মেঘবদল পর্ব -০২+৩

#মেঘবদল
লেখক-এ রহমান
পর্ব ২

মাহমুদা পায়চারী করছে ডাইনিং এর এপাশ থেকে ওপাশ অনবরত। কারণটা নুরুল রহমানের জানা নেই। তাই তিনি তেমন গুরুত্ব দিলেন না। পেপারের পাতাটা উলটাতেই খুব ভালো একটা খবর চোখে পড়ল তাঁর। রাজনীতির প্রতি তার আগ্রহের কোন সীমা নেই। টিভি হোক বা পেপার সব জায়গাতেই তিনি সারাদিন রাজনীতির খবর শোনেন। এতে মাহমুদা চরম বিরক্ত হয়। কিন্তু সেটাতে তাঁর কোন যায় আসে না। এসব বিষয়ে তিনি খুব একটা পাত্তা দেন না। খুব আগ্রহ নিয়ে খবরটা পড়লেন তিনি। কিন্তু তীব্র উত্তেজনার মাঝে তাঁর মনে হল এই মুহূর্তে এক কাপ চা হলে খুব ভালো হতো। সাধারনত তিনি সারাদিন কয়েক কাপ চা খান। কিন্তু আজ তাঁর মনে হল মাহমুদার মন মেজাজ ভালো নেই। কারন তাঁর মন মেজাজ যখন ভালো থাকে না তখন হিসেব করে সকালে এক কাপ আর বিকেলে এক কাপ চা পাওয়া যায়। আজও ঠিক তেমনটাই ঘটতে চলেছে। সামনে বড় দেয়াল ঘড়িটার দিকে তাকাল। এখন ১ টা বাজে। একটা শ্বাস ছেড়ে ঘাড় বেকিয়ে মাহমুদার দিকে তাকালেন। বেশ উদ্বিগ্ন দেখাচ্ছে তাকে। কোন বিষয় নিয়ে খুব বেশী চিন্তায় আছেন। মুখে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে গেছে। দৃষ্টি দরজার দিকে স্থির। নুরুল সাহেব অনেকটা সময় তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করলো পুরো ঘটনা। এদিকে চায়ের পিপাসাটাও বেড়েই চলেছে। মাহমুদার মেজাজ অনুযায়ী এই দুপুর বেলা ভাত খাওয়ার সময়ে চা খেতে চাওয়াটা ঠিক কতটুকু অপরাধ হবে সেটার হিসেব করতে লাগলেন। কিন্তু হিসেব মেলাতে ব্যর্থ হয়ে গেলেন। মাহমুদাকে দরজার দিকে স্থির তাকিয়ে থাকতে দেখে গম্ভির সরে জিজ্ঞেস করলেন
–ইভানের মা? কেউ কি আসছে বাসায়?

মাহমুদা চমকে উঠলো। গভির ভাবনায় ছেদ পড়ায় একটু বিরক্ত হল। কিন্তু সেটা প্রকাশ করলো না। সামলে নিয়ে বলল
–ইভানের জন্য অপেক্ষা করছি।

কথাটা শুনে কপালে ভাজ পড়ে গেলো তাঁর। সন্দিহান কণ্ঠে বলল
–ওর জন্য এভাবে অপেক্ষা করার কি আছে? তোমার ছেলে বাইরে গেছে বিদেশে নয়। ঘুরেফিরে চলে আসবে। এতো বড় ছেলে হারিয়ে যাবারও কোন সম্ভাবনা নেই।

মাহমুদা দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলো। নুরুল সাহেব পেপার ভাজ করে রেখে উঠে গেলেন স্ত্রীর সামনে। শান্ত গলায় বললেন
–কি হয়েছে আমাকে খুলে বল। তোমার কথার মাঝে কেমন অসংগতি খুজে পাচ্ছি। কি করেছে তোমার ছেলে?

মাহমুদা তিব্র বিরক্ত নিয়ে তাকাল। বলল
–ছেলেটা কি শুধু আমার? এভাবে বারবার তোমার ছেলে তোমার ছেলে বলছ কেন?

–আমি সেটা বলিনি। তোমার ছেলে বলছি কারন সে তো আমার কথা খুব একটা গ্রাহ্য করে না। বাবা হিসেবে তেমন গুরুত্ব আমার তাঁর কাছে নেই। তাই অধিকার বোধ থেকে আমার ছেলে বলতে পারি না।

মাহমুদা প্রশ্নবিদ্ধ চোখে তাকাল। বাবা ছেলের মাঝে অদৃশ্য এক প্রতিযোগিতা চলে। যেখানে বাবা ছেলেকে তাঁর মতো বানাতে চায়। আর ছেলে নিজের মন মতো চলতে চায়। ব্যক্তি স্বাধীনতাকে প্রধান্য দেয়। এটাই বাবার পছন্দ না। আর তাদের এই প্রতিযোগিতা দেখতে দেখতে মাহমুদা হাপিয়ে উঠেছে। নুরুল সাহেবের দিকে তাকিয়ে মাহমুদা খুব শান্ত সরে বলল
–ইভান একটু অন্য রকম। নিজের মতো থাকতে পছন্দ করে। এতে এমন দোষের কি আছে বল?

নুরুল রহমান মৃদু হাসলেন। চোখটা নামিয়ে বললেন
–আমার বয়স হয়েছে ইভানের মা। আমি সব সময় চেয়েছি আমার এক মাত্র ছেলে ব্যবসার হাল ধরবে। কিন্তু এসবের প্রতি তো তাঁর কোন আগ্রহ নেই। সে নিজের ক্যারিয়ার নিয়েই ব্যস্ত। চাকরি করবে। বিদেশে যাবে। আমি এখন আর এসব সামলে উঠতে পারি না। শরীর খুব একটা সায় দেয় না আগের মতো।

কথাটা বলেই তিনি থেমে গেলেন। মাহমুদা অসহায়ের মতো তাকাল। নুরুল সাহেবের শরীর এখন আগের মতো নেই। প্রায় সময়ই তিনি অসুস্থ থাকেন। মাহমুদা অতি নরম সুরে বলল
–পুরো ব্যবসাটা দেখাশোনার জন্য একটা লোক রেখে দিলেও তো পারো। তাহলেই নিজেকে আর এতো পরিশ্রম করতে হয় না।

নুরুল সাহেব একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। বলল
–নিজের হাতে তিলে তিলে গড়ে তোলা এই ব্যবসা আমি অন্য কারো দায়িত্তে কিভাবে দিতে পারি মাহমুদা? এই ব্যবসা প্রতিষ্ঠিত করতে আমাকে কতো ত্যাগ করতে হয়েছে সেটা তো তুমি ভালো করেই জানো।

মাহমুদা বিরক্ত নিয়ে তাকালেন। ইভান না হয় নিজের ক্যারিয়ার তৈরি করে দেশের বাইরে চলে যেতে চায়। কিন্তু নুরুল সাহেবও ছেলে মানুষের মতো আচরন করছে। ছেলেটা তাঁর স্বাধীনচেতা। এটা বাবা মেনে নিলেই হয়তো তাদের বাবা ছেলের এই দূরত্ব মিটে যেতো। দুজনকে অনেক বুঝিয়েছে সে। কিন্তু কোন লাভ হয়নি। দুজন দুজনের সিদ্ধান্তে অটল। ছেলে বিদেশে যাবে আর বাবা তাকে নিজের ব্যবসার দায়িত্ব দিতে চায়। নিজের গোপন দীর্ঘশ্বাসটা গোপন রেখে দিলো। কোন কথা বলল না। এই মুহূর্তে তাঁর এসব নিয়ে যুক্তি তর্ক করতে ইচ্ছা করছে না। কারন তিনি মহা চিন্তায় ব্যস্ত। কলিং বেল বেজে উঠলো। মাহমুদা এক প্রকার দৌড়ে গেলেন দুরজা খুলতে। দরজা খুলেই ইভান কে দেখে এক গাল হেসে বললেন
–তুই এসেছিস বাবা?

ইভান সৌজন্য হেসে মাথা নাড়ল। কোন কথা বলল না। মাহমুদা বুঝতে চেষ্টা করলো ঠিক কি হয়েছে। কিন্তু হাবভাব দেখে কিছু বুঝতে পারল না। নিজের কৌতূহল দমাতে না পেরে জিজ্ঞেস করেই বসল
–কথা হয়েছে ঈশার সাথে?

ইভান ততক্ষনে নিজের ঘরের দিকে পা বাড়িয়েছিল। থেমে গেলো। মায়ের দিকে ফিরে কড়া গলায় জবাব দিলো
–তুমি কি আমার নিজের মা? সেটা নিয়ে কিন্তু আমার যথেষ্ট সন্দেহ আছে।

মাহমুদা থতমত খেয়ে ছেলের দিকে তাকিয়ে থাকলেন। নুরুল সাহেব বেশ আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে আছেন পরবর্তী কথা শোনার জন্য। ইভান একটু গলা তুলেই বলল
–নিজের মা হয়ে তুমি কিভাবে নিজের ছেলের জীবনটা এভাবে ধংসের দিকে ঠেলে দিতে চেষ্টা করছ। কি বুঝে ঐ মেয়ের সাথে আমার বিয়ে ঠিক করেছ তুমি? কোন দিক থেকে তোমার মনে হল ঐ মেয়ে আমার যোগ্য।

কথাটা শুনেই নুরুল সাহেব বড় বড় চোখে তাকালেন। মা ছেলের কথার অর্থ তিনি ধরতে পারছেন না। ভ্রু কুচকে জিজ্ঞেস করলেন
–কি নিয়ে কথা বলছ? আর কার বিয়ে?

ইভান তীক্ষ্ণ চোখে তাকাল তার মায়ের দিকে। প্রকাশ্যে বাবার বিরোধিতা করলেও মনে মনে সে বাবাকে খুব ভালবাসে। তাই তাঁর মা এতো বড় একটা ঘটনা বাবাকে জানায় নি সেটা ভেবেই তাঁর বিরক্ত লাগছে। নুরুল সাহেব স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে গম্ভির গলায় বললেন
–কথা বল মাহমুদা। কার বিয়ের কথা বলছ?

ইভান খুব শান্ত ভাবে বলল
–আমার বিয়ের কথা হচ্ছিলো। তোমার ভাইয়ের মেয়ের সাথে। কিন্তু সেই মেয়ে কোনদিক থেকেই আমার যোগ্য না। ওরকম একটা অহংকারী বদ মেজাজি মেয়েকে বিয়ে করে নিজের জীবন নষ্ট করার চেয়ে সারাজীবন একা থাকা অনেক ভালো।

কথা শেষ করেই ইভান ঘরে চলে গেলো। নুরুল সাহেব মাহমুদার সামনে দাড়িয়ে তীক্ষ্ণ গলায় বললেন
–কার কথায় তুমি এই বিয়ের সিদ্ধান্ত নিয়েছ?

মাহমুদা করুন চোখে তাকাল নুরুল সাহেবের দিকে। কাঁপা কাঁপা গলায় বলল
–ঈশা ইভান কে পছন্দ করে। সেটা সে নিজে তাঁর ডাইরিতে লিখেছে। আর আমি সেটা নিয়ে ঈশার বাবা মায়ের সাথে কথা বলেছি। তারাও সম্মতি দিয়েছে। কোন সিধান্ত নেয়ার আগে আমি তাই ইভান আর ঈশাকে আলাদা করে কথা বলতে বলেছিলাম। তাদের কথা বলার পরেই মতামত নিয়ে কথা বাড়াতাম। কিন্তু…।

মাহমুদা থেমে গেলো। নুরুল সাহেব ধরা গলায় বললেন
–দেখেছ স্বাধীনতার পরিনাম। তোমার স্বাধীনচেতা ছেলে আজ মেয়েটার অনুভূতিকে প্রাধান্য দিচ্ছে না। যোগ্যতা নিয়ে কথা তুলছে। আর তোমাকেও বলছি মাহমুদা। এরকম কোন সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে তোমার ছেলের সাথে ভালো করে কথা বলে নিতে। তাহলে আজ মেয়েটাকে এতো কষ্ট পেতে হতো না। তোমার যোগ্য ছেলে শুধু স্বপ্ন ভাংতে পারে। গড়তে পারে না।

নুরুল সাহেব নিজের ঘরে চলে গেলেন। মাহমুদা অপরাধীর মতো এক জায়গাতেই দাড়িয়ে থাকলেন। তাঁর মস্তিস্ক জুড়ে একটাই প্রশ্ন সে কি তবে ঈশার সাথে অন্যায় করলো। কেনই বা ইভান তাকে মেনে নিতে পারছে না।

নিজের ঘরে দাড়িয়ে বাইরে বাবা মায়ের সমস্ত কথা শুনছিল ইভান। তাঁর বাবা যে এই বিষয়টা নিয়ে কষ্ট পেয়েছে সেটা সে বুঝতে পারছে। কিন্তু তাঁর কিছুই করার নেই। সে পরিস্থিতির স্বীকার। পকেট থেকে ফোনটা বের করে স্ক্রিন অন করে ঈশার হাস্যজ্জল ছবিটা দেখে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল
–তোর জন্য আমিই নাহয় সবার কাছে অপরাধি হলাম। শুধু তুই ভালো থাকিস।

————–
–বাসর রাতটা কি বারান্দাতেই কাটিয়ে দেয়ার ইচ্ছা আছে?

জারিফের গম্ভির আওয়াজে ভয় কেঁপে উঠলো ফারিয়া। বারান্দার গ্রিল ধরে রাস্তার দিকে তাকিয়ে ছিল। একা একা এতক্ষন বসে থাকতে বিরক্ত হয়ে গেছে। তাই বারন্দায় গিয়ে দাঁড়িয়েছিল। জারিফ কখন এসেছে সেটা বুঝতে পারেনি। ঐ বাড়ি থেকে আসার পর ফারিয়ার মন মেজাজ কোনটাই ভালো নেই। আর এখন জারিফের এমন কথা শুনে রাগ এখন শরীরের প্রতিটা শিরায় শিরায় জেগে উঠছে। নিজেকে শান্ত করা কঠিন হয়ে পড়ছে। জারিফের কাছাকাছি গিয়ে পাঞ্জাবির কলার দুই হাতে চেপে ধরে বলল
–তুমি কি ভাবছ আমি এখন তোমার সাথে বাসর করবো?

জারিফ ফারিয়ার হাত দুটো ছাড়িয়ে নিয়ে পাঞ্জাবি ঠিক করতে করতে বলল
–বিয়ে করেছ যখন বাসর তো করতেই হবে।

ফারিয়া চোখ বড় বড় করে তাকাল। জারিফ গভির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তাঁর দিকে। দুই কদম পিছিয়ে গিয়ে বলল
–এসবের মানে কি?

জারিফ ভ্রু কুচকে তাকাল। বলল
–তুমি এতটাও ছোট না যে আমার কথার মানে বুঝতে পারছ না। আমি খুব সহজ ভাবে বলেছি।

ফারিয়া পিছনে থাকা চেয়ারে বসে পড়ল। কাঁপা কাঁপা গলায় বলল
–জারিফ তুমি না আমার ফ্রেন্ড? তাহলে এসব কি বাজে কথা বলছ? আমাকে একা পেয়ে সুযোগ নিতে চাও? আমি তো তোমাকে ভালো ভেবেছিলাম। তুমি এমন ছেলে সেটা…।

–শাট আপ!

জারিফের ধমকে ফারিয়া তাঁর কথা শেষ করতে পারল না। জারিফ দ্রুত পায়ে এগিয়ে গিয়ে ফারিয়ার দিকে ঝুকে বলল
–ফ্রেন্ড আগে ছিলাম। এখন তুমি আমার বউ। সারাদিন না খেয়ে থেকে কবুল বলে বিয়ে করেছি। ভুলে গেছ? আর বউয়ের কাছে এসব কথা বলা যায়। আর ছেলে হিসেবে আমি যথেষ্ট ভালো সেটার সার্টিফিকেট তোমার বাবা মায়ের কাছ থেকে নিতে পারো। তারা ভালো করেই জানে বলেই তাদের এই নিয়ন্ত্রনহীন মেয়েকে আমার ঘাড়ে গছিয়ে দিয়েছে। আমার থেকে ভালো তো তোমাকে আর কেউ জানে না। বাড়ির লোকজনের কাছে তুমি তো একদম ভদ্র মেয়ে। কিন্তু বাইরে কি সেটা তো আমি ভালো করেই জানি।

ফারিয়া রেগে গেলো। জারিফ কে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিয়ে উঠে দাঁড়াল। বেশ জোরে বলল
–তোমার ঘাড়ে গছিয়ে দিয়েছে মানে?

জারিফ নিজের জামা কাপড় বের করতে করতে বলল
–এটাকে গছিয়ে দেয়াই বলে। যখন তুমি আমার বন্ধু ছিলে তখনও আমি তোমাকে এভাবে ভাবিনি। ইনফ্যাক্ট তোমার প্রতি আমার বিন্দু মাত্র ইন্টারেস্ট নেই। অথচ সেই তুমি আমার বউ। আমি তোমাকে শুধু আমার ফ্রেন্ড বলেই মেনে নিয়েছি। কিন্তু তোমার বাবার ষড়যন্ত্রে শেষ পর্যন্ত বিয়ে অব্দি গড়াল।

ফারিয়া রেগে দাতে দাত চেপে বলল
–এসবের মধ্যে আমার বাবাকে টানছ কেন? তোমার বাবাও তো কম যায় না। উনি নিজে গিয়ে আমার বাবাকে বলেছেন ভাই সাহেব আপনার মেয়েকে আমার ছেলের জন্য নিতে চাই।

–আমার বাবা নাহয় বলেছিল। কিন্তু তোমার বাবা কি বুঝে রাজি হয়ে গেলো? এরকম একটা হ্যান্ডসাম ছেলের সাথে তার মেয়ের বিয়েটা কোন দিক থেকে মানায়? এই বয়সে বুদ্ধি সুদ্ধি লোপ পেয়েছে মনে হয়।

ফারিয়া বড় বড় চোখে জারিফের কথা শুনছে। এতো বেশী রেগে গেছে যে তার কথা বলার ক্ষমতাও সে হারিয়ে ফেলেছে। জারিফ ওয়াশ রুমের দিকে এগিয়ে যেতে যেতে বলল
–এভাবে দাড়িয়ে থাকার দরকার নেই। ফ্রেশ হয়ে শুয়ে পড়। আর হ্যা তোমার প্রতি আমার কোন ইন্টারেস্ট নেই। তাই একদম নিশ্চিন্তে এই ঘরে থাকতে পারো। তোমার মতো মেয়েকে বন্ধু হিসেবেই মানা যায়। এর থেকে বেশী কিছু অসম্ভব।

শেষের কথা গুলো বেশ তাচ্ছিল্য করে বলেছে জারিফ। ফারিয়াকে কোথাও আঘাত করলো কথা গুলো। একটা মেয়ে হিসেবে তার জন্য এটা সত্যিই অপমান। বিয়ে তো হল কিন্তু এর পরিনতি কি?
#মেঘবদল
লেখক-এ রহমান
পর্ব ৩

ঝুম বৃষ্টির পর আকাশ গুমোট বেধে আছে। আবার যে কোন সময় শুরু হতে পারে বৃষ্টি। মৃন্ময়ী এখনও কাচের দেয়ালের দিকে তাকিয়ে আছে। বাইরের রাস্তায় পানি জমে আছে। তার মধ্য দিয়েই একটা দুইটা করে গাড়ি চলছে।
–ম্যাডাম আর কিছু খাবেন?

ঘাড় ফিরিয়ে ওয়েটার ছেলেটার দিকে তাকাল মৃন্ময়ী। হ্যাংলা পাতলা একটা ছেলে। অধির আগ্রহে অপেক্ষা করছে তার উত্তরের জন্য। সে শান্ত গলায় বলল
–এক কাপ কফি দিতে পারবে?

তার কথায় যে ছেলেটি বেশ অবাক হল সেটা মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে। কারন সে গত এক ঘণ্টায় তিন কাপ কফি খেয়ে ফেলেছে। এবারের টা দিলে চতুর্থ কাপ হবে। মৃন্ময়ী ছেলেটির অবাক হওয়ার কারন বুঝতে পেরেও খুব স্বাভাবিক ভাবেই বলল
–কফি দিতে পারলে দাও।

ছেলেটি মাথা নাড়িয়ে চলে গেলো। মৃন্ময়ী আবারো বাইরের দৃশ্য দেখতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। টেবিলে পড়ে থাকা ফোনটা কেঁপে উঠলো তীব্র শব্দে। ফোনের দিকে তাকিয়ে দেখল মিনা খালা ফোন করেছে। ফোনটা তুলতে মিনা অস্থির ভাবে বলে উঠলো
–মৃনু? ছেলেটা এসেছে? তুই কি এখনও হোটেলে বসে আছিস?

এতো বড় একটা রেস্টুরেন্টকে মিনা খালার হোটেল সম্বোধন মৃন্ময়ীর পছন্দ হল না। মিনা খালা মানুষটাই এমন। জায়গা না বুঝেই এমন কথা বলে ফেলেন যাতে মান অপমানের ব্যাপার হয়ে যায়। বেশ বিরক্ত হয়ে বলল
–এটাকে হোটেল বলেনা খালা রেস্টুরেন্ট বলে।

মিনা খালা মৃন্ময়ীর কথায় পাত্তা দিলেন না। বললেন
–অতো কিছু বুঝি না। যেখানে খাবার খায় আমরা সেটাকে হোটেল বলেই জেনে এসেছি। এখন তো কতো নাম বেরিয়েছে। আচ্ছা বল ছেলেটা কি এসেছে?

–না এখনও আসে নি।

মৃন্ময়ী হতাশ গলায় বলতেই মিনা খালা চেচিয়ে বললেন
–এখনও আসেনি তাহলে কখন আসবে? ছেলের কি কোন সেন্স নেই? একটা মেয়ে তার জন্য অপেক্ষা করছে অথচ সেই ছেলে এখনও আসে না। বিয়ের আগেই যদি এমন হয় তাহলে পরে কি হবে? আমি তোকে বলছি মৃনু তুই এই ছেলেকে না করে দে। তুই এখানে সুখি হবি না।

–খালা! বাইরে প্রচণ্ড বৃষ্টি হচ্ছিলো এতক্ষন। এই বৃষ্টিতে বাইরে বের হওয়া সম্ভব নয়। মাত্র বৃষ্টিটা কমলো। আর কিছুক্ষণ দেখি।

মৃন্ময়ীর শান্ত গলা শুনে মিনা বিরক্ত হয়ে বলল
–এটা কোন কথা না মৃনু। তুই বৃষ্টির আগে যেতে পারলে ছেলেটা কেন আসতে পারবে না? কি সব চাকরি করে বলে এতো ভাব? তুই চলে আয় মৃনু।

মৃন্ময়ী কিছু বলার আগেই ওয়েটার কফির কাপটা দিয়ে গেলো। মৃন্ময়ীকে চুপ করে থাকতে দেখে মিনা আবারো বলল
–তুই আমার কথা শোন মৃনু। তোর ভালো হবে।

একটা কাল রঙের টয়োটা গাড়ি রেস্টুরেন্টের সামনে দাঁড়াল। সেদিকে মনোযোগ দিয়ে তাকাল মৃন্ময়ী। একজন সুদর্শন পুরুষ সেই গাড়ি থেকে নামল। সোজা রেস্টুরেন্টের ভেতরে ঢুকে গেলো। এদিক সেদিক তাকাচ্ছে অস্থির ভাবে। মৃন্ময়ী মৃদু সরে বলল
–খালা আমি রাখছি। পরে কথা হবে।

বলেই ফোনটা কেটে দিলো। মনোযোগ দিয়ে সেদিকে তাকাতেই চোখ আটকে গেলো মৃন্ময়ীর। সেই পুরুষের শত শত রমণীর দৃষ্টি কেড়ে নেয়ার ক্ষমতা আছে। তীক্ষ্ণ সৌন্দর্যের ধারক তিনি। মুহূর্তেই তার মন ভার হয়ে গেলো। মনে হল এই মানুষটার সাথে তার বিয়ে ঠিক হয়ে থাকলে মানুষটার প্রতি চরম অন্যায় করা হবে। কারন সে শ্যাম বর্ণের এক রমণী। আর এই মানুষটা সাক্ষাৎ রাজপুত্র। লোকটাকে তার দিকে এগিয়ে আসতে দেখে মৃন্ময়ীর বুকের কাপন বেড়ে গেলো। হাত পাও কাঁপছে মৃদু। লোকটা এসে সামনে দাড়িয়েই জিজ্ঞেস করলো
–মৃন্ময়ী মজুমদার?

মৃন্ময়ী উঠে দাঁড়াল। অসাভাবিক ভাবে চোখের পাতা এদিক সেদিক ঘুরিয়ে মৃদু সরে বলল
–জি।

ঠোট এলিয়ে হেসে হাত বাড়িয়ে দিলো। মৃদু সরে বলল
–আমি নাহিদ। নাহিদ শাহরিয়ার।

হাত বাড়িয়ে দিতে অসস্তি হচ্ছে মৃন্ময়ীর। ভাবছে কি করবে। কিন্তু না বাড়িয়ে দিলেও বিষয়টা খারাপ দেখাবে। তাই ভীষণ অসস্তির মাঝেই হাত বাড়িয়ে দিলো। নাহিদ হাত ধরেই বুঝতে পারল সে কাঁপছে। তাই হাত ছেড়ে দিলো। অপ্রস্তুত হয়ে বলল
–সরি। আসলে অফিসিয়াল মিটিং এ এভাবে হাত মেলাতে হয় তো। তাই…।

–না না। ঠিক আছে।

নাহিদের কথা শেষ করার আগেই সে অতি ভদ্রভাবে উত্তর দিলো। নাহিদ হেসে বসতে ইশারা করলো। মৃন্ময়ী বসে পড়ল। নীরবে কেটে গেলো কিছু প্রহর। বাক্রুদ্ধ দুজনই। দুজনের জীবনেই এই পরিস্থিতি প্রথম। নাহিদ চোখ তুলে তাকাল। শ্যামবর্ণের মেয়েটি চোখ নামিয়ে বসে আছে। চেহারায় মিষ্টতা আছে তার। কিভাবে কথা শুরু করবে ভাবছে। ঠিক সেই সময় কফির কাপে চোখ পড়ল। কয়েক চুমুক হয়তো খেয়েছে। বাকিটা পুরোটাই পড়ে আছে। সেটার সুত্র ধরেই বলল
–কফি খাচ্ছিলেন বুঝি? ঠাণ্ডা হয়ে গেছে তো। আরেক কাপ দিতে বলি?

মৃন্ময়ী তাকাল। অস্থির ভাবে বলল
–না প্লিজ! আর খাব না।

আবার নিচের দিকে তাকাল। দুজনেই আবারো চুপ হয়ে গেলো। কয়েক মুহূর্ত কেটে যেতেই নাহিদ শান্ত সরে বলল
–আসলে আমি অফিসিয়াল মিটিং ছাড়া এভাবে মেয়েদের সাথে আগে কখনও কথা বলিনি। তাই একটু ইতস্তত বোধ হচ্ছে।

মৃন্ময়ী কোন উত্তর দিলো না। নাহিদ কিছুক্ষণ থেমে আবারো বলল
–এভাবে চুপ করে থাকলে কোন কথাই হবে না। আর বাসায় গিয়ে যখন জিজ্ঞেস করবে আমার মেয়ে পছন্দ হয়েছে কি না সেটার উত্তর দেয়া আমার জন্য কঠিন হয়ে পড়বে।

মৃন্ময়ী চোখ তুলে তাকাল। অগোছালো ভাবে বলল
–কঠিন হবে কেন? সত্যিটাই বলবেন। যা আপনার মনে চলছে।

নাহিদ ভ্রু কুচকে জিজ্ঞেস করলো
–কি চলছে আমার মনে?

মৃন্ময়ী ভীষণ অবাক ভঙ্গিতে বলল
–আমি কিভাবে বলবো আপনার মনে কি চলছে?

থেমে আবার বলল
–তবে আমি জতদুর আন্দাজ করতে পারছি পজিটিভ কিছু নয়।

নাহিদ মৃদু হাসল। শান্ত ভাবে বলল
–হয়তো আপনি ভাবছেন আপনাকে আমার পছন্দ হয়নি বলে কথা বলছি না। সেরকমটা কিন্তু নয়।

মৃন্ময়ী হেসে ফেললো। নাহিদের দিকে তাকিয়ে বলল
–আমি কিছুই ভাবছি না। আমার মনে হল তাই বললাম। বাকিটা আপনার মন জানে।

–আপনি মনের কথা জানতে চান না?

নাহিদের আবেগি কথা কানে লাগতেই অবাক চোখে তাকাল সে। মৃদু সরে বলল
–চাই।

নাহিদ মুখ ভরে হাসল। মৃন্ময়ীর দিকে তাকিয়ে বলল
–কি খাবেন?

মৃন্ময়ী মাথা নাড়াল। যার অর্থ সে কিছুই খেতে চায় না। নাহিদ তবুও ওয়েটারকে ডেকে কিছু খাবারের অর্ডার দিলো। ওয়েটার চলে যেতেই বলল
–আপনার কি এখন বিয়ে করার ইচ্ছা নেই?

মৃন্ময়ী চোখের পাতা পিটপিট করে তাকাল। নাহিদ আবারো বলল
–বাড়ি থেকে কি বিয়ের জন্য চাপ দিচ্ছে? আপনি কি মানসিক ভাবে প্রস্তুত না?

মৃন্ময়ী চোখ নামিয়েই বলল
–সেরকম কিছু না।

–তাহলে কি রকম?

সে নাহিদের কথার উত্তর ভাবতে লাগলো। এর মাঝেই ওয়েটার খাবার নিয়ে এলো। নাহিদ প্লেটে খাবার তুলে নিয়ে মৃন্ময়ীর দিকে এগিয়ে দিলো। বলল
–খান।

খাবারের গন্ধে গা গুলিয়ে এলো তার। এতো গুলো কফি খাওয়ার ফল এখন হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে। নাহিদ তার দিকেই তাকিয়ে ছিল। মৃন্ময়ী চোখ তুলে তাকাতেই নাহিদের চোখে চোখ পড়ল। সাথে সাথে নামিয়ে নিলো। নাহিদ বুঝতে পেরে বলল
–মিস মৃন্ময়ী। সব সম্পর্কের শুরুটা হয় বন্ধুত্ত থেকে। আমাদের মাঝে কোন সম্পর্ক হবে কিনা সেটা আমি জানি না। কিন্তু যদি হয়েই থাকে তাহলে সেটার শুরুটাও বন্ধুত্ত থেকে হবে। জিবনে আমরা কোন সম্পর্কে না জড়ালেও বন্ধুত্তের সম্পর্কটা কি অসম্ভব?

নাহিদের শেষের কথাটা অত্যন্ত ভরসা যোগ্য মনে হল মৃন্ময়ীর কাছে। দমিয়ে যাওয়া সাহস টা বেড়ে গেলো। হেসে ফেলে বলল
–সম্ভব।

———–
দুপুরের রোদ পড়ে যেতেই ঈশা বিছানা ছেড়ে নামল। এই মুহূর্তে এক কাপ চা হলে খুব ভালো হতো। রান্না ঘরে গিয়ে এক কাপ চা বানাল। চায়ের কাপ আর গল্পের বই হাতে নিয়ে ছাদে গেলো। বিকেলের হালকা রোদে বসে এক কাপ চায়ের সাথে গল্পের বই পড়বে। দ্রুত সিঁড়ি বেয়ে ছাদে উঠে গেলো। ছাদে উঠেই দেখল তার মেজ চাচি সায়রা বেগম শুকনো কাপড় ভাজ করছে। ঈশা তার কাছে গিয়ে দাঁড়াল। জিজ্ঞেস করলো
–চাচি কি করছ?

সায়রা কাপড় গুলো হাতে নিয়ে বলল
–আরে ঈশা। আমি তোর কাছে যাব ভাবছিলাম।

–কেন চাচি? কিছু বলবে?

ঈশার কৌতূহল দেখে তিনি পাশেই বসার একটা জায়গায় বসে পড়লেন। বেশ উদ্যমী কণ্ঠে বললেন
–জানিস আজ নাহিদ ঐ মেয়েটার সাথে দেখা করতে গেছে।

ঈশা অন্যমনস্ক হয়ে বলল
–কোন মেয়ে?

সায়রা বেগম বিরক্তিকর দৃষ্টিতে তাকাল। বলল
–যেই মেয়েটার সাথে ওর বিয়ের কথা চলছিল ঐ মেয়েটা।

ঠোট এলিয়ে হাসল ঈশা। বলল
–তাই নাকি? ভাইয়া কি বলল? পছন্দ হয়েছে?

–এখনও তো আসেনি। আসুক আগে তারপর শুনবো কি হল। তুই কিন্তু আমার সাথেই থাকবি। দুজন মিলেই জিজ্ঞেস করব।

ঈশা মাথা নেড়ে চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বলল
–মেয়েটার নাম কি চাচি?

–মৃন্ময়ী।

সায়রা আরও কিছুক্ষণ কথা বলে নিচে নেমে গেলো। সায়রা চলে যেতেই ঈশা এক পাশে বসে পড়ল। বই খুলে সেদিকেই পূর্ণ মনোযোগ দিলো। বই পড়ছে আর মাঝে মাঝে চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছে। সারা বিকেল বই পড়েই কেটে দিলো সে। সন্ধ্যে নামার আগে নিচে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। যা যা সাথে এনেছিল সবটা গুছিয়ে নিলো। ছাদের কার্নিশ ধরে শেষবার নিচে তাকাতেই দৃষ্টি থমকে গেলো। হৃদপিণ্ড চিনচিনে ব্যাথায় কাতর হয়ে উঠলো। ইভান রাস্তার এক পাশে দাড়িয়ে তনুর সাথে কথা বলছে। দুজনের মাঝে বেশ মধুর সম্পর্ক। প্রায় সময়েই তাদের এই হাস্যজ্জল কথোপকথনের দৃশ্য চোখে পড়ে ঈশার। ঠিক সেই সময় মনে হয় কলিজায় কেউ ধারাল ছুরি চালিয়ে দিচ্ছে। অজানা কষ্টে অস্থির হয়ে ওঠে ভেতর। তনুর কাছে শুনেছে ইভানের সাথে নাকি তার সম্পর্কটা অন্য রকম। বন্ধুত্তের চেয়েও বেশী। তার কথা বলার ধরন আর অর্থ বুঝতে ঈশার কষ্ট হয়নি। ইভান আর তনুর সম্পর্ক যে অনেকটা এগিয়ে গেছে সেটা তনুর ফোনে তাদের দুজনের ছবি দেখেও সে আন্দাজ করে নিয়েছে। পাশাপাশি দাড়িয়ে হাস্যজ্জল একটা সেলফি। যেটা দেখে যে কেউ বুঝে যাবে। চোখের কার্নিশ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়তেই ঈশা মুখ ঘুরিয়ে সিঁড়ি বেয়ে নেমে গেলো। সে দৃশ্য দেখার সাধ্য যে তার আর নেই।

চলবে……
চলবে……

(রিচেক করা হয়নি। ভুল ত্রুটি ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here