মায়াডোর পর্ব-২৮+২৯

মায়াডোর (২৮ পর্ব)
.
গোধূলিলগ্নে বিষণ্ণ মনে দু’জন ভার্সিটি থেকে ফিরছে। কল্প ফার্নিচারের দোকানের সামনে এসে নেমে যায়। ইতি রিকশা নিয়ে চলে যায় বাসায়। শুক্র-শনিবার কল্পের অফিস বন্ধ থাকে। তাই সপ্তাহে দু’দিন সন্ধ্যায় একটা টিউশনিতে যায়। আজ আর পড়াতে গেল না সে। দরজা ভেতর থেকে লাগিয়ে বিছানায় শুয়ে রইল। এই মুহূর্তে কি করা দরকার ভেবে পাচ্ছে না৷ টাকা-পয়সা নিয়ে তার কোনো অসুবিধা হবে না সে জানে। কিছু টাকা জমেছে। চাকরিও আছে। জমি-জমা থেকে ফসল আসবে। এগুলো দিয়ে আপাতত ভালোই চলে যাবে। তাছাড়া বড়ো চাচা তো আছেনই। উনি চান নিজে দেশে এসে দুইহাতে খরচ করে তার বিয়ে দিতে। সাময়িক মনমালিন্য বাবার মন থেকে নিপাই বুঝিয়ে দূর করে দিয়েছে। এখন তার সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক। সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে তাহিদ। ওকে তার কাছে বিয়ে দেবে কি-না কে জানে। ইতি অবশ্য সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরাসরি জানিয়ে দেবে কল্পের কথা। সেও সম্মতি দিয়েছে। এখন দেখা যাক কি হয়। রাত আটটার দিকে ইতি তাকে মেসেজ দিয়ে জানায়, ‘এখন বাবা বাসায় ফিরেছেন, সরাসরি বলে দিতে যাচ্ছি। খুবই ভয় করছে জানো? তবুও বলে দেবো। ওরা যদি কথাবার্তা পাকা করে ফেলে তাহলে আবার বিয়ে ভা*ঙা কঠিন হয়ে যাবে। তাই আগেভাগেই সাহস করে বলে দেওয়াটা ভালো।’

মেসেজ দেখে কল্পেরও ভয়ে হৃৎস্পন্দন বেড়ে যায়৷ দুরুদুরু বুকে রিপ্লাই দেয় ‘আচ্ছা বলে দাও, যা হবার হবে। প্রথমেই বলবে এখন বিয়ে করতে চাচ্ছ না, পড়ালেখা করতে চাও, এগুলো বলার পরও যদি চাপাচাপি করে তাহলে আমার কথা বলে দেবে। আমি বিয়ের প্রস্তাব পাঠাবো।’

– ‘আচ্ছা এখন বাই, পরে কথা হবে।’

এরপর অন্ধকারে মোবাইল বালিশের পাশে রেখে বিছানায় এপাশ-ওপাশ করে সময় কাটায় তার। কি হচ্ছে এটা ভেবে বারবার ভয়ে গলা শুকিয়ে আসে৷ অন্ধকার হাতড়ে গিয়ে টেবিল থেকে পানি খেয়ে এসে আবার শুয়ে থাকে। এভাবে অস্থিরতার ভেতর দিয়ে দুইঘণ্টা চলে যায়। কিন্তু ইতি কোনো মেসেজ দেয় না। অধৈর্য্য হয়ে সে নিজেই মেসেজ দেয়, ‘ইতি কি অবস্থা? আপডেট কিছু জানাও আমাকে।’

সিন হয় না মেসেজ। ইতিকে অফলাইন দেখায়। কোনো অসুবিধা কি হয়েছে? না-কি এমনিতেই অফলাইনে? কিন্তু পুরো রাত গিয়ে ভোর হয়ে আসে। অনলাইনে আসে না ইতি। পরেরদিন অফিসে যাওয়ার আগে গেইটে দাঁড়িয়ে মুনার জন্য অপেক্ষা করে। হঠাৎ মনে পড়ে ওরা তো ইন্টারের পরীক্ষা দিয়ে দিয়েছে৷ এখনও ভর্তি হয়নি ভার্সিটিতে। ম্লানমুখে কল্প অফিসে চলে যায়। খানিক পর পর মেসেজ চ্যাক করে দেখে ইতি সিন করেছে কি-না। প্রতিবারই হতাশ হয় সে। এভাবে অপেক্ষা করে তিনদিন। তারপর বুঝতে পারে কোনো অসুবিধা হয়েছে। রোজকার মতোই আজ অফিসে যাওয়ার জন্য বের হয়েছিল। বাইরে গিয়েই গেইটের সামনে মুনাকে পায়। সে কোথাও যাচ্ছিল। হাত বাড়িয়ে ডাকে কল্প, ‘মুনা একটা কথা ছিল।’

মুনা রিকশা ছেড়ে দিয়ে ফিরে আসে, ‘কি ভাইয়া?’

– ‘আচ্ছা ইতির কোনো খবর কি জানেন?’

– ‘না তো। বন্ধ হওয়ায় কারও সঙ্গে তেমন কথা হয় না।’

– ‘ও কিছুদিন থেকে অফলাইনে। কোনোভাবেই যোগাযোগ করতে পারছি না।’

– ‘তাই না-কি? হঠাৎ এরকম হবে কেন?’

– ‘হওয়ার অবশ্য কারণ আছে। ওর বিয়ের আলাপ এসেছিল। ফ্যামিলিকে আমার কথা যেদিন বলতে গেছে সেদিনের পর থেকেই অফলাইন।’

– ‘তাহলে তো সমস্যা।’

– ‘আচ্ছা আপনি কি একবার ওদের বাসায় যেতে পারবেন?’

– ‘আচ্ছা কাল একবার যাব। রুমকিকে নিয়ে যেতে হবে। আমি চিনি না ওদের বাসা।’

– ‘আচ্ছা ঠিক আছে। কালই যান তাহলে।’

মুনা মাথা নেড়ে বিদায় নিয়ে চলে যায়। কল্প চলে আসে অফিসে।

এখন ভোর। ক’টা বাজে ইতি জানে না। মা-বাবা তার প্রতি যতটুকু কঠোর হওয়া দরকার, সর্বোচ্চ হয়েছেন। তাদের ধারণা হয়তো মেয়ের চুড়ান্ত কিছু শাস্তি দরকার। তবেই ঠিক হয়ে যাবে৷ প্রেম-পিরিতের ভূ*ত মাথা থেকে নামবে। ইতির কষ্টও হয়, হাসিও পায়৷ জানালা খুলে এখন বাইরে তাকিয়ে আছে। পুরো রাত কেটে গেছে অনিদ্রায়। মা টেবিলে নাশতা রেখে দরজা লাগিয়ে চলে গেছেন। ইতির খেতে ইচ্ছা করছে না। সারাক্ষণ কল্পের কথা ভীষণ মনে পড়ে। আজ তিন-চার দিন হয়ে গেল মানুষটার সঙ্গে কথা বলতে পারছে না৷ সেদিন রাতে মা-বাবা বসে আছেন। ইতি গিয়ে বললো, ‘বাবা আমার কিছু কথা আছে।’

তিনি শার্ট আনলায় রেখে বললেন, ‘কি কথা?’

– ‘আমি এখন বিয়ে করতে চাই না।’

হুস্না বেগম টিভি অফ করে বললেন, ‘কি বললি?’

– ‘বিয়ে করব না এখন। আমি পড়ালেখা করতে চাই।’

মুজিব উদ্দিন এগিয়ে এসে বিছানায় বসে নাক টান দিয়ে বললেন, ‘বিয়ে করবি না কেন? পড়ালেখার জন্য তাই তো?’

– ‘হ্যাঁ।’

– ‘তাহিদ তোকে ঢাকায় ভার্সিটিতে ভর্তি করাবে। বিয়ে করলেও পড়ালেখা করতে পারবি।’

– ‘আমি তাহিদকে বিয়ে করতে চাই না।’

– ‘কেন ওই বেজন্মার সঙ্গে কি এখনও তোর যোগাযোগ আছে?’

– ‘বাজে কথা বলবা না বাবা। ও গালি শোনার মতো এমন কিছুই করেনি।’

হুস্না বেগম চিবিয়ে চিবিয়ে বললেন,

– ‘এক থা*প্পড় দিয়ে মুখে মুখে তর্ক বার করে দেবো। কি মনে করেছিস? কিছু বলিনি বলে ভাবিস না কিছুই বুঝে না মা। সব জানি আমি। বেশি বাড়লে ট্যাং ভে*ঙে বাসায় ফেলে রাখবো।’

– ‘মা অযথা চিল্লাচিল্লি করবা না। আমি সোজাসুজি আগেই বলে দিতে এসেছি। তোমরা বিয়ের পাকা কথা বললে অকারণ ঝামেলা হবে। তাই স্পষ্ট বলে দিলাম আমি বিয়ে করবো না।’

মুজিব উদ্দিন উঠে হঠাৎ ওর হাত ধরে মোবাইল কেড়ে নিয়ে বললেন, ‘হুস্না এই নাও এটা, আর দিবে না ওর কাছে।’

হুস্না বেগম মোবাইল মেঝেতে ছুড়ে ফেলে বললেন, ‘শুধু মোবাইল কেড়ে নিয়ে কি হবে? ওর দিকে তাকিয়ে দেখো কোনো ডর-ভয় কি আছে? বাপ-দাদার মুখে চুনকালি মাখাতে কি এই মেয়ে দ্বিতীয়বার ভাববে মনে করো? দেখবা কালই পালিয়ে চলে গেছে। তাহিদকেই ওর বিয়ে করা লাগবে। ওরে এখনই এখানে বুঝিয়ে রাজি করাও।

– ‘মা আমি সব বুঝেই বলছি এই বিয়ে করবো না। আমাকে বুঝানোর কিছু নেই।’

হুস্না বেগম এসে ‘ঠাস’ করে ওর গালে চ*ড় দিয়ে চুলের মুঠি ধরে মুজিব উদ্দিনকে বললেন, ‘ওদের এতদিন যোগাযোগ ছিল, দেখেছো? তুমি না বলেছিলে কল্প এক ধমকে সোজা হয়ে বাড়ি ছেড়ে চলে গেছে। তাহলে তোমার মেয়ে এখন কেন ডাক্তার জামাই পেয়েও বিয়ে করছে না?’

– ‘শুধু কল্পের দোষ দিলেই কি হবে? তোর মেয়ে কি কম বাড়ছে? দেখলি না কল্পের হয়ে আমার সঙ্গে তর্ক ধরছে।’

‘খবরদার আমার সঙ্গে তুই-তোকারি করবা না’ বলেই হুস্না বেগম ইতিকে টেনে বিছানায় এনে বসিয়ে বললেন, ‘কেন বিয়ে বসবি না বল? কল্পের জন্য, তাই না? ওই ছেলের খবর কিছু জানিস? ওর তো জন্মেরই ঠিক নাই। ওর মাও ন*ষ্টা। তাহিদের মতো ছেলে থাকতে কল্পকে নিয়ে পড়ে আছিস কেন? আগে বয়স কম ছিল। যা ভুল করেছিস, তা অতীত। আমরা কি সেটা নিয়ে কখনও কিছু বলেছি? এগুলো বাদ দে। তাহিদকে বিয়ে কর। সুখে থাকবি।’

ইতি বিছানা থেকে উঠে যেতে যেতে বললো, ‘আমি বিয়ে করলে কল্পকেই করবো।

– ‘বেশি বাড়াবাড়ি করবি না বললাম।’

– ‘আমি শুধু বিয়ে করবো না বলতে এসেছি মা। তোমরাই বাড়াবাড়ি করেছো।’

হুস্না বেগম বিছানা থেকে উঠে আবার মেয়ের হাত ধরলেন, ‘তুই বাড়াবাড়ির দেখেছিস কি? তুই তাহিদকেই বিয়ে করবি। না হলে আমি জন্ম দিয়েছি তোকে। আমিই শেষ করে দিব। ইজ্জত মারবি তুই আর আমরা আঙুল চুষবো মনে করেছিস, তাই না? কল্পের নাম আর মুখে আনবি না কখনও।’

মুজিব উদ্দিন বিছানায় বসে বললেন, ‘ওর পড়ালেখা সব বন্ধ। বাইরে যাওয়াও বন্ধ। ওকে বন্দি করে রাখো৷ তাহিদের সঙ্গেও বিয়ে দেওয়া লাগবে না। ঘরের ভেতরে ওকে খাবার দিবা। দেখি কতদিন নাগরের ভূ*ত মাথায় থাকে।’

হুস্না বেগম স্বামীর দিকে তাকিয়ে বললেন,

– ‘তাহিদকেই ওর বিয়ে করা লাগবে। ও কি বুঝে দুনিয়ার? আমরা তো ভালোর জন্যই বলছি। তাহিদকেই ওর বিয়ে করা লাগবে, এই কথার হেরফের হবে না।’

ইতি নিজের হাত মোচড়াতে মোচড়াতে বলে,

– ‘তোমরা কি এখন জোর করে বিয়ে দেবে আমাকে?’

হুস্না বেগম আরেকটা থা*প্পড় দিয়ে বললেন, ‘হ্যাঁ, আর না দিতে পারলে হাত-পা ভে*ঙে বসিয়ে বসিয়ে খাওয়াবো৷ তবুও ওই ছেলের কাছে পালিয়ে যাওয়ার সুযোগ দেবো না।’

হইচই শুনে নীলা এবং ফরিদ সাহেব এলেন। মুজিব উদ্দিন বললেন, ‘হুস্না ওকে উত্তরের রুমে তালা মেরে রাখ নিয়ে। ওখানে খাবার দিবি। যদি কোনোভাবে ও বাইরে যায় তোমরা কেউ আর বাড়িতে থাকতে পারবা না। সারাক্ষণ চোখে চোখে রাখবা ওরে। সারাদিন কি করো বাসায়? মেয়ে কি করে তার খেয়াল থাকে না।’

ফরিদ সাহেব এসে ইতির হাত ছাড়িয়ে নেয়ার চেষ্টা করে বললেন, ‘আরে কি হয়েছে? তোমরা মেয়েটার সঙ্গে এমন করতেছো কেন?’

হুস্না বেগম রূঢ় গলায় বললেন, ‘বাবা তোমার প্রশ্রয় পেয়ে ও আরও খারাপ হয়েছে। আর তুমিই যুবতী মেয়ে ঘরে রেখে বাইরের একটা ছেলেকে বাসায় জায়গা দিয়েছিলে।’

– ‘এগুলো কি বলো বউমা!’

মুজিব উদ্দিন বললেন, ‘বাবা তুমি তোমার রুমে যাও তো। এসব বুঝবে না তুমি৷ অকারণ এখানে নাক গলাতে এসো না।’

‘আচ্ছা যা ইচ্ছা কর তোরা। আমার কি, তোদের মেয়ে।’ কথাটা বলে ফরিদ সাহেব চলে গেলেন।

মুজিব উদ্দিন এবার নীলার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘আর নীলা, তোমাকেও একটা কথা বলি। তুমি ইতির চাচি, বান্ধবী না, তাই বলছি চাচির মতো থাকবা। তোমার বিছানায় শুয়ে শুয়ে আমার মেয়ে এতকিছু করেছে। তুমি কি জানতে না।’

হুস্না বেগম সুযোগ পেয়ে বললেন, ‘জানলে কি আর তোমাকে বলবে? পারলে আরও এগিয়ে দিবে। সে নিজেই তো এরকম ছিল। আমার মেয়ে কি এমনি এমনিই নষ্ট হয়ে গেছে? সঙ্গদোষের চাক্ষুষ ফল এগুলো।’

নীলা আহত নয়নে তাকিয়ে রইল। হুস্না বেগম সেদিনই ইতিকে টেনে এনে উত্তরের রুমে রেখে বাইর থেকে দরজা তালা দিয়ে চলে যান। রোজ খাবার এনে দিয়ে একগাদা কথা বলেন, বুঝানোর চেষ্টা করেন। শেষপর্যন্ত ইতির নির্লিপ্ত ভাব দেখে আবার রেগে দরজা তালা মেরে চলে যান।

বিকেলে মুনা এবং রুমকি বিজনতা হাউজের সামনে এসে রিকশা থেকে নামে। গেইট খুলে উঠান পেরিয়ে বারান্দার কাছে আসতেই লতিফার সঙ্গে দেখা হয়। সে দরজা খুলে না দিয়ে বললো,

– ‘কে আপনেরা কাকে চান?’

– ‘ইতির বান্ধবী আমরা। ওর কাছে এসেছি।’

লতিফা ভালোভাবে তাকিয়ে বললো, ‘ও আচ্ছা দাঁড়ান’ বলে হুস্না বেগমকে বললো। তিনি এসে দরজা খুলে নিজের রুমে নিয়ে বসালেন। রুমকি সোফায় বসে আমতা-আমতা করে বলে, ‘আন্টি ইতি কোথায়?’

হুস্না বেগম আন্তরিক গলায় বললেন, ‘কখনও আসো না তোমরা। আজ এলে অথচ ইতি ছুটি কাটাতে গিয়ে বসে আছে ওর নানাবাড়ি।’

মুনা আমতা-আমতা করে বললো, ‘ওকে ফোনেও তো পাই না আন্টি।’

– ‘আর বলো না৷ ফোন হারিয়ে ফেলেছে গিয়ে। তোমরা বসো চা-টা খাও। এই লতিফা তাদের নাশতা দে।’

রুমকি আর মুনা মুখ চাওয়া-চাওয়ি করে বললো, ‘থাক আন্টি আমরা এখন যাই। অন্যদিন আসবো।’

– ‘কি বলো কিছু খাবে না?’

‘না আন্টি, এখন যাচ্ছি’ বলেই তারা উঠে যায়। হুস্না বেগম গেইট পর্যন্ত এগিয়ে দেন তাদের।
__চলবে…
লেখা: জবরুল ইসলামমায়াডোর (২৯ পর্ব)
.
কল্পকে মুনা খবরটা দেয় সন্ধ্যায়। কিন্তু কিছুতেই তার বিশ্বাস হয় না। ইতি হুট করে নানাবাড়ি চলে যাওয়ার প্রশ্নই আসে না৷ কল্প কিছু একটা ভেবে মুনাকে তার নাম্বার দিয়ে বলেছে রুমকিকেও দিতে। ইতি কোনোভাবে খবর পাঠাতে পারে তাদের কাছে। মুনা নাম্বার নিয়ে চলে গেছে। কল্প আজও টিউশনিতে গেল না। খুবই চিন্তা হচ্ছে তার। ইতিকে এরা বন্দি করে রাখেনি তো? এখন আসলে সে কি করবে? কি করা উচিত? সুপ্তিকে কল দেয় কল্প। অনেক্ষণ কথা হয় তাদের। সুপ্তি পরামর্শ দেয় আপাতত বিয়ের প্রস্তাব দিতে৷ জোর করে তো আর বিয়ে দিয়ে দেবে না। কল্প পায়চারি করতে করতে বেলকনিতে গিয়ে তার মা’কে কল দেয়। মা বলেন এসব ঝামেলায় কেন জড়িয়েছে সে। কথায় কথায় রাগারাগি হয় তাদের। সে কল কেটে দেয়। পরেরদিন ভোরে হঠাৎ মনে হলো তাহিদকে সবকিছু খুলে বলবে সে। হয়তো সে ব্যাপারটা বুঝবে। বিয়ে ভেঙে দেবে। তখন আর ইতিকে আঁটকে রাখবে না ওরা। কিন্তু তাহিদের নাম্বার তার কাছে নেই। কল দেয় মা’কে। তিনি রিসিভ করলেন,

– ‘হ্যাঁ বল।’

– ‘মা তোমার সঙ্গে দেখা করেছিলাম না ইতির এক ফুপুর বাসায়। ওদের কারও নাম্বার কি আছে?’

– ‘হ্যাঁ আছে, কেন?’

– ‘তাহিদ ভাইয়ের নাম্বারটা দাও আমাকে।’

– ‘কেন, ওর নাম্বার দিয়ে কি করবি? কেন পাগলামি করছিস বাবা? এতদিনে ইংল্যান্ড…। ‘

কল্প থামিয়ে দেয়,

– ‘এসব আলাপ এখন রাখো মা, নাম্বারের দরকার আছে, তুমি পারলে দাও।’

– ‘এনে দিতে হবে। ওর মায়ের নাম্বার আছে।’

– ‘আচ্ছা এনে দাও। এখন রাখছি।’

সে গোসলে ঢুকে। গোসল শেষে অফিসে যাওয়ার জন্য রেডি হয়ে গেইটের কাছে আসতেই মেসেজ টিউন বাজে। মনিরা বেগম তাকে নাম্বার দিয়েছেন। কল্প রিকশা ডেকে উঠে কল দেয় তাহিদকে। দু’বার রিং হতেই রিসিভ হয় ওপাশ থেকে।

– ‘হ্যালো তাহিদ ভাই বলছেন?’

– ‘হ্যাঁ আপনি কে?’

– ‘ভাই আমি কল্প। ইতিকে নিয়ে আপনাদের বাসায় গিয়েছিলাম। মনিরা যে উনার ছেলে।’

– ‘হ্যাঁ চিনতে পেরেছি। কি খবর তোমার?’

– ‘ভাইয়া ভালো না। আপনাকে কিছু দরকারি কথা বলার জন্য কল দিয়েছি। বুঝতে পারছি না কিভাবে নিবেন।’

– ‘কি কথা, বলো কি বলতে চাও।’

– ‘ভাই কথাগুলো ভেবে দেখবেন। কারণ তাতে আপনারও ক্ষতি ছাড়া লাভ হবে না।’

– ‘কি ক্ষতি ছাড়া লাভ হবে না৷ ভূমিকা ছাড়া স্পষ্ট বলো।’

– ‘আপনি এখন ফ্রি আছেন তো?’

– ‘হ্যাঁ আছি।’

– ‘ভাই ইতির সঙ্গে আপনার শুনলাম বিয়ের কথা হচ্ছে?’

– ‘হ্যাঁ, মা তো এমনিতেই বিয়ের জন্য পিছু লেগে আছেন৷ কিছুদিন আগে ইতির কথা বলায় রাজি হয়ে গেলাম।’

– ‘ভাই এই বিয়েটা প্লিজ আপনি ভেঙে দিন।’

– ‘আশ্চর্য কি বলো এসব!’

– ‘হ্যাঁ ভাই, আমার আর ইতির অনেক দিনের সম্পর্ক। এবং আমি জব করছি। সবকিছু গুছিয়ে বিয়ের আলাপ দিতে চাইছিলাম তার আগেই ঝামেলা হয়ে গেল।’

– ‘কি ঝামেলা? আর ইতিও তোমাকে ভালোবাসে তার প্রমাণ কি?’

– ‘ভাই আপনি ইতির সঙ্গে কথা বলে নিন। তাতেই হবে। আমিই বলতাম ইতিকে আপনার কাছে কল দিতে। কিন্তু ওরা মোবাইল কেড়ে নিয়ে ওরা বন্দি করে রেখেছে।’

– ‘কি বলো এসব। বন্দি করে রাখবে কেন?’

– ‘জানি না ভাই। হয়তো জোর করে বিয়ে দিতে চাইছে।’

– ‘পাগল না-কি, জোর করে বিয়ে দিলে শেষে সমস্যা তো হবে আমার।’

– ‘এটুকু বলার ছিল ভাই। আমি আপনাকে স্ক্রিনশট কিছু পাঠাবো। আপনার কাছে বিয়ে না বসার জন্য ইতি শনিবার রাতে বাবাকে বলতে গিয়েছিল। এরপর থেকে সে অফলাইনে। কোনোভাবে যোগাযোগ করতে পারছি না। একবার ভাবুন এভাবে বিয়ে হলে আমাদের তিনজনেরই জীবন নষ্ট হবে।’

– ‘তুমি এখন ফোন রাখো কল্প। আমি দেখছি ব্যাপারটা।

কল্প ফোন রেখে রোজকার মতো অফিসে চলে যায়।

হুস্না বেগমের মোবাইল বেজে উঠে দুপুর দুইটার সময়। কল রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে তাহিদ সালাম দিয়ে বলে, ‘মামী ইতি কোথায়?’

– ‘কেন বাবা?’

– ‘ওর সাথে কথা বলবো আমি।’

– ‘ও তো ঘুমে এখন।’

– ‘তাহলে ওর মোবাইল বন্ধ কেন?’

– ‘কি হয়েছে বলো তো বাবা।’

– ‘মামী আমি মা’কে দিয়ে কল দেওয়াতে পারতাম। নিজেই দিয়েছি। কারণ আমি ইতির মুখ থেকে স্পষ্ট জানতে চাই সে আমার কাছে বিয়ে বসতে রাজি কি-না।’

– ‘কি যে বলো তুমি তাহিদ। আমরা রাজি আছি যেখানে। ওর আবার দ্বিমত কি হবে?’

– ‘ওর দ্বিমত হলে বিয়ের পর ঝামেলা হবে না?’

– ‘বিয়ের পর ওসব ঠিক হয়ে যায় বাবা। এগুলো তুমি ভেবো না।’

– ‘জোর করে বিয়ে দিলে ঠিক হয় না। উল্টো আমার জন্য যন্ত্রণা হবে। আমি জেনেছি ইতির কল্পের সাথে রিলেশন ছিল।’

হুস্না বেগম খানিক থমকে যান। তারপর নিজেকে সামলে হেঁসে বলেন, ‘আরে এগুলো কিছু না। ওই ছেলে তাবিজ-কবচ কিছু করছিল। আর মেয়েটার বয়স কম তো, তাই পাগলামি করেছে। এখন এসব ভুলে গেছে।’

– ‘মামী ধামাচাপা দেন, আর যাই করেন। মেয়েকে আগে বুঝিয়ে বিয়েতে রাজি করান। জোর-জবরদস্তি করে বিয়ে দিলে আমি এসবে নাই। ওর রিলেশন ছিল বা আছে তাতে আমার কোনো সমস্যা নেই। সে এখন আমার কাছে বিয়েতে রাজি কি-না এটা শুধু আমি দেখবো।’

– ‘হ্যাঁ রাজি তো বাবা। এগুলো ভেবো না।’

– ‘মামী বুঝতে পারছো না৷ শেষপর্যন্ত বিয়ে কিন্তু করবো না আমি। এখন তোমরা জোরাজুরি করছো আমি জানি। তাই সময় নিয়ে বুঝাও। বিয়ের আগে আমি ওকে ঠিকই জিজ্ঞেস করবো রাজি কি-না। তাই ধামাচাপা না করে বুঝানোর চেষ্টা করো। আর না পারলে আমার সঙ্গে বিয়ে ভে*ঙে দাও। রাখলাম এখন৷’

হুস্না বেগম মোবাইল রেখে বিছানায় বসে পড়েন। মাথা দপদপ করছে। মুজিব উদ্দিন বাজারে চলে গেছেন৷ কাকে বলবেন এই বিপদের কথা? তিনি চাবি নিয়ে দরজা খুলে ইতির রুমে যান৷ অন্ধকারে বিছানায় শুয়ে আছে ইতি। রুমে আলো দেখে উঠে বসে সে। চোখের নিচে কালি পড়ে গেছে৷ চুলগুলো জট-পাকানো। হুস্না বেগম বিছানায় এসে বসে ওর গাল টিপে ধরে চিবিয়ে চিবিয়ে বললেন, ‘যে নাগরের জন্য মরে যাচ্ছিস সে কি করেছে জানিস? বে*জন্মাটা তাহিদকে সব বলে দিছে৷ এখন দেখ কার জন্য মরে যাচ্ছিস? সে কি তোর ভালো চায়? ভালো চাইলে এই কাজ করতো? যার সঙ্গে বিয়ে ঠিক করেছি তার কাছে ব*দনাম করে বিয়ে ভে*ঙে দিতে চাইছে। সে তো শ*ত্রু। তোর ব*দনাম বলে ভে*ঙে দেওয়ার পায়তারা করে। কেমন শ*য়তানের ঘরের শ*য়তান। এমনিতে মনে হতো একেবারে ফেরেশতা। যাকে যত ফেরেশতা লাগে৷ সে হয় আরও বড়ো শয়*তানের বাচ্চা। আর তাতে হয়েছে কি? বিয়ে কি ভে*ঙে দিতে পারছে? তাহিদ কি ওর মতো ছেলে? তাহিদ উল্টো বলেছে অতীতে যাইই করুক ইতি। যদি সে এখন আমার কাছে বিয়ে বসতে চায় তাহলে আমি বিয়ে করবো। দেখেছিস কেমন সুবোধ ছেলে তাহিদ? টাকা-পয়সা, বংশ সবদিক থেকেই তাহিদ যোগ্য পাত্র। তাই বলছি এসব ঘ্যা*ড়ত্যা*ড়ামো বাদ দিয়ে রাজি হয়ে যা৷ তাহিদের সঙ্গে কথা বল। দেখবি ভালো লাগবে৷ কল্প আর তাহিদের মাঝে আলাদা কি আছে? তাহিদও ছেলে কল্পও ছেলে। উল্টো তাহিদ ডাক্তার। টাকা-পয়সার অভাব নেই।’

– ‘মা কেন ব্যর্থ চেষ্টা করছো? আমি মরে গেলেও কল্পকে ছাড়া বিয়ে করবো না। এই যে এই রুমে আমাকে রেখেছো। জানো? এই রুমে আমি মরে গেলেও শান্তি পাব? এই রুমটায় কল্প থাকতো। আমার কাছে এই রুমের সবকিছু বড়ো আপন। তোমরা যত যাইই করো, আমার উল্টো ভালো লাগছে। গর্ব হচ্ছে। আমি কল্পের জন্য কষ্ট করছি..।’

কথা শেষ করার আগেই হুস্না বেগম চুলের মুঠি ধরে গালে ‘ঠাস’ করে চ*ড় দিয়ে বললেন, ‘তুই ওই বে*জন্মা, রাস্তার ছেলেকে কখনও পাবি না। বিয়ে করলে তাহিদকেই করা লাগবে। নির্লজ্জ মেয়ে। এসব যে বলিস লজ্জা করে না?’

ইতি চুল থেকে হাত টেনে সরিয়ে বলে, ‘অকারণ ওকে কেন গালি দাও? আমি জানি কল্প কেমন মানুষ। আর আমি নির্লজ্জ হতে যাব কেন? ও আমার স্বামী। বিয়ে না করলেও আমি স্বামী মনে করি। শুধু সময়-সুযোগের অভাবে আমরা কাগজপত্রে বিয়েটা করিনি। আমাদের দু’টি মনের সেই পবিত্র বন্ধন বহু আগে থেকে হয়ে গেছে। ওর কথা বলতে আমার কোনো লজ্জা করে না মা।’

হুস্না বেগম আর রাগ ধরে রাখতে পারেন না। গলা চেপে ধরে চিবিয়ে চিবিয়ে বলেন, ‘মনটা তো চায় গলা টিপে মে*রে ফেলিরে ন*টি। সিনেমা দেখে দেখে এগুলো শিখেছিস তাই না? জীবনটাকে সিনেমা পেয়েছিস?’

– ‘নাটক-সিনেমা তো মানুষকে দেখেই বানায় মা। এগুলো আমার মনের কথা। আমার সকল সুখ শান্তি ওই কল্পের বুকে…।’

– ‘কি পেয়েছিস এই খা*নকির ছেলের কাছে? লজ্জা করে না বাপ এসে রাতে অন্ধকার রুমে পেয়েছিল? আমার পেটে তোর মতো খা*নকি কিভাবে জন্ম নিল কিভাবে? বল আমারে?’

– ‘বাজে কথা বলো না মা। আমি নির্লজ্জের মতো হতে চাইনি। শুধু বিয়ে করতে চাই না বলতে গিয়েছিলাম। তোমরাই বাড়াবাড়ি করছো।’

– ‘বিয়ে করবি না কেন? তাহিদের সঙ্গে বিয়ে হলে ভেবে দেখ তোর জীবন কেমন হবে? ঢাকা শহরে থাকবি, নিজের বাসা। ডাক্তার ছেলে। টাকা-পয়সার অভাব নেই। দেশ-বিদেশ ঘুরবি। দামি জামা-কাপড় গহনা পরবি।’

ইতি ফ্যাকাসে মুখে হাসে৷ তারপর দূর্বল গলায় বলে, ‘আর শান্তি? তুমি যা কিছু বললে এগুলো তো নীচু মনের মানুষদের কাজ। যারা অন্যকে দেখানোতে ব্যস্ত। আমি চাই নিজের সুখ-শান্তি। একটা গহনা গায়ে দিলে কি হয়? আরেকজন দেখে বলে বাহ বড়োলোক? তাতে আমার কি? আমার গহনা, দামি পোশাক থেকেও শান্তি কল্পের সঙ্গে থাকতে পারা।’

হুস্ন বেগমের রাগে গা আরও জ্বলে উঠে। চুলের মুঠি ধরে আবার টেনে ধরে পিঠে একের পর এক ঘু*সি মারতে মারতে বলেন,

– ‘তোরে আমার মে*রে ফেললেও মেজাজ ঠাণ্ডা হবে না। এই খা*নকি তোর লজ্জা-শরম কি নাই? এগুলো মুখে আনিস কিভাবে? ওই বে*জন্মার ঘরের বে*জন্মা জাদু-টোনা করছে না-কি? বল আমারে বল?’

ইতির হঠাৎ কি যে হলো। বারবার কল্পকে গালি দেওয়া সে সহ্য করতে পারছে না। আচমকা জোরে ধাক্কা মা*রে মা’কে। হুস্না বেগম ছিটকে গিয়ে পড়েন মেঝেতে। ইতির মাথায় হঠাৎ কিছু একটা আসে। পলকে বিছানা থেকে পা বাড়িয়ে চলে যায় টেবিলে। সেখান থেকে এক লাফে রুমের বাইরে আসে। হুস্না বেগম তাড়াতাড়ি উঠে ‘এই দাঁড়া’ বলে তেড়ে আসার আগেই সে বাইরে থেকে দরজা তালা মেরে দেয়। তারপর আর পিছু ফিরে তাকায় না ইতি। ছুটে যেতে চায়। কিন্তু বারান্দা পেরিয়ে এসেই করিডরের সামনে থমকে দাঁড়ায়।
(আজ রাতেই আরেক পর্ব আসতে পারে। রাতে ঘুমানোর আগে একবার পেইজে উঁকি মে*রে যাবেন)
_চলবে…
লেখা: জবরুল ইসলাম

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here