মেঘবদল পর্ব -০৪+৫

#মেঘবদল
লেখক-এ রহমান
পর্ব ৪

গোধূলি পেরিয়ে ঘন অন্ধকার নেমেছে পৃথিবীর বুকে। কালো মেঘে ঢাকা আকাশ। ঠাণ্ডা হাওয়াটা মাঝে মাঝে শরীর কাপিয়ে দিচ্ছে। রেস্টুরেন্টের বাইরে দাড়িয়ে রাস্তার দিকে তাকিয়ে আছে মৃন্ময়ী। রাস্তায় পানি জমে আছে। ফুটপাত ধরে হেঁটে চলেছে অনেকে।

–আপনি কোনদিকে যাবেন?

মৃন্ময়ী ঘাড় বেকিয়ে তাকাল। নাহিদ তার উত্তরের অপেক্ষায় তাকিয়ে আছে। মৃন্ময়ী মৃদু সরে বলল
–আমি সাইন্স ল্যাবের দিকে যাবো। ঐখানেই আমার খালার বাসা।

নাহিদ একটু ভেবে বলল
–আমিও ঐদিকেই যাচ্ছি। আপনি আমার সাথে গাড়িতে যেতে পারেন। আমি আপনাকে বাসায় নামিয়ে দেবো।

মৃন্ময়ী গাড়ির দিকে তাকাল। এরকম বিলাসিতা তার একদম পছন্দ নয়। তার কাছে এরকম গাড়ির চেয়ে রিক্সা ভ্রমণটাই বেশী ভাললাগে। সেটার মাঝে এক অন্য রকম স্বাধীনতা আছে। কিন্তু গাড়ির ভেতরে কেমন বন্দি বন্দি লাগে তার। শান্ত সরে বলল
–ধন্যবাদ। তবে আমি রিক্সা করেই চলে যাবো। এখান থেকে কাছেই।

নাহিদ হেসে বলল
–অনেক্ষন ধরেই তো দাড়িয়ে আছেন। কোন রিক্সা যেতে দেখেছেন কি? রাস্তা ডুবে গিয়েছে। তার উপর ঝিরি ঝিরি বৃষ্টি এখনও হচ্ছে। রিক্সা পাওয়া মুশকিল। এমনিতেই সন্ধ্যা পেরিয়ে গেছে। আমি আপনাকে পৌঁছে দিলে কোন ক্ষতি হবে না। বিশ্বাস করতে পারেন।

শেষের কথায় মৃন্ময়ী একটু অপ্রস্তুত হয়ে গেলো। বেশ অগোছালো ভাবেই বলল
–বিশ্বাস অবিশ্বাসের কথা নয়। আসলে আমার মোশন সিকনেস আছে। গাড়িতে উঠলেই প্রবলেম হয়। মাথা ঘুরায়।

নাহিদ চুপ হয়ে গেলো। এরকম পরিস্থিতিতে তার কি বলা উচিৎ সেটা বুঝতে পারল না। কিন্তু এখন তো এখানে কোন রিক্সাও পাওয়া যাবে না। আর এভাবে একটা মেয়েকে একা রেখে সে জেতেও পারবে না। গভির সমস্যায় পড়ে গেলো সে। একটু ভেবে বলল
–সেটা হয়তো আপনি ম্যানেজ করে নিতে পারবেন। কিন্তু এভাবে এখানে দাড়িয়ে থাকা ব্যাপারটা ঠিক লাগছে না। রাত হয়েছে। আবার আপনি একা। আমি আসলে আপনাকে এভাবে একা এই সময় ছেড়ে দিতে চাইছি না। তাই অনুরধ করছি। আশা করি আমার কথাটা রাখবেন।

মৃন্ময়ী হতবিহবল চোখে তাকাল। নাহিদের কাছ থেকে এরকম কথা সে কখনও আশা করে নি। আর এভাবে কোন মানুষ বললে তাকে কি না বলা সম্ভব? মৃন্ময়ী মৃদু হেসে বলল
–এভাবে বলবেন না প্লিজ। আমি আপনার সাথেই যাবো।

নাহিদ হেসে গাড়ির কাছে গিয়ে দরজা খুলে বলল
–আসুন।

———–
ঘুম থেকে উঠেই আড়মোড়া ভেঙ্গে কিছুক্ষণ বিছানায় বসে থাকলো ফারিয়া। চোখের ঘুম পুরোপুরি মিলিয়ে যেতেই তার মনে পড়ল সে নিজের বাড়িতে নেই। শশুর বাড়িতে আছে। আশে পাশে তাকাল কেউ নেই ঘরে। পাশ ফিরে সোফায় তাকাল। কাল রাতে জারিফ ওখানেই শুয়েছিল। কিন্তু তার বালিশ কাথা সব কিছু বিছানার এক পাশে সুন্দর করে সাজানো। দৃষ্টি ফিরিয়ে দেয়াল ঘড়ির দিকে তাকাতেই আঁতকে উঠলো। ৯ টা বাজে। সে সকালে উঠতে পারে না ঠিকই কিন্তু এখন তো আর বাড়িতে নেই। শশুর বাড়িতে প্রথম দিন। তার খেয়াল করা উচিৎ ছিল। সবাই এখন কি ভাববে কে জানে। তড়িঘড়ি করে উঠে ওয়াশ রুমে গেলো। কোন রকমে ফ্রেশ হয়ে ঘর থেকে বের হতেই জারিফের সাথে ধাক্কা খেলো। জারিফের হাত থেকে মোবাইলটা নিচে পড়ে গেলো। সে ফারিয়ার দিকে তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে বলল
–ইডিয়েট! দেখতে পাওনা? চোখ কি বাপের বাড়িতে রেখে এসেছ?

ফারিয়ার পুরো বিষয় বুঝতে কয়েক মুহূর্ত কেটে গেলো। মস্তিস্কে পুরো বিষয় বোধগম্য হতেই জারিফের উপরে রাগটা প্রকট হল। অগ্নি দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল
–তুমি কখন ঘুম থেকে উঠেছ?

জারিফ নিচে থেকে ফোনটা তুলে ভালোভাবে নেড়ে চেড়ে দেখছিল। এমন কথা শুনে ফারিয়ার দিকে কৌতূহলী চোখে তাকাল। গম্ভির কণ্ঠে বলল
–রাত পার হতেই নিজের রুপ চেঞ্জ করে ফেললে। বউয়ের মতো জেরা করতে শুরু করেছ? এখন কি তোমাকে আমার প্রতি মিনিট সেকেন্ডের হিসেব দিতে হবে?

ফারিয়া জারিফের উপরে প্রচণ্ড বিরক্ত হল। তার এরকম প্রশ্ন করার পিছনে এমন কোন উদ্দেশ্য ছিল না। বিরক্তিকর সরে বলল
–লিসেন! তোমার মিনিট সেকেন্ডের প্রতি আমার কোন ইন্টারেস্ট নেই। ইনফ্যাক্ট তোমার উপরেই আমার কোন ইন্টারেস্ট নাই।

জারিফ সরু চোখে তাকাল। তার কথা যে ফারিয়া তাকেই ফেরত দিলো সেটা বুঝতে সময় লাগলো না। ফারিয়া রাগি সরে বলল
–তুমি যখন উঠেছ আমাকে ডাকো নি কেন? কতো বেলা হয়েছে সেটা দেখেছ? আর সবাই কি ভাববে? শশুর বাড়িতে প্রথমদিন বউ এতো বেলা করে ঘুম থেকে উঠছে।

জারিফ কিছুক্ষণ শান্ত চোখে তাকিয়ে থাকলো। তারপর খুব শান্ত গলায় বলল
–তোমার বাবা তোমাকে আমার গলায় গছিয়ে দিয়েছে। তোমার ব্যক্তিগত এসিস্টেন্ট হিসেবে আমাকে চুজ করেছে সেটা তো বলেনি একবারও।

ফারিয়া বড় বড় চোখে তাকাল। জারিফ আবারো বলল
–তোমাকে যে সকালে ঘুম থেকে ডেকে তুলতে হবে টাইমলি সেটা বলে দেয়া উচিৎ ছিল তোমার বাবার। অন্তত আমাকে বলতে পারতো যে তার অকাজের মেয়ে কোন কাজ করতে পারে না। তাই আমাকে তার সব কাজ করে দিতে হবে।

ফারিয়ার রাগ হলেও সে আর কথা বাড়াতে চায় না। কারন এমনিতেই দেরি হয়ে গেছে। আর দেরি সে করতে চায় না। তাই দ্রুত পায়ে ডাইনিং এর দিকে এগুতেই জারিফ তাকে আটকে দিলো। থেমে তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে বলল
–আমার তোমার সাথে এই মুহূর্তে কথা বলার মুড নেই জারিফ। ছেড়ে দাও আমাকে।

জারিফ টেনে সামনে দাড় করিয়ে দিয়ে বলল
–সেটা বুঝতে পারলাম। কিন্তু এভাবে কোথায় জাচ্ছ?

–ডাইনিং এ যাচ্ছি।

ফারিয়া সহজ ভাবে উত্তর দিতেই জারিফ দাতে দাত চেপে বলল
–সিরিয়াসলি তুমি ডাইনিং এ জাচ্ছ এভাবে?

ফারিয়া নিজের দিকে ভালোভাবে তাকাল। দেখে নিয়ে বলল
–সবই তো ঠিক আছে। এভাবে কি সমস্যা?

জারিফ হাত ধরে তাকে রুমে নিয়ে আসলো। দরজা বন্ধ করে দিয়ে বলল
–আর ইউ ক্রেজি ফারিয়া? তুমি নতুন বউ সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠেই সবার সামনে এভাবে যাবে?

ফারিয়া জারিফের কথা বুঝতে পারল না। মৃদু সরে বলল
–আমি তো অনেক আগেই ঘুম থেকে উঠেছি। ফ্রেশ হয়েছি। এভাবে যেতে সমস্যা কি?

জারিফ এমন অবুঝ প্রশ্নে খুব বিরক্ত হল। তবুও নিজেকে শান্ত রেখে বলল
–কাল তোমার বাসর রাত ছিল। রাতে চেঞ্জ না করেই শুয়ে পড়েছিলে। আর তুমি সকালে উঠে সেই কাপড় পরেই সবার সামনে যাচ্ছ। এসব চেঞ্জ করো। শাওয়ার নিবে তারপর বাইরে যাবে।

ফারিয়া অগ্নি দৃষ্টি ফেলে বলল
–এখন শাওয়ার নিতে গেলে কতো দেরি হবে সেই আইডিয়া তোমার আছে? এমনিতেই আমি দেরি করে ফেলেছি।

জারিফ তপ্ত শ্বাস ছেড়ে শান্ত গলায় বলল
–এভাবে সবার সামনে গেলে কতো প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হবে সেটা ভেবেছ? পারবে সব কিছু সামলে নিতে? একটু দেরিই হল নাহয় আজকে। নতুন বউ হিসেবে তোমার ভুল হয়তো মাফ করে দেবে। কিন্তু তুমি এভাবে সবার সামনে গেলে সবাই বিষয়টা অন্যভাবে নেবে। সময় নষ্ট না করে যা বলছি সেটা শোনো। তোমার ভালো হবে।

ফারিয়া বুঝতে পারল জারিফের কথা। রাতে প্রচণ্ড টায়ার্ড ছিল বলে সে চেঞ্জ না করেই ঘুমিয়ে পড়েছিলো। দেরি না করে কাপড় নিয়ে ওয়াশ রুমে চলে গেলো। দ্রুত শাওয়ার নিয়ে বের হয়ে এলো। জারিফ বিছানায় বসে ছিল। ফারিয়া বের হয়েই জারিফের সামনে দাড়িয়ে বলল
–এখন ঠিক আছে?

জারিফ পা থেকে মাথা পর্যন্ত পুরোটাই দেখে নিলো। মৃদু হেসে মাথা নাড়ল। যার অর্থ ঠিক আছে। ফারিয়া রুম থেকে বের হয়ে গেলো। জারিফ সেই দিকেই তাকিয়ে ভাবছে শেষ পর্যন্ত তাদের বিয়েটা হয়েই গেলো। অবশ্য এই বিয়ে হওয়ার পেছনে দুজনেরই দোষ আছে। রাজি না থাকলেও তারা দুজনেই পরিবারের বিরুদ্ধে গিয়ে নিজের মতামত প্রকাশ করতে পারেনি। বলতে পারেনি যে বিয়ে করতে চায় না। কারন তারা দুজন দুজনকে বিয়ে না করতে চাইলে অন্য কোথাও বিয়ে দিয়ে দিবে। আর এখন কেউই বিয়ের জন্য প্রস্তুত ছিল না। তাই আর কোন উপায় না দেখে শেষ পর্যন্ত রাজি হয়ে যায়। জারিফ চোখ বন্ধ করে একটা তপ্ত শ্বাস ছেড়ে বের হয়ে গেলো বাইরে।

————-
বেশ অনেকটা সময় যাবত নাহিদের ঘরের বাইরে পায়চারী করছে ঈশা আর সায়রা। কেউ ভেতরে ঢুকতে পারছে না। একটু পর পর তারা দরজার দিকে উকি দিচ্ছে। বেশ কিছুক্ষণ পর নাহিদ রেডি হয়ে বের হল। এভাবে তার মা আর ঈশাকে ঘরের বাইরে দাড়িয়ে থাকতে দেখে থেমে গেলো। অবাক দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে প্রশ্ন করলো
–তোমরা এখানে? কি হয়েছে?

সায়রা বেগম ঈশার দিকে তাকাল। ঈশা দাত কেলিয়ে হাসল। তারপর জিজ্ঞেস করলো
–ভাইয়া তুমি কি কোথাও যাচ্ছ?

নাহিদ সরু চোখে তাকাল। সন্দিহান কণ্ঠে বলল
–একটু বাইরে যাচ্ছি। কিন্তু তুই কেন জিজ্ঞেস করছিস? কিছু বলবি?

ঈশা দাত কেলিয়ে বলল
–বাইরে যাওয়ার আগে চা খেয়ে যাও। চাচি চা বানিয়েছে। আমরা একসাথে চা খাব বলে অপেক্ষা করছিলাম।

ঈশার কথা গুলো বেশ অসঙ্গতিপূর্ণ। সে বুঝতে পারল এই দুজনের মাথায় কিছু একটা চলছে। তাই তাদের কথা মতই চা খেতে বসল টেবিলে। চা খেতে খেতে এক পর্যায়ে ঈশা বলল
–আচ্ছা ভাইয়া তোমার কি কোন পছন্দ আছে?

নাহিদ চায়ে চুমুক দিয়ে কাপটা টেবিলে রেখে দিলো। তীক্ষ্ণ চোখে ঈশার দিকে তাকিয়ে বলল
–কি বলতে চাস তুই? পরিস্কার করে বল।

ঈশা এই সুযোগটা হাত ছাড়া করতে চাইল না। সহজ ভাবে বলে ফেললো
–মৃন্ময়ীকে তোমার পছন্দ হয়েছে?

নামটা শুনে নাহিদের মুখের আকৃতি পরিবর্তন হয়ে গেলো। নিচের দিকে তাকিয়ে গভির ভাবনায় ডুবে গেলো সে।
#মেঘবদল
লেখক-এ রহমান
পর্ব ৫

ঈশা আর সায়রা অধির আগ্রহে অপেক্ষা করছে নাহিদের উত্তরের জন্য। ঈশা বড় বড় চোখে নাহিদের দিকে তাকিয়ে থাকলেও সায়রার মনে হচ্ছে তার যেন দম বন্ধ হয়ে আসছে। নাহিদ যদি কোনভাবে না বলে দেয় তাহলে সত্যি সত্যি তার দম বন্ধ হয়ে যাবে। শুকনো ঢোক গিলে ফেললো। সামনে গ্লাসটা তুলে পানি খেয়ে আবার রেখে দিলো। ভিত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো
–তোর পছন্দ হয়নি বাবা?

নাহিদ খুব স্বাভাবিক ভাবে তাকাল। শান্ত কণ্ঠে বলল
–একটা মানুষকে চিনতে সারাটা জীবন পার হয়ে যায় মা। মানুষটার প্রতি অনুভূতিটা ঠিক কতটা তীব্র সেটা বুঝতে মানুষের অনেক সময় লেগে যায়। কয়েক ঘণ্টার আলাপে সেটা বুঝতে পারা অসম্ভব।

নাহিদের কথার আগা মাথা কিছুই বুঝতে পারল না সায়রা। কয়েক মুহূর্ত নিরবতায় কেটে যেতেই ঈশা উত্তেজিত হয়ে বলল
–তোমার এরকম কথা বলা এখন বন্ধ রাখ ভাইয়া। এই ব্যাপারে মেয়ের বাড়ি থেকে যখন ফোন করে জিজ্ঞেস করবে যে তোমার মেয়ে পছন্দ হয়েছে কিনা তখন আমরা কি বলবো?

নাহিদ পূর্ণ দৃষ্টি মেলে তাকাল ঈশার দিকে। ঈশা বিরক্ত হয়ে বলল
–তোমার কথা অনুযায়ী যদি তখন বলা হয় যে কয়েক ঘণ্টার আলাপে ভালো লাগা খারাপ লাগা বোঝা সম্ভব হয় নি। আরও সময় প্রয়োজন তাহলে মেয়ের বাড়ির লোকজন কি ভাববে বুঝতে পারছ? তাই সহজ ভাবে বলে দাও তোমার পছন্দ হয়েছে কি না?

নাহিদের ফোন বেজে উঠলো। ফোনটা ধরেই কিছুক্ষণ কথা বলেই উঠে চলে গেলো। কথোপকথন শুনে মনে হল খুব জরুরী কাজে যাচ্ছে। কিন্তু এইদিকে ঈশা আর সায়রা খুব বিরক্ত হল। হতাশ হয়ে দুজনেই তাকিয়ে থাকলো নাহিদের দিকে। ঈশা একটু ভেবে বলল
–তুমি ভেব না চাচি। আমি তোমার ছেলের পেট থেকে কথা বের করেই ছাড়বো।

সায়রা ঈশার কথা শুনেও নিশ্চিন্ত হতে পারল না। কারন তার ছেলে বরাবর এমন। কোন কথাই স্পষ্ট বলে না। এবারও যে কিছুই বলবে না সেটা সে জানে।

————–
নুরুল রহমান সকালের চায়ে চুমুক দিতেই কলিং বেল বেজে উঠলো। তিনি বেশ বিরক্ত হলেন। এতো সকালে নিশ্চয় দারোয়ান কোন বার্তা নিয়ে এসেছে। গ্রাম থেকে একটা ছেলেকে এনে দারোয়ানের চাকরি দিয়েছেন তিনি। কিন্তু ছেলেটা অত্যন্ত বোকা। খুব তুচ্ছ বিষয়েও ছেলেটি নিজের বুদ্ধি খাটাতে পারে না। ছেলেদের এতো বোকা ভাব মানায় না। এখন তার মনে হচ্ছে তিনি ভুল করেছেন। কারন দারোয়ানের চাকরির জন্য বিচক্ষন ব্যক্তি নির্বাচন করতে হয়। যাতে খুব গুরুত্বপূর্ণ সময়ে অতি বিচক্ষণতার সাথে সিদ্ধান্ত নিতে পারে। চায়ের কাপটা টেবিলে রেখে তিনি দরজা খুলতে গেলেন। নুরুল সাহেব দরজা খুলতেই ঈশাকে দাড়িয়ে থাকতে দেখে অবাক হলেন। জিজ্ঞেস করলেন
–এতো সকালে তুই?

ঈশা অত্যন্ত নরম সুরে বলল
–তোমাদের জন্য মা খাবার পাঠিয়েছে। বড় মার নাকি শরীর খারাপ?

নুরুল সাহেব আরেকদফা অবাক হলেন। কণ্ঠে অবাকের রেশ টেনে বললেন
–তুই কিভাবে জানলি তোর বড় মার শরীর খারাপ?

ঈশা ভেতরে ঢুকে স্যান্ডেল খুলতে খুলতে বলল
–মা ফোন করেছিল। তখন শুনেছে বড় মার প্রেসার বেড়েছে। তাই আমাকে নাস্তা নিয়ে আসতে বলল।

তারপর নুরুল সাহেবের দিকে তাকিয়ে আবার বলল
–চা কি তুমি বানিয়েছ? বড় মা কোথায়?

নুরুল সাহেব হ্যা সুচক মাথা নাড়লেন। মৃদু সরে বললেন
–ঘরে শুয়ে আছে।

ঈশা টেবিলে নাস্তা রেখে ঘরের দিকে গেল। মাহমুদা শুয়ে আছে। ঈশা ঘরে ঢুকে জিজ্ঞেস করলো
–বড় মা কেমন আছ এখন?

মাহমুদা চোখ মেলে তাকাল। ক্লান্ত গলায় বলল
–তুই এসেছিস?

ঈশা পাশে বসল। মাহমুদা উঠতে চাইলে ঈশা বাধা দিলো। শুয়ে দিয়ে বলল
–তোমাকে উঠতে হবে না। কি করতে হবে সেটা বল আমাকে। এখন কেমন লাগছে?

–ভালো লাগছে না রে।

ঈশা মাথায় হাত দিয়ে বলল
–তুমি একটু ঘুমাও বড় মা। আমাকে বল কি করতে হবে।

মাহমুদা ক্লান্ত গলায় বললেন
–তোর বড় বাবা আর ইভান কে খেতে দে। ওরা বাইরে যাবে।

ঈশা মাথা নেড়ে বের হয়ে এলো ঘর থেকে। এসে দেখে ইভানের বাবা খাবার নিয়ে বসে পড়েছেন। ঈশা এগিয়ে এসে বলল
–তোমার কি লাগবে বড় বাবা?

নুরুল সাহেব চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। বললেন
–আমার আর কিছু লাগবে না রে মা। আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে। আমি যাচ্ছি তুই বরং ইভান কে খেতে দে।

ঈশা মাথা নাড়াল। নুরুল সাহেব চলে গেলেন নিজের কাজে। ঈশা রান্না ঘরে গেলো রান্না করতে। বেশ কিছুক্ষণ পর ইভান ঘর থেকে বের হয়ে এলো। এসেই টেবিলে বসে গলা ছেড়ে বলল
–মা খেতে দাও।

ঈশা রান্না ঘর থেকে বের হয়ে এসে দাঁড়াল তার সামনে। ইভান ফোনের দিকে তাকিয়ে ছিল। উপস্থিতি বুঝতে পেরে চোখ তুলে তাকাল। ঈশাকে দেখে মুহূর্তেই তার মুখভঙ্গি পরিবর্তন হয়ে গেলো। অদ্ভুত এক অনুভূতি। রাগ আবার ভালো লাগার সংমিশ্রন। ঈশা প্লেটে খাবার বেড়ে দিতে দিতেই বলল
–বড় মা অসুস্থ। প্রেসার বেড়েছে। শুয়ে আছে।

ইভান অস্থির হয়ে বলল
–মার প্রেসার বেড়েছে আমাকে বলে নি কেন?

ঈশা ইভানের কথার উত্তর না দিয়ে বলল
–এখন ঠিক আছে। ঘুমাচ্ছে। তোমার কি লাগবে আমাকে বল?

ঈশার কথা শুনে অদ্ভুত ভাবে ইভানের মন ভাল হয়ে গেলো। ক্ষীণ হাসি ফুটে উঠলো ঠোটের কোনে। কিন্তু সেটা প্রকাশ না করে চেপে গেলো। চেহারায় গাম্ভীর্যতা এনে চুপচাপ বসে থাকলো। ঈশা খাবার বেড়ে দিয়ে রান্না ঘরে চলে গেলো। ইভান কিছু একটা ভেবে হেসে ফেললো। ঈশাকে এভাবে দেখে তার খুব ভালো লাগছে। ঈশা তার ফোন ইভানের পাশে রেখে চলে গেছে রান্না করতে। ইভান খাওয়া শুরু করতেই ফোন বেজে উঠলো। স্ক্রিনে রাতুল নাম দেখেই ইভানের মেজাজ খারাপ হয়ে গেলো। ফোনটা কেটে দিয়ে বন্ধ করে দিলো। ঈশা রান্না ঘর থেকে এসে ফোনের দিকে তাকিয়ে বলল
–আমার ফোন বাজল?

–না।

ইভানের সোজা সাপটা জবাব ঈশার বিশ্বাস হল না। সে তীব্র বিরক্তি প্রকাশ করে বলল
–আমি স্পষ্ট আমার ফোনের রিংটোন শুনতে পেয়েছি। একবার বেজেই বন্ধ হয়ে গেলো।

ইভান তীক্ষ্ণ চোখে তাকাল। ভারি গলায় বলল
–তাহলে কি বলতে চাচ্ছিস আমি শুনতে পাই না? নাকি আমি তোর সাথে মজা করছি।

ঈশা ভ্রু কুচকে বলল
–আমি এটা কখন বললাম?

–আমি এখানে বসে আছি। ফোন বাজলে অবশ্যই শুনতে পেতাম।

ঈশা ভাবল তার মনের ভুল হতে পারে। তাই আর গুরুত্ব দিলো না চলে গেলো নিজের কাজে। ইভান বাকা হেসে নিজের খাওয়ায় মন দিলো। খাওয়া শেষ করে রান্না ঘরে গেলো। ঈশার সমস্ত মনোযোগ তার রান্নায়। তাই ইভান কে খেয়াল করলো না সে। ইভান ধির পায়ে ঈশার পিছনে গিয়ে দাঁড়াল। উপস্থিতি টের পেয়ে ঈশা পিছনে ঘুরে তাকাল। ইভান কে দাড়িয়ে থাকতে দেখে জিজ্ঞেস করলো
–তুমি এখানে? কিছু লাগবে?

–চা খাব।

ইভান খুব সহজ ভাবে উত্তর দিলো। ঈশা পেয়াজ কাটছিল। সেদিকে তাকিয়ে বলল
–এটা শেষ করেই চা বানিয়ে দিচ্ছি।

–থাক। আমি বানাচ্ছি। তুই তোর কাজ কর।

বলেই ইভান চা বানাতে চুলা জালিয়ে দিলো। ঈশা অবাক চোখে তাকিয়ে আছে। তাকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে ইভান বলল
–এভাবে দেখার কি আছে? তোর কি ধারনা আমি কোন কাজ করতে পারি না?

ঈশা নিজের কাজে মনোযোগ দিয়ে বলল
–আমি এরকম কিছু বলি নি। আমি ভাবছিলাম তোমার আজ অফিস নেই? যাবে না?

ইভান দেয়ালে হেলানি দিয়ে দাড়িয়ে বলল
–অফিসে এখন যেতে হবে না। ট্রেনিং শুরু পরশু থেকে। তারপর শেষ হলেই দেশের বাইরে চলে যাবো।

ইভানের কথা শুনে ঈশার খুব কষ্ট হল। ইভান চলে যাবে ভাবতেই চোখ ছলছল করে উঠলো। অসাবধানতায় ছুরি দিয়ে চাপ দিতেই হাত কেটে গেলো। মৃদু আর্তনাদ কানে আসতেই ইভান অস্থির হয়ে হাত ধরে ফেললো। খুব বেশী কাটেনি হালকা চামড়া উঠে গেছে। কিন্তু প্রচুর রক্ত ঝরছে। ঈশার হাতটা পানির নিচে ধরল। তারপর চেপে ধরে অস্থির কণ্ঠে বলল
–এভাবে ধরে থাক। আমি আসছি।

ঈশা চেপে ধরে দাড়িয়ে আছে। কিছুক্ষণ পরেই ইভান তুলা আর ডেটল নিয়ে আসলো। ডেটলের ঢাকনা খুলতেই ঈশা হাঁসফাঁস করতে শুরু করলো। ভারি হয়ে উঠলো মাথা। তার এমন অবস্থা দেখে ইভান অস্থির কণ্ঠে বলল
–কি হয়েছে? এমন করছিস কেন?

ঈশা কথা বলতে পারল না। জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছে সে। মাথাটা আচমকাই ঘুরে উঠতেই ইভানের গায়ে পুরো ভর ছেড়ে দিলো। ইভান দুই হাতে তাকে জড়িয়ে ধরে ডাকতে লাগলো
–ঈশা কি হয়েছে? কথা বল? খারাপ লাগছে তোর?

ততক্ষনে ঈশা সম্পূর্ণ ভাবে নিস্তেজ হয়ে গেছে। কোন জ্ঞান নেই তার। ইভানের মাথায় কিছুই ঢুকছে না। হুট করে ঈশার এরকম জ্ঞান হারানর কারন কি হতে পারে। সামান্য কেটে যাওয়ার কারনে এমন হওয়ার তো কথা নয়।

চলবে……
চলবে……

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here