মেঘের পরে মেঘ-১০

মেঘের পরে মেঘ -১০

আজকাল শায়েরীর দিনগুলো কাটে নাবিলের অপেক্ষায়।দুজন মানুষের সংসারে কাজ তেমন নেই।একটানা কাজ করলে বেলা এগারোটা বারোটার দিকেই সব কাজ শেষ হয়ে যায়।এরপর অখণ্ড অবসর।কিছুক্ষন বই পড়ে তো কিছুক্ষন গাছের পরিচর্যা করে।
এতে কি আর সময় কাটে?
নাবিল বাসায় থাকলে আড্ডা খুনসুটিতে মেতে থাকে দুজন।সময় কিভাবে পার হয়ে যায় টেরই পাওয়া যায় না যেন।একমাত্র ছুটির দিন ছাড়া নাবিলকে পাওয়াও কস্টকর।একাকিত্ব ভীষণ ভাবে পোড়ায় ওকে।
বাড়িতে একটা ল্যান্ডলাইন কানেকশন আছে। মাঝে মাঝে কথা হয় নাবিলের সাথে। তাও অল্প সময়ের জন্য। ভালো লাগে না শায়েরীর।
নাবিল ঠিকই বলে,এখন একটা বাবুর দরকার।তাহলেই শায়েরীর সময় কাটানো নিয়ে কোন সমস্যাই থাকবে না।
শায়েরীও চায় খুব করে।কিন্তু তার তো দেখাই নেই।

সব কাজ শেষ করে একাকী বারান্দায় বসে এসবই ভাবছিল শায়েরী। হঠাৎই মনে হলো আজ সন্ধ্যায় চারতলায় দাওয়াত আছে।চারতলার ভাবি এসে গতকাল খুব করে বলে গেছে যাতে নাবিলকে নিয়ে ও যায়।আজ ওনাদের দশম বিবাহ বার্ষিকী।খুব হাসি খুশি দম্পতি।
শায়েরী রাতেই নাবিলকে বলে রেখেছিল।নাবিল অফিসে যাওয়ার সময় টাকা দিয়ে শায়েরী কে বলে গেছে একটা গিফট কিনে আনতে।

মনে হতেই চটজলদি ও তৈরি হয়ে বেরিয়ে পরলো নিউমার্কেটের উদ্দেশ্যে।

বেশকিছু সময় ঘোরাঘুরি করে একটা শাড়ি পছন্দ করলো শায়েরী।বেগুনি রঙের জর্জেট শাড়ি।দুদিকের পাড়জুড়ে পাথর আর স্প্রিংয়ের কাজ করা।জমিনেও আছে তার ছোয়া।দোকানী দামটা আকাশ ছোঁয়া চাইলেও দরাদরি করে দামটা নিজের সামর্থ্যের মধ্যে নিয়ে এসেছে শায়েরী।
শাড়ির প্যাকেট নিয়ে খুশি মনে বাড়ি ফিরছিলো শায়েরী।পথে নাবিলের মতো কাউকে মনে হলো যে কিনা তার স্ত্রী বাচ্চা কে নিয়ে কেনাকাটা করতে বেরিয়েছে।
কিন্তু নাবিল কিভাবে হবে?নাবিল যদি কাউকে নিয়ে বের হয় বা ঘোরাঘুরি করার থাকে তাহলে তো ও অবশ্যই শায়েরীকে বলে।তাছাড়া নাবিল তো এখন অফিসে।শায়েরী রিকশা নিয়ে সেই রিকশার পিছু কিছুসময় ছুটে পরবর্তীতে মনের ভুল ভেবে চলে আসলো।

______

“আমি বলেছিলাম না ভয়ের কিছু নেই?শুধু শুধু চিৎকার করে করে কাঁদলে।দেখ তোমার বাচ্চা একদম ঠিক আছে।”
হেসে হেসেই তানজু কে বললো নাবিল।

উত্তরে তানজু একটু হাসলো।আসলে বিপদে পরলে হুশ থাকে না।অজানা আশংকায় মন দুলে ওঠে। বাচ্চা টা ছাড়া জীবনে এগিয়ে যাওয়ার মতো কোন পাথেয় নেই ওর।ইদানিং নাবিলকে খুব আপন মনে হয়।নাবিল ওর বাচ্চা টাকে খুব আদর করে। মনে হয় যেন এটা নাবিলেরই বাচ্চা।
হ্যাঁ নাবিলেরই হতে পারতো।যদি ও তানজুর ডাকে সাড়া দিতো।কতোটা দিন ও নাবিলের জন্য অপেক্ষা করেছে আর ভেবেছে, এই বুঝি নাবিল ওর ডাকে সাড়া দিলো।কিন্তু না দেয় নি।ও একজনের জন্য পাগল ছিলো শায়েরী।ওর বউ।
শায়েরী কে তো দেখেছে তানজু।তেমন কোন সুন্দরী নয়।তার চেয়ে তানজুই এগিয়ে।ঝকঝকে ফর্সা রং।টিকালো নাক।আর শায়েরী?রংটা যেন খুব ফর্সা হয়েও হয়নি।একটা চাপা ভাব আছে।তার জন্যই কিনা পাগল নাবিল।
নাবিল জানেনা ওর জন্য তানজু এখনো কতোটা পাগল।এমন না যে তানজুর বিপদে এগিয়ে আসার মানুষ নেই।আছে।কিন্তু ও ইচ্ছে করেই কাউকে ডাকে না।নাবিলকে ডাকে।নাবিলও ওকে অসহায় ভেবে দৌড়ে আসে ওর সাহায্য করার জন্য।

পাড়ার দুয়েকটা পাতি গুন্ডা ওর পিছনে লেগেছিলো।তাদেরকেও দমিয়েছে একটা কথা বলে।নাবিল ওর হাসবেন্ড। জাহিদের মৃত্যুর পরই ওকে বিয়ে করেছে তানজু।কিন্তু নাবিলের পরিবার এখনো জানেনা।অনেক বড়লোক ওরা।এখন জানলে সমস্যা হবে তাই নাবিল এখানে থাকে না।মাঝে মাঝে আসে। খুব শীঘ্রই ওরা এখান থেকে চলে যাবে।
এরপর আর ওকে বিরক্ত করেনি ওরা।তানজুও নিঃশ্বাস ফেলে বেঁচেছে।এসব কিছুই হয়েছে নাবিলের অজান্তে। নাবিল যাতে জানতে না পারে সে চেষ্টাই করে যাচ্ছে।
কিন্তু একটা আশা আবারো মনে উঁকি দিয়েছে। কোনভাবে যদি নাবিলকে নিজের জীবনে আনতে পারে।এ দুনিয়ায় কিছুই তো অসম্ভব নয়।এরজন্য হয়তো একটু কাঠখড় পোড়াতে হবে।কিন্তু কাজ টা করতে হবে খুব সুকৌশলে। এমনভাবে নাবিলকে নিজের দিকে টানতে হবে যাতে করে নাবিল ওর কোন দোষ খুঁজে না পায়।নিজের বাচ্চা টাকে এ কাজের বড় হাতিয়ার হিসেবে নিয়েছে তানজু।নাবিল ওর বাচ্চা টাকে খুব পছন্দ করে।সেই দুর্বলতাকে কাজে লাগাতে চাইছে। কতটুকু সম্ভব হবে বলা যায় না।
এবারও না নাবিল হাত ফসকে বেরিয়ে যায়?
আগে যখন তখন ডাকলেই পাওয়া যেতো ওকে।এখন বাড়িতে আসতে চায় না।দুরে থেকেই যা করার করে দেয়।

“কোথায় হারিয়ে গেলে?”
চোখের সামনে তুড়ি মেরে জিজ্ঞেস করলো নাবিল।
আর তাতেই ভাবনার জগত থেকে এ দুনিয়ায় ফিরে এলো তানজু।হাসিমুখে বললো,

“কিছু না।তুমি ওকে নিয়ে বাড়ি চলো এখন।রান্না করেছি খেয়ে যাও।”

“না।আজ হবে না।শায়েরীর সাথে দাওয়াতে যাবো আজ। ওকে বলেছিলাম বিকেলেই বাসায় চলে যাবো।কিন্তু দেখো সন্ধ্যা হয়ে গেলো।”
চিন্তিত কিন্তু হাসিমুখে বললো নাবিল।

“ঠিক আছে। তাহলে আর আটকাবো না।তুমি যাও।কাল না হয় একবার এসে বাবুকে দেখে যেও।”

“অবশ্যই আসবো।আর চেষ্টাও করবো আসার।শায়েরীও আসতে চেয়েছিলো তোমাকে দেখতে।দেখি,কাল অফিসে যাওয়ার পথে ওকে নামিয়ে দিয়ে যাবো তোমার এখানে।”

শায়েরীর কথা শুনে মোটেও খুশি হলো না তানজু।তবু মুখে বললো,

“হ্যাঁ,দিয়ে যেও।আর তুমিও এসো অফিস শেষে। ”

“আসবো।”

________

নিজের ঘরে ফিরতে নাবিলের প্রায় আটটা বেজে যায়।শায়েরীকে নিয়ে ভীষণ চিন্তায় ছিলো।মেয়েটা বোধহয় রেগে থাকবে এমনটাই ভেবেছিল নাবিল।কিন্তু না।শায়েরী দরজা খুলে ওকে দেখে হাসিমুখেই ওকে তৈরি হতে বলেছে।নিজেও মোটামুটি তৈরি।

নাবিল দ্রুত ওয়াশরুমে ডুকলো ফ্রেশ হতে।বেরিয়েও আসলো তাড়াতাড়ি।খাটের উপর রাখা পায়জামা পাঞ্জাবী পরতে পরতে শায়েরীর দিকে তাকালো।

“তুমি কি আজ কারো সাথে কোথাও গিয়েছিলে?”
নিজের চুলে চিরুনি বুলাতে বুলাতে জিজ্ঞেস করলো শায়েরী।

“না।”
তৎক্ষনাৎ উত্তর নাবিলের।যদিও ও এই কথাটা বলতে চায়নি কিন্তু কেমন করে যেন বেরিয়ে গেলো।

“ও।জানো আজ যখন মার্কেট থেকে ফিরছিলাম তখন মনে হলো তোমার মতো একজন তা বৌ বাচ্চা নিয়ে এসেছে। ”

“তাই না কি?তো তাদের ডাকতে?”

“পিছু নিয়েছিলাম তো।পরে মনে হলো দুর কি ভাবছি এসব।তুমি তো অফিসে। ”

“তারপর কি করলে? চলে এলে?”

“হ্যাঁ।”

“কোথায় গিয়েছিলে আজ?”

“নিউমার্কেট। ”
বলেই নিজের চুল গুলোকে খোঁপা করতে থাকলো শায়েরী।
নাবিলের চাপা দীর্ঘশ্বাস কানে এলো না ওর।
আসলে ওটা নাবিলই ছিলো।তানজুর ছেলে টাকে ডাক্তার দেখিয়ে নিয়ে গিয়েছিলো কিছু কাপড় কিনে দেয়ার জন্য। কথাটা কি বলে দেবে শায়েরীকে?না থাক।পরে বলা যাবে।

শায়েরীর খোঁপা করা শেষ হলে ওকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে ঘাড়ে চুমু দিলো নাবিল।কানের কাছে মুখ নিয়ে আস্তে আস্তে বললো,

“আমি তোমাকে খুব ভালোবাসি শায়েরী।কখনো কোন কারনে আমাকে ছেড়ে যেও না।”

শায়েরী অবাক হলো।
“এসব কি বলছো?ছেড়ে যাবো কেন?”

“এমনি।বলো না?”

নাবিলের গলা দুহাতে পেঁচিয়ে ধরলো শায়েরী।নাকে নাক ঘষে দিয়ে ঠোঁট ছোঁয়ালো গালে।তারপর গাঁঢ় গলায় বললো,
“কখনো যাবো না।”

চলবে……

মুনিরা মেহজাবিন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here