মায়ায় জড়ানো সেই তুমি পর্ব -২৮

#মায়ায়_জড়ানো_সেই_তুমি
#পার্ট_২৮
জাওয়াদ জামী

তানিশা গভীর ঘুমে মগ্ন। সাদিফ তানিশার উপর ঝুঁকে আছে। তার চোখে টলটল করছে অশ্রু। একপাশে তূর্ণা ঘুমিয়ে আছে। অতি সন্তর্পনে তানিশাকে নিজের দিকে সরিয়ে নেয় সাদিফ৷ একে একে বেশ কয়েকটা চুমু দেয় তানিশার চোখেমুখে। সেই সাথে চোখ থেকে টুপ টুপ করে অশ্রু ঝরছে। নিজেকে আজ তার অপরাধী মনে হচ্ছে। কেন সে তানিশাকে এ অবস্থায় একা রেখে গেল। মেয়েটার মুখ জুড়ে ক্লান্তির রেশ। এত যত্নের পরও কোন উন্নতি হয়নি। এটাই সাদিফকে ভাবাচ্ছে। বালিশের চারপাশে ছড়িয়ে থাকা ঘন কালো কেশরাশিতে হাত বুলিয়ে দিতে থাকে। একসময় ওকে আলতো করে জড়িয়ে ধরে নিজেও ঘুমিয়ে পরে।

সকালে সাদিফের বাহুডোরে নিজেকে দেখে অবাক হয় তানিশা। কখন এসেছে তারা! আমাকে ডাকলনা কেন! তানিশার নড়াচড়ায় সাদিফের ঘুম ভেঙে যায়।
” গুড মর্নিং বউ। এখন নিজেও ঘুমাও আর আমাকেও ঘুমাতে দাও প্লিজ। ” তানিশার পেটে হাত সাদিফের।
” গুড মর্নিং বলে আবার ঘুমাতে চাচ্ছেন! আজব তো। সকাল হয়েছে। এখন উঠে পড়ুন। আর আপনারা এসেছেন আমাকে ডাকেননি কেন? আমার বোনটাকে বউ সাজে দেখতে পারলামনা। এখন ওর কাছে আমাকে নিয়ে চলুন। ” তানিশার মুখ ভার হয়ে গেছে।
এক লাফে উঠে বসে সাদিফ। দু’হাতের আঁজলায় তানিশার মুখ নিয়ে ঠোঁটে আলতো করে চুমু আঁকে।
” আমার বউ দেখছি পা*গ*ল হয়ে যাচ্ছে দিনদিন। ওরা এখনই ঘুম থেকে উঠবে বলে মনে হয় তোমার! রাতে দুজন ঘুমিয়েছে মনে কর! নতুন নতুন জুটিদের রাতে ঘুম হয় বুঝি! ” এক ভ্রু উঁচিয়ে তানিশার দিকে তাকিয়ে আছে সাদিফ।
” ছিহ্ বড় ভাইয়ের কথা বুঝি এমন হয়! নি*র্ল*জ্জ*তা*র সীমারেখা দিনদিন পার করে যাচ্ছেন দেখছি। ঠিক আছে ওরা উঠলেই তবে আমাকে নিয়ে যাবেন। ”
” বউ, তোমার কি মনে হয়, আমি উঁকিঝুঁকি মেরে দেখব ওরা কখন উঠবে! ছিহ্ আমি বড় ভাই হয়ে তাদের দরজায় উঁকি দিব। ” সাদিফের গলায় দুষ্টুমির ছাপ।
” এখন উঠুন না। আমাকে ওয়াশরুমে নিয়ে চলুন। আমার খুব ক্ষুধা লেগেছে। ”
” চলো বউ। ফ্রেশ হয়ে এসে একটু অপেক্ষা করো আমি খাবার নিয়ে আসছি। ওয়াশরুমের দরজা খোলাই থাক। তুমি একা বের হওয়ার চেষ্টা করনা। ” তানিশাকে ধরে ওয়াশরুমে নিয়ে যায়।

সাদিফ নিচে এসে দুইটা ডিম সেদ্ধ, কলা, ব্রেড আর মাখন নিয়ে উপরে আসে। ততক্ষণে তানিশাও ফ্রেশ হয়েছে। সাদিফ এসে তানিশাকে ওয়াশরুম থেকে নিয়ে আসে। তানিশা বিছানায় বসলে সাদিফ ওয়াশরুমে ঢুকে। তানিশার ক্ষুধা লাগায় খেতে শুরু করে।
কিছুক্ষণ পর তূর্ণা ঘুম থেকে উঠলে সাদিফ মেয়েকে ফ্রেশ করিয়ে দেয়। তানিশাকে রেষ্ট করতে বলে মেয়েকে নিয়ে নিচে আসে। ছোট চাচার মেয়েকে তানিশার কাছে পাঠিয়ে দেয়।

ঘুম ভাঙ্গলে ঘড়ির দিকে চোখ যায় তিয়াসার। ঘড়ির কাঁটা নয়টার দিকে নির্দেশ করছে। লাফ দিয়ে বসে তিয়াসা। ওর লজ্জা লাগছে বিয়ের পর প্রথম দিনই ঘুম থেকে উঠতে নয়টা বাজিয়ে দিয়েছে। সবাই কি ভাববে। পাশে তাকিয়ে দেখে সাইফ টান হয়ে হয়ে কপালে ডান হাত ভাঁজ করে রেখে ঘুমাচ্ছে। ফ্যানের বাতাসে এদিকসেদিক উড়ছে অবাদ্ধ চুলগুলো৷ অনেক কষ্টে তিয়াসা তার চুল এলোমেলো করার ইচ্ছা দমিয়ে রাখে।
” মিষ্টার আনরোমান্টিক ভূত, ঘুমালেও আপনাকে সেই লেবেলের কিউট লাগে। ঠিক যেন কিউটের ডিব্বা। ইশ, আমি কল্পনা করতে পারছিনা এতদিন যাকে লুকিয়ে লুকিয়ে দেখতাম আজ তার রুমেই আমার বাস। আর আপনাকে লুকিয়ে দেখতে হবেনা। ভাবতেই কি যে সুখ সুখ অনুভূতি হচ্ছে বুকের ভিতর। ”
ফ্রেশ হয়ে তিয়াসা বারান্দায় এসে দাঁড়ায়। আজ নিচে যেতে কেমন লজ্জা লজ্জা লাগছে।
” তোমাকে নিচে ডাকছে, যাও। সবাই অপেক্ষা করছে তোমার জন্য। ” ঘুমে ঢুলুঢুলু চোখে দাঁড়িয়ে আছে সাইফ।
ইশ, এত মাদকতা কেন ঐ গলায়! কি আছে এই লোকটার মাঝে যার দুর্নিবার আকর্ষনে তিয়াসা বারবার নিজেকে হারিয়ে ফেলে! চুম্বক আছে নাকি লোকটার মাঝে, শুধু তার সাথে সেঁটে থাকতে ইচ্ছে করে!
” এই মেয়ে, তুমি থেকে থেকে কোথায় হারিয়ে যাও? আমার কাজিনরা সবাই তোমার জন্য দরজার বাইরে অপেক্ষা করছে। ”
তিয়াসা প্রায় দৌড়ে রুমের বাইরে আসে। সেখানে ওর জন্য কয়েকজন অপেক্ষা করছিল। তিয়াসা প্রথমে তানিশার কাছে যায়। তানিশা বসে বসে তসবিহ পাঠ করছিল। তিয়াসাকে দেখে হাত বাড়িয়ে নিজের কাছে ডাকে। তিয়াসা এসে বোনকে দু’হাতে জড়িয়ে ধরে।
” তুমি এখন কেমন আছো আপু? খেয়েছ কিছু? ”
” আমি আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি। তুই ভালো আছিস তো? তোদের দুজনের মধ্যে সব
ঠিকঠাক আছে তো? সাইফ তোকে মেনে নিয়েছে? ”
তিয়াসা একটু অপ্রস্তুত হয়ে যায়। ইতিউতি করে জবাব দেয়, ” আমাদের মধ্যে সবকিছুই ঠিক আছে আপু। তিনি ভাইয়াকে খুব ভালোবাসেন তাই ভাইয়ার অসম্মান হয় এমন কিছুই করবেনা। তাই আমাকেও মেনে না নেয়ার প্রশ্নই আসেনা। ” দুই বোন মিলে কিছুক্ষণ সময় কাটিয়ে তিয়াসা নিচে আসে। শায়লা চৌধুরী তার ননদ, জা সবার সাথে তিয়াসাকে পরিচয় করিয়ে দেয়। তারপর তাদের সাথে তিয়াসাকে খেতে দিয়ে তিনি তানিশার জন্য খাবার নিয়ে উপরে আসেন।

তানিশা শ্বাশুড়িকে দেখে মৃদু হাসে।
” বউমা, একটু উঠে বস। আমি তোমাকে খাইয়ে দিই। ”
” মা আমি খেয়েছিতো। আপনারা সবাই খেয়েছেন? তূর্ণা আপনার ছেলে ওরা খেয়েছে? ”
শায়লা চৌধুরী পরোটার সাথে মাংস নিতে নিতে জবাব দেয়, ” তূর্ণাকে আমি খাইয়ে দিয়েছি। সাদিফ ওর বাবা-চাচাদের সাথে খেয়েছে। আর তিয়াসা খাচ্ছে। এবার তুমি খাওতো। ”
” আপনি, সাইরা খেয়েছেন? আপনাদের ওপর দিয়ে খুব ধকল যাচ্ছে অথচ আমি কোন সাহায্য করতে পারছিনা। ” তানিশার মনটা খারাপ হয়ে যায়।
” বড় বউমা, এটা কেমন কথা! তুমি আগে সুস্থ হও তারপর নিজের হাতে সব কর। আমার ছেলে আর সাইরার ভাইয়ের বিয়ে একটুআধটু কাজতো আমাদের করতেই হবে। তুমি এসব নিয়ে চিন্তা করোনা। আগে নিজে সম্পূর্ণ সুস্থ হও তারপর সব চিন্তা মাথায় নিও। এবার তোমরা দুই বোন সংসারের দ্বায়িত্ব নিজেদের হাতে নিয়ে আমাকে ছুটি দিও। ”
” আপনার কোন ছুটি নেই মা। আমারদের মাথার ওপর ছায়া হয়ে সর্বদাই থাকতে হবে। ”
” তোমার মত বউমা নামের একটা মেয়ে যে বাড়িতে থাকে সেখানে ছায়া দিতে কারো থাকতে হয়না। এমনিতেই বটবৃক্ষ সেখানে জন্মায়। আর নিজের ছায়াতলে সবাইকে শীতল রাখে। ”

রবিবার সকাল এগারোটার মধ্যেই তালিব শেখ আত্মীয় স্বজনদের নিয়ে ঢাকায় পৌঁছেছে। চৌধুরী বাড়ি আজ লোকজনের পদচারণায় মুখরিত। সাদিফ সকাল থেকেই কাজে ব্যস্ত। সাইফও ভাইয়ের সাথে কাজে হাত লাগাচ্ছে। তালিব শেখ প্রথমেই আসেন বড় মেয়ের কাছে। তার সাথে তার ভাই-বোনেরাও আছে। রুমে ঢুকেই মেয়েকে কিছুক্ষণ বুকে জরিয়ে রাখেন। মেয়ের অবস্থা দেখে তার ভিষণ কষ্ট হচ্ছে। তৃষ্ণা, তানিম এসে ওদের আপুর সাথে দেখা করে তিয়াসার কাছে যায়।

বিকেলের দিকে তালিব শেখ আত্মীয় স্বজনদের নিয়ে রওনা দেন। আজ তিয়াসার যাওয়া হবেনা।সাইফের ছুটি নেই তাই তাদের যাওয়া হচ্ছেনা। তবে জামিল চৌধুরী বেয়াইকে কথা দিয়েছেন সাইফ ছুটি পেলেই তিয়াসাকে নিয়ে কদম তলী থেকে ঘুরে আসবে। তালিব শেখ মনমরা হয়ে বিদায় নিলেন কন্যাদের কাছ থেকে।

তানিশার হাত-পায়ে পানি জমেছে। মাঝেমধ্যেই প্রচন্ড ব্যথা করে। আজ সেই দুপুর থেকে ব্যথা করছে। কিছুতেই শান্তি পাচ্ছেনা। তিয়াসা বিকেল পর্যন্ত ম্যাসাজ করে দিয়েছে। ও আরও কিছু সময় দিতে চেয়েছে কিন্তু তানিশা আর নেয়নি। সাদিফ অফিস থেকে ফিরে দেখল তানিশা বিছানায় শুয়ে ছটফট করছে। সে তানিয়া মাথার পাশে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়।
” খুব কষ্ট হচ্ছে, বউ? কোথায় কষ্ট হচ্ছে আমাকে বল। ”
” আপনি আগে ফ্রেশ হয়ে আসুন। আপনার শরীরে বিশ্রী গন্ধ। আমার বমি পাচ্ছে। ” সাদিফ হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে থাকে তানিশার দিকে। মাথা নিচু করে শুঁকে দেখে গন্ধ আছে কিনা। আশ্চর্য কোন গন্ধ নেই। সে এসি রুমে বসে কাজ করেছে। বাসায় এসেছে এসি গাড়িতে করে। গন্ধ কোথা থেকে আসবে! একটু ঘামের ছিটেফোঁটাও নেই শরীরে! তবে এটা সে শুনে আসছে এই আটমাস যাবৎ। সে কাছে আসলেই তানিশার গন্ধ লাগে। তাই আজকাল নিজেকে দুর্গন্ধের ডাষ্টবিন মনে হয়।
সাদিফ ফ্রেশ হয়ে এসে তানিশার কাছে বসে।
” বউ, এবার বল তোমার কি হয়েছে? ”
” হাত-পা খুব ব্যথা করছে। ” তানিশার আর কিছুই বলতে হয়না। সাদিফ তানিশার পা নিজের কোলের উপর নিয়ে ধীরে ধীরে ম্যাসাজ করে দেয়। অনেক সময় ধরে হাত-পা ম্যাসার করে দেয়। এতে আরাম পেয়ে একসময় ঘুমিয়ে পরে তানিশা। এরপর সাদিফ তূর্ণার খোঁজ করে। তূর্ণা ওর দাদুর সাথে আছে। সে মেয়েকে ডেকে নিজের হাতে খাইয়ে দেয়। এরপর সবার সাথে বসে খেয়ে নেয়। আর তিয়াসাকে তানিশার জন্য খাবার রাখতে বলে। ও ঘুম থেকে জাগলেই খাইয়ে দিবে। মেয়েকে নিয়ে রুমে আসে সাদিফ। মেয়েকে ঘুমিয়ে দিয়ে তানিশার পাশে বসে থাকে। ঘুমন্ত স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে ভাবতে থাকে, কখনও কি ভেবেছিল এই মেয়েটা তার জীবনের সব হবে। অথচ কত অবহেলাই না করেছে একটা সময়! আজ এই মেয়েটা তার আসক্তিতে পরিনত হয়েছে। এত মায়া কেন এই মেয়েটার মাঝে! এ কি মায়ায় জড়ালো সে সাদিফকে৷ যার মায়া কাটিয়ে ওঠা কয়েক জন্মেও সাদিফের পক্ষে সম্ভব নয়। কত ভালোবাসার একটা সংসার দিয়েছে, একটা পুতুলের মত সন্তান দিয়েছে আর দিয়েছে এর আকাশ ভালোবাসা। এতটা নিঃস্বার্থ কিভাবে হতে পেরেছে সে! আবেগে সাদিফের দুচোখ ভাসে। নিজের মাঝে শক্ত করে আঁকড়ে ধরে তানিশাকে।

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here