মেঘবদল পর্ব -১০

#মেঘবদল
লেখক-এ রহমান
পর্ব ১০

সারা বাড়ি জুড়ে পিনপতন নীরবতা। সবার উৎসুক দৃষ্টি ঈশার উপরে স্থির। শাড়িটা খামচে ধরে দাড়িয়ে আছে সে। হাত পা কাঁপছে তার। শুকনো ঢোক গিলে অস্থির দৃষ্টি এদিক সেদিক ফেলছে। তার বাবা গর্জে উঠে বললেন
–তুমি কি চাও স্পষ্ট করে বল।

ঈশা কেঁপে উঠলো। ভয়ে তার গলা শুকিয়ে গেছে। কথা গলায় দলা পেকে যাচ্ছে। সেই ঘটনার পরে ইভান ঘর থেকে বেরিয়ে এসে বাইরের বিষয়টা স্বাভাবিক ভাবেই সামলে নেয়। প্রথমে সবার মনে একটু সন্দেহ তৈরি হলেও ইভান নিজের কথার জালে বিষয়টা দূর করে দিতে সক্ষম হয়। কিন্তু বিপত্তি বাধে যখন ঈশাকে আংটি পরাতে ডাকা হয়। আংটি পরানোর আগ মুহূর্তে ঈশা কঠিন গলায় বলে সে এই বিয়েতে রাজি না। ঈশার তীব্র আপত্তি বুঝে ছেলে পক্ষ আংটি না পরিয়েই চলে যায়। আর যাওয়ার আগে ঈশার বাবাকে অপমানের সুরে বলে এভাবে মেয়েকে না জানিয়ে তাদেরকে ডেকে আনা তার ঠিক হয়নি।মেয়ে রাজি কিনা সেটা আগে জেনে নেয়া উচিৎ ছিল। ঈশার বাবা আর একটু কাছাকাছি এসে বলল
–কেন তুমি এই বিয়ে করতে পারবে না? কি সমস্যা তোমার? খুলে বল।

ঈশা ঢোক গিলল। হাত পা অসাড় হয়ে যাচ্ছে। কথা বলতে চেয়ে বুঝতে পারল কণ্ঠ অস্বাভাবিক রকম কাঁপছে তার। তার বাবা হুঙ্কার দিয়ে বলল
–কথা বল ঈশা।

ঈশা কেঁপে উঠে শাড়ি খামচে ধরল আরও শক্ত করে। চোখ বন্ধ করে জোরে একটা শ্বাস টেনে এক নিশ্বাসে বলে ফেললো
–আমি ইভান কে ভালবাসি। বিয়ে করলে তাকেই করবো।

নিরবতায় কেটে গেলো কয়েক মুহূর্ত। সবার দৃষ্টিতে আকাশসম বিস্ময় আর কৌতূহল। কিন্তু খানিকবাদেই পুরো ঘটনা বদলে গেলো। ঈশার বাবা সজরে মেয়ের গালে থাপ্পড় মারলেন। রাগে তিনি কাঁপছেন। চিৎকার দিয়ে বললেন
–এসব কি তোমার কাছে ছেলে খেলা মনে হয়? তুমি যখন বিয়েই করবে না তাহলে কেন রাজি হয়েছিলে? তোমাকে জিজ্ঞেস করেই আমি তাদেরকে বাসায় আসতে বলেছিলাম। আর তুমি জানতে যে তারা তোমাকে আংটি পরানোর প্রস্তুতি নিয়েই আসবে। সেটাতেও তোমার মত ছিল। আমি চাইলেই তোমাকে না জিজ্ঞেস করেই আংটি পরানোর ব্যবস্থা করে ফেলতে পারতাম। কিন্তু আমি অমন বাবা নয়। তাই তোমার কাছে শেষবার জানতে চেয়েছিলাম। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে আমি ভুল করে ফেলেছি।

ঈশার দুই বাহু শক্ত করে ধরলেন তিনি। ইভান এতক্ষন নিরব দর্শকের মতো সব দেখছিল। পুরো ঘটনা বুঝতে তার অনেকটা সময় লেগে গেলো। সে এগিয়ে যেতেই নাহিদ তাকে আটকে দিলো। ফিসফিসিয়ে বলল
–তুই এখন ওখানে যাস না। এমনিতেই ছোট চাচা রেগে আছে তুই গেলে আরও পরিস্থিতি খারাপ হয়ে যাবে।

ঈশার বাবা তাকে ধরে বলল
–তুমি কি বুঝতে পারছ তুমি আমাকে কতটা ছোট করেছ? আমার মান সম্মান বলে কিছু থাকলো না। কি ভেবেছ তুমি যা ইচ্ছা তাই করবে?

ঈশার বাবা কথা শেষ করতে পারলেন না। রাগের মাত্রা এতো বেড়ে গেছে যে তার কথা জড়িয়ে যাচ্ছিল। ইভানের বাবা এগিয়ে এসে ভাইকে ধরে বললেন
–শান্ত হ। আমরা এটা নিয়ে পরে ঠাণ্ডা মাথায় কথা বলবো।

ইভানের বাবা তাকে ধরে ঘরে নিয়ে গেলো। সবার চেহারায় বিস্ময় প্রকাশ পেলেও ইভানের মায়ের চেহারা দেখেই বোঝা যাচ্ছে অপ্রত্যাশিত ভাবে মনের চাওয়াটা সত্যি হওয়াতে তিনি বেশ খুশী। ঈশা দাড়িয়ে কাঁদছে। ইভান শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার দিকেই। নাহিদ ইভানের ঘাড়ে হাত রেখে বলল
–তুই আর ঈশা কিভাবে কি? কিছুই তো বুঝতে পারলাম না। তোরা তো সারাদিন ঝগড়া করিস। ঝগড়া থেকে প্রেম! বেশ অদ্ভুত ব্যাপার।

ইভান বিরক্তিকর শ্বাস ছেড়ে নাহিদের দিকে তাকাল। ভ্রু কুচকে বলল
–আমাকে আগে বুঝতে দাও তারপর তোমাকে বোঝাচ্ছি।

তার কথা শুনে নাহিদ আকাশ থেকে পড়ল। বিস্ময়কর চোখে তাকিয়ে বলল
–মানে?

বড়রা সবাই ঘরে চলে গেলো। বিষয়টা নিয়ে ঈশার বাবা প্রচণ্ড রেগে আছে। তাকে বোঝানো দরকার। ঈশা তখনও সেখানে দাড়িয়ে কাঁদছে। সবাই চলে যেতেই ইভান গ্লাসে পানি ঢেলে নিয়ে ঈশার সামনে ধরল। ঈশা গ্লাসের দিকে একবার তাকিয়ে চোখ তুলে ইভানের দিকে তাকাল। দৃষ্টি তীক্ষ্ণ তার। ইভান সেই দৃষ্টি দেখে ঘাবড়ে গেলো। তার উপরে ঈশার এতো রাগ করার কোন কারন নেই। তার তো কোন দোষ নেই। ইভান নরম সরে বলল
–পানিটা…।

ঈশা হাত থেকে গ্লাসটা নিয়ে ছুড়ে ফেলে দিলো। ইভান বিরক্ত হল। এরকম আচরন করার কোন কারন নেই। বিরক্তিকর কণ্ঠে বলল
–একজনের রাগ আরেকজনের উপরে দেখানোটা কি ঠিক? আর অসময়ে সাহস দেখালে এরকম পরিস্থিতির স্বীকার তো হতেই হবে।

ঈশা আরও রেগে গেলো। নাক কাঁপছে তার। ইভান শান্ত সরে বলল
–বিয়ে করবি না সেটা আগে বললেই হতো। তাহলেই তোর বাবা এতো আয়োজন করত না। এখন এসে সামলাতে না পেরে অজথা আমাকে ফাসিয়ে দিলি। সেটা একদম ঠিক হল না ঈশা।

ঈশা রাগ সামলাতে না পেরে কেঁদে ফেললো। করুন চোখে তাকাল ইভানের দিকে। তারপর নিজের ঘরে চলে গেলো। জারিফ ইভানের উপরে ভীষণ বিরক্ত হল। তিক্ত কণ্ঠে বলল
–একটা মেয়ে সবার সামনে এভাবে তার ভালবাসার কথা বলল আর তোমার আচরন দেখে মনে হচ্ছে পুরো বিষয়টাই তোমার কাছে ফানি মনে হচ্ছে। কেন ইভান? তুমি কি তাহলে অন্য কাউকে ভালোবাসো?

ইভান তাচ্ছিল্য ভরা কণ্ঠে বলল
–ভালবাসি মুখে বললেই সেটা ভালবাসা হয় না। ভালবাসলে সেই মানুষটার উপরে বিশ্বাস থাকতে হয়। তুমি যখন কাউকে ভালবাসবে তখন তোমার সবটা জুড়ে শুধু সেই থাকবে। তার মাঝেই হবে তোমার অস্তিত্ব।

ইভান কথা শেষ করে চলে গেলো বাইরে। জারিফ নাহিদকে বলল
–আমি ইভানের কথা কিছুই বুঝলাম না। কি বোঝাতে চাইল সে?

নাহিদ হতাশ শ্বাস ছেড়ে বলল
–আমিও না।

তারা আর সেখানে দাঁড়াল না। যে যার মতো চলে গেলো।

————–
গাড়ি নিয়ে বড় রাস্তা পেরিয়ে ছোট একটা গলিতে ঢুকল নাহিদ। সারাদিনে অফিসে কাজ করে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। লম্বা বিশ্রাম দরকার তার। একটু এগিয়ে যেতেই ভিড় দেখে গাড়ির গতি কমিয়ে এগিয়ে যেতে লাগলো। ভিড়ের কাছাকাছি যেতেই বেশ জোরে জোরে হর্ন বাজাল। তার গাড়ির শব্দ শুনে ভিড় ঠেলে একজন মহিলা বের হয়ে এসে গাড়ি থামাতে বলল। নাহিদ তৎক্ষণাৎ থামিয়ে দেয় গাড়ি। মহিলা ব্যস্ত ভঙ্গিতে বলল
–এখানে একটা ছোট এক্সিডেন্ট হয়েছে। আপনার সাহায্য দরকার।

নাহিদ এক্সিডেন্টের কথা শুনে তাড়াহুড়ো করে গাড়ি থেকে নেমে গেলো। মহিলাকে উদ্দেশ্য করে বলল
–কি হয়েছে?

মহিলাটা ভিড়ের দিকে আঙ্গুল তাক করে বলল
–একটা মেয়ে রিক্সা থেকে পড়ে গিয়ে মাথা ফেটে গেছে। অনেক রক্ত পড়ছে। তার জ্ঞান নেই। হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে।

নাহিদ ভিড় ঠেলে ঢুকেই চেহারা দেখে আঁতকে উঠলো। দৌড়ে গিয়ে কাছে বসে কয়েকবার ডাকল
–মৃন্ময়ী? মৃন্ময়ী? শুনতে পাচ্ছেন?

কিন্তু মৃন্ময়ীর তখন কোন জ্ঞান নেই। মাথা ফেটে অনেক রক্ত পড়েছে। নাহিদ আর দেরি না করেই লোকজনের সাহায্য নিয়ে তাকে গাড়িতে তুলে হাসপাতালে নিয়ে এলো। মৃন্ময়ীকে এমারজেন্সিতে নিয়ে মাথায় ব্যান্ডেজ করে দেয়া হল। কিন্তু তার জ্ঞান ফিরছে না। তাই ডাক্তার সিদ্ধান্ত নিয়েছে তাকে জ্ঞান ফেরা পর্যন্ত হাসপাতালেই রাখবে। নাহিদ কিছু বলল না। সে বসে অপেক্ষা করতে লাগলো। ঘণ্টা খানেক অপেক্ষা করার পর তার মনে পড়ল মৃন্ময়ীর বাড়িতে তো এসবের কিছুই জানে না। তারা চিন্তা করবে তার জন্য। মৃন্ময়ীর ব্যাগটা তার কাছেই ছিল। সেটা হাতড়িয়ে ফোনটা বের করে নিলো। কিন্তু ফোনটা লক করা। হতাশ হয়ে বসে পড়ল সে। সব কিছু এলোমেলো লাগছে তার। কিভাবে কি করবে বুঝতে পারছে না। আর সারারাতে যদি মৃন্ময়ীর জ্ঞান না ফিরে আসে তাহলে বিপদ হয়ে যাবে। সাত পাঁচ ভাবতে গিয়ে মনে হল তার মায়ের কাছে মৃন্ময়ীর কোন ঠিকানা বা নাম্বার থাকতে পারে। আর দেরি না করে মাকে ফোন দিলো। সায়রা ফোন ধরতেই সে ব্যস্ত ভঙ্গিতে বলল
–মা তোমার কাছে মৃন্ময়ীর কোন আত্মীয়ের নাম্বার আছে?

ঘটনার আকস্মিকতায় কিছুই বুঝতে পারল না সায়রা। মিনমিনে কণ্ঠে বলল
–কে মৃন্ময়ী?

নাহিদ বিরক্ত হয়ে বলল
–ভুলে গেছ? যেই মেয়েটা আমার জন্য পছন্দ করেছিলে সেই মেয়েটার নাম মৃন্ময়ী। তার কারো নাম্বার বা ঠিকানা কিছু আছে তোমার কাছে?

সায়রা কিছুক্ষণ চুপ করে বুঝতে চেষ্টা করলেন। সবটা বুঝতে পেরে তিনি মনে মনে বেশ খুশী হলেন। উতফুল্য কণ্ঠে বললেন
–তার খালার একটা নাম্বার ছিল। এখন আছে কিনা জানি না। খুজে দেখতে হবে।

নাহিদ অস্থির কণ্ঠে বলল
–একটু খুজে দেখো না মা।

সায়রা নাহিদের এমন কণ্ঠ শুনে বুঝতে পারল যে কোন বিপদ হয়েছে। সে জানতে চাইলে নাহিদ তাকে সবটা খুলে বলল। সায়রা সব শুনে নাম্বার খুজে বের করে নাহিদকে দিলো আর সাথে হাসপাতালেও আসতে চাইল। কিন্তু নাহিদ রাজি হল না। রাত হয়ে গেছে অনেক। নাম্বারটা পেয়ে নাহিদ সেটাতে কল দিলো। কিন্তু ফোনটা বন্ধ। কয়েকবার কল করেও পেলো না। বারবারই ফোনটা বন্ধ দেখাচ্ছে। এখন সে কি করবে সেটা নিয়েই ভাবছে। তার খালার বাড়ির ঠিকানা সে জানে। সেদিন লিফট থেকে নামার পর মৃন্ময়ী বলেছিল সেখানে তার খালার বাড়ি। কিন্তু এই অবস্থায় তাকে রেখে নাহিদ কোথাও যেতে পারবে না। মাথার চুল ধরে টেনে কিছুক্ষণ ভাবল কি করবে এখন। কোন উপায় নেই তার কাছে। এখন মৃন্ময়ীর জ্ঞান না ফেরা পর্যন্ত অপেক্ষা করা ছাড়া আর কোন উপায় নেই। আর একটা উপায় আছে সেটা যদি মৃন্ময়ীর ফোনে তার বাড়ি থেকে কেউ ফোন করে।

চলবে……
(রিচেক করা হয়নি। ভুল থাকলে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here