মেঘবদল পর্ব -০৬+৭

#মেঘবদল
লেখক-এ রহমান
পর্ব ৬

ফ্যানের খটখট আওয়াজ কানে আসলো ঈশার। মনে হচ্ছে সে কিছু সময়ের জন্য গভির ঘুমে ছিল। চোখ খুলতেই ঝাপসা আভা দেখতে পেলো। চোখ বন্ধ করে পুনরায় খুলে ইভান কে পাশে বসে থাকতে দেখে ঘাবড়ে গেলো। অস্থির দৃষ্টি এদিক সেদিক ফেলে বুঝতে চেষ্টা করলো কোথায় আছে। সবটা মনে পড়তেই উঠে বসলো। ইভান সন্দিহান কণ্ঠে বলল
–ঠিক আছিস?

ঈশা মাথা নাড়াল। সে ঠিক আছে। ইভান আবারো জিজ্ঞেস করলো
–কি হয়েছিল তোর?

ঈশা তীক্ষ্ণ চোখে ইভানের দিকে তাকাল। বলল
–তুমি জানো আমার ডেটলের গন্ধে মাথা ঘুরায়। আমি শ্বাস নিতে পারি না।

ইভানের মুখভঙ্গি পরিবর্তন হয়ে গেলো। চিন্তিত চেহারায় অসহায়ত্ব ভিড় করলো। অপরাধীর মতো তাকিয়ে বলল
–সরি। আমি জানি কিন্তু মাথায় ছিল না। আসলে ঐ অবস্থায় মাথা কাজ করছিল না। তাই এতো কিছু খেয়াল করিনি।

ঈশা অভিমানী কণ্ঠে বলল
–এটা নতুন কিছু না। আমার কথা কোনদিনই তোমার মাথায় ছিল না। তোমার মাথায় রাখার মতো অনেক কিছুই আছে। আমার জন্য তোমার মনে কোন জায়গা নেই।

হতাশ শ্বাস ছেড়ে বিছানা থেকে উঠে গেলো। ঈশার কথার ধরন আর অর্থ কোনটাই ইভান বুঝতে পারল না। কিন্তু অভিমানটা ঠিক বুঝতে পারল। ঈশা রান্না ঘরে গিয়ে আবারো কাজে লেগে পড়ল। ইভান একটু ভেবে সেও রান্না ঘরে চলে গেলো। ঈশা আবারো হাতে ছুরি ধরতেই সে হাত থেকে ছুরি নিয়ে বলল
–আমি কেটে দিচ্ছি।

ঈশা বেশ রাগ করেই বলল
–আমাকে নিয়ে তোমার এতো ভাবতে হবে না। তুমি তোমার কাজ করো। আর আমাকে আমার কাজ করতে দাও। বিরক্ত করছ তুমি আমাকে।

ইভান শান্ত ভাবে তাকাল। বেশ নরম সরে বলল
–আমাকে দেখলেই তোর মেজাজ এরকম খারাপ হয়ে যায় কেন?

ঈশা কোন কথা বলল না। ইভান উত্তরের জন্য কিছুক্ষণ অপেক্ষা করছে। ঈশার কাছ থেকে কোন উত্তর না পেয়ে ছুরিটা ঈশার গলার কাছাকাছি ধরে বলল
–সমস্যা কি তোর? কথা বলছিস না কেন?

ঈশা সরে দাড়াতে চাইলে ইভান তাকে টেনে ধরে আবারো বলল
–পুরো সমস্যা খুলে বলবি। আর খুব তাড়াতাড়ি। খুব বেশী সময় তুই পাবি না।

ইভানের এমন আচরনে ঈশা মোটেই ভয় পেলো না। কারন সে জানে আর যাই হোক ইভান তার কোন ক্ষতি করতে পারবে না। তাই ঠোট বাকিয়ে হাসল। ঈশার সেই হাসি দেখেই ইভান বুঝতে পারল যে সে তাকে মোটেই ভয় পাচ্ছে না। তাই ছুরিটা রেখে ঈশাকে দেয়ালের সাথে চেপে ধরল। অনেকটা কাছে এসে বলল
–আমাকে ভয় পাস না তাই না? কিভাবে ভয় পাওয়াতে হয় সেটা আমার জানা। দেখাবো?

ইভানের আচরন বেশ অসঙ্গতিপূর্ণ। কি করবে সেটা ভেবেই ঈশা শুকনো ঢোক গিলে ফেললো। ইভান বুঝতে পারল সে এবার ভয় পাচ্ছে। তাই আর একটু কাছাকাছি যেতেই ঈশা কাঁপা কাঁপা গলায় বলল
–কি…কিসের সমস্যা? আমার কোন সমস্যা নেই।

ইভান তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে বলল
–আমাকে কেন সহ্য করতে পারিস না তুই? আমি কি করেছি তোর সাথে?

শুকনো ঢোক গিলে ফেললো ঈশা। জোরে শ্বাস টেনে বলল
–সহ্য করতে পারি না কে বলেছে?

ইভান ঈশাকে ছেড়ে দিলো। নরম কণ্ঠে বলল
–এতো রাগ কেন? তোর কিসের এতো অভিমান আমার উপরে?

ঈশা অসহায় চোখে তাকাল ইভানের দিকে। চোখ ভরে এলো তার। ঠিক সেই সময় মাহমুদার ক্ষিন কণ্ঠ কানে আসতেই ঈশা চলে গেলো রান্না ঘর থেকে সেদিকে। ইভান বিরক্তিকর শ্বাস ছাড়ল। এভাবে সব কিছু চাপিয়ে রাখলে ইভান বুঝবে কিভাবে। নিজেকে খুব অসহায় মনে হল তার। ঈশার সাথে কথা বলেও লাভ হচ্ছে না। কিভাবে সব কিছুর সমাধান হবে।

————
নিজের বাড়ি ছেড়ে এই প্রথম একটা সপ্তাহ কেটে গেলো ফারিয়ার। বাড়ির জন্য খুব মন খারাপ লাগছে। চুপচাপ বসে আছে একা ঘরে। জারিফ ব্যস্তভাবে এসে ঘরে ঢুকল। ফারিয়া ঘাড় ফিরিয়ে তাকাতেই সে বলল
–তোমার বাবা এসেছে।

ফারিয়া মুখে হাসি ফুটে উঠলো। উতফুল্য কণ্ঠে বলল
–বাবা এসেছে?

জারিফ মাথা নাড়ল। কোন কথা বলল না। ফারিয়া আয়নার সামনে দাঁড়াল। নিজের কাপড় ঠিক করে চুল হালকা আঁচড়ে নিলো। পিছন ঘুরে জারিফের দিকে তাকিয়ে বলল
–চল বাইরে যাই।

জারিফ গভির ভাবনায় ডুবে ছিল। ফারিয়ার কথা শুনতে পেলো না। ফারিয়া কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলো। জারিফকে কোন কথা না বলতে দেখে কাছে গিয়ে গায়ে হাত দিয়ে বলল
–কি ভাবছ?

জারিফ চমকে তাকাল। নরম কণ্ঠে বলল
–কিছু না। তুমি বাইরে যাও। আমি আসছি।

ফারিয়া চলে গেলো। জারিফকে একটু অন্যরকম মনে হলেও সে খুব একটা পাত্তা দিলো না। বাইরে গিয়ে তার বাবার সাথে কথা বলায় ব্যস্ত হয়ে গেলো। ফারিয়াকে বেশ হাসিখুশি দেখাচ্ছে। মেয়েকে এত হাসিখুশি দেখে তার বাবার বেশ ভালো লাগলো। তারা কিছুক্ষণ কথা বলতেই জারিফ ঘর থেকে বেরিয়ে এলো। বেশ চিন্তিত দেখাচ্ছে তাকে। সোফায় বসে বলল
–তোমাদের সাথে আমার একটা কথা আছে।

সবাই জারিফের কথায় মনোযোগ দিলো। এরকম মলিন চেহারা দেখে কিছুটা ঘাবড়ে গেলো সবাই। জারিফের বাবা চিন্তিত কণ্ঠে বলল
–কোন সমস্যা হয়েছে কি জারিফ?

জারিফ বিচলিত হয়ে বলল
–না বাবা। তেমন কোন সমস্যা না। আসলে আমি বিয়ের আগে একটা চাকরিতে এপ্লাই করেছিলাম। বেশ ভালো চাকরি। আমার চাকরিটা হয়ে গেছে।

জারিফের চাকরির কথা শুনে সবাই বেশ খুশী হল। ফারিয়ার সেদিকে কোন মনোযোগ নেই। জারিফের চাকরি হওয়া না হওয়াতে তার কোন যায় আসে না। তাই সে চুপচাপ থাকলো। জারিফের বাবা হাস্যজ্জল মুখে বললেন
–এটা তো খুবই ভালো কথা। আমরা সবাই চাই তুমি ভালো কিছু একটা করো। বিয়েটা তো হয়েই গেলো এখন একটা চাকরিও হয়ে গেলো। বাহ! আমার তো খুব আনন্দ হচ্ছে।

জারিফ এবার অতি নরম সরে বলল
–সে ঠিক আছে বাবা কিন্তু আমার পোস্টিং ঢাকায়। আমাকে দুই একদিনের মধ্যেই ঢাকা যেতে হবে।

জারিফের কথা শুনে এবার সবাই চিন্তিত হয়ে গেলো। চাকরি সুত্রে তাকে ঢাকা যেয়ে থাকতে হবে। আর ঢাকায় তাদের সেরকম কাছের আত্মীয় কেউ নেই। সবাই ভাবনায় ডুবে গেলো। সবার ভাবনাটা এক রকম হলেও ফারিয়ার বাবার ভাবনাটা ভিন্ন। কারন জারিফ ঢাকায় চলে গেলে ফারিয়া কোথায় থাকবে সেটা তার মাথার ব্যাথা হয়ে দাঁড়াল। তিনি চান না যে জারিফ আর ফারিয়া আলাদা থাকুক। এদিকে জারিফের ঢাকায় যাওয়ার কথা শুনে সব থেকে বেশী খুশী ফারিয়া। সে ভাবছে জারিফ চলে গেলে সে আর এই বাড়িতে থাকবে না। বাবার বাড়িতে চলে যাবে। আবার সেই আগের মতো জীবন যাপন করবে। কিন্তু তার সব চিন্তায় পানি ঢেলে দিয়ে ফারিয়ার বাবা গম্ভির ভাবে বললেন
–তুমি ঢাকায় গিয়ে কোথায় থাকবে সেটা নিয়ে কিছু ভেবেছ?

জারিফ হতাশ হয়ে বলল
–এখনও কিছু ভাবিনি। তবে আমার পরিচিত কয়েকজন বন্ধু আছে। গিয়ে তাদের সাথেই প্রথমে উঠবো। তারপর চাকরিতে জয়েন করে কিছুদিন পর ভাববো।

ফারিয়ার বাবা কিছুক্ষণ ভাবলেন। তারপর জারিফের বাবার উদ্দেশ্যে বললেন
–ভাই সাহেব আমার মনে হয় জারিফের ফারিয়াকে সঙ্গে নিয়ে যাওয়া উচিৎ।

তার কথা শেষে পিনপতন নিরবতা চলল কিছুক্ষণ। এই কথায় সব থেকে বেশী আহত হল ফারিয়া। মনে মনে বাবার উপরে ভীষণ রাগ হল। তারপর ভাবল এখন শেষ ভরসা জারিফ। সে যদি একবার বলে এখনই ফারিয়াকে নিয়ে যেতে পারবে না। তাহলেই কাজ হবে। তাই জারিফের দিকে তাকাল। আর তার ধারনা অনুযায়ী সত্যি সত্যি জারিফ বলল
–আসলে আমি নিজেই ওখানে গিয়ে কি অবস্থায় থাকবো সেটা জানি না। আর এই অবস্থায় ফারিয়াকে নিয়ে যাওয়া ঝামেলা। তাই আমি বলছিলাম কি ফারিয়া নাহয় থাকুক। আমি পরে সব ঠিক করে তাকে নিয়ে যাবো।

ফারিয়ার বাবা এমন ভাব করলেন যেন জারিফের কথা শুনতে পেলেন না। তিনি আবারো জারিফের বাবার উদেশ্যে বললেন
–আমার এক বন্ধুর বাড়ি আছে ঢাকায়। খুব কাছের বন্ধু। আমি ওর সাথে কথা বললে ওদের থাকার ব্যবস্থা হয়ে যাবে। আর শুধু ব্যবস্থা না একদম বাড়ির মতই থাকতে পারবে তারা। কোন অসুবিধা হবে না। আপনি যদি বলেন তাহলে আমি কথা বলে দেখব?

জারিফের বাবা সস্তি পেলেন। শ্বাস ছেড়ে বললেন
–আপনি যা ভালো বোঝেন। যদি এরকম সুবিধা থাকে তাহলে তো আর কথাই নেই। আমি আসলে এটা নিয়েই ভাবছিলাম যে দুজন দুইদিকে থাকবে বিষয়টা কেমন দেখায়।

ফারিয়ার বাবার বেশ উতফুল্ল্য কণ্ঠে বলল
–তাহলে আমি আজই কথা বলে নেবো। আর আমার বন্ধু অবশ্যই কোন ব্যবস্থা করে দেবে। জারিফ ফারিয়া তোমরা যাওয়ার প্রস্তুতি নাও।

ফারিয়ার ভীষণ মন খারাপ হল। চোখ ছলছল করে উঠলো তার। এখনই গাল বেয়ে পানি পড়বে। তাই দ্রুত পায়ে সেখান থেকে ঘরে চলে এলো। সাথে সাথেই কেঁদে ফেললো সে।

————-
নাহিদ গাড়ি নিয়ে যাচ্ছিল তার গন্তব্যে। জ্যামে আটকে আছে সে। হঠাৎ করে রাস্তার এক পাশে ফুচকার দোকানে চোখ পড়ল তার। মৃন্ময়ী একজন ছেলের সাথে বসে কথা বলছে আর ফুচকা খাচ্ছে। বেশ হাসিখুশি দুজনেই। দেখেই বোঝা যাচ্ছে তাদের মাঝে সম্পর্ক বেশ ভালো। নাহিদ একবার ভাবল মৃন্ময়ীর সাথে কথা বলবে। কিন্তু পরক্ষনেই তার মনে হল এভাবে আগ বাড়িয়ে তার কথা বলা মৃন্ময়ীর যদি পছন্দ না হয়। যদি অন্য কিছু ভেবে বসে। আর ছেলেটার সাথে তার সম্পর্ক কি। এমনও তো হতে পারে সে তার বয়ফ্রেন্ড! এই অবস্থায় কথা বলা শোভনীয় নয়। তাই আর সময় নষ্ট না করে নাহিদ চলে গেলো।
#মেঘবদল
লেখক-এ রহমান
পর্ব ৭

গোধূলি পেরিয়ে গেছে অনেক আগেই। পুরো বাড়িতে হইচই। জারিফ বাইরে থেকে এসেই দেখে ফারিয়ার পুরো পরিবার এসেছে। মেয়েরা সবাই কাজে ব্যস্ত। আর ছেলেরা সোফায় বসে খুব গুরুত্বপূর্ণ কোন আলোচনায় মশগুল। আজ রাতেই তারা ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা দেবে। তাই এতো আয়োজন। ফারিয়ার বাবা ইতিমধ্যেই তাদের সব ব্যবস্থা করে দিয়েছে। সেখানে গিয়ে থাকার কোন অসুবিধা হবে না। তার বন্ধু বলেছেন ছেলে মেয়ে একদম বাড়ির মতো নিশ্চিন্তে থাকতে পারবে। সেই কারনেই তিনি খুব খুশী। জারিফ প্রয়োজনীয় কিছু জিনিস পত্র আনতে বাইরে গিয়েছিল। যাওয়ার আগে বাড়িতে কেউ ছিল না। কিন্তু ঘণ্টা খানেকের মধ্যে ফিরে এসে দেখে বাড়ির সুরৎহাল পরিবর্তন হয়ে গেছে। বিরক্ত হল সে। সোজা নিজের ঘরে চলে গেলো। ঘরে ঢুকেই দেখল ফারিয়া নিজের জিনিস পত্র গুছিয়ে নিচ্ছে। আশে পাশে ছোট বড় বেশ কয়েকটা ব্যাগ। জারিফ সব গুলর দিকে একবার করে দেখে নিয়ে ফারিয়ার দিকে তাকাল। সে একটু পর পর নাক টানছে। জারিফ একটু এগিয়ে যেতেই বুঝতে পারল ফারিয়া কাঁদছে। নরম সরে জিজ্ঞেস করলো
–ফারিয়া কাঁদছ কেন? তোমার কি হয়েছে?

ফারিয়া তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকাল। অনেকক্ষণ ধরেই সে কাঁদছিল। চোখ মুখ সব লাল হয়ে গেছে। জারিফ তাকিয়ে আছে তার দিকে। ফারিয়া ঝাঁঝালো গলায় বলল
–আমার কি হয়েছে সেটা জেনে তোমার কি লাভ?

জারিফ বুঝতে পারল ফারিয়া কোন কারনে রেগে আছে। তাই নিজে আর রাগারাগি করলো না। নরম সুরে বলল
–লাভ ক্ষতি আমরা পরে হিসেব করবো। আগে বল কি সমস্যা সেটা সমধান করি। তারপর বাকিটা দেখা যাবে।

ফারিয়া জারিফের কাছাকাছি এসে দাঁড়াল। চেচিয়ে বলল
–তুমি নিজেই আমার জিবনের সব থেকে বড় সমস্যা। কিভাবে সমাধান করবে জানতে চাও? আমাকে আমার মতো ছেড়ে দাও। তাহলেই সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে।

জারিফ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলো। সে যথেষ্ট ভালোভাবেই কথা বলছিল। কিন্তু ফারিয়ার মতো মেয়ে ভালো কথা বোঝার মতো না। তাই সেও নিজের রাগ সামলাতে পারল না। ঝাঁঝালো গলায় বলল
–এসব কথা এখন বলে কোন লাভ নেই। আমাকে নিয়ে এতই যখন সমস্যা তোমার আগেই সেটা ভাবা উচিৎ ছিল। এখন ভাবার সময় আর নেই।

ফারিয়া ভীষণ রেগে গেলো। উত্তেজিত কণ্ঠে বলল
–শুধু কি আমার ভাবা উচিৎ ছিল? তোমার ছিল না? নাকি বলতে চাও আমাকে বিয়ে করে তোমার মধ্যে কোন আক্ষেপ নেই। বিয়ের প্রথম দিন কি বলেছিলে সেটা মনে আছে? নাকি মনে করিয়ে দিতে হবে?

জারিফ কোন উত্তর দিলো না। ফারিয়া তাচ্ছিল্য হেসে আবার বলল
–আমাকে বউ হিসেবে মেনে নিতে তোমার সমস্যা সেটা খুব স্পষ্ট ভাবেই বলেছিলে। আর এখন বলছ তোমাকে বিয়ে করতে শুধু আমার সমস্যা। তোমার কোন সমস্যা ছিল না। ক্ষনে ক্ষনে তোমার নতুন রুপ দেখছি জারিফ। কয়েকদিনেই তুমি এতটা বদলে যাবে ভাবতেও পারিনি। যাই হোক আমি তখন বলতে পারিনি কিন্তু এখন বলবো। বাইরে গিয়ে এখনই বলবো আমি তোমার সাথে যেতে চাই না। আমি আমার বাড়িতে যেতে চাই।

জারিফ শান্ত হয়ে শুনছিল ফারিয়ার কথা। ফারিয়া নিজের কথা শেষ করেই সত্যি সত্যি বাইরে যাচ্ছিল সবাইকে বলতে। কিন্তু জারিফ তাকে আটকে দিয়ে দাতে দাত চেপে বলল
–তুমি কোথাও যাবে না।

ফারিয়া ঘুরে তাকাল। জারিফের হাত থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে নেয়ার চেষ্টা করে পারল না। জারিফ খুব শক্ত করে ধরে আছে। ফারিয়ার ব্যথা লাগছে। কিন্তু কিছুই বলছে না সে। রুষ্ট কণ্ঠে বলল
–তোমার সাথে থাকা সম্ভব না জারিফ। এখনও সময় আছে নিজের ভুল শুধরে নেয়ার।

জারিফ একই অবস্থায় দাতে দাত চেপে বলল
–আমার সাথেই তোমাকে থাকতে হবে। বিয়েটা যখন হয়েই গেছে এখন আর কিছুই করার নাই। তোমাকে আমার সাথেই থাকতে হবে সারাজীবন।

ফারিয়া তাচ্ছিল্য করে বলল
–হাহ! তুমি বলে দিলে আর আমি মেনে নিলাম তাই না? আমার মতামতের কোন দাম নেই?

–না নেই। যখন মতামত প্রকাশ করার দরকার ছিল তখন করতে পারো নি। পরিবারের সামনে মুখ ফুটে বলতে পারো নি তুমি আমাকে ভালবাস না আর আমাকে বিয়ে করতে চাও না। এখন তাহলে কেন মতামত প্রকাশ করতে চাইছ।

বেশ ধমকের সুরে কথাটা বলতেই ফারিয়া কেঁদে ফেললো। জারিফ হাত ছেড়ে দিলো। অসহায়ের মতো কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলো। ফারিয়া বরাবর অবুঝ। তার এরকম আচরন স্বাভাবিক। কিন্তু জারিফের এভাবে উত্তেজিত হয়ে যাওয়া এটার কোন সমাধান আনতে পারবে না। বিষয়টা অযথাই বাড়াবাড়ি পর্যায়ে চলে যাচ্ছে। জারিফ চোখ বন্ধ করে ফেললো। নিজেকে যথেষ্ট শান্ত করে নিয়ে খুব ঠাণ্ডা কণ্ঠে বলল
–-আমাদের ভুলেই বিয়েটা হয়েছে। সময় মতো আমরা কেউই নিজের মতামত প্রকাশ করতে পারি নি। এখন আমরা দুজনই পরিস্থিতির স্বীকার। আমরা যা করবো তার জন্য আমাদের পরিবার সাফার করবে। আমাদের জন্য পরিবারকে কষ্ট দেয়ার কোন মানে হয় না। কারন আমরা পরিবারের কথা ভেবেই এতো বড় সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছি। যা কিছুই হোক তোমার কাছে আর কোন অপশন নেই। আমার সাথেই থাকতে হবে। তুমি কোথাও যাবে না ফারিয়া। আমি তোমাকে তোমার পছন্দ মতো কোন সিদ্ধান্ত নিতে সুযোগ দেবো না। এর জন্য তুমি আমাকে খারাপ ভাবলেও ভাবতে পারো আমার আপত্তি নেই।

জারিফ কথা শেষ করে ওয়াশ রুমে চলে গেলো। ফারিয়া কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল। সব কিছু এলোমেলো লাগছে তার। কোনটা ঠিক কোনটা ভুল সেটা ধোঁয়াশার মতো তার কাছে।

————
নভেম্বরের মাঝের দিকে হালকা শীত পড়তে শুরু করেছে। জারিফ ফারিয়ার দিকে তাকাল। সিটে মাথা এলিয়ে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে। জানালাটা যদিও বা বন্ধ তবুও কাঁচ ভেদ করে বাইরের রাস্তাটা দেখা যাচ্ছে। ফারিয়ার হতাশ চোখজোড়া নিশ্চুপ শান্ত। জারিফ মৃদু সরে জিজ্ঞেস করলো
–ঠাণ্ডা লাগছে?

ফারিয়া কোন উত্তর দিলো না। এমন কি তার অবস্থারও পরিবর্তন হল না। শুনতে পেয়েও যেন পেলো না। জারিফ হতাশ শ্বাস ছেড়ে জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল। ফারিয়া যে কথা বলবে না সেটা হয়তো জারিফের একটু হলেও ধারনা ছিল। কারন জারিফের তখনের কথা গুলো হয়তো একটু কড়া ছিল। কিন্তু কোন ভুল ছিল না। ফারিয়ার হয়তো অনেকটা কষ্ট হয়েছে। তাই তারপর থেকে আর কোন কথা বলে নি। নিজের মতো সব কিছু গুছিয়ে নিয়েছে। বিদায় নেয়ার সময় মোটামুটি সবাই কাঁদছিল। জারিফের একটু খারাপ লাগলেও ফারিয়া ছিল পাথরের মতো। মলিন হেসেছিল শুধু। বাসে উঠে একবার বলেছিল সে জানালার পাশে বসতে চায়। জারিফ নির্বাক মেনে নিয়েছিল। দিরুক্তি করেনি। জারিফ আরাম করেই বসে পড়ল। জার্নিতে তার ঘুম হয় না। তারপরেও চোখটা বন্ধ করে নিলো। ফারিয়ার ঘুম আসে কিনা সেটা জানে না সে। জানার চেষ্টাও করলো না। কারন এখন কথা বলা মানেই আগুনে ঘি ঢালা হয়ে যাবে। তাই সে নিশ্চুপ থেকে গেলো। বেশ কিছুক্ষণ পর মনে হল ফারিয়া কি করছে। চোখ খুলে ফারিয়ার দিকে তাকাল সে। ফারিয়া তখন গভির ঘুমে। মাথাটা গিয়ে ঠেকেছে জানালার কাঁচে। বাসের দুলুনির কারনে বারবার জানালায় বাড়ি খাচ্ছে। জারিফ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে ফারিয়ার মাথাটা নিজের বুকে নিয়ে নিলো। এক হাতে আলত করে চেপে ধরল যাতে মাথাটা এদিক সেদিক চলে না যায় আর ফারিয়ার ঘুম ভেঙ্গে না যায়। কিন্তু আবার এটাও ভয় হচ্ছে যে ফারিয়া জেগে গিয়ে নিজেকে এই অবস্থায় দেখলে কুরুক্ষেত্র বাধিয়ে দেবে। কিন্তু তার থেকেও ফারিয়ার ঘুমটা বেশী জরুরী। তাই পরের যা হবে দেখা যাবে সেই ভেবেই সেও চোখ বন্ধ করে নিলো।

————–
বেশ তাড়াহুড়ো করে সিঁড়ি বেয়ে নামছে ঈশা। তার আজ মাস্টার্স পরীক্ষা। এমনিতেই দেরি করে ফেলেছে। এখন রিক্সা পেতে দেরি হয়ে গেলে বিপদ হয়ে যাবে। শেষ সিঁড়িটা অতিক্রম করতেই চোখ পড়ল সামনে রাস্তার ধারে দাড়িয়ে থাকা দুজন মানুষের উপরে। ইভান বাইকে হেলানি দিয়ে দাড়িয়ে আছে। আর তনু তার পাশেই দাড়িয়ে কিছু একটা বলছে। ঈশা ধির পায়ে নিচে নামলো। একটু কাছাকাছি আসতেই তনুর কথা স্পষ্ট কানে এলো
–আমি চাচ্ছি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বিয়েটা করে ফেলতে। তুই একটু বুঝিয়ে বল। নাহলে আমার বাসা থেকে বিয়ের জন্য উঠেপড়ে লেগেছে।

ইভান নিচের দিকে তাকিয়ে বলল
–এতো অস্থির হচ্ছিস কেন? আমি তো তোকে বলেছিই পজিটিভ রেজাল্ট এসেছে। সবার ইচ্ছা বিয়ের অনুষ্ঠানটা বড় করে করবে। তাই প্রস্তুতির ব্যাপার তো আছেই। একটু সময় দে। আমি আরেকবার সবার সাথে কথা বলি।

কথা শেষ করে ইভান চোখ তুলে তাকাতেই ঈশার দিকে চোখ পড়ল। শান্ত সরে জিজ্ঞেস করলো
–কোথায় জাচ্ছিস এখন?

ঈশা কোন উত্তর দিলো না। ইভান অপেক্ষা করছে। তনু হেসে বলল
–ঈশা আজ তো তোমার পরীক্ষা আছে তাই না? দেরি হয়ে গেছে তো। এতো দেরি করলে কেন?

ঈশা নরম সরে বলল
–এমনিতেই।

বলেই সামনে পা বাড়াল। ইভান ধির কণ্ঠে ডাকল। বলল
–ঈশা। আমি তোকে দিয়ে আসি?

ঈশা ঘুরে তাকাল। মৃদু হেসে বলল
–লাগবে না। আমি যেতে পারবো।

ইভান আবারো বলল
–দেরি হয়ে গেছে। এখন তুই রিক্সার জন্য অপেক্ষা করলে আরও দেরি হয়ে যাবে। আমার সাথে গেলে সময় মতো পৌছাতে পারবি।

ঈশা কঠিন চোখে তাকাল। বেশ ঝাঁঝালো সরে বলল
–তোমাকে কে এতো ভাবতে বলেছে? আমার ভাবনা আমাকে ভাবতে দাও। দেরি করে পরীক্ষা দিতে গেলে আমার খুব বেশী ক্ষতি হয়ে যাবে না। আর তুমি তোমার কাজ কর না। আমি তো তোমাকে বিরক্ত করছি না।

ইভান বেশ অবাক হল এমন কথা শুনে। এমন আচরনের কারন বুঝতে না পেরে ভ্রু কুচকে তাকাল। ঈশার দিকে তাকিয়ে নরম সরে বলল
–আমি তো শুধু…।

কথা শেষ করতে দিলো না ঈশা। বলল
–প্লিজ ইভান ভাইয়া। আমি তোমার সাথে যাবো না। আমাকে জোর করো না।

ইভান আর কথা বলল না। ঈশা এলোমেলো পা ফেলে হাঁটছে সামনে। বুকের মাঝে তীব্র ব্যথা অনুভুত হচ্ছে তার।

চলবে……
চলবে……

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here