মেঘের পরে মেঘ-২৮

মেঘের পরে মেঘ-২৮

“তো খুব খুশি এখন তুমি?”
হাসতে হাসতে বললো প্রলয়।

“খুশি হবো না?কি বলেন?এতোদিন পর মনে হচ্ছে আমি সত্যিকারের খুশি হয়েছি।”

“আর এদিকে তো আমার কপাল পুড়লো।”

“কেন? কপাল পুড়বে কেন?”
অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো রুপসা।

“এতো বড়লোক মানুষ কি আমার মতো সাধারণ একটা ছেলেকে মেনে নিবেন?”

“কেন নিবেন না?অবশ্যই নিবেন।আপনি জানেন না আমার বাবা খুব ভালো।নিজের ভালোবাসার লোকদের থেকে এতোদিন দুরে ছিলেন।উনি নিশ্চয়ই জানেন ভালোবাসার মানুষ কে ছাড়া জীবন কাটানো কতো কস্টের।আমি ও একই কস্ট করি তা নিশ্চয়ই বাবা চাইবেন না।আর মা তো সব জানেন।আমার মা যে লোভী নয় এতটুকু আপনি নিশ্চয়ই জানেন।মেয়ের খুশি টাই উনার কাছে বড়ো থাকবে এতটুকু বিশ্বাস আমার আছে উনাদের প্রতি।”

“এই দাঁড়াও দাঁড়াও।”

“কি হয়েছে? ”

“তুমি আমাকে ভালোবাসো না কি?”
দুস্টুমির স্বরে বললো প্রলয়।রুপসা ধরতে পারলো ব্যাপারটা।প্রলয় মাঝে মাঝেই এমন করে।

“কেন?বিশ্বাস হয় না?”

“কিভাবে হবে বলো?কখনো তো মুখ ফুটে বলোনি।বুঝবো কিভাবে? ”

“আমি মুখ ফুটে কখনোই কিছু বলবোনা।সবটা আপনাকে বুঝে নিতে হবে।আমার মুখের কথা, মনের কথা, না বলা কথাগুলোও।”
আবেগি হয়ে বললো রুপসা।

“ইনশাআল্লাহ। আল্লাহ যেন সেই তৌফিক টুকু আমাকে দান করেন।”

“মাঝে মাঝে কি মনে হয় জানেন?”

“কি?”

“যদি মা বাবার মতো কোন ঘটনা আমাদের জীবনে ঘটে আর আমরা আলাদা হয়ে যাই।তখন কি হবে?কিভাবে বাঁচবো প্রলয়?মায়ের শক্তি হিসেবে আমি ছিলাম।আমার তো কেউ নেই?”

“রুপসা?”

“হুম।”

“এসব কথা আর কখনো বলবেনা।আমার খুব কস্ট হয়।আল্লাহ চায় তো কখনো এমন কিছু হবে না।আমি সবসময় নামাজ পড়ে সে দোয়াই করি।”

“খুব কস্ট পেয়েছেন?”

“মোটামুটি। বুঝোই তো দুরে থাকি।তোমাকে নিয়ে এমনিতেও টেনশন করি।তার মধ্যে তুমি এসব কথা বললে খুব খারাপ লাগে।”

“সরি।আর কখনো বলবোনা।”

“সরি গ্র‍্যান্টেড হবে,যখন তুমি আমাকে তুমি করে বলবে।তুমি বলো।”

“আমি এখন পারবোনা।বিয়ের পর বলবো।প্রমিস।”
কাচুমাচু হয়ে বললো রুপসা। যদিও মোবাইলে তা দেখা গেলো না।কিন্তু প্রলয় ফোনের এ পাশে থেকেও বুঝলো রুপসার ফর্সা গাল দুটো রক্তিম বর্ন ধারন করেছে।হাসলো প্রলয়।

“উফফ,কবে যে সে সময় টা আসবে?আমার এক মুহূর্তও তোমাকে দুরে রাখতে মন চায় না।মনে চায়…”
বাকিটা আর শেষ করে না প্রলয়।
প্রলয়ের আকুলতা রুপসার বুকেও ঢেউ তোলে।লজ্জায় ভেঙে পরে।কথা বলতে পারে না।

“আই লাভ ইউ রুপসা।রাখি এখন সন্ধ্যায় কথা হবে।”
রুপসাকে সহজ করতেই বললো প্রলয়।

“ঠিক আছে। আল্লাহ হাফেজ।”

“আল্লাহ হাফেজ।”

লাইন কেটে গেলেও রুপসা মোবাইলটা কানে চেপে রইলো আরো কিছুক্ষন।এই মোবাইলটা গত সপ্তাহে ওর বাবা এনে দিয়েছে ওকে।স্মার্টফোন।মোবাইল পেয়ে সবার আগে যে কথাটা মনে হয়েছে তা হলো,প্রলয়ের সাথে কথা বলতে আর কোন বাঁধা রইলো না।চাইলেই এখন কল করা যাবে,মেসেজ দেওয়া যাবে।যদিও প্রলয়ের সময় বাঁধা।এর বড় কারন বাংলাদেশ আর অস্ট্রেলিয়ার সময়ের পার্থক্য।ভালোবাসা অটুট থাকলে কোন বাঁধাই আর বাঁধা থাকে না।

মা বাবার সাথেও খুব সুন্দর সময় কাটছে রুপসার।কতোদিন পর ওদের পরিবার পূর্ণ হলো।কিন্তু আর বেশিদিন একসাথে থাকা হবে না।আর মাত্র পনেরো দিন।এরপর ছুটতে হবে নতুন দিশায়।

________

নতুন জায়গায় সব কিছু মানিয়ে নিতে একটু কস্টই হচ্ছে শায়েরীর।এতোদিন পর স্বামীর সংসারে ফেরা,সব কিছু তো এতো তাড়াতাড়িই মাপে আসবে না।একটু সময় তো লাগবেই। এই যেমন নাবিলের সাথে ওর এখনো যথেষ্ট দুরত্ব রয়েছে।এক খাটে ঘুমাতে গেলেও কেমন যেন লাগে।অবশ্য নাবিলও যে অবুঝ তা তো নয়।বরং সময়ের ঘাতপ্রতিঘাতে আরো বুঝদার হয়েছে। মানিয়ে নিতে শিখেছে।

রুপসাকে নিয়ে চিন্তা ছিলো বেশি। কিন্তু ওই যেন আরো বেশি চিন্তা করে মা বাবার ভালো মন্দ নিয়ে। আর মাত্র পাঁচদিন সময় আছে। এরপর রুপসা ছুটবে রাজশাহী।
সেজন্যই আজও ওর পছন্দের খাবারগুলো থেকেই রান্না করছে শায়েরী।গরুর মাথার মাংস বুটের ডাল দিয়ে রান্না করবে,করলা ভাজি ইলিশের ডিম দিয়ে, চিংড়ি মাছ দোপেয়াজা আর কয়েকপদের ভর্তা।এই খাবারগুলো শুধু যে রুপসা পছন্দ করে তা নয়।নাবিলের ভীষণ পছন্দের।
দুপুরে নাবিল খেতে আসে।সেই সময়ের মধ্যে সব তৈরি করে ফেলে শায়েরী। খুব যত্ন নিয়ে খাওয়ায় ওকে।নাবিলের চোখে খুশির পানি ঝকমক করে।প্রায়ই বলে,

“জানো শায়ু,তুমিও চলে গেলে আর সবাই আমাকে ছেড়ে চলে গেলো।তুমি যাওয়ার বছর দুই পরেই মা বাবা একটা রোড এক্সিডেন্টে মারা যান।যত্ন করে খাওয়ানোর একমাত্র মানুষটাও আর রইলো না।”

তাই শায়েরী চেষ্টা করে নাবিলের সমস্ত অপ্রাপ্তিগুলোকে পূর্ণ করে দিতে।একই চেষ্টা থাকে নাবিলেরও।যেন ক্ষতিপূরণ দেওয়ার প্রতিযোগিতা চলছে।

রান্না প্রায় শেষের দিকে। ঘড়ির দিকে তাকালো শায়েরী।নাবিল চলে আসার সময় হয়ে গেছে।শেষ বারের মতো সবকিছুতে চোখ বুলিয়ে দেখে নিলো সব ঠিক আছে কি না।কাজের মেয়েটাকে মাংসটা দমে রাখতে বলে শায়েরী গোসলে ঢুকলো।

গোসল সেড়ে বের হতেই দেখে নাবিল চলে এসেছে।

“গোসল করবেন না খাবার দেবো?”

“কোনটাই না।এখানে বসো কথা আছে। ”

“বলুন।”
নাবিলের সামনের একটা চেয়ারে গিয়ে বসলো শায়েরী।

“তোমরা শফিক সাহেবের বাড়িতে থাকতে বলো নি তো?”

“বলার কি আছে?উনি তো আর স্পেশাল কেউ নন।আর আপনিও তো তাকে চেনোও না।”

“কে বললো চিনি না?উনি তো আমাদের অফিসের ম্যানেজার।”

“তাই না কি?তা আপনি জানলেন কি করে আমরা উনার বাসায় ছিলাম?”

“সেই বললো।আরো কিছু কথা বলেছে,আমি তার সত্যতা জানতে চাই। ”

“কি কথা?”

“উনার ছেলের সাথে না কি রুপসার সম্পর্ক ছিলো।উনি এখন রুপসাকে পুত্রবধূ করে ঘরে নিতে চান।”

“আপনি কি বললেন?”

“আমি বলেছি যদি আমার মেয়ে এতে ইনভলভ থাকে আর ছেলে যদি ভালো হয় তবে আমার আপত্তি নেই।কিন্তু যদি মিথ্যে কথা হয় তাহলে উনার খবর আছে।এখন তুমি আমাকে ব্যাপারটা ক্লিয়ার করো।আমার কিন্তু এতো তাড়াতাড়ি মেয়েকে বিয়ে দেবার একদম ইচ্ছে নেই।কিন্তু রুপসার যদি পছন্দ থাকে তো ব্যাপার আলাদা।তখন বিয়ের ব্যাপারটা নিয়ে ভাবতে হবে।”

“রুপসার পছন্দ উনার ছেলেকে আর প্রলয়ও ভীষণ পছন্দ করে রুপসাকে।প্রলয় ছেলে হিসেবে ভীষণ ভালো।শিক্ষিত,অস্ট্রেলিয়ায় একটা মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে সিনিয়র এক্সিকিউটিভ হিসেবে কাজ করছে।দেখতেও সুদর্শন।”

“তাহলে কি আগাবো?”

“না।”

“কেন?তুমিই না বললে ছেলে সব দিক দিয়েই ভালো।তাহলে সমস্যা কোথায়? ”

“সমস্যা আছে।”

“কি সমস্যা?”

শায়েরী ধীরে ধীরে সবটা খুলে বললো।সবটা শোনার পর নাবিল রেগে গেলো খুব।

“ওই শফিকের এতো বড় সাহস,আমার বৌ আর মেয়েকে এমন কথা বলে।আমি ওকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করবো।”

“বরখাস্ত করার কি আছে?থাকুক না।”

“না থাকবে না।ওর এতোবড় সাহস হলো কি করে,তোমাদের অপমান করে।”

“উনি কিন্তু তখন জানতেন না তুমি রুপসার বাবা।বাবা ছাড়া মেয়েরা বড় হলে অনেক কটুকথাই শুনতে হয় কিংবা হয়েছেও।যার আঁচ আমি কখনো ওর গায়ে লাগতে দিই নি।যদি প্রলয় নিজেকে প্রমান করতে পারে তবেই ও রুপসা কে পাবে না হলে না।”

নাবিল চুপ করে থাকলো।এতো রাগ লাগছে বলে বোঝানো যাবে না।সাথে এও বুঝতে পারছে এটুকু তো ছোটখাটো একটা ঝলক কস্টের, এর থেকেও আরো বড়ো কস্ট ওরা পেয়েছে।তাই এতো শক্ত মা, মেয়ে।

“বসেই থাকবেন?”

“উহু।উঠছি।শফিক কে কি বলবো?”

“বলবেন,আপনি এখন মেয়ের বিয়ে দেবেন না।মেয়ের পড়াশোনা শেষ হলে তারপর এ বিষয় টা নিয়ে ভাববেন।ততদিন যদি উনি বা উনার ছেলে অপেক্ষা করতে পারে তো ভালো। না হলে কিছু করার নেই।”

“আর রুপসা?”

“রুপসাকে যা বলার আমি অনেক আগেই বলে দিয়েছি।ভাববেন না।”

নাবিল আর কথা বাড়ালো না ওয়াশরুমে ঢুকে গেলো গোসলের জন্য। শায়েরী মুখে একটু হাসিরেখা দেখা গেলো।যে লোকটা এই কয়েকদিন আগেও ওদের মা মেয়েকে গালমন্দ করেছে,লোভী বলেছে, আজ অবস্থান পাল্টে যাওয়ায় সে লোক নিজেই এসেছে রুপসাকে ছেলের বৌ করার জন্য। হায় রে মানুষ। হায় রে মানুষের মন।

________

আজ থেকে রুপসার ক্লাস শুরু হয়েছে। গত পরশু ও রাজশাহী এসে পৌঁছেছে।বাবা মা দুজনেই এসেছিলো।বাবা ওর জন্য একটা ফ্ল্যাট ভাড়া করেছে।দুজন কাজের মানুষ রেখেছেে।একটা গাড়ি আর একজন ড্রাইভারও জোগাড় করে দিয়ে গেছেন।যাতে রুপসার কোন দিক দিয়ে কোন অসুবিধা না হয়।বাবার তো থাকার উপায় নেই।মা অবশ্য থাকতে চেয়েছিলো কিন্তু রুপসাই রাখেনি।এক রকম জোর করেই পাঠিয়েছে বাবার সাথে। এতোদিন পর দুজন একসাথে হয়েছে, থাকুক না একসাথে। রুপসা তো ছোটটি নেই।ও নিজেই সব বুঝে চলতে পারবে।
কোন সমস্যা যদি হয়েই যায়, বাবাকে বললেই হবে।ঢাকা আর কতোদুর?

প্রথমদিন বলে তেমন কোন পড়াশোনা হলো না।খুব তাড়াতাড়িই ছুটি হয়ে গেলো।
ভার্সিটি পেরিয়ে যখন গাড়ি তে উঠতে যাবে তখনি রুপসাকে থামতে হলো।রুপসা নাম ধরে কেউ একজন ডাকছে ওকে।

একজন যুবক এগিয়ে আসছে ওর দিকে।প্রথমে চিনতে না পারলেও সামনে আসতেই চেহারা পরিস্কার হলো।নুর।প্রলয়ের বন্ধু নুর।কিন্তু উনি এখানে কিভাবে?

নুর সামনে আসতেই কথা বললো রুপসা,

“কেমন আছেন ভাই?”

“ভালো।তোমার খবর কি?”

“ভালো।আপনি এখানেই থাকেন বুঝি?”

“না না।আমি তো ঢাকায় থাকি।এখানে আমার খালাতো ভাই নতুন ভর্তি হয়েছে।একা আসতে না কি ওর ভালো লাগছিলো না, তাই আসলাম ওর সাথে। সবকিছু দেখিয়ে দিলাম।”

“এখানকার সবকিছু কি আপনার চেনা?আপনি কি এখানে পড়তেন না কি?”

“না এখানে পড়তাম না।এখানে অনেকবার এসেছি এমনিতেই। তাই মোটামুটি সব চেনা বলতে পারো।তুমি বুঝি এখানেই ভর্তি হলে?”

“হ্যাঁ,ট্রিপল ই তে।আপনার সেই ভাই কোন ডিপার্টমেন্টে? ”

“ওতো বোটানিতে।”

“ও।তাহলে তো আর দেখা হবে না তেমন।”

“তুমি কোন হোস্টেলে উঠেছো?”

“আমি তো কোন হোস্টেলে উঠি নি ভাই।বাবা আমার জন্য একটা ফ্ল্যাট ভাড়া করেছেন,এই তো সামনেই।সেখানেই থাকবো।”

“ও।ভালো থেকো তাহলে।আসি।”

“আপনিও ভালো থাকবেন।”

নুর কিছুদুর গিয়েই আবার রুপসাকে ডাকলো।
রুপসা তখন প্রায় গাড়িতেই উঠে গেছিলো। নুরই এগিয়ে এলো।একটা প্যাকেট রুপসার দিকে এগিয়ে দিলো।

“এটা প্রলয় যাওয়ার সময় তোমাকে দিয়ে গিয়েছিল, সেই বার আমি ভুলে গেছিলাম আনতে।তাই এবার নিয়ে এসেছি।”

রুপসা প্যাকেট টা নিলো।তারপর নুর এর থেকে বিদায় নিয়ে বাসার দিকে ছুটলো।রুপসা চলে যেতেই একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো নুর।সেই কতোদুর থেকে শুধু রুপসাকে এক ঝলক দেখবে বলে এসেছিল।এবার শান্তি।

চলবে……..

মুনিরা মেহজাবিন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here