মেঘবদল পর্ব -০৮+৯

#মেঘবদল
লেখক-এ রহমান
পর্ব ৮

‘মেঘবদল’ বড়ই অদ্ভুত নাম। ঢাকা শহরের অলিগলিতে বিচিত্র ঘটনা ঘটে থাকে সেটা সবাই জানে। কিন্তু এমন বিচিত্র নামের বাড়িও যে থাকতে পারে সেটা ফারিয়া জারিফ কারো ধারনা ছিল না। এমন অদ্ভুত নাম রাখার কারণটা কেউই খুজে পেলো না। জানার তীব্র ইচ্ছা থাকলেও নতুন হিসেবে প্রশ্নটা করতে সায় দিলো না মন। তাই দুজনেই নিজের কৌতূহল দমন করে সোফায় বসে আছে। তাদের ঠিক সামনেই বসে আছে নুরুল রহমান আর ইভান। নিজেদের পরিচয় পর্বটা সেরে নিচ্ছে তারা। আর মাহমুদা ততক্ষণে কথা শেষ করে চলে গেছে। রান্না ঘরে নাস্তা বানাতেই ব্যস্ত। অতিথি এসেছে বাড়িতে। প্রতিদিনের নিয়ম ভেঙ্গে নতুন কিছু আয়োজনের পায়তারা তার। কলিং বেলের আওয়াজে তাদের কথার মাঝে বাধা পড়ল। ইভান বলল
–আমি দেখছি।

দরজা খুলে ঈশাকে দেখেই সকাল সকাল তার মনটা ভালো হয়ে গেলো। ঈষৎ হাসির রেখা মিলল ঠোটের কোনে। দৃষ্টি গভির হল। কিন্তু ইভান কে দেখে ঈশার মনের অবস্থা ঠিক বিপরীত। রাগ আর অভিমান ভিড় করলো পুরটা জুড়ে। একবার তাকিয়েই চোখ নামিয়ে নিলো ঈশা। ইভান মুচকি হেসে সরে দাঁড়াল। ঈশা ভেতরে ঢুকেই দুজন সম্পূর্ণ অপরিচিত মানুষকে দেখে থেমে গেলো। চোখে মুখে কৌতূহল তার। নুরুল সাহেব ঈশাকে হাতের ইশারায় তার কাছে ডাকল। ঈশা দাড়াতেই তিনি বেশ উতফুল্যতার সাথে বললেন
–আমার বন্ধু ফিরোজের মেয়ে আর তার জামাই। তোদের পাশের ফ্ল্যাটে থাকবে এখন থেকে।

ঈশা সৌজন্য হাসল। নুরুল রহমান উঠে দাড়িয়ে বললেন
–আমার একটু কাজ আছে। আমি বাইরে যাবো। তোমরা থাক তাহলে। পরে কথা হবে তোমাদের সাথে। আর কোন অসুবিধা হলে ঈশাকে বলবে। আমার ছোট ভাইয়ের মেয়ে। তোমাদের পাশের ফ্ল্যাটেই থাকে।

কথা শেষ করে নুরুল সাহেব চলে গেলেন। মাহমুদা রান্না ঘর থেকে বেরিয়ে এলো। সবাইকে টেবিলে বসতে বলল খাওয়ার জন্য। ফারিয়া, জারিফ আর ইভান বসে পড়ল। ঈশা মাহমুদার সাথে রান্না ঘর থেকে খাবার এনে দিলো টেবিলে। মাহমুদা রান্না ঘরে যেতে যেতে ঈশাকে বলল
–তুইও বসে পড়। খেয়ে নে।

ঈশা অভিমানি দৃষ্টিতে ইভানের দিকে একবার তাকাল। সে খাবার নিয়ে খাওয়াতে ব্যস্ত। ক্লান্ত সরে বলল
–আমি খাব না বড় মা। মা খাবার পাঠিয়েছিল তাই দিতে এসেছিলাম।

বলেই পা বাড়াতেই ইভান হাত ধরে ফেললো। ঈশা অবাক চোখে তাকাল তার দিকে। ভীষণ বিরক্ত হল তার উপরে। রাগে নাক কাঁপতে লাগলো। বিরক্ত হলেও অপরিচিত দুজন মানুষের সামনে খারাপ ব্যবহার করলো না। ইভান শান্ত সরে বলল
–খেয়ে তারপর যাবি।

ঈশা কঠিন দৃষ্টিতে তাকাল। যার অর্থ সে খাবে না। হাত টান দিতেই ইভান হাতের জোর আরও বাড়িয়ে দিলো। আঙ্গুলের দাগ চেপে বসে গেলো হাতে। পাশের চেয়ারটায় ইশারা করে কঠিন গলায় বলল
–সময় নষ্ট না করে বসে পড়।

ফারিয়া জারিফ দুজনেই তাদের দিকে তাকিয়ে আছে বিস্ময় নিয়ে। সবটা বুঝতে না পারলেও তাদের মাঝে অব্যক্ত কোন মান অভিমান আছে সেটা ভালোভাবেই বুঝে গেলো দুজন। তাদের দৃষ্টির কৌতূহল আর বিস্ময় ইভান খেয়াল না করলেও ঈশা ভালো করেই দেখতে পেলো। তাই আর কথা বাড়াল না। বসে পড়ল টেবিলে। খানিকবাদে মাহমুদা রান্না ঘর থেকে বেরিয়ে এসেই বলল
–তোমরা কিন্তু দুপুরেও খাবে।

ফারিয়ার বিষয়টা ভালো লাগলো না। প্রথম দিন এসেই তাদের এমন বিরক্ত করার ইচ্ছা তার নেই। তাই তীব্র আপত্তি জানালো। বলল
–না আনটি আমরা একটা ব্যবস্থা করে নিবো।

মাহমুদা অবাক সরে বলল
–এটা কেমন কথা? এখনও গুছিয়ে উঠতে পারো নি। পুরো বাড়ি গোছাতে অনেক সময়ের ব্যপার। আর এই অবস্থায় রান্না করার কোন দরকার নেই।

ফারিয়া জারিফ দুজনেই আপত্তি জানালেও মাহমুদার তীব্র জেদের কাছে আর কোন কথা বলতে পারল না। ঈশা বলল
–রাতের খাবারটা আমাদের বাসায়। আজ আমার ছোট বোনের জন্মদিন। তাই ছোট করে একটু আয়োজন করা হয়েছে রাতে। আপনারা কিন্তু থাকবেন।

ঈশার জোরে রাজি হয়ে গেলো তারা। টেবিলেই সেরে নিলো পরিচয় পর্ব। সবাই মিলে বেশ কিছুক্ষণ কথা বলল। তারপর মাহমুদা ঈশাকে পাঠিয়ে দিলো ফারিয়ার সাথে বাড়ি গোছাতে।

———–
অফিসের বাইরে একটা মিটিং শেষ করতেই নাহিদের বিকেল পেরিয়ে সন্ধ্যা হয়ে গেলো। বেশ তাড়াহুড়ো করছে বাড়ি যাওয়ার জন্য। কারন আজ ইলুর জন্মদিন। বিকেলের মধ্যেই সবাইকেই বাসায় থাকতে বলেছে। আর সেও কথা দিয়েই বেরিয়েছিল ঠিক সময় মতো চলে আসার। কিন্তু কথা রাখতে না পারায় বেশ খারাপ লাগছে। লিফটের বাটন প্রেস করে দাড়িয়ে থাকল। লিফট নিচ থেকে উপরে উঠছে। ঠিক সেই সময় ফোন বেজে উঠলো তার। ফোনটা ধরে হ্যালো বলতেই ওপাশ থেকে ব্যস্ত ইভান বলল
–ভাইয়া তুমি কোথায়? এখনও আসছ না কেন?

নাহিদ ক্লান্ত সরে বলল
–আর বলিস না। একটা কাজে দেরি হয়ে গেলো। আমি চলে আসছি এখনই। বেশী সময় লাগবে না।

আরও দুই একটা কথার মাঝেই লিফট এসে থেমে গেলো। দরজা খুলতেই চোখে ঠেকল এক বিবর্ণ দৃশ্য। মৃন্ময়ীর পাশে এক সুদর্শন যুবক। দুজনের হাতের ভাজে হাত। মৃন্ময়ীর সাজ সজ্জা চোখে লাগার মতো। শাড়িতে জড়ান শ্যাম বর্ণের নারী এক যুবককে আঁকড়ে ধরে দাড়িয়ে আছে। লিফটের দরজা বন্ধ হতেই ছেলেটি আবার বাটন চাপ দিলো। দরজা খুলে গেলেই নাহিদ তার সম্ভিত ফিরে পেলো। ভেতরে ঢুকে এক পাশে দাঁড়াল। ছেলেটিকে চিনতে নাহিদের অসুবিধা হল না। আগেরদিনেও এই ছেলেকেই দেখছে সে। মৃন্ময়ী নাহিদের দিকে তাকিয়ে আছে অপলক দৃষ্টিতে। এই মুহূর্তে তার সাথে দেখা হওয়ায় বেশ অপ্রস্তুত সে। নাহিদ কথা বলার মতো আগ্রহ খুজে পেলো না। মৃন্ময়ী কয়েকবার চোখের পলক ফেললো। কথা বলতে গিয়েও গলায় কেমন ঠেকল। তবুও সৌজন্য হিসেবে কিছু তো বলতেই হয়। নাহলে বিষয়টা কেমন দেখায়। শুকনো ঠোট জোড়া ভিজিয়ে নিয়ে মৃদু সরে বলল
–আপনি এখানে?

নরম কণ্ঠ কানে লাগতেই নাহিদ চোখ তুলে তাকাল। শান্ত সরে বলল
–একটু কাজ ছিল। তাই এসেছিলাম।

‘ওহ’ বলেই থেমে গেলো দুজনে। পিনপতন নিরবতায় লিফট এসে থামল। নাহিদ আগে বের হতেই পেছন থেকে ফিসফিসানির আওয়াজ কানে এলো। কয়েক কদম এগিয়ে যেতেই ছেলেটি পেছন থেকে ডাকল
–নাহিদ ভাইয়া?

নাহিদ থেমে পিছনে ঘুরে তাকাল। ছেলেটি মৃন্ময়ীর হাত ছেড়ে দিয়ে নাহিদের দিকে এগিয়ে আসছে। তার কাছে এসে বলল
–আপনি নাহিদ ভাইয়া তাই না?

নাহিদ মাথা নাড়াল। ছেলেটি এক গাল হেসে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল
–আমি মামুন। মৃন্ময়ী আমার আপু।

নাহিদ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলো। ছেলেটির কথা মাথায় ঢুকতেই ঠোট এলিয়ে হেসে হাত মেলাল। মৃন্ময়ী এগিয়ে এসে দাঁড়াল। মামুন অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে বলল
–দেখুন না। আপু আমাকে একবারও আপনার কথা বলল না। আগেই যদি বলতো তাহলে এতক্ষনে পরিচয় হয়েই যেতো।

নাহিদ হাসল। কি উত্তর দিবে ভেবে পেলো না। শুধু নিজের চিন্তা ভাবনার উপরে বিরক্ত হল। না জেনে কাউকে এভাবে সন্দেহ করা একেবারেই ঠিক না। মৃন্ময়ীর সম্পর্কে কতো কিছুই না ভেবে বসেছে সে। নিজের ভাবনা নিজের কাছেই বাজে ঠেকতেই সে ভীষণ লজ্জিত ভঙ্গিতে তাকাল মৃন্ময়ীর দিকে। মৃন্ময়ী এগিয়ে এসে বলল
–৫ তলায় আমার খালার বাসা। আমি সেখানেই থাকি। আর মামুন ওর কলেজের হোস্টেলে থাকে। একটু বাইরে যাচ্ছিলাম দুজনেই।

নাহিদ লজ্জিত ভঙ্গিতে বলল
–ওহ আচ্ছা।

থেমে আবার বলল
–কোনদিকে যাবেন আপনারা?

মামুন হেসে বলল
–ঐ সামনে একটা শপিং মল আছে ওখানেই যাবো।

নাহিদ বিনয়ের সুরে বলল
–আমার গাড়িতে যেতে পারেন। কোন সমস্যা নেই।

মৃন্ময়ী এগিয়ে এসে মামুনের হাত ধরে বলল
–না না। কাছেই। আমরা রিক্সা নিয়ে চলে যাবো।

মামুন বোনের কথা শুনল না। হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বলল
–আমরা যাবো ভাইয়া। এর ফাকে ভাইয়ার সাথেও কথা হয়ে যাবে।

মৃন্ময়ীর কথা সেখানে আর খাটল না। সবাই মিলে গাড়িতে উঠে বসল। বেশ গল্পের সাথেই জাত্রা শেষ হল। শপিং মলের সামনে গাড়ি থেকে নেমে গেলো দুজন। নাহিদ মৃন্ময়ীর দিকে তাকাল। সেদিন কোন কারনে এতো গভির ভাবে দেখার সুযোগ হয়ে উঠেনি। কিন্তু আজ তার চোখে মৃন্ময়ীর সৌন্দর্যের গভিরতা ধরা দিলো। কিছু বলতে চেয়েও বলা হয়ে উঠলো না। মৃন্ময়ী মৃদু হেসে বিদায় নিয়ে চলে গেলো সেখান থেকে। নাহিদ গভির দৃষ্টিতে তাকাল। সেদিন এমন ভাবে খেয়াল না করলেও আজ তার মনে হল মেয়েটির মাঝে অদ্ভুত এক মায়া আছে।
#মেঘবদল
লেখক-এ রহমান
পর্ব ৯

কোলাহল পূর্ণ পরিবেশের এক পাশে বসে বেশ মনোযোগ দিয়ে ফোনে কিছু একটা একটা দেখছে ইভান। জারিফ হাতে একটা জুসের গ্লাস নিয়ে সেদিকে এগিয়ে এসে ইভানের পাশে বসে পড়ল। তারপরেও ইভানের মনোযোগে ব্যাঘাত ঘটল না। বিষয়টা দৃষ্টিতে ঠেকতেই জারিফের কৌতূহল বেড়ে গেলো। মনে তীব্র কৌতূহল জাগল ইভান কি দেখছে সেটা জানার। কিন্তু সেটা কোনভাবেই ঠিক হবে না সেটা ভেবেই কৌতূহলটা দমিয়ে রাখল। কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে জারিফ আর ইভানের মাঝে বেশ বন্ধুসুলভ সম্পর্ক তৈরি হয়েছে। জারিফের কাজে ইভান অনেক সাহায্য করেছে। আর তার ফাঁকেই তাদের মাঝে বেশ আলাপ হয়েছে। পরিচিতি পর্বে উভয়েই জানতে পেরেছে তারা সম বয়সী। তাই বন্ধুত্বটা খুব তাড়াতাড়ি জমে উঠেছে। জারিফ মৃদু সরে জিজ্ঞেস করলো
–এতো মনোযোগ দিয়ে কি দেখছ?

ইভান চোখ তুলে তাকাল। ফোনের স্ক্রিনটা অফ করে বলল
–তেমন কিছু না।

জারিফ এবার হেসে দুষ্টুমি করে বলল
–গার্ল ফ্রেন্ডের ছবি দেখছিলে বুঝি?

ইভান হেসে ফেললো। বলল
–আমার সেরকম কেউ নেই। তবে…।

কথাটা শেষ করলো না। জারিফ আবারো জিজ্ঞেস করলো
–তবে কি?

ইভান উত্তরে শুধু মলিন হাসল। কোন কথা বলল না। জারিফ তার আচরনে অবাক হলেও প্রকাশ করলো না সেটা। এর মাঝেই নাহিদ এসে দুজনের মাঝে বসে পড়ল। তার হাতেও জুসের গ্লাস। সেটাতে চুমুক দিতেই ইভান দুষ্টুমি করে বলল
–শুনলাম চাচী নাকি তোমাকে একটা মেয়ে পছন্দ করে দিয়েছে। আর সেই মেয়ের সাথে কথা বলেও তাকে পছন্দ করতে পেরেছ কিনা সেটা তুমি নিজেই বুঝতে পারছ না।

বলেই হেসে ফেললো সে। নাহিদ তীক্ষ্ণ চোখে তাকাল তার দিকে। কঠিন গলায় বলল
–আমার পছন্দ হলেই কি শুধু হবে? মেয়ের পছন্দ হতে হবে না?

ইভান একটু ভেবে বলল
–তার মানে তোমার পছন্দ হয়েছে। এখন মেয়ের উত্তরের জন্য অপেক্ষা করছ?

নাহিদ শান্ত চোখে তাকাল। বলল
–এতো কথা তোকে কে বলেছে? ঈশা?

ইভান হতাশ সরে বলল
–ঈশার সাথে তো আমার কথাই হয় গুনে গুনে। সেখানে এতো কথা বলা কি সম্ভব? আর যেটুকু কথা হয় পুরোটাই শুধু ঝগড়া। ভালোভাবে কখনও কথা হয়েছে কিনা সেটা ঠিক আমি বলতে পারছি না। কোনদিন দুজন দুজনকে ভালো করে জিজ্ঞেসও করিনি যে আমরা ভালো আছি কিনা।

ইভানের শেষের কথাটা বেশ অসহায় শোনালো। পরিস্থিতি গম্ভীর হয়ে গেলো কিছু সময়ের জন্য। বিষয়টা খেয়াল করতেই ইভান পরিস্থিতি সামলাতে বলে উঠলো
–তাহলে তোমার মেয়ে পছন্দ হয়েছে তাই না নাহিদ ভাইয়া?

নাহিদ হতাশ শ্বাস ছাড়ল। অসহায় কণ্ঠে বলল
–কিছু সময়ের জন্য একটা মানুষকে দেখে পছন্দ হয়তো করা সম্ভব। কিন্তু মানুষটা আমার জন্য কতটুকু ঠিক সেটা বোঝা অসম্ভব।

ইভান কথার রেশ টেনে ধরল। কণ্ঠে তীব্র অসন্তোষ এনে বলল
–মানুষটা তোমার জন্য কতটুকু ঠিক নাকি ভুল সেটা বিচার করে কি বিয়ে করা উচিৎ? আমার কাছে মনে হয় দুজন মানুষ একসাথে থাকার জন্য ভালবাসা থাকা জরুরী। আমি যাকে ভালবাসি তাকেই বিয়ে করবো।

টেবিলে খাবার সাজাচ্ছিল ঈশা। ইভানের কথাটা কানে আসতেই সেদিকে ফিরে তাকাল। অস্থির হয়ে উঠলো মন। বেড়ে গেলো হৃদয়ের স্পন্দন। হাত থেমে গেলো। মনোযোগ স্থির করলো সেদিকে পরের কথাটা শোনার জন্য। ঠিক সেই সময় জারিফ আগ্রহ নিয়ে জিজ্ঞেস করলো
–তার মানে তোমারও ভালবাসার মানুষ আছে। জানতে পারি কে সে?

ইভান চোখ নামিয়ে হাসল। অসহায়ের মতো বলল
–জানবে শুধু সময়ের অপেক্ষা।

জারিফ হাসল শুধু। নাহিদ জারিফের দিকে তাকিয়ে কৌতূহলী কণ্ঠে বলল
–ভালবাসার সংজ্ঞাটা আসলে তোমার কাছে কেমন?

জারিফ ভাবনায় ডুবে গেলো। সে কখনও এভাবে ভাবেনি। তবে তার বিবাহিত জীবনের কথা মাথায় আসতেই মনে হল ফারিয়ার সাথে সংসার করতে তার আপত্তির কারন ফারিয়ার প্রতি তার কোন অনুভূতি কাজ করে না। যদি করত তাহলে হয়তো কোন আপত্তি থাকতো না। উদাসীন কণ্ঠে বলল
–আমার মনে হয় ভালবাসার জন্য অনুভূতিটা খুব বেশী প্রয়োজন।

নাহিদ মৃদু হেসে বলল
–আমার কাছে বন্ধুত্বটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। কারন প্রতিটা সম্পর্কের শুরু বন্ধুত্ব থেকেই হয়।

জারিফ ইভান কে জিজ্ঞেস করলো
–তোমার কাছে ভালবাসা কেমন?

ইভান ঈশার দিকে তাকাল। সে একটা চেয়ারে বসে খাবার নিয়ে নাড়াচাড়া করছে। ইভান সেদিকে তাকিয়েই বলল
–আমার কাছে ভালবাসা মানে যাকে দেখেই জীবনে সঙ্গীর প্রয়োজনীয়তা অনুভুত হয়। যার হৃদয়ের প্রতিটা স্পন্দন আমাকে জানিয়ে দেয় আমার জিবন্ত সত্ত্বার কথা। যার মাঝেই আমার অস্তিত্ব।

থেমে গেলো ইভান। নিচের দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে আবার বলল
–আমার মনে হয় আমি যাকে ভালবাসি সৃষ্টি কর্তা আমার মনে শুধু তার জন্যই ভালবাসা সৃষ্টি করেছে। আমার সবটা জুড়ে শুধু সেই আছে। আর তাকে ছাড়া আমি অসম্পূর্ণ। যখন থেকেই আমি বুঝতে শিখেছি ভালবাসা, তখন থেকে শুধু তাকেই ভালবাসি। আর বিয়ে করলে তাকেই করবো।

ইলুর ডাকে তাদের কথোপকথনে বাধা পড়ল। সবাইকে খেতে ডাকছে টেবিলে। সবাই টেবিলে বসল খেতে। বড়রা ঘরে গল্প করছে। ঈশা সবাইকে খাবার দিচ্ছে। ফারিয়া তাকে সাহায্য করছে কাজে। টুকটাক কিছু কথোপকথনের মাঝেই খাবারের পর্ব শেষ করে ফেললো। খাবার শেষে সবাই যে যার মতো চলে গেলো। ফারিয়া আর জারিফ তাদের নতুন বাড়িতে এলো। সবই ঠিক ছিল কিন্তু বিপত্তি বাধল রাতে শোয়ার সময়। ফারিয়া তীব্র আপত্তির সুরে বলল
–এতদিন বাসায় সবার সামনে এক ঘরে বাধ্য হয়ে থেকেছি। কিন্তু এখন তো নাটক করার কোন প্রয়োজন নেই। তাই আমি আলাদা ঘরে থাকতে চাই।

জারিফ শান্ত দৃষ্টিতে ফারিয়ার দিকে তাকাল। কোন দ্বিতীয় বাক্য ছাড়াই মেনে নিলো। বালিশ কাথা নিয়ে বলল
–তুমি এই ঘরেই থাকো। আমি যাচ্ছি।

বলেই বের হয়ে চলে গেলো অন্য ঘরে। ফারিয়া সস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বলল
–আজ কতদিন পর নিজের মতো থাকতে পারবো। উফ! কি শান্তি।

বলেই শুয়ে পড়ল বিছানায়। ঘরের দরজাটাও লাগিয়ে দিলো না। যেটা যেমন ছিল সেটা তেমনই আছে। মাঝরাতে জারিফের ঘুম ভেঙ্গে গেলো। পানি খাওয়ার জন্য উঠে দেখল ঘরে পানি নিতে ভুলে গেছে। তাই বাইরে ডাইনিং এ বের হল। কিন্তু বের হয়েই ফারিয়ার ঘরের দিকে দৃষ্টি গেলো। লাইট জ্বালানো দেখে দরজার দিকে এগিয়ে গেলো। ফারিয়াকে এলোমেলো ভাবে শুয়ে থাকতে দেখে বিরক্তিকর শ্বাস ছাড়ল সে। ফারিয়ার এসব আচরনের কারনেই সে তার উপরে খুব বিরক্ত হয়। মেয়েটার ছেলে মানুষী এখনও কাটেনি। ভেতরে ঢুকল জারিফ। ফারিয়ার কাছে গিয়ে ঠিক করে শুয়ে দিয়ে কাথা গায়ে দিয়ে দিলো। লাইট অফ করে ঘরের দরজা বন্ধ করে নিজের ঘরে চলে এলো। নিজেও শুয়ে ঘুমিয়ে গেলো।

———
প্রায় সপ্তাহ খানেক পেরিয়ে গেছে। সবাই নিজেদের জীবনে ব্যস্ত। কিন্তু মেঘবদলের দ্বিতীয় তলা আজ বেশ সরব। ঈশাদের বাড়িতে মেহমানের সমাগম। সবাই ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছে। রান্না বান্না নানান আয়োজনে পরিপূর্ণ। ঈশা লাল সবুজের মিশ্রনে একটা সুতি শাড়ি পরেছে। ফারিয়া ঈশাকে সাজগোজে সাহায্য করছে। হালকা সাজিয়ে দিয়ে ফারিয়া উতফুল্য কণ্ঠে বলল
–বাহ! বেশ দেখাচ্ছে তোমাকে।

ঈশা মলিন হাসল। উত্তর দেয়ার আগেই তার মা একটা খাবার ভর্তি ট্রে নিয়ে ঘরে ঢুকল। হাসি মুখে বলল
–এটা নিয়ে বাইরে যা। আর মাথায় কাপড়টা ভালো করে দিস।

ঈশা কোন কথা না বলেই মাথায় কাপড় টেনে ট্রেটা নিয়ে বেরিয়ে গেলো পাত্রপক্ষের উদ্দেশ্যে। ঈশাকে দেখতে এসেছে তার বাবার পরিচিত এক সম্ভ্রান্ত পরিবারের ছেলের জন্য। সবাই বেশ খুশী। কারন তারা ঈশার ছবি দেখেই পছন্দ করেছে। এখন শুধু সামনা সামনি দেখে আংটি পরিয়ে রাখবে। ঈশা খাবার নিয়ে টেবিলে রেখে সবার সামনে দাড়িয়ে নম্রভাবে সালাম দিলো। সবাই খুশী হল ঈশার আচরনে। ছেলের মা বেশ কিছুক্ষণ কথা বলে ঈশার বাবার উদ্দেশ্যে বলল
–আমরা আজই মেয়েকে আংটি পরিয়ে রাখতে চাই।

ঈশার বাবা মেয়ের দিকে একবার তাকাল। কিছুক্ষণ পর বলল
–আমি আমার মেয়ের সাথে একটু কথা বলতে চাই। তারপর সিদ্ধান্ত জানাবো।

ঈশা তখনও মাথা নিচু করেই দাড়িয়ে আছে। ঠিক সেই মুহূর্তে কোথা থেকে ক্ষিপ্র গতিতে ইভান বাসায় এলো। চোখ তার রাগে লাল হয়ে আছে। মুখেও রাগের আভা। জোরে জোরে শ্বাস ফেলছে সে। ঈশার দিকে তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে আছে। তীব্র রাগে হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ঈশার হাত ধরে সবার সামনেই টেনে নিয়ে গেলো ঘরে। এদিকে সবাই যে তাদের দিকে তাকিয়ে আছে সেটা ইভানের মাথাতেই নেই। এমন কি বাড়িতে মেহমান এসেছে সেটাও সে খেয়াল করেনি। ঘরের দরজা বন্ধ করে দিতেই ঈশা চেচিয়ে বলল
–এভাবে সবার সামনে টেনে আনলে কেন?

ইভান তীক্ষ্ণ চোখেই তাকিয়ে আছে। চোখ দিয়ে আগুন ঝরছে তার। ঈশা আবারো বলল
–বাইরে সবাই কি ভাবল। তুমি কি…।

ঈশা কথা শেষ করতে পারল না। তার আগেই ইভান তাকে দেয়ালের সাথে চেপে ধরল। দাতে দাত চেপে বলল
–তনুকে কি বলেছিস তুই? আমি তনুকে বিয়ে করবো সেটা তোকে কে বলল?

ঈশা শান্ত চোখে তাকাল। কয়েক মুহূর্ত ইভানের চোখের দিকে তাকিয়ে থেকে আর পারল না। চোখ বেয়ে পানি ঝরে পড়ল তার। কেঁদে ফেললো। কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বলল
–আমি এতদিন ভুল বুঝেছিলাম। ভেবেছিলাম তোমাদের মাঝে প্রেমের সম্পর্ক আছে। তাই তনু আপুকে বলেছিলাম তোমরা যেন তাড়াতাড়ি বিয়ে করে ফেলো। কিন্তু…।

আর বলতে পারল না ঈশা। কেঁদে ফেললো। ইভান ছেড়ে দিয়ে সরে দাঁড়াল। গম্ভীর কণ্ঠে বলল
–কিন্তু তনু যখন বলল যে সে শাওনকে বিয়ে করছে। কারন তারা দুজন দুজনকে ভালবাসে তখন তোর মনে হল তুই ভুল করে ফেলেছিস। তাই তো?

ঈশা কোন কথা বলল না। ইভান চেচিয়ে বলল
–তুই নিজেকে কি ভাবিস? আমার সব কিছু কি তুই ঠিক করে দিবি? তুই তো আমাকে বিয়ে করতে চাস না। তাহলে আমি কাকে বিয়ে করবো না করবো না সেটা নিয়ে তোর এতো মাথা ব্যথা কেন?

ঈশা কোন উত্তর দিতে পারল না। তার গলায় কথা দলা পেকে যাচ্ছে। কান্না আটকে রাখতে পারছে না। বসে পড়ল নিচে। কাঁদতে কাঁদতে বলল
–কারন বাবা আমারও বিয়ে ঠিক করেছে। আর আমি চাই তুমিও বিয়ে করো।

ইভানের মাথায় কথাটা ঢুকতেই শান্ত হয়ে গেলো। অবিশ্বাস্য কণ্ঠে বলল
–তোর বিয়ে?

ঈশা মাথা নাড়ল। ইভান চোখ বন্ধ করে ফেললো। এতক্ষনে তার মনে হল বাইরে বেশ কয়েকজন অপরিচিত মানুষ বসে থাকতে দেখেছে সে। চোখ খুলে ঈশার দিকে তাকাল। তার সাজ সজ্জা দেখে ইভান ঠোট বাকিয়ে হাসল। আহত কণ্ঠে বলল
–আমি সত্যিই বুঝতে পারিনি ঈশা যে বাইরে তোর হবু শশুর বাড়ির লোকজন বসে আছে। বুঝতে পারলে হয়তো এমন কিছু করতাম না। আমার খুব খারাপ লাগছে। জানিনা কে কি ভাবল। তবে তুই ভাবিস না। আমি সব ঠিক করে দিবো। বাইরে গিয়ে আমি বিষয়টা সামলে নিচ্ছি। তুই ফ্রেশ হয়ে বাইরে আয়। তোকে কেউ কোন প্রশ্ন করবে না। আমি কথা দিলাম।

চলবে……।
চলবে……

(

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here