মারিয়া,পর্ব:৫

কফি হাউজের এক কোণায় দু’টো চেয়ার দখল করে মুখোমুখি বসে পড়লো দু’জন। মারিয়াকে কিছুটা দ্বিধাগ্রস্ত দেখাচ্ছে। ইয়াসির দু’কাপ কফি অর্ডার করে সরাসরি প্রশ্ন করলো,
— “দেখো মারিয়া, যেহেতু তুমি আমার আর মারিয়ার ব্যাপারে অনেককিছু জেনেছো। তোমাকে পুরোটা খুলে বলব। তুমি কী কী জেনেছ ডায়েরি থেকে?”
স্বাভাবিক কণ্ঠেই মারিয়া জবাব দিলো,
— “মারিয়ার মায়ের ব্যাপারটা। আর ওদের পারিবারিক ব্যাপারে। এই বাড়িটা ওদের খুব পুরনো। ওর বাবা আর মায়ের পারিবারিক, দাম্পত্য এসবই জেনেছি।”
— “এখন বলো তো, এই ডায়েরিটা পড়ার সময় তোমার কি মারিয়ার জন্য খারাপ লেগেছে?”
— “প্রচুর। আমার মনে হয়, আমি মারিয়াকে ফিল করতে পারি। যেদিন প্রথম এই বাড়িতে উঠি, সেদিন থেকেই মারিয়ার প্রতিটা জিনিসের সাথে আমার অন্যরকম অনুভূতি জুড়ে যায়।”

ইয়াসির ব্যাপারটা এড়িয়ে গেল। শুধু জিজ্ঞেস করলো,
— “আমি ওর ডায়েরিটার ব্যাপারে শুধু প্রশ্ন করেছি।”
— “ওহ্ হ্যাঁ। হ্যাঁ আমার কাছে মেয়েটার জন্য খুব খারাপ লেগেছিল।”

ইয়াসির চাপা নিঃশ্বাস ছাড়ে। এরই মাঝে বয় এসে কফি দিয়ে যায়। নিজের কফিটা কাছে টেনে কাপে চুমুক রাখে ইয়াসির। মারিয়াকেও কফি নিতে ইশারা করে। হাতে নিয়েও কফির মগটা রেখে দেয় মারিয়া। ইনিয়েবিনিয়ে বলল,
— “আমার খুব ক্ষুধা লেগেছে। কফি খেলে এখন পেটে যা চুটিপুটি আছে তাও উগড়ে বের হয়ে যাবে।”
মারিয়ার অসহায় মুখশ্রী দেখে ইয়াসিরের বুকে টান খেলে যায়। বয়কে ডেকে দু’টো স্যান্ডউইচ দিয়ে যেতে বলল।
— “রাতে কি ও বাড়িতে কিছু হয়েছিল?”
মারিয়া মাথা দোলায়। পরক্ষণেই বলল,
— “প্রচুর ভয় পেয়েছিলাম। আমি তো মনে করেছিলাম, আর বেরই হতে পারব না। কীভাবে যে ছুটে এসছি সেটা আমিই জানি।”
— “কী হয়েছিল?”

গতরাতের দারোয়ানের অস্বাভাবিক আচরণ আর তার উপর নজর রাখার ব্যাপারটা সবকিছুই পরিষ্কার করে বলে মারিয়া।
সব শুনে ইয়াসির বলল,
— “আচ্ছা, তুমি যেখান থেকে এসেছো। সেখানে কি ভালো জবের খোঁজ পাওনি? এখানেই কেন এলে?”

মারিয়া স্যান্ডউইচে বড়ো এক কামড় বসিয়ে বলল,
— “আমা… র… আই ওই… ও.. ই…”
ইয়াসিরের চোখ ছোটো হয়ে যায়। মারিয়াকে হাতে ইশারা করে থামিয়ে বলল,
— “খেয়ে এরপর ধীরেসুস্থে বলো।”
আর কোনো কথাবার্তার আওয়াজ শোনা যায় না কোণার টেবিল থেকে। স্নিগ্ধ সকালের পিনপতন নীরবতায় মুহূর্ত কাটছে।
ইয়াসির পকেট থেকে ফোন বের করে কফিতে শেষ চুমুক দিয়ে পরিচিত এক নাম্বারে মেসেজ পাঠালো। ফোন অফ্ করে টেবিলে রেখে মারিয়ার দিকে তাকায়। মেয়েটা দু’দুটো স্যান্ডউইচ একাই গোগ্রাসে খেয়ে ফেলেছে।

টিস্যুপেপারে হাত মুছে গলা ভেজালো মারিয়া। আগের কফিটা আবার গরম করে আনতে বলে ইয়াসিরের দিকে কিছুটা ঝুঁকে আসে। শীতল কণ্ঠে বলল,
— “আব্বুর অবস্থা ভালো ছিল না। তাই জব খুঁজছিলাম। তখন র্যাবিক্স কোম্পানির খোঁজ পাই, অ্যাপ্লাই করি আর হয়েও যায়। এরপরেই এখানে আসা।”
— “তোমার পড়াশোনা কতদূর?”
আড়চোখে ইয়াসিরের দিকে তাকিয়ে থাকে মারিয়া। মুখ ঘুরিয়ে বলল, অনার্স সেকেন্ড ইয়ার পর্যন্ত। এরপরই বাবা অসুস্থ হয়ে পড়ে আর আমি আর পড়তে পারিনি। জব খুঁজতে উঠে পড়ে লাগতে হয়েছে।”
— “ওহ্ আচ্ছা!”

এবার ইয়াসির কিছুটা নরম কণ্ঠেই বলল,
— “অথচ এখানে র্যাবিক্স নামে কোনো কোম্পানি নেই।”
— “কিহ?”
— “হ্যাঁ!” ইয়াসিরের চেহারায় কোনো ভাবান্তর দেখা গেল না। নির্লিপ্ত দেখাচ্ছে তার ফ্যাকাশে চেহারা। মারিয়া উত্তেজনায় চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। তার শরীর রীতিমতো কাঁপছে। এগুলো কি সত্যি?

মারিয়াকে বসতে ইশারা করে ইয়াসির। ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে বসে পড়ে মারিয়া। একেবারে গুটি মেরে রইলো।
— “মিস্টার মর্গান, যার বাড়িতে তুমি আছো। তিনি একজন বিকৃত মস্তিষ্কের লোক। বিজ্ঞানের ভাষায় বললে, তিনি মানসিক রুগী। আর সাধারণ রোগ নয়, তার অবস্থা এতই বিকৃত যে সে মানুষের রক্ত চুষে খেতে পছন্দ করে।”
মারিয়ার মনে হলো, তার চামড়ার উপর দিয়ে কেউ আলতো করে নখের আঁচড় কেটে গেল। কেমন শিরশিরে শিহরণ অনুভব হচ্ছে!
ভয়ার্ত দৃষ্টিতে সামনের মানুষটির পানে চোখ রাখে সে।

— “প্রথমত বলি, এখানে তোমার বলা নামে কোনো কোম্পানি নেই। খোঁজ নিয়ে দেখতে পারো। তোমার অবস্থা সে জানতো বলেই, তোমাকে সহজে কাবু করতে পেরেছে। এসব শুধুমাত্র তার চাল, যেন শিকার নিজে এসে তার কাছে ধরা দেয়। যেভাবে তুমি এখানে এসেছ। নয়তো আজ ক’দিন? তোমাকে কেন এখনও কোম্পানিতে ডাকছে না?”

মনোযোগী শ্রোতা হয়ে বসে আছে মারিয়া। ইয়াসিরের গমগমে কণ্ঠ শোনা যায়,
— “দ্বিতীয়ত, মারিয়ার মাকে মিষ্টার মর্গান নিজেই খুন করে, আর মারিয়াকেও। মারিয়ার অসুস্থতা ছিল, যেটাকে উনি কাজে লাগিয়েছেন। তার কাজে মারিয়ার অসুস্থতা জাস্ট হেল্প করেছে।”

মারিয়া কিছু বলতে চাইলে ইয়াসির থামিয়ে দেয়। নিজেই বলতে থাকলো,
— “তৃতীয়ত, ডায়েরির শুরুর কথাগুলো মারিয়ার নিজের লেখা। কিন্তু শেষের দিকে ওকে জোর করে লিখতে হয়, নয়তো মর্গান তার কাজে সফল হতো না।
চতুর্থ, তোমার আসার আগেও এখানে একটা মেয়ে এসেছে। এবং ধারাবাহিকভাবে তাকেও খুন করে লাশ গায়েব করে দেওয়া হয়েছে।”

মারিয়ার চোখের সামনে সবকিছু ঝাপসা হচ্ছে, সে স্পষ্ট বুঝতে পারছে, তার শরীর আর ভার নিতে পারছে না। কিছু বলতে গিয়েও বলা হয় না। চেয়ারেই কাত হয়ে পড়ে যায় সে। ইয়াসির হুলুস্থুল করে উঠে দাঁড়ায়। কফি হাউজের বয়টাও দৌড়ে আসে। সকালের প্রথম কাস্টমারের কোনো ক্ষতি করতে তারা ইচ্ছুক নয়। ইয়াসির ভালো করে মারিয়ার নার্ভ চেক করে। অজ্ঞান সে।
বয়কে বিল পরিশোধ করে মারিয়াকে পাঁজাকোলা করে কোলে তুলে নেয় ইয়াসির। এখন এই মেয়েকে নিয়ে সে কোথায় যাবে? তার বাসায়? কিন্তু সে চায় না, এই মারিয়া কোনোদিন তার বাসায় যাক!
___

মিষ্টার মর্গানকে একের পর এক ফোন দিচ্ছে দারোয়ান। বিরক্তিতে তার মাথা ধরে গেল! এই বুড়ো ব্যাটা কী করছে? ঘণ্টা ধরে তাকে ফোন দিয়ে যাচ্ছে সে, তার কোনো খবরই নাই!

একপর্যায়ে ফোন রিসিভ হলে দারোয়ান ক্ষিপ্রগতিতে বলল,
— “ঐ মেয়ে বলল, তার নাকি অফিসে লেট হয়া যাবে। অফিস থেকে ফোন আসছে, সে তো বের হয়ে গেল। আপনি তো আমাদেরকে কিছু বললেন না।”
ওপাশ থেকে কড়া ঘুম উবে যায় মিষ্টার মর্গানের।
চোখমুখ লাল করে দারোয়ানকে বিশ্রী একটা গালি দিয়ে বললেন,
— “এক্ষুণি ওরে খুঁজে বের কর। ওরে না পাইলে তোদের রক্ত চুষব।”
দারোয়ানের মেজাজ খারাপ হয়ে যায়। একটা বাংলা গালি দিয়ে ফোন রেখে দেয় সে। কিছুটা দূরেই তার স্ত্রী দাঁড়িয়ে ছিল। কাছে এসে বলল,
— “এখন আবার কী ঝামেলা হইলো? কী বলে?”

স্ত্রীকে সব বলতেই সে বলে উঠলো,
— “উঠলো না ঘাড়ে নতুন মুসিবত? এখন এই মেয়েরে কই খুঁইজা পাই? আর এই মেয়ে কি কিছু টের পাইলো?”
— “কে জানে! যা গিয়া খুঁজা শুরু কর।”
___

মিষ্টার মর্গান আপাতত নিজের কাজে অন্য শহরে ক’দিনের জন্য যান। এর মাঝেই মারিয়াকে বাড়িতে বন্দি করার ফঁন্দিও এঁটে ফেলেছিলেন, হঠাৎ করে সব ভেস্তে যাবে তিনি তো ভাবতেও পারেননি। হাতের কাজ ফেলে দ্রুত তিনি বাড়িতে আসার প্রস্তুতি নেন।
যেভাবেই হোক মারিয়াকে হাতছাড়া করা যাবে না!
___

মাঝারি আকারের তিনরুমের বাসা ইয়াসিরের। শুরুতে পুরো ফ্যামিলি একসাথে থাকতো। পরবর্তীতে তার বাবার বদলির কারণে সবাই চলে যায়, শুধু মারিয়ার টানে ইয়াসির এত বড়ো খালি বাসায় একা পড়ে থাকে। সুবিধাই হয়েছে, মারিয়ার স্মৃতি বুকে আঁকড়েই থাকতে পারে সে। যেভাবে পেরেছে বাসাটা নিজের মতো গুছিয়েছে। বাহিরের রুমে মারিয়ার বিশাল বড়ো ছবি টাঙানো, ব্ল্যাক ড্রেস পরে হাতে লালচে কালো মিশেলের গোলাপগুচ্ছ।

ভেতরের রুমে মারিয়াকে শুইয়ে দিয়েছে ইয়াসির। আপনাআপনি জেগে উঠুক সে। ইয়াসির তার ধারে কাছেও ঘেঁষবে না। পকেট থেকে ফোন বের করে পুরনো নাম্বারে কল দেয়। ফোন রিসিভ হতেই ওপাশ থেকে একজন বলল,
— “হা, বল।”
— “একটু বাসায় আয়।”
— “এখন সম্ভব না। আগে রুগী দেখা শেষ হোক।”
— “বাসাতেও একটা রুগী পড়ে আছে। পারলে রিমিকে নিয়েই আয়।”

ওপাশের লোকটি চমকে উঠে। তার কণ্ঠ শুনেই বুঝা যাচ্ছে, সে খুব অবাক! একের পর এক প্রশ্ন করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে সে,
— “কোন রুগী? কে সে? কোথায় থাকে? পেলি কোথায়? তোর কী হয় সে? কখন হলো? কীভাবে হলো? কী হলো?”

রান্নাঘর থেকে কফির কাপটা হাতে নিয়ে ইয়াসির বলল,
— “আসলেই তো শুনতে পারবি?”

টুক করে ফোন রেখে দেয়। ওপাশের ফোনের মালিককে আর কোনো কথা বলার সুযোগ দিতে সে ইচ্ছুক নয়।

মোটা ভারি কাপটার ভেতর কফি গুঁড়োর সাথে দু’চামচ চিনি মিশিয়ে কফি বিটার দিয়ে সেটাকে পাতলা তরলে পরিণত করলো। চুলোয় রাখা দুধে গরম ধোঁয়া ভেসে উঠলেই, আঁচ বাড়িয়ে দুধে বুঁদবুঁদ ফুটিয়ে তোলে। দুধটুকু মগে ঢেলে বাকি জিনিস গুছিয়ে সোফায় চলে আসে। সোফার সামনেই টি টেবিল, ওটার ভেতর থেকে গোপন কাজে ব্যবহৃত ল্যাপটপটা বের করে আনে। কীসব টাইপ করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে ইয়াসির।

একবার এপাশ আরেকবার ওপাশ তাকাচ্ছে রাফি। মারিয়ার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে সে ইয়াসিরকে চাপা স্বরে বলল,
— “এত পুরাই তোর মারিয়া’রে। হুবহু কার্বন কপি কেমনে সম্ভব!”
রিমি পাশ থেকে বলল,
— “হতেই পারে। লোককথা জানো না? পুরো পৃথিবীতে একই চেহারার সাতজন করে মানুষ থাকে।”
রিমির কথা উড়িয়ে দেয় রাফি। হাত নাড়িয়ে বলল,
— “তাই বলে, এরকম? একদম ডুপ্লিকেট?”

প্রশ্নের জবাব দিলো না রিমি। অহেতুক কথা বলা সে পছন্দ করে না। চুপ থাকাটা দিনে দিন তার অভ্যাস নয়, পেশায় পরিণত হচ্ছে।
মারিয়ার জন্য একগ্লাস গ্লুকোজ বানিয়ে পাশের টেবিলে রেখে দিলো। আর কিছুক্ষণ পরেই হয়তো ওর জ্ঞান ফিরবে। রাফি ও ইয়াসিরকে রুম থেকে বেরোনোর জন্য তাগাদা দিলো সে।
ওরা চলে যেতেই ও মারিয়ার পাশে বসলো। হুবহু মারিয়ার অনুরূপীকে দেখে তারও অবাক লাগছে, একটা মানুষ আরেকটা মানুষের রূপ এমন নিখুঁত করে কীভাবে ধরতে পারে? একটু কেন ছিটেফোঁটাও অমিল নেই!

জ্ঞান ফিরতেই মাথার পাশে একজন শ্যামল সুন্দরীকে দেখতে পায় মারিয়া। প্রথমবার তাকাতেই তার চোখ আটকে যায়। মেয়েটার চেহারায় এত মায়া! কেমন করে মায়াবী চোখে তাকিয়ে আছে মেয়েটা।
উঠে বসে মারিয়া। রিমি চমক মুচকি হেসে উঠে, সে হাসি তার চেহারায় অন্যরকম উজ্জ্বলতা টেনে আনে। রিমিই প্রথম বলল,
— “এটা ইয়াসিরের বাসা। তুমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলায় ও তোমাকে এখানে নিয়ে এসেছে।”
— “আপনি?”
— “আমি ইয়াসিরের ফ্রেন্ড। আমার স্বামী রাফি, আমি আর ইয়াসির, আমরা কলেজ লাইফের বন্ধু।”
— “ওহ্!”
মারিয়ার পানে চেয়ে নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে হেসে উঠে রিমি। গ্লুকোজের গ্লাসটা তার দিকে বাড়িয়ে বলল,
— “এটা খেয়ে ফ্রেশ হয়ে আসো। আমি বাহিরে গিয়ে বসছি।”
মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানায় মারিয়া। দ্রুত গ্লাসে চুমুক দেয়।

‘চলবে…’

মারিয়া__পর্ব:- ০৫
কলমে:- সায়ীদা নুহা।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here