি থেকে নয়নভরে দেখা। ইতি বেপরোয়া প্রেমিকের মতো ফার্নিচারের দোকানের সামনে এসে কল দেয়। কল্প বেলকনিতে গিয়ে হাত নাড়ে। একে অন্যের দিকে তৃষ্ণার্ত চোখে তাকিয়ে থাকে। এভাবেই কয়েক মাস চলে যায়। এর ভেতরে শ্রেয়ার সঙ্গে কথা হয় কল্পের। কথা হয় সুপ্তির সঙ্গেও। মা কিংবা মামার সঙ্গে কোনো কথা হয় না। পরিবারের সঙ্গে নিপা ইংল্যান্ড চলে যায়। কল্প নানান প্রশ্নের মুখোমুখি হওয়ার ভয়ে বিদায় করতেও যায় না। তবে নিপার সঙ্গে হোয়াটসঅ্যাপে যোগাযোগ হয়। কিছুদিন পর তার পড়ালেখা আর টিউশনির সঙ্গে যুক্ত হয় চাকরির ইন্টারভিউ। প্রাইভেট কোম্পানিগুলোতে ছোটাছুটি। কোনোভাবেই কিছু হয় না। প্রায় ছয় মাস পর একটা জব পায়। মোটামুটি ভালো। প্রাইভেট একটা কোম্পানিতে মার্কেটিং অফিসার। পরীক্ষা আর পড়ালেখার জন্য প্রয়োজনীয় সকল ছুটিই পাবে সে। বেতন প্রথমে বারো হাজার। ধীরে ধীরে বাড়বে। জব টাইম দশটা থেকে পাঁচটা অবধি। কল্প জয়েন করার পর দেখেছে টাইম ঠিক থাকে না। কখনও সাতটা আটটাও হয়। আরও এক বছর চলে যায় জব করে। এর ভেতরে ইতির ইন্টারও শেষ হয়ে গেছে। পুরো দেড় বছরই তাদের চ্যাট আর মাঝে-মাঝে দেখা সাক্ষাৎ করে কেটে যায়। কল্পেরও বেতন বাড়তে বাড়তে ততদিনে ১৮ হাজারে এসেছে৷ এছাড়াও প্রতিদিনের বোনাস, ওভার টাইম সহ একুশ হাজারের কাছাকাছি হয়ে যায়। তবে সবচেয়ে বড়ো ব্যাপারটা হচ্ছে, দীর্ঘ দেড় বছরের চাকরি জীবন কল্পকে অনেকটাই পালটে দিয়েছে। চরিত্র থেকে অতি বিনয়ী ভাব একেবারে খসে পড়েছে। সরলতা উধাও হয়ে কথাবার্তায় রূঢ় ভাব স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। প্রায়ই এখন মামা-চাচাদের সঙ্গে কথা হয়। মায়ের সঙ্গে কথা হয়। সবার সঙ্গেই রূঢ় আচরণ করে। পরোক্ষভাবে নিজের অধিকারের বিষয়ে কথা বলে। আজকাল ইতিও তাকে বিয়ের জন্য চাপাচাপি কর‍তে শুরু করেছে। সেও বিয়েটা করে ফেলতে চায়। তবুও যেন সবকিছু গুছিয়ে নিতে পারছে না৷
আজ অফিসে থাকতেই কিছু বিষয়ে ভেবে সিদ্ধান্ত নিয়ে এসেছে। সেসব বিষয়ে মায়ের সঙ্গে খোলাখুলি কথা বলবে সে। গরমের দিন। বাসায় ফিরে সন্ধ্যায় গোসল করলে আরাম পায়। আজও গোসল করে বের হয়েছে। শরীর মুছে একটা গেঞ্জি গায়ে দিয়ে বিছানায় গা হেলিয়ে মা’কে কল দেয়। ওপাশ থেকে রিসিভ করেন মুনিয়া বেগম। কল্প সালাম দেয়। তিনি জবাব দিয়ে বললেন, ‘কি করছিস বাবা?’

– ‘এইতো অফিস থেকে এলাম।’

– ‘পড়ালেখা কেমন চলছে।’

– ‘ভালো না। চাকরি-টাকরির সঙ্গে পড়ালেখা ভালো হবে কিভাবে। আচ্ছা শ্রেয়া কি করে? কেমন আছে?’

– ‘ভালো, ওর তো এসএসসি পরীক্ষা সামনে।’

– ‘ও, আচ্ছা শোনো মা, তোমাকে একটা দরকারে কল দিয়েছি।’

– ‘কি?’

– ‘আমাদের গ্রামের রহমত মিয়াকে চেনো? ওইযে অন্যের বাড়ি থাকে।’

– ‘না, কেন?’

– ‘ওর ছেলে তো আমাদের বাড়িতেই চাকরিতে থাকে।’

– ‘ও আচ্ছা, তো কি হয়েছে।’

– ‘আমি মাঝে একবার বাড়িতে গিয়েছিলাম। রহমত আলীর ছেলেকে একটা অটোরিকশা কিনে দিয়েছি। ছোট চাচাও ছিলেন সঙ্গে। সে মাসে মাসে টাকা পাঠায় ঠিকঠাকমতো।’

– ‘ভালো তো, ভালো করেছিস।’

– ‘আমি অন্যকিছু ভাবছি। আব্বার ভাগের তো অনেক জায়গা-জমি আছে। সেগুলো ছোট চাচা এত বছর থেকে করেন। বাড়িতেও আমার ভাগ আছে।’

– ‘হ্যাঁ তা আছে তো।’

– ‘আমি চাচ্ছি সেগুলো আলাদা করে নিতে। রহমত চাচা বললো প্রায় একশো মন ধান পান চাচা।’

– ‘এখন ভাগ দিয়ে কি করবি তুই? বিয়ে-শাদি করে সংসার কর। তারপর না এগুলো দিবে।’

– ‘আজাইরা কথা বলবে না তো। এত বছর যে করে খাচ্ছে। তুমি ওদের বলেছিলে আমার ধানের টাকা জমাইতে? আমি এখন থেকে রহমত চাচাকে চুক্তিতে সব জমি দেবো। খরচও আমি দেবো। ওরা শুকিয়ে বিক্রি করে টাকা দেবে আমাকে। আর আমি বিয়ে করে সংসার করতে হলে কি বাড়িঘর লাগবে না? ওরা আমার বাড়ি ভাগ করে দিক। আমি তালা মেরে রেখে আসবো। না হয় রহমত আলীকে ঢুকিয়ে দেবো। আমার জমি-জমা দেখবে।’

– ‘তো কর আমি কি করবো? তুই তো নিজের কপাল পুড়িয়ে ফেলেছিস আগেই। এতদিনে ইংল্যান্ড থাকতি।’

– ‘তোমরা সবাই তো এই এক গান পেয়েছো। তোমার ভাইও। আমি ইংল্যান্ড না গিয়ে কি গাঁ*জা খাচ্ছি বসে বসে? পড়ালেখা করছি, জব করছি। তোমার ভাই তো বাড়ি থেকেই বের করে দিছে। এখন আমার বাড়ি-ঘর লাগবে না? তুমি সিলেট আসো, আর তোমার ভাই যদি যায় আমার সঙ্গে তাহলে তো ভালোই। আমি তোমাদের নিয়ে ছোট চাচার সঙ্গে এগুলো নিয়ে কথা বলতে চাই। এর পরের সিজনেই আমি নিজে আমার জমি করাবো।’

– ‘তোর বড়ো চাচার সঙ্গে কথা বলেছিস?’

– ‘হ্যাঁ বলেছিলাম। উনি বলছে মামাকে নিয়ে যেতে। উনি কলে কথা বলবেন ছোট চাচার সঙ্গে। তুমিও আসো।’

– ‘আমি এসে কি করবো? তোর মামাকে কল দিয়ে বলবো, সে যাবে সঙ্গে। সমস্যা নেই।’

– ‘হ্যাঁ তুমি আসবে কেন! তুমি তো দুনিয়ার আলাদা মহিলা। আর কেউ বাপের বাড়ি আসে না৷ তোমাকে কিনে নিয়েছে একেবারে।’

– ‘কল্প তুই ইদানীং বেশি কথা বলিস। এসব নিয়ে কথা না বলতে নিষেধ করেছি না?’

– ‘কিসের নিষেধ? তোমাকে যে বাপের বাড়িই আসতে দেয় না তার কাছে তুমি কেমন সুখে আছো? এরচেয়ে তো হাজতবাস ভালো। আমার জন্য সিলেট আসতে না দেওয়ার তো কিছু নেই। কল্প তো গিয়ে বাপ ডাকবে না তাকে। আমি কি কখনও বলছি তোমাদের কাছে যেতে? তো এত কাহিনির কি আছে এখানে৷ তোমাকে বলছি না, আমি এখন জব করি। দরকার হয় বাসা নেব। তুমি চলে আসো শ্রেয়াকে নিয়ে।’

– ‘কিসব আবোল-তাবোল কথা বলিস এসব তুই? পাগল হয়েছিস না-কি। তোর কথা শেষ হলে ফোন রাখ।’

– ‘যাইহোক তুমি জমির ব্যাপারে কথা বলতে আসবে কি-না বলো। না হলে তোমার ভাইকে কল দিয়ে জিজ্ঞেস করো যাবে কি-না। না গেলে কেউ লাগবে না আমার। একাই যাব।’

– ‘বেশি কথা বলিস না৷ আমি মোস্তাককে কল দিচ্ছি। দেখি কি বলে।’

কল রেখে দেয় কল্প। পরেরদিন মুনিয়া বেগম জানান মোস্তাক সাহেব যাবেন। কল্প পরের শুক্রবারে মামাকে নিয়ে গ্রামে যায়। বড়ো চাচাও কলে কথা বলেন। সবকিছুই সুন্দরভাবে সমাধান হয়। তাই ছোট চাচা আর মামাকে নিয়েই কল্প রহমত মিয়ার সঙ্গে জমি করার বিষয়ে আলোচনা করে। সে জমির যাবতীয় খরচ দেবে। রহমত আলী জমিগুলো করে একেবারে ধান বিক্রি অবধি করে দিতে হবে। তাতে অর্ধেক ফসলই পাবে রহমত আলী। তাছাড়া বলে এসেছে জমি ঠিকঠাক মতো করলে, গরুও কিনে দেবে প্রতিবছর। লাভের অর্ধেক পাবে তারা। বাড়িও তাকে আলাদা করে দেওয়া হয়েছে। কল্প একরাত থাকলো সেখানে। মোস্তাক সাহেব চলে গেলেন বাড়িতে। গ্রামে পাড়া-পড়শীদের সঙ্গে অন্যভাবে মিশলো। সবার বাড়িতে গেল দেখা করতে। ফিরে এলো পরেরদিন বিকেলে। খুবই ফুরফুরে লাগছে তার। এতদিন নিজেকে কেমন পরিচয়হীন, গৃহহীন মনে হতো। এখন কেমন শান্তি লাগছে। বাসে আসতে আসতেই মনে হয় আজ যেহেতু অফিস ছুটি। তাহলে ইতির সঙ্গে দেখা করা যায়। মেসেঞ্জারে গিয়ে মেসেজ দিল, ‘ম্যাডাম কোনো বান্ধবীর বাসায় যাবে বলে বের হতে পারবেন? আমি তিনটার আগে মেসে ফিরবো। তুমি সাড়ে তিনটার আগে চলে আসো।’

ইতি মেসেজ সিন করেছিল দেরিতে৷ তবুও রিপ্লাই দিয়ে বলেছে আসবে। কল্প বেলকনিতে চেয়ার নিয়ে বসে অপেক্ষা করছে৷ ইতি কল দিল এসে তিনটা চল্লিশে। সে রিসিভ করে বললো, ‘এসেছো?’

– ‘হ্যাঁ কাছাকাছি, আপনি ফার্নিচারের দোকানের সামনে আসুন।’

– ‘আচ্ছা আসছি।’

কল্প তাড়াতাড়ি বের হয়ে নিচে নামে। ফার্নিচারের দোকানের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। ইতিকে খানিক পর রিকশাতে দেখা গেল। কল্প এগিয়ে গিয়ে বললো, ‘নামার দরকার নেই এটাতেই যাই।’

– ‘আচ্ছা আসো।’

– ‘কোথায় যাবে? কোনো রেস্টুরেন্টে গিয়ে বসি?’

– ‘তুমি কি কোনোদিন আমাকে আর ভার্সিটিতে নিয়ে যাবে না?’

কল্প হেঁসে বলে, ‘আচ্ছা চলো।’

দু’জন ভার্সিটিতে আসে। চারদিকে হেঁটে হেঁটে শহিদ মিনারের সামনে এসে কল্প বলে ‘ফুচকা নিই?’

ইতি সম্মতি জানায়। কল্প ফুচকা নিয়ে হেঁটে হেঁটে সিঁড়ির দিকে তাকিয়ে বললো, ‘পারবে উঠতে?’

ইতি ফিসফিস করে বলে, ‘কোলে নিয়ে উঠুন।’

– ‘চারদিকে মানুষ, তাকিয়ে থাকবে।’

– ‘ওমা তাতে কি হয়েছে।’

– ‘হাত ধরো তো। চলো আস্তে আস্তে উঠবো।’

দু’জন ধীরে ধীরে সিঁড়ি দিয়ে উঠে। কল্প ইতির দিকে তাকায়। খোলা চুল। ঠোঁটে লিপস্টিক। কপালে ছোট্ট একটা টিপ। ভ্রু দিন দিন আরও কালো হচ্ছে। গালের মাঝখানের তিলটায় ভীষণ মায়াবী লাগে ওকে। কিছুটা মোটাও হয়েছে ইতি। চেহারায় লাবণ্যতা আরও বেড়েছে। সিঁড়ি আঁকাবাঁকা হয়ে উঠায় নিচ থেকে মাঝখান দেখা যায় না। কল্প ওর দিকে তাকিয়ে বললো, ‘কষ্ট হচ্ছে তোমার?’

ইতি কল্পের বাহুতে গাল চেপে ধরে বললো, ‘কষ্ট হলেও তো কোলে নিবেন না।’

কল্প ফুচকা বাড়িয়ে দিয়ে বললো, ‘এটা একটু নাও।’

ও হাতে নিতেই সে পাঁজাকোলা করে কোলে নেয়। ইতি আঁতকে উঠে গলা জড়িয়ে ধরে বলে, ‘লাগবে না, আমি এমনিতেই বলেছি, নামান।’

– ‘আরও অনেক উঁচুতে তো। একটু হেল্প করি। এরপর একা উঠবে।’

– ‘আচ্ছা কষ্ট হলে নামিয়ে দিয়েন।’

কল্প মাথা নেড়ে উঠতে থাকে। ইতি চারদিকে তাকায়। সবুজ অরণ্যে ঘেরা চারপাশ। বেশ কিছু সিঁড়ি উঠতেই কল্পের শ্বাস ঘন হয়ে আসে। ইতি বুঝতে পেরে বলে, ‘সিঁড়ির দুই পাশে দেয়াল আছে। আমরা চাইলে তো বসতে পারি।’

– ‘শহিদ মিনার তো উপরে। ওই জায়গাটা সুন্দর।’

– ‘তা বুঝেছি, কিন্তু জিরিয়ে জিরিয়ে যাব। এত তাড়া তো নেই।’

‘আচ্ছা ঠিক আছে’ বলে কল্প নামিয়ে দিয়ে বললো, ‘বাবা তোমার এত ওজন।’

ইতি খিলখিল করে হাঁসে। বেশকিছু সিঁড়ি পর পর বাঁক নেয়ার আগে কিছুটা বৃত্তাকার পাকা জায়গা। ইতি তাকে টেনে নিয়ে একপাশে বসে। হাতটা বগলি করে ধরে পেশিতে গাল চেপে রেখে আনমনে হঠাৎ কামড় দেয়। কল্প আর্তনাদ করে সরিয়ে নেয়৷ ইতি হাসতে হাসতে মুখ ঢেকে নেয় দুইহাতে।

– ‘এটা কি হলো দাগ পড়ে গেছে?’

– ‘ডিম ভেবে কামড় দিয়ে দিছি স্যরি।’

– ‘আমি দেই একটা?’

– ‘কোথায়?’

– ‘এইযে ডিমের কুসুমের মতো মায়াবী গাল, ঠিক মাঝখানে একটা কালো তিল।

– ‘পরে সবাই কামড়ের দাগ দেখে কি বলবে?’

– ‘লোকের কথা বাদ দাও, তুমি ব্যথা পাবে না?’

– ‘ব্যথা সহ্য করে নেব।’

কল্প মুচকি হেঁসে পিঠের দিকে হাত নিয়ে জড়িয়ে ধরে ইতির গালে একটা চুমু দিয়ে বলে, ‘এবার উপরে যাই।’

– ‘আরেকটু বসি, জায়গাটা নিরিবিলি আছে।’

– ‘আচ্ছা ঠিক আছে।’

– ‘ও হ্যাঁ, আরেকদিন দূর থেকে দেখে আমাকে মেসেজে বলেছিলেন আমি কিছুটা মোটা হয়েছি।’

– ‘হ্যাঁ, হয়েছো তো।’

– ‘খারাপ লাগে?’

– ‘না না ভালোই তো লাগে।’

– ‘আজ আপনার মন ভালো মনে হচ্ছে।’

– ‘হ্যাঁ বাড়ি থেকে এলাম। অনেক ঝামেলা শেষ হয়েছে। জায়গা-জমি ভাগাভাগি হলো। বাড়িও পেয়েছি।’

– ‘ওমা আমি বিয়ের পর কি গ্রামে থাকবো?’

– ‘তা না, তুমি আমার সঙ্গেই থাকবে। তবুও নিজের বাড়ি থাকতে হবে না? তোমার পরিবার শেষে বিয়ে দিতে চাইবে না।’

ইতি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো,

– ‘আমার কাছে কিন্তু একটা দুঃসংবাদ আছে। তবুও আমাকে স্বাভাবিক লাগছে তাই না?’

– ‘হ্যাঁ, স্বাভাবিকই তো মনে হচ্ছে।’

– ‘আমি আপনাকে আজ রাতেই দুঃসংবাদটা দিতাম। আপনি দেখা করতে বলার পর ভাবলাম এসে সামনা-সামনি বলবো। আবার রিকশা থেকে আপনার চেহারা দেখে বলতে ইচ্ছা করছে না।’

– ‘আমার চেহারা আবার কি দোষ করছে?’

– ‘দেখেই বুঝতে পারছি আপনার মন ভালো। এই সংবাদ দিলে খারাপ হয়ে যাবে।’

– ‘কি হয়েছে বলো তো। এত প্যাঁচাচ্ছ কেন!’

ইতি কাতর হয়ে ওর গাল রেখে বললো, ‘প্লিজ অস্থির হইয়ো না। পরে বলি? এখনই তোমার মন খারাপ করে দিতে ইচ্ছা করছে না।’

– ‘কি দুঃসংবাদ আল্লাহই জানে।’

– ‘আপনাকে অল্প অল্প দাড়িতে অনেক মায়া লাগে।’

– ‘জানি, তবুও শেভ দিতে ইচ্ছা করে। দাড়ি নিয়ে চলাফেরা অশান্তি মনে হয়। শেভ দিলে কেমন হালকা হালকা লাগে।’

– ‘আপনার যেরকম ভালো লাগে সেভাবে থাকুন, আমি এমনিতে বললাম।’

কল্প ইতির হাতটা এনে চুমু খেয়ে বললো, ‘আর শেভ দেবো না। নিজের মতো না, আমি আমার অভিমানী পাখিটার মতো থাকবো।’

ইতি অবাক হয়ে তাকিয়ে বললো, ‘ওই দেখুন একটা গাছে হলুদ পাখি। অনেক কিউট না?’

– ‘হ্যাঁ, তোমার মতোই।’

– ‘ধ্যাৎ, আচ্ছা আপনি প্রতিদিন কি এখানে আসেন?’

– ‘না।’

– ‘আপনাদের ভার্সিটি অনেক সুন্দর। মনেই হয় না সিলেটে আছি। কোনো জঙ্গলের ভেতরে মনে হচ্ছে।’

– ‘আচ্ছা উপরে যাই।’

– ‘হুম।’

দু’জন উঠে দাঁড়ায়। ইতি হাঁটছে। কল্প চারদিকে তাকিয়ে নিয়ে বললো, ‘দাঁড়াও।’

ইতি পিছু ফিরে বললো, ‘কি?’

– ‘সিঁড়ি থেকে নেমে আসো। এখানে সমান জায়গা আছে।’

ইতি নামতে নামতে বললো, ‘কি?’

কল্প আঁজলা করে ওর মুখটা ধরে কপালে চুমু খায়। ইতি প্রতিবারের মতো চোখবুজে গ্রহণ করে এই স্পর্শটুকু। কল্প তারপর বুকে টেনে আনে। একই জড়িয়ে ধরা, একই চুমু, একই অনুভূতি। তবুও বারবারই যেন ইচ্ছা করে। প্রতিবারই দু’জন হারিয়ে যায় কোথাও। কল্প কানের কাছে ঠোঁট নিয়ে ফিসফিস করে বলে, ‘প্রচণ্ড ভালোবাসি ইতি।’

ইতির কথা বলতে ইচ্ছা করে না। চোখ খুলতেও না। সে নিঃশব্দে, নিভৃতে মিশে থাকে বুকে। খানিক্ষণ কেটে যায় এভাবে। কল্প আচমকা আলগোছে কোলে তুলে নেয়। ইতি কেঁপে উঠে। ঘোর লাগা চোখে তাকায়। একটা অদ্ভুত ঘ্রাণ ইতিকে মাতাল করে রাখে। ঘন জঙ্গলের ভেতরে একটা পাখি ডেকে ডেকে কোথাও ছুটে যাচ্ছে। উপরে উঠে এলো তারা। ইতি মুগ্ধ হয়ে গেল চারপাশে তাকিয়ে। কিছু ছবি তুললো দু’জন। খানিক পর আবার দু’জন একপাশে বসে। কল্প দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে, ‘এবার ম্যাডামের দুঃসংবাদ দাও।’

ইতি কল্পের আরও ঘনিষ্ঠ হয়ে বসে কাঁধে মাথা রেখে বলে,

– ‘প্লিজ শুনে দুশ্চিন্তা করো না। আমি এসব সামলে নেব।’

– ‘আচ্ছা বলো।’

– ‘তাহিদের সাথে আমার বিয়ের কথা হচ্ছে। ওইযে মরিয়ম ফুপুর ছেলে তাহিদ। আমাকে মোবাইল গিফট করেছিল। ডাক্তার তো সে। বাবা-মা সহ সবাই অস্থির হয়ে গেছে বিয়ে দেয়ার জন্য।’

__চলবে…
লেখা: জবরুল ইসলাম

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here