মায়ার বাঁধন পর্ব -৯+১০

#মায়ার_বাঁধন🍂
০৯.
সিঙ্গেল সোফায় বসে আয়েশ করে খাবার খাচ্ছে তুরান।
তা মুগ্ধ দৃষ্টিতে উপভোগ করছে নীরা। খিদের তাড়নায় তুরানের ডানে বামে হুঁশ নেই। নিজের মনে খেয়ে চলেছে।
পেট যখন ভরে এসেছে প্রায় অকস্মাৎ তার চোখ আটকায় নীরাতে। ভ্রু জোড়া কুঞ্চিত হয়। সন্দিহান কন্ঠে বলে,

-“এভাবে তাকিয়ে আছো কেন? খিদে পেয়েছে? তাহলে খাবার নিয়ে এসে খেয়ে নাও।”

নীরার চেতনা ভঙ্গুর হয়। তড়িৎ গতিতে মাথা নাড়ায় যার অর্থ না। তার খিদে পায়নি। তুরানের কুঞ্চিত ভ্রু এমন উত্তর পেয়ে দ্বিগুণ কুঞ্চিত হয়। নিরেট কন্ঠে শুধায়,

-“তাহলে?”

নীরা ভ্যাবাচ্যাকা খায়। কী বলবে এখন সে? সে যে ভ্যাবলার মতো চেয়ে চেয়ে তুরানকে দেখছিল এটা তো কিছুতেই বলা চলবে না। সে কী ছ্যাচড়া নাকি? কিন্তু বলবে টা কী এখন? ভেবেচিন্তে হঠাৎ মাথায় এক বুদ্ধি আসে। বলে দেয়,

-“এটাই দেখছিলাম যে, এতো এতো খাবার কীভাবে রা’ক্ষ’সের মতো এক মুহূর্তে ফিনিস করে ফেললেন। দেখতে মনে হচ্ছিল কয়েক বছরের অভুক্ত মানব।”

তুরান এতক্ষণে খাবার শেষ করে হাত ধুয়ে নিয়েছে। নীরা কথাগুলো বলতে বলতে সেই সুযোগে থালাবাসন গুছিয়ে নিয়েছে। বাক্যগুলো সম্পূর্ণ হতেই সেখান থেকে এক প্রকার ছুটে চলে গেল। তুরান আহাম্মকের মতো বসে। নীরার কথাগুলো মস্তিষ্কে ঢুকতেই দাঁতে দাঁত চেপে দু-হাতে নিজের চুল নিজে টেনে ধরে। পরপরই ফোঁস করে শ্বাস ফেলে বিড়বিড়িয়ে বলে ওঠে,

-“আমাকে রা’ক্ষ’স বলে গেলে? তুমি তো বউ নামে ক’ল’ঙ্ক। ঠিকমতো স্বামী সেবাই করতে পারো না। কোথায় ভাবলাম আটঘাট বেঁধে খায়িয়ে দেবে তা না নিজ হাতেই খেতে হলো।”

—–
রাত ন’টা অব্দি শ্বাশুড়ির সঙ্গে টেলিভিশন দেখে, গল্প করে কাটিয়ে দিল নীরা। তুরান সেই সন্ধ্যায় খাবার খেয়ে ফের বেড়িয়েছে। বলেছে ফিরতে লেট হবে। নীরার মনটা এখনো থেকে থেকে অস্থির হয়ে উঠছে। তবু শ্বাশুড়ির সঙ্গে থেকে আপ্রাণ চেষ্টা করছে দুশ্চিন্তা মুক্ত থাকার। জাহানারা চৌধুরীর চোখ এড়ায়নি বিষয়টা। তিনি মনে মনে দীর্ঘ শ্বাস ফেললেন৷ তিনিও বেশ চিন্তিত বোধ করছেন। শেষ পর্যন্ত তুরান কী যেতে রাজি হবে? না গেলে চৌধুরী বাড়ির মানইজ্জত বিকিয়ে যাবে বেয়াই বাড়ির নিকটে।

খাবার পর্ব চুকিয়ে রাত সাড়ে দশটা নাগাদ ঘরে ফিরেছে নীরা। তুরান এখনো অব্দি ফেরেনি। শ্বাশুড়ি মা তাকে স্বামী বাড়ি ফিরলে নিজ হাতে খাবার পরিবেশন করে খাওয়ানোর দ্বায়িত্ব দিয়ে গেছে। সেই দ্বায়িত্ব পালনের অপেক্ষায় রাত জেগে বসে থাকতে হচ্ছে তাকে। অসময়ে সঙ্গী হিসেবে বেছে নিয়েছে নিজস্ব ফোনটাকে। কখনো ফেসবুক স্ক্রলিং করছে তো কখনো ইউটিউব দেখছে। এভাবেই কোনো মতে সময় পাড় করছে। কিন্তু কিছুতেই স্বস্তি মিলছে না।

অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে তুরান বাড়ি ফিরেছে রাত বারোটার কাছাকাছি সময়ে। কলিং বেল বাজতেই নীরা ওপর থেকে ছুটে এসেছে। তাড়াহুড়োয় ঘড়ি দেখতেও ভুলে গেছে। নীরাকে দরজা খুলতে দেখে তুরান ভ্রু কুঁচকে ফেলে। ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে ভারিক্কি কন্ঠে বলে,

-“তুমি? এখনো ঘুমাওনি কেন? এতো রাত জাগতে কে বলেছে?”

নীরার অস্বস্তি হলো। সরাসরি জাহানারা চৌধুরীর কথাটা বলতেও পারছে না। আমতা আমতা করতে করতে বলল,

-“এমনিতেই জেগে ছিলাম। কলিং বেলের শব্দ শুনে এসেছি।”

তুরান আরেক পল নীরাকে ভ্রু কুঁচকে দেখে নিল। অতঃপর ঘরের দিকে যেতে যেতে বলল,

-“জেগে যখন আছোই আমার খাবারটা সার্ভ করে দাও। আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি।”

তুরান চলে যেতেই নীরা মুখ ভেংচি কাটে। ব্যঙ্গাত্নক কন্ঠে বলে,

-“না করলে হয়? এই মহত্ত্ব সাধনের অপেক্ষায়ই তো বসে আছি।”

বিড়বিড় করতে করতে খাবার গুলো সার্ভ করতে যায় নীরা। কিন্তু খাবার গুলো তো একেবারে ঠান্ডা হয়ে আছে। পরপরই দ্রুত পায়ে খাবার গুলো মাইক্রোওভেনে গরম করে নেয় সে। তারপর সুন্দর করে পরিবেশন করতে থাকে। ততক্ষণে তুরান ফ্রেশ হয়ে নিচে নামছে। সিড়ি দিয়ে নামতে নামতে এক অমায়িক সৌন্দর্যপূর্ণ মুহুর্তের সাক্ষী হয় সে। আহ তার পিচ্চি বধূ কী সুনিপুণ হাতে তার জন্য খাবার পরিবেশন করছে। ভাবতেই প্রশান্তিময় অনুভূতিরা ডানা মেলছে মনে। তুরান টু শব্দবিহীন চেয়ার টেনে বসে পড়ল। খাবারের প্লেট টেনে নিয়ে খেতে আরম্ভ করে দিল৷ নীরা এক সাইডে দাড়িয়ে। তুরান সেভাবেই নীরাকে প্রশ্ন করল,

-“তুমি খেয়েছ?”

জবাবে নীরা মাথা দোলায় যার অর্থ সে খেয়েছে। উত্তর পেয়ে তুরানের কী জানি কী হলো সে একপল নীরাকে সূক্ষ্ম দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করে পরপরই গম্ভীর কন্ঠে বলল,

-“তাহলে এখানে থাকতে হবে না আর। ঘরে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ো।”

নীরা কাঠকাঠ গলায় বলল,
-“এতদূর যখন করেই দিয়েছি বাকিটুকুও না হয় করেই যাই।”

তুরান আর কিছু বলল না। তবে পুরোটা সময়ই ঝকঝকে মুখটা ভারাক্রান্ত করে রাখল। নীরা বুঝল না এমন রিয়াকশনের কারণ। সে ও আর ঘাটল না। চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। তুরানের খাবার শেষ হতেই সে উঠে ওপরে চলে গেল। নীরার সঙ্গে আর একটিও বাক্য ব্যয় হলো না। নীরা অবাকান্বিত চাহনি মেলে দেখল। পরপরই দীর্ঘ শ্বাস ফেলে টেবিল গোছাতে মনোযোগী হলো।

—–
আগেকার সময় গুলোতে জাহানারা চৌধুরী নিজে তুরানের জন্য রাত জেগে লিভিং রুমে অপেক্ষা করতেন। কিন্তু আজ হলো ব্যতিক্রম। তাই অভ্যাস বসত তুরান নিজে থেকেই একবার প্রবেশ করল বাবা মায়ের ঘরে। আলহাম চৌধুরী শান্তির ঘুম দিচ্ছেন। কিন্তু ঘুম নেই জাহানারা চৌধুরীর চোখে। যতই ছেলে বড় হোক, বউ আসুক। মায়ের কাছে সন্তান বরাবরই শিশু। অমূল্য ধন। সেই ধন যদি রাত বিরেতে এই ঝু’কি’পূ’র্ণ শহরে চলাচল করে বেড়ায় মায়ের চোখে কী আর ঘুম ধরা দেয় তখন। দুশ্চিন্তা ধামাচাপা দিতে উপন্যাসের বইয়ে মুখ গুজে বসে ছিলেন তিনি। ছেলের আগমন টের পেয়েছে অনেক আগেই। কলিং বাজার সঙ্গে সঙ্গেই। কিন্তু বের হননি ঘর থেকে। ছেলে-ছেলে বউয়ের মধ্যকার দূরত্ব ঘোচাতে তাদের একান্ত ছেড়ে দেওয়া ভীষণ জরুরি। দুজন দু’জনের যত কাছাকাছি থাকবে তবেই তো সম্পর্কে দূরত্ব ঘুচে মধুরতা আসবে।

দরজায় ঠকঠক শব্দে বইয়ের পাতা বন্ধ করলেন জাহানারা চৌধুরী। দরজার পানে তাকিয়ে বললেন,

-“তুরান এলি? ভেতরে আয়।”

আলগোছে দরজা খুলে ঢুকে পড়ল তুরান। মায়ের সম্মুখে গিয়ে বসল। অভিমানী কন্ঠে বলল,

-“দ্বায়িত্ব থেকে যখন মুখ ফিরিয়ে নিয়েছ তবে শুধু শুধু অপেক্ষা করে সময় নষ্ট না করে ঘুমিয়ে গেলেই পারো।”

জাহানারা চৌধুরী মুচকি হাসলেন। মায়ের কাছে এলে সকল সন্তানই কেমন শিশুসুলভ আচরণ করে বসে। বয়স যতই বারুক না কেন মায়ের কাছে আবদার, অভিমানে সকলেই দক্ষ ভূমিকা পালন করে। জাহানারা চৌধুরী ছেলেকে কাছে টেনে নিলেন। তুরানের মাথাটা নিজের কোলের ওপর শুয়িয়ে দিয়ে বললেন,

-“কে বলল দ্বায়িত্ব থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছি? শুধু হস্তান্তর করেছি যথাযথ স্থানে। মানুষ কর্মক্ষেত্রে যেমন বয়স বেড়িয়ে গেলে রিটায়ার্ড হয় তেমনই সেই জায়গা দখল করে অন্য কোনো সুযোগ্য কেউ। আমার সংসার জীবনেও তেমনই হস্তান্তর প্রক্রিয়ার সময় এসেছে। সুযোগ্য মানুষের হাতেই আমি তুলে দিয়েছি আমার ছেলের ভাড়। আমি আর কদিন। বাকি জীবনটা সে ই আমার ছেলের সকল দ্বায়িত্ব বয়ে বেড়াবে। সুখ-দুঃখ, মান-অভিমানের সঙ্গী হবে। শুধু সময়ের অপেক্ষা।”

তুরান মায়ের কোলে শুয়েই সেভাবেই জাহানারা চৌধুরীর পা জড়িয়ে ধরে। দৃঢ় কন্ঠে বলে,

-“কখনোই না। তোমার কিচ্ছু হবে না। তুমি আজীবন আমার সঙ্গে থাকবে। সে যতই দ্বায়িত্ব আরেকজনকে চাপিয়ে পাড় পাও না কেন আমার জ্বালাতন থেকে কখনো মুক্তি পাবে না।”

জাহানারা চৌধুরী ছেলের চুলে হাত বুলাতে বুলাতে বলেন,

-“তা কী আর হয় বাবা। সময়ের নিয়মে সকলেরই শেষ সময় আসবে। সঠিক স্থানে পৌঁছতে হবে সকলকেই।
সে যাই হোক, এখন একটা কথা বলি শোন। তুই কিন্তু না বলতে পারবি না। তোকে শুনতেই হবে।”

তুরান ভ্রু কুঁচকে ফেলল। মায়ের এমন আবদারি কন্ঠ শুনে বুঝল নিশ্চয়ই তলে তলে কোনো ঘোট পাকিয়েছে তার জন্য। সে সেভাবেই ভ্রু কুঁচকে বলল,

-“কী কথা বলো দ্রুত?”

.
চলবে,
অহমিকা মুনতাহাজ নিশি#মায়ার_বাঁধন🍂
১০.
জাহানারা চৌধুরী উশখুশ করতে করতে বললেন,

-“কাল তুই নীরাকে নিয়ে ওদের বাড়িতে যাবি। তিনদিন থেকে, ঘুরেফিরে আবার নীরাকে সঙ্গে নিয়ে ফিরবি।”

তুরান ঝট করে মায়ের কোল ছেড়ে সোজা হয়ে বসল। কন্ঠে ক্রোধ টেনে বলল,

-“কখনোই সম্ভব নয় মা। তুরান তাসরিফ চৌধুরী দ্বিতীয় বার গ্রামে পা রাখবে না।”

-“আহ তুরান এভাবে কেন বলছিস? এটাই নিয়ম বিয়ের তিনদিনের মাথায় বউ সমেত শ্বশুর বাড়ি যেতে হয় আবার বউকে সঙ্গে নিয়ে ফিরতে হয়। এখন তুই যদি না যাস আমাদের মানইজ্জত কোথায় গিয়ে দাড়াবে ভেবে দেখেছিস?”

-“এটা তোমাদের আগেই ভাবা উচিত ছিল মা। এটা নিয়ে আর কিচ্ছু শুনতে চাই না আমি। যাব না বলেছি ব্যস যাব না। প্রয়োজনে তোমার বউ মাকে সঙ্গে নিয়ে তুমিই চলে যাও।”

-“আমার কথাটা তো শোন বাবা…….”

ওড়নার আঁচলে মুখ চেপে ধরে দৌড়ে ঘরে চলে গেল নীরা। সে এতক্ষণ মা ছেলের সব কথাই শুনেছে। তুরানের ঘরে যাওয়ার আগে বাবা-মায়ের ঘরটা আগে পড়ে। সেভাবেই খাবার গুছিয়ে এ ঘরের সামনে দিয়ে ক্রস করার সময় থমকে দাড়ায় নীরা। কৌতুহল দমাতে না পেরে শুনে নেয় তুরানের ভাষ্য। আর এক মুহূর্ত দাড়ানোর শক্তি হয় না তার। রুমে গিয়ে ধপ করে কম্বল মুড়ি দিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ে। ক্ষণে ক্ষণে শুধু হেঁচকি তুলার আওয়াজ ভেসে আসছে। নীরা কাঁদছে তবে তা প্রকাশ করতে চাইছে না। শত চেষ্টায় আটকে রাখা কান্না গুলো হেঁচকি রুপে বেড়িয়ে আসছে।

—–
তুরান ঘরে আসে বেশ সময় নিয়ে। ঘরে ঢুকে দেখে নীরা শুয়ে পড়েছে। সে ভেবেছে নীরা ঘুমিয়ে পড়েছে তাই কোনো কিছু না বলে সে ও বিছানার আরেকপ্রান্তে শুয়ে পড়ে। ধীরে ধীরে তলিয়ে যায় ঘুমের রাজ্যে। নির্ঘুম রইল কেবল নীরা। চোখের পাতা চেয়েও এক করতে পারল না। নিজে যেমন পরিস্থিতিতেই থাকুক না কেন পরিবারকে সে বিষয়ে অবগত করতে ইচ্ছুক নয় সে। তাহলে যে তার বাবা – মা বড্ড কষ্ট পাবে। দুশ্চিন্তায় থাকবে তাকে নিয়ে। মায়ের ব্ল্যাড প্রেসার আছে। হাইপার হলে দূ’র্ঘ’ট’না ঘটে যেতে সময় নেবে না। চিন্তায় চিন্তায় নীরা নিজেই ভেতরে ভেতরে শেষ হয়ে যাচ্ছে।

খুব সকালে বিছানা ছেড়ে উঠে নামাজ সেড়ে নেয় নীরা। কিছু সময় বিছানায় বসে একদৃষ্টে চেয়ে থাকে তুরানের মুখপানে। কাঙ্খিত সময় পর দীর্ঘ শ্বাস ফেলে উঠে যায়। চলে যায় কিচেনে। শ্বাশুড়ির সঙ্গে কাজে হাত লাগাতে হবে।

কাজের ফাঁকে জাহানারা চৌধুরী খেয়াল করেছেন নীরার মনটা এখনো বিষন্ন হয়ে আছে। তিনি ভেবে পেলেন না এখনো নীরা উদাসীন কেন? পরপরই ভাবল হয়তো তুরানের সঙ্গে বনিবনা হচ্ছে না বলে মন খারাপ করে থাকে। দীর্ঘ শ্বাস ফেললেন তিনি। মনে মনে ওপর ওয়ালাকে স্মরণ করে বললেন,

-“হে আল্লাহ! তুমি ওদের সুখী করো।”

—–
প্রতিদিনের ন্যায় আজও নীরার হাতের কফি খেয়ে সকালটা শুরু হলো তুরানের। তবে সে আজকে নীরার মধ্যে কিছু ভিন্নতা লক্ষ্য করেছে। এই যেমন মেয়েটা একেবারে চুপচাপ হয়ে আছে। প্রয়োজন ছাড়া কোনো কথা বলছে না। নীরাকে পর্যবেক্ষণ করতে করতে কফি শেষ করে তুরান ওয়াশরুমে ঢুকে যায়। আর নীরা শুরু করে বিছানা গোছাতে।

ওয়াশরুম থেকে বেড়িয়ে তুরান নীরাকে ঘরে পায় না। ঘড়ির কাঁটায় লক্ষ্য করে বুঝতে পারে হয়তো ডাইনিংয়ে গেছে। শার্ট,প্যান্ট গায়ে জড়িয়ে সে ও নেমে পড়ে ব্রেকফাস্ট করতে। নিচে নেমে দেখে নীরা খাবার সার্ভ করছে। তুরান চুপটি করে চেয়ার টেনে বসে পড়ে। আড়চোখে একটু পরপর নীরাকে দেখছে। মেয়েটার বিষন্নতায় ঘেরা মুখশ্রী দেখতে তার একদমই ভালো লাগছে না। বুকের মধ্যে কোথাও একটা চিনচিনে ব্যথা অনুভূত হচ্ছে। মনে হচ্ছে জাপ্টে ধরে কী সমস্যা জেনে নিতে। কিন্তু আফসোস সেটাও পারছে না।

সকলকে খাবার বেড়ে দিয়ে শ্বাশুড়ির আদেশে নীরাও বসে পড়ে খেতে। এমন সময় হিয়া,টিয়া হুটোপুটি করে উপস্থিত হয়। দুজনের হাতেই ব্যাগপত্র। বেশ পরিপাটি হয়েও এসেছে। নীরা ওদের দেখে খুশি হয় পরক্ষণেই আবার ওদের এভাবে ফিটফাট দেখে নিজের কাছেই নিজে প্রশ্নবিদ্ধ হয়। ওরা কোথায় যাচ্ছে?

হিয়া,টিয়া সোফার ওপর ওদের ব্যাগপত্র রেখে সোজা এসে চেয়ার টেনে বসে পড়ে। টিয়া প্লেট নিতে নিতে তড়িঘড়ি করে বলে,

-“বড় মা জলদি খেতে দাও। খুব খিদে পেয়ে গেছে। সাজগোজ করতে করতে লেট হয়ে গেছে তাই ভাবলাম হয়তো ভাইয়া-ভাবি আমাদের ফেলে চলে যাবে। এজন্য একেবারে না খেয়েই হাজির হয়ে গেছি।”

হিয়া টিয়ার মাথায় গাট্টা মে’রে বলল,
-“হ্যাঁ নিজে তো এক পা’গ’ল সেই সঙ্গে আমাকেও পা’গ’ল করে ছাড়বি।”

জাহানারা চৌধুরী ওদের পাতে খাবার তুলে দিচ্ছে আর হাসছে। আলহাম চৌধুরী, তুরানও হাসছে। সবার দেখা দেখে নীরাও হাসল তবে তার বোধগম্য হচ্ছে না এদের কথার মানে। তাই কৌতুহল বসত প্রশ্ন করেই বসল। বলল,

-“তোমরা কোথায় যাচ্ছ হিয়া-টিয়া?”

উপস্থিত সকলে যেন আকাশ থেকে পড়ল। সকলেই স্তম্ভিত মুখে নীরার দিকে তাকিয়ে। শুধু তুরান বিপরীত। সে নিজের মতো খেয়ে চলেছে। নীরা পড়ে গেছে অস্বস্তিতে। সে এমন কী ভুল বলল যার কারণে সকলে এভাবে চিড়িয়াখানার জন্তুর মতো তাকে পরখ করছে? নীরার কাচুমাচু ভঙ্গি আর এদিকে টিয়ার সন্দেহী কন্ঠ,

-“কোথায় যাচ্ছি মানে? তোমার আর ভাইয়ার সঙ্গেই তো আমরা যাচ্ছি। বাই এনি চান্স, তুমি আমাদের নিতে ইচ্ছুক নও?”

-“এ মা তা কেন হবে। আমি অবশ্যই তোমাদের নিতে ইচ্ছুক কিন্তু….?

-” কিন্তু কী ছোট ভাবি?”

-“আসলে হয়েছে কী… আমরা যাচ্ছি টা কোথায়?”

এবারেও সকলে আরেকটা ঝটকা খেল। এবার টিয়া কিছু বলার আগেই জাহানারা চৌধুরী তুরানের উদ্দেশ্যে বললেন,

-“কী রে তুই কিছু বলিসনি ওকে?”

তুরান সাবলীল ভঙ্গিতে উত্তর দিল,
-“নাহ সুযোগ হয়নি ৷ রাতে ঘুমিয়ে গিয়েছিল।”

জাহানারা চৌধুরী এবারে বুঝতে পারলেন সকালেও কেন নীরার মন খারাপ ছিল। ও তো এখনো কিছু জানেই না। জাহানারা চৌধুরী নীরাকে এবার কিছু বলতে উদ্ধত হলে তার আগেই টিয়া লাফিয়ে বলে ওঠে,

-” ও মা ছোট ভাবি, কী আশ্চর্য বলো! তোমাদের বাড়িতে যাচ্ছি আর তুমিই জানো না।”

এবারে জাহানারা চৌধুরীও বললেন,
-“হ্যাঁ রে নীরা তুরানের সঙ্গে গিয়ে বাবার বাড়ি থেকে ঘুরে আয় কিন্তু তুরানের আবার একটা শর্ত আছে। সে নাকি এক রাতের বেশি থাকতে পারবে না। তার ভার্সিটিতে নির্বাচন সামনে অনেক ঝামেলা আছে। ফিরতে হবে ওকে। তুইও বরং ওর সঙ্গেই ফিরে আসিস। তুইও তো নতুন ক্লাস জয়েন করলি। এমনিতেই অনেক লেটে ভর্তি হয়েছিস এখন বেশি ক্লাস মিস দিলে পড়ালেখায় ক্ষতি হয়ে যাবে। তারচেয়ে বরং এখন একসঙ্গে দুটো দিন থেকে আয় পরে না হয় সময় সুযোগ করে বেশিদিন থেকে আসিস।”

আলহাম চৌধুরীও স্ত্রীর সঙ্গে সহমত পোষণ করলেন। নীরা নির্বাক শ্রোতার মতো শুধু শুনে গেল। তবে মাথা নেড়ে সম্মতি জানিয়েছে সকলের কথায়। তুরান যে যেতে রাজি হয়েছে এটাই অনেক তার কাছে। শেষমেশ ও বাড়ির সামনে মানইজ্জত টুকু তো রক্ষা হলো।

নীরার বিষন্নতায় ঘেরা মুখশ্রীতে এবার যেন উৎফুল্লতা নেমেছে। তুরান বার কয়েক খেয়াল করেছে সেদিক। মনে মনে ভেবেছে,

-“ওহ তাহলে মহারানীর মন খারাপের কারণ এটাই। আগে জানলে বহুত আগেই জানিয়ে দিতাম। এভাবে হু’তু’ম’প্যাঁচা সেজে ঘুরতে দিতাম না কখনোই।”

.
চলবে,
অহমিকা মুনতাহাজ নিশি

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here