মেঘের উল্টোপিঠ পর্ব -০৮

#মেঘের_উল্টোপিঠ
#সাদিয়া_মেহরুজ_দোলা
[পর্ব-০৮]

পূর্বের ফোন স্ক্রিনে জ্বলজ্বল করছে আমার এবং আপুর একটা ছবি। ছবিটা বেশ পুরোনো! আমি কলেজে পড়াকালীন ছবি। আপু এবং আমি সাজেক ভ্যালিতে ট্যুর দেয়ার সময়কার ছবি এটা! এই ছবিটা পূর্বের কাছে? নিশ্চয়ই আপু দিয়েছে। আপু আর পূর্বের রিলেশন ছিলো ২,৩ বছর আগে। রিলেশনের সময়কাল নিতান্তই অতি স্বল্প! মাত্র ১ মাস তারা রিলেশনে ছিলেন।

সকল ভাবনা ঠেলে আমি এক চিন্তায় মগ্ন হয়ে পড়ি। পূর্ব আসলে দেখছেন কাকে ছবিতে?আমায় নাকি আপুকে? আপুকে দেখছেন না তো?হতেই পারে। তারা এককালে প্রেম নামক বন্ধনে আবদ্ধ ছিলো। আমাকে কেনো দেখবে? আমার সাথে তার বিয়েটা ছিলো অনাকাঙ্ক্ষিত! আমাকে সে পছন্দ করেন কিনা তা সম্পর্কেও অবগত নই আমি। হুট করে চোখের কার্নিশে পানি এসে জমলো! খারাপ লাগছে কেনো? চটপট দৃষ্টি আশপাশে দেই। তারই মাঝে পূর্ব ভরাট কন্ঠে বললেন,

‘ তুমি পড়ো! আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি। কোনো কিছুতে হেল্প লাগলে আমি এসে দেখিয়ে দিবো। ‘

নতজানু হয়ে নিম্ন কন্ঠে বললাম, ‘ জি আচ্ছা! ‘

ভাঙা স্বর! পূর্ব আঁড়চোখে আমার পানে দৃষ্টিপাত স্থাপন করলেন। নম্র কন্ঠে বললেন, ‘ আর ইউ ওকে?’

কন্ঠনালি দ্বারা জবাব না দিয়ে ইশারায় ‘ হ্যা ‘ বলি। পূর্ব এক পলক তাকিয়ে তার ফোনটা সোফায় রেখে দিয়ে উঠে দাঁড়ালেন। কাবার্ডের কাছে গিয়ে হাতে তুলে নিলেন শুভ্র রঙের টাওয়াল। তারপর তার যাত্রা শুরু হলো ওয়াশরুমের পথে। দরজা বন্ধ করতেই আমি চোখের কার্নিশে জমে থাকা অশ্রুজল মুছে ফেলে তার ফোনটা সন্তপর্ণে হাতে তুলে নেই। কৌতূহল বশত ফোন ওপেন করে লক খুলি। পূর্ব যখন প্রথম ফোন খুলেছিলেন তখন আঁড়চোখে পাসওয়ার্ড রপ্ত করে নিয়েছিলাম। অতঃপর ‘Gallery Lock ‘ এ্যাপ্সটাতে লগইন করেই পড়লাম বিপত্তিতে। এটার পাসওয়ার্ড আমার জানা নেই! তবুও চোখের সামনে যা ভেসে উঠেছিলো তাই দিয়ে দিলাম দু’বার! কাজ হলোনা! আর একবার বাকি। এটাতে বিফল হলে আমার ছবি উঠে যাবে অটোমেটিকলি। তখন নিশ্চিত পূর্ব জেনে যাবেন আমি তার ফোন ধরেছি। তার প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হবে নিশ্চিত! তখন কি জবাব দিবো?

শুষ্কো ঢোক গিলে মনে করার চেষ্টা করি পাসওয়ার্ড। ‘ স্নিগ্ধপরী ‘ বা ‘ স্নিগ্ধময়ী ‘ টাইপ পাসওয়ার্ড ছিলো। দু’টোই ট্রাই করা শেষ। কাজ হয়নি! এ্যালফাবেট এ গড়বড় হয়েছে বোধহয়। পরিশেষে ফোনটা রেখেই দিতে হলো! বই কোল থেকে কাঁচের টেবিলেটার ওপর শব্দ করে রেখে দিয়ে উঠে দাঁড়ালাম! অস্থির অস্থির লাগছে খুব। হেঁটে সামনে যেতেই পায়ের তলায় তীব্র ব্যাথা অনুভব হলো। মাথা নিচু করে তাকাতেই খেয়াল হলো রক্ত! পাশেই কাঁচের কিছু সুক্ষ্ম কণা পড়ে রয়েছে। এই কাচ দ্বারা যে ‘ পা ‘ আমার ক্ষতবিক্ষত হয়েছে তা বুঝতে আর বেগ পেতে হলো না।

ফ্লোরে ধীরেসুস্থে বসে ক্ষতস্থান হতে কাঁচের টুকরো বের করার সাহস হলোনা। কাচ বের না করলে ড্রেসিং করাও সম্ভব না! ব্যাথায় দাঁত মুখ খিঁচে বন্ধ করতেই পূর্বের সেই রাশভারী কন্ঠস্বর কর্ণপাত হলো। তিনি বললেন,

‘ ফ্লোরে বসে কি করছো?’

চোখজোড়া চটপট খুলে নেই। ওয়াশরুমের দিকে পিঠ দিয়ে বসে তাই বোধহয় তিনি আমার রক্তাক্ত পা দেখতে পারছেন না। খানিকক্ষণ বাদে পদধ্বনির শব্দে স্পষ্টত বুঝতে পারলাম পূর্ব আমারই দিকে আসছেন। মাথা তুলে তাকাতেই দৃশ্যমান হলো তার নিস্তব্ধ চাহনি! চমকে পায়ের দিকে তাকিয়ে আছেন, তার এতোটা চমকে যাওয়াতে ভড়কে গেলাম। ধীর কন্ঠে কোনোরকম ব্যাথা দমন করে বলি,

‘ ফাস্ট- এইড বক্সটা একটু দিবেন প্লিজ?’

পূর্ব নড়লেন না! উত্তর দিলেন না। এমনকি কোনো প্রতিক্রিয়াও দেখালেন না। তার বর্তমান অবস্থা সে প্রাণ ছাড়া কেও! বর্তমানে তার বিহেভে বড্ড বিরক্ত হলাম। ব্যাথাতুর কন্ঠে ফের বললাম,

‘ আপনি কি আমার কথা শুনতে পেরেছেন? ‘

পূর্ব চটজলদি আমার পাশে বসলেন। আঘাতপ্রাপ্ত পা টেনে নিয়ে তার পায়ের ওপর রাখলেন। ক্ষত স্থানটা একটু বেশিই। কাচটা আকারে বড় ছিলো। পূর্ব তা দেখে ব্যাকুল হয়ে বললেন,

‘ ব্যাথা কি করে পেলে? চোখ কি তোমার মাথার ওপরে? দেখে চলতে পারো না তুমি? রুমে কাচ-ই বা আসলো কি করে? ‘

তার কথার উত্তর দেয়া হলো না। ব্যাথায় চোখের কার্নিশে অশ্রুরা এসে ভীড় করেছে। আর এই লোক এ মূর্হতে আমায় এসব জিজ্ঞেস করছে? পূর্ব আমার পা সন্তপর্ণে ধীরে মাটিতে রেখে কাবার্ড থেকে ফাস্ট এইড বক্স আনলেন। কাঁচের টুকরো দক্ষতার সাথে বের করায় অতোটা ব্যাথা অনুভূত হলোনা। শুভ্র ব্যান্ডেজ দ্বারা আঘাতপ্রাপ্ত স্থান মুড়িয়ে দেন। তার চেহারায় ফুটন্ত অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে আঘাত আমি নই তিনি পেয়েছেন! তার কাজ শেষ হতেই তিনি গলার কন্ঠস্বর উঁচু করে তার মা, ভাবীসহ আরো কয়েকজন কে ডাকলেন।

ক্ষনিক বাদে তাদের আগমন ঘটে রুমে। মামনি আমার পায়ে ব্যান্ডেজ দেখে এগিয়ে আসতে নিলেই পূর্ব হাত উঁচু করে রুষ্ট কন্ঠে বললেন,

‘ এখন দরদ দেখাতে হবেনা! রুমে কাচঁ ফেলে রেখেছিলো কে? আমি বারবার করে বলে দিয়েছি যাতে কোনোরূপ ত্রুটি দ্বারা ওর ক্ষতি না হয়। কথাটা রাখলেনা! আমাকে কষ্ট দিতে তোমার এতো ভালো লাগে কেনো মা?’

মামনি আহত দৃষ্টিতে তাকালেন। আমি বিষ্ময়কর দৃষ্টিতে তাকাই পূর্বের পানে। মামনির সাথে এভাবে কথা বলছেন কেনো তিনি? এতো রুষ্ট কন্ঠে! মামনি কিছু বলতে তার আগেই পিছন হতে একটা মেয়ে এগিয়ে আসলো। বেশ-ভুষায় মনে হলো মেয়েটা এ বাড়িতে কাজ করে। কাচুমাচু করে মাথা নুইয়ে মেয়েটি বলল,

‘ আমারে মাফ কইরা দেন ভাই। বউমনি আইবো তাই আপনে কইছিলেন পুরা বাড়ির ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ময়লা, ধুলবালি পরিস্কার করতে। বউমনির ধুলাবালিতে হাঁচি আহে তাই। তহনই এই রুম পরিস্কার করার সময় ময়লার ব্যাগ থেকা মনেহয় কাঁচের টুকরা পড়ছে। আমি খ্যাল (খেয়াল) করিনাই। মাফ কইরা দেন ভাই! ‘

পূর্ব রাগে হাত মুষ্টিবদ্ধ করলেন। নিজেকে ধাতস্থ করে মামনির পানে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললেন,

‘ কি টাইপ লোকদের কাজে নিয়োগ করো? দেখে- শুনে তো করা উচিত না আম্মু? ক্ষতিটা তো দিনশেষে আমাদেরই হয়। ‘

পূর্ব আর কিন্তু বললেন না। নিঃশব্দে সবার সামনেই এক অদ্ভুত কাজ করে বসলেন তিনি। হুট করে কোলে তুলে নিয়ে আমায় বেডে আধশোয়া হয়ে বসিয়ে দিলেন। পুরো সময় আমি ছিলাম নির্বাক! এবার সোফার কাছে গিয়ে বই এনে আমার হাত বই ধরিয়ে দিয়ে নম্র কন্ঠে বললেন,

‘ এভাবেই বসে পড়ো। নিচে নামবেনা একদম। দরকার হলে আমায় বলবে! ‘

আমি মাথা নেড়ে সম্মতি জানাই। লজ্জায় কথা বলার শক্তি লোপ পেয়েছে! মা, ভাবীর সামনে এভাবে কোলে তুলে নিলো? ইশশ! কি লজ্জাকর মূর্হত! ক্ষনেই রুমে শূন্যতা বিরাজমান হয়! পূর্ব ফোন নিয়ে বেলকনিতে কথা বলছেন।

_______________________

রাতে মামনি এসে হাসিমুখেই আমায় নিজ হাতে খাইয়ে দিয়ে গিয়েছেন। ভাবী এসে বেশ কয়েকবার খোঁজ – খবর নিয়ে গিয়েছেন। সেই কাজের মেয়েটা, তাহিরা নাম! সেও বারংবার এসে আমায় উঁকি, ঝুঁকি মেরে দেখে গিয়েছেন। পূর্ব বাহিরে গিয়েছেন। যাওয়ার আগে বাড়ির সবাইকে বলে গিয়েছেন আমায় দেখতে! রুমের দরজার বাহিরে দাঁড়িয়ে নিচু কন্ঠে পূর্ব কথাটি সবাইকে উদ্দেশ্য করে বললে আমি তা শুনতে পাই যতই নিচু কন্ঠে হোক! পূর্বের এমন নিভৃতে আমার খেয়াল রাখার বিষয়টি চমৎকার লাগে।

পূর্ব কোথাও উধাও হয়েছে জানা নেই। তবে যাওয়ার আগে আমায় সে পাইপাই করে বলে গিয়েছে যেনো ‘ বেড থেকে আমি না নামি! ‘ তার কথামতো তাই করা হয়েছে। অমান্য করার সাহস হয়নি।

এখন রাত ১২ টা ছুঁই ছুঁই!
অবিন্যস্ত রূপে রুমের পর্দাটা উড়ছে। বাহিরে নিকষ কালো আঁধার বিরাজমান। হিম বায়ু এসে বারংবার চুলগুলো এলোমেলো করে দিয়ে যাচ্ছে। নিঃশব্দে পড়াকালীন পদধ্বনির শব্দ কর্ণপাত হয়! খানিক বাদে সামনে দৃষ্টিপাত মেলতেই দেখা মিললো পূর্বের মুখশ্রীর! নীল রঙের টিশার্ট ঘামে ভিজে তার সুঠাম দেহের সাথে মিশে আছে। তাকে দেখা মাত্র আমি বলি,

‘ আপনি কোথায় ছিলেন?’

পূর্ব রুমে প্রবেশ করে তার ঘন কুচকুচে কালো চুলে হাত গলিয়ে বললেন,

‘ হসপিটালে! ইমার্জেন্সি এসেছিলো। ‘

প্রতুত্তরে ‘ অহ! ‘ বলে চুপ হয়ে যাই। পূর্ব ওয়াশরুম ঢুকে আরেকদফা সাওয়ার নিয়ে এসে ক্ষ্যান্ত হয়ে বসলো আমার পায়ের কাছটায়। হাত এগিয়ে ক্ষত স্থান দেখে বললেন,

‘ ব্যাথা আছে? ‘

‘ উঁহু! ‘

‘ রাতে খেয়েছো?’

আমি তপ্তশ্বাস ফেলে বলি, ‘ জি। মামনি খাইয়ে দিয়ে গেছেন। ‘

পূর্ব এবার রাশভারী কন্ঠে বললেন,

‘ অনেক পড়েছো। আজ আপাতত আর পড়ার দরকার নেই। ঘুমিয়ে পড়ো! ‘

আমি ইতস্তত বোধ করে বলি, ‘ কোথাও ঘুমাবো?’

‘ কেনো এখানেই। বেডে! ‘

আমি চট করে বলি, ‘ তাহলে আপনি কোথায় ঘুমাবেন?’

পূর্ব কপালে সুক্ষ্ম ভাজ ফেলে বললেন, ‘ তোমার পাশে। ‘

পূর্বের কথার বিপরীতে আর কিছু বললাম না। তবে অস্বস্তি হচ্ছে! তার সাথে এক বেডে ঘুমাতে হবে ভাবতেই লোমকূপ দাঁড়িয়ে যাচ্ছে।হুট করে বিয়েটা মস্তিষ্ক এখনো হজম করতে পারেনি। বই হাত হতে রেখে দিয়ে শুয়ে পড়তেই পূর্ব উঠে গিয়ে লাইট অফ করে দিলেন। সেকেন্ড খানিক পর তিনি আমার পাশে এসে বসে আমাদের দু’জনের মাঝে কুশন রেখে শীতল কন্ঠে বললেন,

‘ এবার আর অস্বস্তি নেই তো? ‘

আমি চমকে বললাম, ‘ আপনি বুঝলেন কি করে?’

পূর্ব জবাব দিলেন না। টানটান হয়ে একহাত তার মাথার নিচে দিয়ে নিঃশব্দে শুয়ে পড়লেন! আমি কিছুক্ষণ তার পানে তাকিয়ে থেকে চোখজোড়া বন্ধ করে নেই। পূর্বের প্রতি শ্রদ্ধাটা দিনদিন বাড়ছে।

_________________________

হলদেটে রৌদ্দুরের আমাগোনা রুম জুড়ে! পূর্বের উঁচু কন্ঠ শুনে হকচকিয়ে উঠে বসি। ঘুমুঘুমু চোখে চটজলদি বেড থেকে নেমে করিডরে এসে নিচে দৃষ্টি দিতেই চোখ আমার ছানাবড়া! দ্রুত সিঁড়ি দিয়ে নামতে গিয়ে পায়ে পুনরায় আঘাত পেয়ে পা ধরে ফ্লোরে বসে পড়লাম! অতঃপর দৃশ্যমান হলো শুভ্র ফ্লোরে ফের রক্তের আনাগোনা। কিন্তু সেদিকে খেয়াল নেই আমার। বিষ্ফোরিত চাহনি নিক্ষেপ করে সামনে আমার দৃষ্টিপাত!

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here