#মায়াবতী_৫(অন্তিম পর্ব)
কলমে রোকেয়া পপি।
মায়া আজ সবুজ তাঁতের শাড়ি পরেছে।
শ্রেয়া সুন্দর করে চুল বেঁধে খোঁপায় বেলি ফুলের মালা দিয়ে আটকে দিচ্ছে।
মায়া অবাক! সে বিস্মিত হয়ে বললো, এই শ্রেয়া তুই বেলি ফুলের মালা কোথায় পেলি?
আনিয়েছি আপু।
কাকে দিয়ে আনালি?
সে জেনে তোমার কাজ নেই।
তোমাকে এখন দেখাচ্ছে পরীদের রানীর মতো। দাঁড়াও আমার কাছে লাল চুড়ি আছে কিনা দেখি। সবুজ শাড়ির সাথে কিন্তু সবুজ যায় না। পরতে হয় লাল।
লাল সবুজে মাখামাখি। বাংলাদেশের পতাকা।
হা হা হা।
মায়া ফিক করে হেসে ফেললো। তোর সব কিছুতেই ফাজলামি।
ফাজলামি না আপু, সিরিয়াসলি ।
এই দেখো, দেখেছো কি সুন্দর মানিয়েছে। শ্রেয়া খুব যত্ন করে চুড়িগুলো পড়িয়ে দিলো। সাথে বড়ো বড়ো দুটো ঝুমকা।
আপু গলায় কিছু পরবে?
শুধু ঝুমকো আর খোঁপায় ফুল, তাতেই তোমার দিক থেকে চোখ ফেরাতে পারছি না।
মায়া বললো নারে আর কিছু পরবো না। বেশি সাজলে আমাকে জবরজং লাগে।
এর মধ্যে গাড়ির আওয়াজ শুনে শ্রেয়া দৌড়। আপু ওরা এসে গেছে মনে হয়।
মায়ার বুকের মধ্যে ধুকধুক করতে লাগলো। গলা শুকিয়ে কাঠ। হাত পা অবশ হয়ে আসছে। ইদানিং খুব অল্পতেই এমন বুক ধড়ফড় করে। আগে এমন হতো না।যতো দিন যাচ্ছে ততই বাড়ছে। কে জানে হার্টের কোন সমস্যা হলো কিনা।
মেহমানরা বসার রুমে বসেছেন। অনেক রকমের মিষ্টি, ফল আর কেক নিয়ে আসছে শুভ্রর বাবা মা।
শ্রেয়া তার বাবাকে ও হুইল চেয়ারে করে মেহমানদের পাশে বসিয়ে দিয়ে গেছে।
মায়া খুব সহজ ভঙ্গিতে চায়ের ট্রে নিয়ে ঢুকলো। সে ধরেই নিয়েছিলো, সে ঢোকা মাত্র সবাই একসঙ্গে তাকাবে আর সাথে সাথে তার হাত পা ঠান্ডা হয়ে যাবে। কিন্তু তেমন কিছুই হলোনা। শুধু শুভ্রর সাথে চোখাচোখি হলো।
মায়ার চোখে চোখ পড়া মাত্র শুভ্র একটা ধাক্কার মতো খেলো। টেবিলে অনেক নাস্তার আয়োজন থাকলেও কেউ কোন খাবারে হাত দেয়নি। শুধু শুভ্রর বাবা একপিচ সিঙ্গারার এক কোনা ভেঙে খেয়েছে।
মায়া চা ঢেলে দেওয়া মাত্র সবাই চা খেয়ে প্রশংসা করলেও শুভ্রর মা কাপের এককোনে ঠোঁট ছুঁইয়েছে মাত্র।
কথা যা বলার শুভর বাবা বলছেন, শায়লা বানু একদম চুপচাপ। তার ভাবখানা এমন তাকে কোন নর্দমায় এনে ফেলে দেওয়া হয়েছে। কপাল কুঁচকে আছে। আর আচরণ ও খুব ঠান্ডা!
শায়লা বানু ব্যাগ থেকে আংটিটা বের করে শুভ্রকে কাছে ডাকলেন। শায়লা বানু খুব নরম স্বরে প্রায় ফিসফিস করে বললেন, রিং টা পড়ানোর আগে তুমি কি আরেকবার চিন্তা করতে চাও?
না আম্মু।
আমার ডিসিশন ফাইনাল। আমি মায়াকে চাই।
শায়লা বানু থমথমে মুখে বললো, ওকে ।
শায়লা বানু মনে মনে ছেলের ওপরে একটু বিরক্ত। তারা চাইলেই তাদের ছেলের জন্য আরো অনেক বড়ো ঘর থেকে সুন্দরী কোন মেয়ে আনতে পারে। কিন্তু শুভ্র তাদের অনেক আদরের একমাত্র সন্তান। চাওয়ার আগে সব এনে হাজির করা হয় শুভ্রর সামনে। সেই ছেলে যখন মুখ ফুটে বিয়ের কথা বলেছে, তখন আর পিছিয়ে যাওয়ার কোন কারণ নেই। অনিচ্ছা সত্ত্বেও ব্যাগ থেকে রিং বের করে শুভ্রর হাতে দিল, স্মিত হেসে বললো, তাহলে পরিয়ে দাও।
রিং পরানোর সময় শুভ্র মিটমিট করে হাসছে, যেটাকে বলে দুষ্টুমি হাসি।
মায়া আড় চোখে সবকিছুই দেখছে। ওর গাল দুটো রক্তিম বর্ন ধারন করেছে শুভ্রর দুষ্টুমি মার্কা হাসি দেখে।
শায়লা বানু একবারে বিয়ের দিন তারিখও ঠিক করে বিদায় নিলেন।
ছালেহা বেগম প্রথমে কিছুতেই রাজি হচ্ছিলো না কনভেনশন সেন্টারে অনুষ্ঠান করতে।
তার এক কথা কিছুদিন আগে তার ছোট মেয়ের বিয়ে উপলক্ষে অনেক টাকা পয়সা খরচ হয়েছে। এখন তার পক্ষে অনুষ্ঠান করে বিয়ে দেওয়া সম্ভব নয়। তারা অল্প কয়েকজন মিলে বাসায় এসে বিয়ে পড়িয়ে যেন মেয়ে নিয়ে যায়।
শেষ পর্যন্ত শুভ্রর বাবার মধ্যস্থতায় সব ঠিক হয়েছে।
একি কনভেনশন সেন্টারে একসাথে রিসিপশন পার্টি হবে। খরচ ছেলে পক্ষ বহন করবে। বিয়ের দিন সার্বক্ষণিক এর জন্য একটা গাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হবে।ওরা পার্লার ঠিক করে দিবে। ওখান থেকে সেজে মায়া কনভেনশন হলে চলে যাবে।
মায়ার পেছনে তেমন কোন খরচ করতে হবে না জেনে ছালেহা বেগম মহা খুশি। বিনা বাক্য ব্যয়ে তিনি বেয়াইয়ের সব কথা মেনে নিলেন।
মায়ার কিছু গয়না আছে সেগুলো পালিস করতে পাঠানো হয়েছে। এর বাহিরে আর কোন কিছু করতে তিনি নারাজ।
আংটি টার দিকে যতোবার চোখ পড়ছে, মায়ার চোখ আপনা আপনি ভিজে উঠছে। বুকের ভেতর এক ধরনের চাপা কষ্ট অনুভব করছে। বাবাকে ছেড়ে চলে যেতে হবে, এটা ভাবলেই নিজের অজান্তেই ভেতর থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস বের হয়ে আসছে। শ্রেয়া পারবে তো ঠিক মতো বাবার যত্ন আত্তি করতে! এটা ভেবেও সে খুব চিন্তিত। কারণ বাবার সেবা যত্ন পুরোটাই মায়া করতো। শ্রেয়া সবসময় একটু ছটফটে এবং নিজেকে নিয়ে বেশি ব্যস্ত।
কি এতো ভাবছিস আপা? আয় বিছানায় শুয়ে শুয়ে গল্প করি। শ্রেয়া এক রকম হাত ধরে টানতে টানতে বিছানায় নিয়ে আসলো মায়াকে। আপা লাইটা অফ করে দেই?
মায়া মাথা কাত করে সম্মতি জানালো।
আপা খেয়াল করেছিস বাতি নিভিয়ে গল্প করার অন্য রকম একটা মজা আছে। যেটা আলোতে গল্প করে পাওয়া যায় না।
হুম।
কি এতো হুম হুম করছিস! কেন এতো মন খারাপ করে রাখছিস আপা? একটু হাস তো।
হাসবে কি! মায়ার এখন দু চোখ আবেগে ভিজে উঠতে চাইছে। ভাগ্যিস রুমটা অন্ধকার।
আপা শোন মন খারাপ করিস না। মা তো এমনই। দেখিস তুই খুব সুখী হবি। আমার মন বলছে তোর দুঃখের পালা শেষ। তোর নতুন জীবন শুরু হবে চমৎকার ভাবে।
সে জীবনে কোন দুঃখ, কষ্ট তোকে স্পর্শ করতে পারবে না। এই আমি বলে রাখলাম।
খুব পেকেছিস না। মায়া শ্রেয়ার গালটা টিপে দিয়ে বোন কে আদর করে জড়িয়ে ধরলো আর মনে মনে বললো, তোর কথা যেন সত্যি হয় বোন। অনেক রাত হয়েছে এখন ঘুমা বোন।
আপা তুই কি আমাকে এখনো ছোট মনে করিস?
মায়া ফিক করে হেসে দিয়ে বললো, ছোটই তো।
আমি অনেক বড়ো হয়ে গেছি আপা। তোর চেয়ে ও অনেক বড়ো। তোর তো এখনো বিয়ে হয়নি। আর আমি …
অন্ধকারে শ্রেয়ার হাসি শোনা যাচ্ছে। হাসির শব্দটা কি করুন শোনাচ্ছে। হয়তো শ্রেয়া কাঁদছে। ওর চোখের পানি মায়া দেখতে পাচ্ছে না, কিন্তু অনুভব করতে পারছে।
বোনের কষ্ট ওকে ছুঁয়ে দিচ্ছে। ও শ্রেয়ার কপালে আলতো করে চুমু দিয়ে বললো, চুপ কর বোন। এসব ভুলে যা। আর কখনো এসব মুখে আনবি না। আয় আমি তোর চুলে বিলি কেটে ঘুম পাড়িয়ে দেই।
পার্লার থেকে সাজার পর মায়া নিজেই নিজেকে চিনতে পারছেনা। সাজানোটা খুব সুন্দর হয়েছে।
কোন রকম কোন ঝামেলা ছাড়াই খুব সুন্দর ভাবে ওদের বিয়েটা সম্পর্ণ হয়েছে। মায়ার কাছে সবকিছু স্বপ্নের মতো লাগছে। ওর মতো একটা সাধারন মেয়ের বিয়ে এতো জাঁকজমকপূর্ণ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে হলো, তাও আবার কোন ঝামেলা ছাড়াই! তবে ও খেয়াল করেছে ওর মা সবসময় মুখটা কেমন অন্ধকার করে রেখেছে।
গাড়ি থেকে নেমে শুভ্রদের বাড়ি দেখে মায়া হকচকিয়ে গেল। সে অনেক বার শুনেছে শুভ্রদের বিশাল আলিশান বাড়ি, বিশাল ব্যাবসা।
সেই বিশাল বাড়ি যে এমন হুলস্থুল তা সে বুঝতে পারেনি। এমন বাড়ির একটা ছেলে হয়ে শুভ্রর মধ্যে কোন অহংকার নেই!
মেয়ে কে বিদায় দিয়ে এসে ছালেহা বেগম ইনিয়ে বিনিয়ে কান্না করছে। তার মেজাজ আজ সপ্তমে। সে ভাবতেও পারেনি মায়ার মতো এমন অবহেলা অযত্নে বেড়ে ওঠা কালো একটা মেয়ের এতো বড় ঘরে বিয়ে হবে।
মায়ার শশুর বাড়ির আর্থিক অবস্থা দেখে তার মাথা খারাপের মতো হয়ে গেছে। মুখে যা আসছে বলেই চলেছে।
শ্রেয়া খুব বিরক্ত তার মায়ের ওপর। বেশ শক্ত করে এক ধমক দিয়ে বললো, মা তুমি একটু থামবে!
থামবো কেন?
তোকে এতো যত্ন করে বড়ো করলাম। দেখতেও তো তুই কম সুন্দর না। তোর বিয়েতে কতো টাকা খরচ করলাম। তারপর ও তোর কপাল পোড়া কেন? শাড়ির আঁচলে নাকের পানি মুছতে মুছতে আবার বলা শুরু করলো,
আর মায়ার কপাল দেখ। টাকা পয়সা খরচ করলাম না, তারপরও কতো দামী দামী শাড়ি, গহনা! কতো টাকা খরচ করে কতোবড়ো আয়োজন করে মায়াকে নিয়ে গেল। বিয়ে হতে না হতেই এখন আবার কি সুন্দর নেপালে হানিমুনে ও গেছে। যেই মেয়েকে কোনদিন কোথাও ঘুরতে নিয়ে গেলাম না। সেই মেয়ে কিনা দেশের বাইরে চলে গেল ঘুরতে!
শ্রেয়া ঠোঁট বাঁকিয়ে বললো, খুব ভালো হয়েছে।
তুমি যে আপন মা না, সেটা প্রতি মুহূর্তে আপাকে বুঝিয়ে দিয়েছো। আপা তো কখনো তোমাকে সৎ মায়ের চোখে দেখে নি। তোমাকে অসন্মাণ করেনি। তার পর ও কখনো আপার একটু ভালো চাওনি তুমি। তোমার এতো এতো লোভ যে, তা বলার জন্য আমি সঠিক ভাষা ও খুঁজে পাচ্ছি না।
তুমি যেই দেখলে আপুর জন্য একটা ভালো প্রপোজাল আসছে, ওমনি আপুর সাথে আমাকে জোর করে ছেলের সামনে পাঠিয়ে দিলে।
কারণ তুমি জানো আমাকে দেখলে আপুকে কেউ পছন্দ করবে না।
শোন আল্লাহ বলে কেউ একজন আছে। তিনি ছাড় দেন, কিন্তু ছেড়ে দেন না। তার হিসাব অন্য রকম। তিনি সব কিছু আগে থেকেই ঠিক করে রাখেন।
আল্লাহ নিজ হাতে যে প্লান তৈরি করে রেখেছেন, সেই প্লান বানচাল করার তুমি কে?
তুমি যতোই তোমার নিজের মেয়ের ভাগ্য সুন্দর করতে চাও না কেন, তোমার পাপের শাস্তি তোমার সন্তান ভোগ করবেই।
এটাই আল্লাহর বিচার।
ছালেহা বেগমের কান্নার বেগ আরেকটু বেড়েছে। তিনি নাকের পানি, চোখের পানি এক করে বললেন,
যার জন্য করি চুরি সেই বলে চোর!
খোদা তুমি আমাকে উঠিয়ে নিয়ে যাও। আমার আর বেঁচে থাকার ইচ্ছে নেই। পেটের সন্তান মায়ের সাথে কিভাবে কথা বলে!
পাশের রুমে বিছানায় শুয়ে শুয়ে মায়ার বাবা হাসছেন, আর ক্রমাগত চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়ছে পানি। তিনি মনে মনে বললেন, এই দিনটির অপেক্ষায় ছিলাম ছালেহা বেগম। আমি এই দিনটি দেখার জন্য বেঁচে ছিলাম। এখন মরে গেলেও আমার আর কোন দুঃখ থাকবে না।