মায়াবতী পর্ব ৯

#মায়াবতী
#পর্ব_৯
#সুলতানা_পারভীন

-জি? কাকে চাই?

-আম–। মানে? এটা মায়াবতী মানে মায়াদের বাসা না?

-জি—। আপনাকে তো চিনতে পারলাম না—-?

-মানে–। আমি রাহাত—-। মায়া আমার–। মায়া আমার পি.এ–। এ্যাকচুয়েলি দুদিন আসছে না তাই–। খবর দিতে আসলাম কি হয়েছে—-।

-ওহ—। স্যার? আসুন ভিতরে আসুন—-।

-জি—। আপনি?

-আমি মায়ার বড় ভাই–।

-ওহ—।

-আসুন–আসুন—। মা? দেখো কে এসেছে?

ছেলেটা রাহাতকে ড্রইংরুমে বসতে বলে বাসার ভিতরে চলে গেল। রাহাতের মনে হল বুকের উপর থেকে এক টনের পাথর নামলো। মায়ার যে একটা বড় ভাই আছে সেটা ওর জানাই ছিল না। দরজায় ছেলেটাকে দেখে কত কি ভাবছিল! ব্যাপারটা মনে পড়তেই নিজে নিজেই লজ্জা পেল রাহাত। যে ছেলে কোন মেয়ের দিকে একবারের বেশি তাকিয়েও দেখে না সে নাকি যাকে চিনেও না এমন একটা ছেলেকে মায়ার বাসায় দেখে টেনশনে পড়ে গেছে! কিসব হচ্ছে ওর সাথে আজকাল কে জানে! কে এই মায়াবতী? কেন ওর দিকে এতো আকৃষ্ট হয়ে ছুটে যেতে ইচ্ছে করছে ওর?

রাহাত এসব ভাবতে ভাবতেই কারো কণ্ঠস্বর শুনে হুঁশ ফিরে পেল। একজন বয়স্ক ভদ্রমহিলা আগে দেখা ছেলেটার সাথে ড্রইংরুমে ঢুকছে।। রাহাত কি করবে চিন্তা করে এগিয়ে এসে সালাম করলো। কেন করলো নিজেও জানে না। উনাকে দেখেই বুঝা যাচ্ছে উনি মায়ার মা। মায়া অনেকটাই ওর মায়ের মতো হয়েছে।

-বেঁচে থাকো বাবা–। মিহান তোমার কথা বললো—। তুমি নাকি মায়াকে দেখতে এসেছ? মেয়েটা কি করে যেন এক্সিডেন্ট করে বসেছে–। পরশু রাত থেকে ধুম জ্বর। এখন একটু ঘুমাচ্ছে।

-এক্সিডেন্ট? হ্যাঁ আসলে ওর ওষুধ গুলো নিয়ে এসেছিলাম–। সেদিন তাড়াহুড়ায় আনতে ভুলে গেছে।

-ওহ–। মেয়েটাকে কত বলি সাবধানে চলাফেরা করবি–। কে শুনে কার কথা! এতোটা লাপরওয়া হলে হয় বলো বাবা?

-সেটাই আন্টি—। আন্টি আমি একটু মায়াকে দেখে আসবো? না মানে যদি কিছু মনে না করেন—।

রাহাতের এমন আবদার শুনে মায়ার মা আর মিহান একে অন্যের মুখ চাওয়াচাওয়ি করলো একবার। তারপর রাহাতের দিকে তাকিয়ে হাসলো।

-ওই রুমটায় মায়া আছে—-।

মিহানের দেখানো রুমটায় ঢুকে আলতো করে দরজাটা চাপিয়ে দিল রাহাত। মেয়েটা এই সময়ে ঘুমিয়ে আছে? ঘড়িতে দেখলো সন্ধ্যা পার হয়ে রাত নেমেছে। ঘড়িতে আটটা বাজে। এই সময় মায়াকে দেখতে ছুটে এসেছে তাও একেবারে মায়ার রুমে! ভাবতেই একটু ইতস্তত করলো রাহাত। মেয়েটাকে না দেখে আর এক মিনিট থাকা সম্ভব হচ্ছিল না ওর পক্ষে। কি আর করবে!

ধীর পায়ে মায়ার মাথার কাছে এসে বসলো রাহাত। মুখটা দেখেই বুকের ভেতরটা ধ্বক করে উঠলো। চোখ মুখ বসে গেছে মেয়েটার। চোখের নিচে হালকা কালি ফুটে উঠেছে। তবুও এই মুখটায় কতই না মায়া! মায়াবতীর মায়া ভরা মুখটা দেখে দুদিনের না দেখার কষ্টটা একেবারে উবে গেল রাহাতের৷ একটু ঝুঁকে মায়ার কপালে একটা ভালোবাসার পরশ বুলিয়ে দিল রাহাত। মায়া একটু নড়ে উঠতেই চুলে আলতো করে বিলি কেটে দিল। মায়া আবার গভীর ঘুমে তলিয়ে গেল।

মায়ার বেডসাইড টেবিলে একটা নোট প্যাড আর কলম দেখে একটা চিরকুট মতো লিখে রাখলো রাহাত৷ তারপর ওষুধের প্যাকেটটা রেখে উঠে বেরিয়ে গেল রুম থেকে। ছোট্ট চিরকুটটায় কয়েকটা লাইন লিখেছে রাহাত।

“মায়াবতী,

প্লিজ তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে ফিরে এসো। তোমাকে ছাড়া সব একেবারে এলোমেলো হয়ে আছে। আমি একদম এলোমেলো হয়ে আছি। সুস্থ হও জলদি।”

এই চিরকুট দেখে মায়ার কি রিএ্যাকশন হবে সেটা নিয়ে এই মূহুর্তে মাথা ঘামাচ্ছে না সে। আর কয় দিন মায়াবতীকে না দেখে কাটাতে হবে সেটা ভেবেই দুনিয়াদারি অন্ধকার লাগছে রাহাতের।

দুদিন পার হয়েছে। সকালে অফিসে যাওয়ার আগে কি মনে হতে মায়ার ফ্ল্যাটের দিকে গেল রাহাত। মেয়েটার একটু খোঁজ খবর নেয়া দরকার। আর এক নজর চোখের দেখাটাও দেখে আসা ছাড়া শান্তি লাগছে না ওর। ভাবতে ভাবতেই মায়ার বাসার সামনের বড় রাস্তায় পৌঁছেছে রাহাত৷ রাস্তার একপাশে যাত্রী ছাউনিতে মায়াকে দেখেই গাড়ি ব্রেক করলো রাহাত৷ মেয়েটা বাসের জন্য দাঁড়িয়েছে! মায়াকে দেখে জাস্ট সব ভুলে হা করে তাকিয়ে রইলো বেচারা।

একটা তাঁতের শাড়ি পড়েছে মায়া। সাদা আর কালো রঙা। সাথে কালো ফুল হাতা ব্লাউজ। চুলগুলো বেণী করে বাঁধা। কানে ছোট কানের দুল। আর হালকা কাজল টানা চোখ। এই কয়দিন যে এতো অসুস্থ ছিলে সেটা মায়াকে দেখলে বোঝাই সম্ভব না। ওকে দেখতে প্রথম বর্ষার পর গাছের সতেজ ফুলের মতো দেখাচ্ছে। একদম তরতাজা, প্রাণবন্ত। আর সেই মায়াভরা চোখ মুখ দেখে রাহাতের অবস্থা কাহিল। মায়াকে দেখতে দেখতে সময়ের খেয়ালই ছিল রাহাতের। হুঁশ হলো মায়া উঠে দাঁড়ানোয়। সম্ভবত বাস চলে এসেছে।

মায়া বাসের দিকে যাচ্ছে দেখে হর্ন বাজালো রাহাত। মেয়েটা বাসের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে দেখে আরো দুবার থেমে থেমে হর্ন দিলো রাহাত। এবার মায়া থমকে দাঁড়িয়ে গেছে দেখে রাহাতের ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে উঠলো। আরেকবার হর্ণ দিতেই মায়াও এদিক ওদিক তাকিয়ে শেষে রাহাতের গাড়িটা দেখতে পেয়ে এগিয়ে এলো। চোখে মুখে রাজ্যের কৌতূহল।

-স্যার আপনি এখানে? তাও এখন?

-গাড়িতে উঠে এসে বসো—-।

-না স্যার–। আমি বাসে চলে যেতে পারবো–।

-চুপচাপ উঠে আসুন মায়াবতী—। রাস্তার মাঝ থেকে উঠিয়ে আনা ব্যাপারটা ভালো দেখাবে না-।

মায়া ভ্রু কুঁচকে রাহাতকে একবার দেখে গাড়িতে এসে বসলো। রাহাতও মনের আনন্দে ড্রাইভ করা শুরু করলো।

-আপনি এখন এখানে কি করছেন স্যার?

-একজনকে দেখতে এসেছিলাম–।

-ওহ—।

-জ্বর সেরেছে মিস মায়াবতী?

-জি স্যার—-।

-কই দেখি—-?

রাহাত বাম হাত দিয়ে মায়ার কপালে আলতো করে ছুঁয়ে দেখলো। জ্বর নেই। কয়েক দিনের চিন্তার পর শান্তি লাগছে রাহাতের। আর মায়া রাহাতের স্পর্শে কেঁপে উঠে বাইরের দিকে তাকালো। এই মানুষটার কাজকর্ম ইদানিং কিছুই বুঝতে পারে না ও৷ সেদিন বাসায় ওষুধ আর চিরকুটটা পেয়ে একেবারে অবাক হয়ে গেছে মায়া। এত কম সময়ে একটা মানুষের এতোটা বদল কি আধো সম্ভব! ভাবতে ভাবতেই অফিসে চলে এসেছে ওরা দুজনে।

গাড়ি পার্ক করে মায়া আর রাহাত অফিসে ঢুকতেই কারো গলার আওয়াজে থমকে গেল। কণ্ঠটা পরিচিত। আর আসছেও অফিসের বসার ঘরের দিক থেকে৷ ভ্রু কুঁচকে রুমটার কাছাকাছি আসতেই কথাগুলো কানে গেল ওদের দুজনেরই।

-ওই মেয়েটা রাহাত স্যারকেও হাত করেছে–। সব জাল প্রুফ দেখিয়ে আমাকে বদনাম করার চেষ্টা করছে। আমি তো ছুটে গেছি। দেখছো তো সকলে? আর আমি এতোগুলো দিন তোমাদের সাথে কাজ করি—। আমাকে তো তোমরা ভালো করেই চিনো–। আমি হয়তো এখানে আর থাকবো না–। তবে এই মেয়ে স্যারদের সব সম্পত্তি আত্মসাৎ করবে-। মিলিয়ে নিও তোমরা।

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here