হলরুমের সোফায় বসে রাফিকে নিয়ে ল্যাপটপে কাজ করছে ইয়াসির। গম্ভীর ভাব বজায় রেখে মনোযোগ সহকারে ল্যাপটপে দৃষ্টি নিবেদন করতে ব্যস্ত রাফি। রিমি এসেই ইয়াসিরের পাশে বসলো।
— “জ্ঞান ফিরেছে, ফ্রেশ হচ্ছে।”
“হুম” বলে রিমির পাশ ছেড়ে উঠে দাঁড়ায় ইয়াসির, রাফির থেকে ল্যাপটপ সরিয়ে বলল,
— “আর কিছু খাবি তোরা?”
— “আরে, আর না। অনেক খেয়েছি। আবার হাসপাতালে যেতে হবে। বেশি খেলে সমস্যা, রুগী দেখতে বসলেই ঘুম!” বলেই রিমির কোলে মাথা রেখে সোফায় শুয়ে পড়লো রাফি।
রিমির হাত দু’টো মাথার উপর নিয়ে বলল,
— “মাথাটা একটু টিপে দাও তো। ব্যথা করছে খুব!”
মুখে কিছু না বলে স্বামীর আদেশ পালন করে রিমি। আলতো হাতে স্বামীর ঘন রেশম চুলে হাত বুলিয়ে দেয়। ইয়াসির সরে আসে সেখান থেকে। দু’জনকে আলাদা স্পেস করে দিলো সে।
চোখেমুখে পানি ছিটিয়ে আয়নায় নিজের চেহারাটা গাঢ় নজরে পরখ করে মারিয়া। অজ্ঞান হওয়ার আগমুহূর্তে সে যা কিছু শুনেছিল, সেসব আবার মনে পড়ছে। সেকেন্ডেই শরীরে কাঁপন ধরে! কোনোরকম ওয়াশ বেসিন ধরে নিজেকে সামলে নেয়। অল্পতেই ভয় পাওয়ার ফোবিয়া আছে মারিয়ার। ভয়ানক বিষয়গুলো হজম করতে তার বেশ বেগ পোহাতে হয়!
ভেতরে রাখা ঝুলন্ত সাদা তোয়ালেতে মুখ মুছে বেরিয়ে আসে সে। এলোমেলো বাহারি চুলগুলো হাত খোঁপা করে বিছানা গুছিয়ে রুম থেকে নিঃশব্দে বেরিয়ে যায়। বাহিরে আসতেই তার দৃষ্টি সোজা রিমি আর রাফির দিকে পড়ে। দু’জন সোফায় বসে-শুয়ে নিজেদের মতো ঘুম দিয়েছে। ডানে যাবে না বায়ে যাবে মারিয়া ভেবে পায় না। এদিক ওদিক তাকিয়ে অন্যরুমের দিকে হাঁটা দেয়।
রুমটায় এসেই সে অবাকের চূড়ান্তে। রুমের বড়ো দেওয়ালে বিশাল করে তার ছবি টাঙানো। ছবিটা চারপাশে চিকন সাদা কালো মিশ্রণের ফ্রেম বাঁধিয়ে রেখেছে, ইউনিক! বিড়বিড় করে সামনে এগিয়ে যায় মারিয়া। কাছে যেয়ে বিছানায় উঠে পড়ে। বিছানায় দাঁড়িয়েই সে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে ছবিটাকে পর্যবেক্ষণ করছে। ছবিটির এক কোণায় ইংরেজি স্টাইলিশ লেটারে মারিয়া লেখা, নিচে জন্মসাল। কিন্তু এটা তো তার জন্মসাল না। হঠাৎ করেই মারিয়ার মনে পড়ে, এটা কি সেই ডায়েরির মেয়েটা?
হুবহু যে আমার মতো দেখতে! ঘাড় বাঁকিয়ে তখনও সে খাটের উপর কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। পেছন থেকে কেউ একজন উহুম উহুম কেশে উঠলো। মারিয়া চমকে পেছনে তাকায়। ইয়াসির!
— “ও আমার মারিয়া!”
“আমার মারিয়া” কথাটা বলতেই ইয়াসিরের বুক ধুক করে উঠে। মারিয়া ওহ্ বলে নিচে নেমে আসে। বিস্ময় প্রকাশ করে বলল,
— “একদম আমার মতো দেখতে। একটুও অমিল নেই!”
সামনে থেকে সরে গিয়ে ইয়াসির বলল,
— “আছে।”
ভ্রু কুঁচকে যায় মারিয়ার। এতক্ষণ ধরে সে এই ছবিটা দেখছে, কই? সে তো কোনো অমিল পায়নি।
ছবিটার দিকে আরেকবার তাকিয়ে বলল,
— “কোথায় অমিল? আমি তো পেলাম না। দেখান আপনি।”
— “ভালো করে দেখো, নিজেই পেয়ে যাবা।”
ইয়াসিরের কথায় আবারও ছবিটার কাছে গিয়ে দাঁড়ালো মারিয়া। নাহ্, সে তো কোনো অমিলই খুঁজে পাচ্ছে না…
ফিরে এসে ইয়াসিরের পিছনে গিয়ে দাঁড়ালো মারিয়া, পিঠে আঙুল দিয়ে খোঁচা মেরে বলল,
— “পাই না।”
হাতের কাজ রেখে ঘুরে দাঁড়ায় ইয়াসির। মারিয়ার চোখের দিকে সরাসরি দৃষ্টি রাখে, তার চোখের মণি যেন বলছে, এ দু’চোখে অনেকদিনের জমানো ব্যথা লুকায়িত! কেউ চাইলেই হয়তো এই চোখে নিজের জন্য মায়া জমাতে পারে। ইয়াসিরের চোখের দৃষ্টি উপেক্ষা করার সাহস পায় না মারিয়া, সেও সরাসরি পলকহীন সে গম্ভীর চোখে তাকিয়ে থাকে।
— “আমার মারিয়ার চোখে যে মায়ার সৃষ্টি, সেটা তোমার চোখে নেই! তোমার কেন? পৃথিবীতে অন্য কোনো মেয়ের চোখে এই মায়ার সৃষ্টি হবে না!”
কী হলো এটা! ইয়াসির কি তাকে অপমান করলো? এটা কেমন অপমান! তাকে কি সরাসরি বলল, তার চোখ দেখতে সুন্দর নয়? কেউ তার চোখের প্রেমে পড়বে না? আরেকটু হলেই হয়তো মারিয়া ইয়াসিরের প্রেমে পড়ে যেত, কিন্তু সে এভাবে তাকে অপমান করলো?
দৃষ্টি সরিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে যায় ইয়াসির। যাওয়ার আগে বলে গেল,
— “আমার রুমে কেউ পারমিশন ছাড়া আসতে পারে না। এই অধিকার আমি যাকে তাকে দেই না, কথাটা যেন পরেরবার মনে থাকে!”
আবারও অপমান! রাগে, ক্ষোভে, অপমানে মারিয়ার শরীর ফুলে যাচ্ছে, মনে হচ্ছে এখনই গিয়ে ইয়াসিরের জিহ্বাটা সে টেনে ছিঁড়ে ফেলুক! একটা মানুষ আরেকটা মানুষকে কীভাবে এমন সরাসরি অপমান করতে পারে? এগুলো কেমন ব্যবহার! মারিয়া কল্পনা করে, ইয়াসিরকে সে মাটিতে শুইয়ে হাতে গ্লাভস পরে তার জিহ্বা টেনে ছিঁড়ছে। কল্পনাটা বেশ সুন্দর!
তবুও মারিয়ার মাথার অবস্থা রমরমা। এই সময়ে তার ভেতরের রাগটা কোথায় প্রকাশ করলে খাটবে সেটা খুঁজছে সে। হন্তদন্ত হয়ে রুমে কিছু খোঁজার চেষ্টা করে। তখনই রুমে থাকা ছোটো সাইড টেবিলটার দিকে তার চোখ পড়ে। একছুটে কেচিটা একটানে ছোঁ মেরে ছবিটার দিকে হাত বাড়ায়। ছবিটা নষ্ট করার ইচ্ছে হলেও পারে না। যতকিছু হোক, ছবিটা তো তার অনুরূপী কারোর। এটা নষ্ট করলে নিজেরও খারাপ লাগবে। অবশেষে বিছানায় রাখা নরম একটা বালিশ দেখে সেটার মাঝবরাবর কেচি ঢুকিয়ে সে হাত ঝেড়ে রুম থেকে বেরিয়ে যায়। নিশ্চয়ই পাষাণটা নরম বালিশে ঘুমায়!
আহ্, এবার মনে একটু শান্তি লাগছে!
___
— “কিরে পাইলি কোথাও?”
মুখে অসহায়ত্ব ফুটিয়ে দারোয়ানের স্ত্রী জবাব দিলো,
— “না। খুঁজলাম তো আশেপাশে। একবারেই চলে গেল নাকি?”
— “এখন কী করি?”
— “কিচ্ছু জানি না!”
চেয়ারে পা উঁচিয়ে বসে পড়লো দারোয়ান। এখন আর তাদের কিছুই করার নেই। মিষ্টার মর্গান আসুক, এরপর দেখা যাবে বাকিটা!
___
কোমরে কিচেন টাওয়াল বেঁধে রান্নার কাজ শুরু করে দেয় ইয়াসির। দু’ঠোঁটের ফাঁকে জ্বলন্ত সিগারেট রেখে কিছুক্ষণ পরপর সম্মুখে ধোঁয়া ছুঁড়ছে। বিষয়টা দেখতে পারছে না মারিয়া, তবুও একা একা তার আর কিছু করার নেই। অগত্যা এখানেই বসে আছে সে। একটু পরপর নাক চেপে ধরছে আবার ছেড়ে দিচ্ছে।
— “সিগারেটটা এখন না খেলে হয় না?”
নাকে বাজানো সুর ভেসে আসে ওপাশ থেকে। চুলোয় আঁচে রাখা তরকারিতে নাড়া দিয়ে মারিয়ার দিকে সরু চোখে তাকায় ইয়াসির। ঠোঁটের থেকে সিগারেট সরিয়ে বলল,
— “সমস্যা কী?”
— “আমার দম নিতে কষ্ট হচ্ছে।”
— “রুমে গিয়ে বসো।”
— “কোন রুমে যাব? যে রুমে আমি ছিলাম ওটায় তো রিমি আপু আর রাফি ভাই দখল করে আরামে ঘুম দিচ্ছে। আমি আর কই যাব?”
কেন? আমার রুমে যাও? বলতে গিয়েও কথাটা বলল না ইয়াসির। চুপচাপ সিগারেট শেষ করে ডাস্টবিনে ফেলে দিলো। আবার রান্নার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ে সে।
পিনপতন নীরবতা! কাজের ফাঁকে ব্যবহৃত চামচের টুকটাক টিংটং আওয়াজ কানে বাজছে। ঘুম পাচ্ছে মারিয়ার। ইয়াসিরের রান্না এখনও শেষ হয়নি। এভাবে অযথা আর বসে থাকতে না পেরে মারিয়া বলেই ফেলল,
— “রাঁধতে এতক্ষণ লাগে? এত কী রাঁধেন?”
ইয়াসিরের বলতে ইচ্ছে করলো,
“এই বেয়াদ্যোপ, তুই রাঁধতে জানিস আদৌ? আমার কাজে বাগড়া দেস যে!” মনের কথা মনেই দমিয়ে রাখে সে, মুখে আর ফুটিয়ে তুলে না। মারিয়ার চোখেমুখে এখনও বিরক্তির চাহনি! সে চাহনি দেখে ইয়াসিরের ইচ্ছে করছে, এখনই তার হাতে থাকা খুন্তিটা মারিয়ার মুখ বরাবর মারুক!
ভদ্রতার খাতিরে শুধু সে কিছু করতে পারছে না।
গমগমে কণ্ঠে বলল,
— “রাঁধতে পারো?”
মারিয়া রাঁধতে জানে না। রাঁধতে কী কী মশলা ব্যবহার করতে হয় তাও সে জানে না। কিন্তু আবারও ইয়াসির তাকে অপমান করার সুযোগ পাক এটা সে ভুলেও চায় না। চোখেমুখে গর্বিত ভাব ধরে বলল,
— “বড়ো রান্না না পারি, ডিম তো ভাজতে পারি।”
বেশি বললে পরে যদি ফেঁসে যায়, তাই সে একটু কম করে মিথ্যা বলল। ইয়াসির বুঝি তার এই মিথ্যেটুকুও ধরে ফেলেছে। একপাশে সরে গিয়ে বলল,
— “আমার রান্না শেষ। এবার একটা ডিম ভাজি করো তো। ওদের উঠতে অনেক দেরি, আমার ক্ষুধা লেগেছে। নেও খালি করে দিচ্ছি সব, ভেজে ফেলো।”
চুলার জায়গাটা খালি করে মারিয়াকে যেতে বলল ইয়াসির।
এবার কী করবে মারিয়া? সে তো ডিমও ভাজতে জানে না। কিন্তু এখন তো সত্যিও বলা যাবে না, এভাবে নিজের প্রেস্টিজ সে ডাউন করতে পারে না…
ধীরে সুস্থে সামনে এগোয় মারিয়া। চুলায় একটা কড়াই বসিয়ে সর্বোচ্চ আঁচ বাড়ায়। ফ্রিজ থেকে একটা ডিম নিয়ে এসে চুলার সামনেই দাঁড়িয়ে রইলো। ইয়াসিরকে বুঝতে দেওয়া যাবে না, সে কিছুই পারে না। মান-সম্মান সব ধেই ধেই করে বাতাসে কেন, রাস্তার ধুলোয় উড়বে!
মারিয়ার ভীষণ আফসোস হচ্ছে। কেন যে সে মায়ের কথা শুনতো না। মা সবসময় বলতো, এত বড়ো ধামড়ি একটা মেয়ে। দু’দিন পর শ্বশুরবাড়ি যাবে, এখনও নাকি তার রান্নাবান্নার প্রতি কোনো টান আসে না। সংসার কি গিয়ে আমি করে আসবো?
ইয়াসির গভীর চোখে মারিয়ার কার্যকলাপ দেখছে। মারিয়া চামচের আগা দিয়ে একটু একটু করে ডিমের উপর বাড়ি দেয়। বাড়িগুলো খুবই সাবধানে দিচ্ছে সে। ইয়াসিরের সামনে নিজের প্রেস্টিজ ধরে রাখার কী তুমুল চেষ্টা-তদবির তার!
ওদিকে যে কড়াই পুড়ছে, ধোঁয়ায় রান্নাঘর ভাসছে, সে খেয়াল আছে মেয়েটার?
ডিম ভেঙে কড়াইয়ের উপর ধরে রাখলো মারিয়া। একটুখানি ফুটো ডিমে, সে ফুটো দিয়ে আস্তে ধীরে আরাম করে ডিমের সাদা অংশ নিচে নামছে। ইয়াসির তখনও গম্ভীর হয়ে মারিয়ার ডিম ভাজা দেখতে ব্যস্ত…
কড়াইয়ে ডিম পড়া শেষ হলেই মারিয়া অপেক্ষা করে। ডিমটা একটু শক্তপোক্ত হলেই সেটা উল্টে দিবে। তার চোখেমুখে খুশির ভাব! ইয়াসিরের সামনে এবার আর সে অপদস্ত হচ্ছে না তাহলে।
ডিম উল্টোতে গেলেই মারিয়া পড়লো বিপাকে। হায়রে, ডিম তো আর উল্টায় না! খুন্তি দিয়ে খোঁচা দিয়েও লাভ হচ্ছে না, ডিম তো একদম লেগে গেছে। পরক্ষণেই মারিয়ার চেহারাটা কাঁদো কাঁদো হয়ে যায়। ইয়াসিরের দিকে তাকিয়ে বলল,
— “আপনার কড়াই-ই তো নষ্ট, ডিম উল্টায় না কেন?”
সেদিকে ডিম পুড়ে অবস্থা যাচ্ছে তাই! ইয়াসির এবার উঠে এসে দ্রুত চুলা অফ্ করে দিলো। কড়াই নামিয়ে ডিম নামাতে গিয়ে মনে মনে বিড়বিড় করে বলছে,
— “তুই ডিম ভাজতে পারিস, না? আজকে এই ডিম তোরে কেমনে খাওয়াই এটা দেখিস খালি! তুই আমার বারোশো টাকার এত সুন্দর কড়াই পুড়লি। মন চাচ্ছে, তোর কোমর ভেঙে বাঁকা করে আমি তোকেই চুলায় বসায় দেই। এরপর তোকে ডিম ভেজে দেখাই!”
আড়চোখে মারিয়ার অসহায় মুখশ্রীটা দেখে ইয়াসির। সেকেন্ডের জন্যও তার উপর মায়া হয় না। উল্টো ইচ্ছে করছে, কড়াইটা দিয়ে ইয়া জোরে একটা বাড়ি মারুক মারিয়ার মাথায়। আর মারিয়া ধপাস করে ফ্লোরে পড়ে যাক। ইয়াসির কল্পনা করে, যদি সে সত্যিই মারিয়ার মাথায় বাড়ি মারে তবে কেমন হবে? মারিয়া কি চিৎপটাং হবে? ওর চোখ কি উল্টে যাবে নাকি সোজা সিলিং এর দিকে থাকবে? ভেবে একবার সিলিং দেখে নেয় ইয়াসির।
এসব উল্টো পাল্টা ভেবেও ইয়াসিরের মুখে ভাবান্তর হয় না। মারিয়া তখনও ইয়াসিরের পাশে ঠায় দাঁড়িয়ে! চোখেমুখে কী অসহায়ত্ব!
‘চলবে…’
মারিয়া
পর্ব:- ০৬
কলমে: সায়ীদা নুহা