মেঘের পরে মেঘ-১৩

মেঘের পরে মেঘ -১৩

“ইচ্ছে করে বুকের ভেতর লুকিয়ে রাখি তারে,”

এন্ড্রু কিশোরের গাওয়া একটি বিখ্যাত গানের এই অন্তরা শুনে একটু আনমনা হলো রুপসা।গত কয়েকদিন যাবত প্রায় প্রতিদিনই এ সময়ে একটা ছেলে
বেশ দরাজ গলায় গান করে। প্রায় প্রতিটি গানই রোমান্টিক জনরার।যেন কাউকে উদ্দেশ্য করে গাইছে মনের সবটুকু দরদ দিয়ে।কাকে উদ্দেশ্য করে এই গান গায় ছেলেটা?নিশ্চয়ই কোন মেয়ে।এ বয়সের ছেলেরা একটু আধটু মেয়েদের জন্য এমন গান করেই থাকে।যদিও রুপসা এখনো ছেলেটাকে দেখেই নি।তার বয়স জানার ও কোন কথা না।তবু কেনো যেন মনে হয় ছেলেটার বয়স বেশি না।

এসময় টায় রুপসা মুলত গল্পের বই পড়ে না হয় ঘুমিয়ে থাকে।গত কয়েকদিন যাবত বই পড়ছে।গত সপ্তাহে কলেজ থেকে আসার সময় মনিকার কাছ থেকে হুমায়ুন আহমেদ এর কয়েকটা বই এনেছে।সব কয়টা বই নাকি সেই লেবেলের ভালো।যদিও কথাটার বক্তা ও নয়।মনিকাই বলেছে।সব কয়েকটা বই ওর ভীষণ প্রিয়।
রুপসার মা এসব নোবেল পড়া একদম পছন্দ করেন না।তাই লুকিয়েই পড়তে হয়।
এসময় রুপসার মা শায়েরী বাড়িতে থাকেন না।ওনি স্থানীয় একটা নামকরা স্কুলের হেডমিস্ট্রেস। ওনার স্কুল ছুটি হয় চারটায়।এরপর যদি কোন মিটিং থাকে তবে বাড়ি ফিরতে আরো দেরি হয়।
আর রুপসার কলেজ ছুটি হয় একটা কি দেড় টায়।বাড়িতে এসে নাওয়া খাওয়া শেষ করতে করতেই আড়াইটা তিনটা বেজে যায়।এরপর একটু খানির অবসর নিজের জন্য। বই পড়ার জন্য তাই এ সময়টাকেই বেছে নিয়েছে ও।
কিন্তু পড়া আগাচ্ছে না একদমই। যখনি বই নিয়ে বসে
ছেলেটার গানের গলা ভেসে আসে। খুব সুন্দর করে গায় সে।আর না চাইতেও রুপসা পুরোটা সময় মনোযোগ দিয়ে শোনে।গান শেষ হলেও তার রেশ রয়ে যায় ওর মনে।
আজও তার ব্যতিক্রম হলো না।রুপসারা ছাদের এক কোনের দুটো রুম নিয়ে ভাড়া থাকে।অন্যপাশটা খালি।বারান্দায় উঁকি দিয়ে ও দেখার চেষ্টা করলো ছেলেটাকে।কিন্তু পারলো না। রুপসার একবার মনে হলো যায়, গিয়ে দেখে আসে কে ছেলেটা।পরক্ষনেই সেই চিন্তা বাদ দেয়। না, থাক কি দরকার।
গান শুনছে সেই ভালো,গায়ককে দেখার কোন দরকার নেই।পরে যদি মা জানতে পারে, তবে খুব বকবে।
মনটাকে বকে দিয়ে জোর করেই বইয়ে মনোযোগ দিলো রুপসা।
কিন্তু বারে বারেই আনমনা হয়ে যেতে লাগলো।

________

অফিসে বসে বিগত বছরের রেজাল্ট শিট দেখছিলো শায়েরী।ওর স্কুলের রেজাল্ট যথেষ্ট ভালো। শায়েরী হেড হিসেবে জয়েন করার পর ও বিশেষ কিছু নিয়ম চালু করেছে যা আগে ছিলো না।স্কুলের শিক্ষকদের সাথেও ওর সুসম্পর্ক। যে কারো কাছ থেকেই যে কোন ধরনের সাহায্য পেয়ে থাকে শায়েরী।
অথচ একটা সময় কতো কস্ট করেছে।বিশেষ করে যখন রুপসা পেটে ছিলো।কি ভীষণ ভয়াবহ সেই দিন গুলো।যখনি মনে পড়ে নিজের অজান্তেই দীর্ঘশ্বাস বের হয়ে আসে।
ফাইল থেকে মাথা উঠিয়ে সামনে রাখা ফটোফ্রেম টা হাতে নিলো।রুপসার ছবি রাখা তাতে।হাসোজ্জল মুখ।চুল গুলো একপাশে ছড়িয়ে আছে। একদম সিল্কি।ওর বাবার চুল পেয়েছে ও।অবশ্য রুপসার পুরোটা জুড়েই নাবিল।
নাবিলকে ছেড়ে যতো দুরেই আসুক না কেন নাবিল যেন মেয়েকে দিয়েই ওর পাশে রয়ে গেছে।
মাঝে মাঝেই ওর কথা মনে হয়।কেমন আছে নাবিল?নিশ্চয়ই অনেক ভালো। ভালো থাকবে বা নাই কেন?
ভালো থাকার জন্যই শায়েরীকে ছেড়ে গেছে।
বিশ্বাসঘাতক একটা। একটা মানুষ এতো নিখুঁত অভিনয় করতে পারে তা ওকে না দেখলে জানাই হতো না শায়েরীর।
এখন ওর পৃথিবী জুড়ে শুধু রুপসার বসবাস।মা মেয়ে বেশ ভালো আছে।নিজে যে ভুল করেছে তা নিজের মেয়ে কে কখনো করতে দেবে না শায়েরী।প্রেম তো দুর নিজের পায়ে না দাঁড়ানো পর্যন্ত বিয়ের কথাও ভাববে মা।রুপসা কে নিয়ে কতো আশা শায়েরীর।ও কি তা বুঝবে না?অবশ্যই বুঝবে।
শায়েরী ছোট চুমু একে দিলো রুপসার ছবিতে।
আজ ফিরতে দেরি হবে।কি করছে মেয়ে টা?কে জানে?

_______

আকাশ জুড়ে মেঘ করেছে।খুব জোর বাতাসও বইছে।যে কোন সময় বৃষ্টি নামবে।বই পড়তে পড়তে কখন দুচোখ বুঁজে এসেছিলো তা বলতেই পারবে না রুপসা।বাতাসের তোড়ে জানালার পর্দা উড়ে এসে বারবার ওর মুখে পরছিলো।আর তাতেই ঘুম ভেঙে যায় ওর।বাইরের পুরো পরিস্থিতি বুঝতে ওর কিছু টা সময় লাগলো।তারপরই উঠে এক দৌড় দিলো ছাদের উদ্দেশ্যে।সেখানে মাসকলাই ডাল দিয়ে বানানো কুমড়ো বড়ি শুকাতে দিয়ে গেছে ওর মা।সকালে ঝলমলে রোদে শুকোতে দিয়ে রুপসাকে বলে গিয়েছিলো তা ঘরে এনে রাখতে।বিশেষ করে বৃষ্টির সময়।বৃষ্টির পানি বড়ি গুলোর উপর পরলে একদমই নস্ট হয়ে যাবে।
রুপসা বড়ি রাখা কাগজ টাকে নিয়ে খুব সাবধানে হেঁটে আসতে লাগলো।
কিন্তু হটাৎই বাঁধা পেলো। সামনে কেউ একজন এসে দাঁড়িয়েছে।বেশ লম্বা এতটুকুই বুঝতে পারলো রুপসা।
উপরে না তাকিয়ে ও চলে যেতে চাইলো।কিন্তু এদিকে হলো আরেক বিপত্তি। ও যেদিকে যায় লোকটাও সেদিক যায়।বিরক্ত হয়ে রুপসা তাকালো উপর দিয়ে।
এক জোড়া গভীর হাসি হাসি চোখ ওর দিকেই দৃষ্টিপাত করে আছে।ঠোঁটেও হাসির রেখা।
রুপসার রাগ হলো ভীষণ। যে কোন সময় বৃষ্টি নামবে আর এই লোক কি না বাঁদরামো করছে।

“কি সমস্যা? এমন করছেন কেনো?”

“কেমন করছি?”
মুখে হাসি লেগেই আছে।

“কেমন করছেন মানে কি?আমার পথ আগলে দাঁড়িয়ে আছেন কেনো?সরুন আমি যাব।”

“পথ আগলালাম কোথায়? আমি তো আপনাকে একটু৷ হেল্প করতে চাইছি।আপনার কাগজটা একদিকে ঝুঁকে আছে। যে কোন সময় ভেতরের সব কিছু পরে যেতে পারে।আসুন আমি একদিকে ধরি,আপনি অন্য দিক টা ধরুন।তাহলেই আর কোন সমস্যা হবে না।”

“লাগবে না।”

বলতে বলতেই বৃষ্টির ফোঁটা পরতে শুরু করলো।রুপসা আৎকে উঠলো।ও প্রায় চিৎকার উঠলো।

“আরে সরুন সরুন।সব ভিজে যাবে।”

ঘটনার গুরুত্ব বুঝে একপাশে সরে গেলো লোকটা।
রুপসা প্রায় দৌড়ে ঘরে ঢুকে কাগজটা একপাশে রেখে দিলো।তারপর দরজা বন্ধ করলো।দরজায় টোকা পরলো তখনি।রুপসা দৌড়ে গেলো।মা এসে পরেছে।
দরজা খুলে অবাক হলো রুপসা।একটু আগের সেই লোকটা।

“কি চাই আপনার?”

“এক কাপ চা।”

“মানে?”

“কেউ কাউকে হেল্প করলে এক কাপ চা তো অন্তত খাওয়ায়।তাই চা খেতে এলাম।”

রুপসার বিস্ময়ের শেষ রইলো না।বলে কি এই লোক?
“আমি কখন আপনার কাছ থেকে হেল্প নিলাম?”

“এই কিছু সময় আগে।”

“কই আমি তো নেই নি।বরং উল্টো আপনি আমাকে গায়ে পরে হেল্প করতে চেয়েছেন।এখন বলছেন,আপনি আমাকে হেল্প করেছেন।”

“চেয়েছি তো।সেটাই অনেক।আজকাল যা যমানা পরেছে চাইলেও কেউ কাউকে সাহায্য করতে চায় না।”

“শুনুন, এতো৷ কথার কোন কাজ নেই।আমি আপনাকে চা টা খাওয়াতে পারবোনা।আপনি আসুন।মা এসে আপনার সাথে কথা বলতে দেখলে খুব রাগ করবে।”

বলেই দরজা লাগিয়ে দিলো রুপসা।আর বাইরে দাঁড়িয়ে প্রলয় হাসতে থাকলো।
যাক্।অবশেষে মহারানীর দেখা পাওয়া গেলো।

চলবে……..

মুনিরা মেহজাবিন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here