মেঘের পরে মেঘ -২৯
মাথার দু পাশে হাত দিয়ে চোখ বুঁজে টেবিলের উপর মাথা রেখে বসে আছে প্রলয়।টেনশনে মাথার রগ ছিড়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে।অফিসের হিসাবের খাতায় বেশ বড়সড় গোলমাল হয়েছে।প্রায় তিন কোটি টাকার গোলমাল।টাকাটা কেউ ব্যাংক থেকে উঠিয়ে নিয়েছে।কিন্তু কে এই কাজটা করেছে বুঝতে পারছেনা প্রলয়।এই অফিসের প্রায় সত্তর শতাংশ লোক বিদেশী।
তাদের সাথে প্রলয়ের সম্পর্ক ও ভালো। কেউ তাকে এমন প্যাঁচে ফেলবে তা কল্পনাও করেনি প্রলয়।
যদি ব্যাংক চেক টা প্রলয় ইস্যু না করতো তাহলে কোন সমস্যা ছিলো না।কিন্তু চেক টা প্রলয়ের মাধ্যমেই ইস্যু হয়েছে।
তাই এই তছরুপের পুরো দায়ভার প্রলয়ের ঘাড়ে চেপেছে।বিপদে পরলে মানুষ না কি চোখে সর্ষেফুল দেখে এতোকাল শুনে এসেছে আজ তার প্রমান পেলো।
অফিস থেকে ওকে শো-কজ করা হয়েছে।আগামী পনেরো দিনের মধ্যে এর যথাযথ কারন ওকে দর্শাতে হবে।হয় প্রকৃত অপরাধী কে ধরিয়ে দিতে হবে, না হয় পুরো টাকাটা ওকে ফেরত দিতে হবে।অন্যথায় ওকে পুলিশ কাস্টডিতে নেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন ওদের বস।
তিন কোটি টাকা।এতোগুলো টাকা এখন কোথায় পাবে প্রলয়?ঢাকায় কদিন আগেই জমানো টাকাগুলো দিয়ে একটা এপার্টমেন্ট কিনেছে।রুপসার জন্য কিছু গয়না কিনেছে।হাতে কোন টাকাই নেই।আর যদি কোনভাবে ম্যানেজ করে দিয়েও দেয় তবুও সবাই ওকেই দোষী ভাববে।আর যেখানে টাকা নেয়নি সেখানে দেওয়ার প্রশ্নই আসে না।
এ কোম্পানিতে আজ সাড়ে চার বছর যাবত কাজ করছে।নিজের সবটা উজার করে কাজ করেছে প্রলয়।কখনো এমন কোন কাজ করেনি যাতে ওর গায়ে বিশ্বাসঘাতকের তকমাটা লেগে যায়।আর আজ বিনাদোষে দোষী হলো।
গত দুদিন ধরে পুরো ব্যাপারটা ভেবে চলেছে প্রলয় কিন্তু কোন ভাবেই কাউকে ট্রেস করতে পারছে না।
অফিসের সমস্ত কর্মকান্ড ও মনে করতে পারলেও বিস্ময়কর ভাবে চেক সংক্রান্ত ব্যাপারটা ওর মাথাতেই আসছে না।
ভাবনার সুতো ছিড়লো কলিংবেলের আওয়াজে।
প্রলয় উঠে দাঁড়ালো। দরজা খুলে যাকে দেখলো তাকে দেখে যারপরনাই অবাক হলো প্রলয়।ওদের চেয়ারম্যান এর মেয়ে।মিস তনিমা।
প্রলয় এতোটাই অবাক হলো যে কুশল জিজ্ঞেস করার কথাও ভুলে গেলো।তনিমা হাসলো।
“ভেতরে আসতে বলবেন না?”
“ও হ্যাঁ।অবশ্যই।ভেতরে আসুন ম্যাম।”
প্রলয় সড়ে দাঁড়ালে তনিমা ভেতরে ঢুকলো। চুইংগাম চিবুতে চিবুতে এদিক সেদিক ঘুরে ফিরে দেখে ড্রয়িংরুমের সিঙ্গেল সোফাটায় বসলো।
প্রলয়ের দিকে মিস্টি হেসে বললো,
“ঘাবড়ে গেছেন মনে হচ্ছে? দাঁড়িয়ে আছেন কেন?প্লিজ বসুন।আপনারই ঘর। বি কমফোর্টেবল। ”
“ইটস্ ওকে ম্যাম।আপনি কি নেবেন?কোল্ডড্রিংকস্ না কফি?”
“ইমম্,খাওয়াবেন?তাহলে বরং কফিই দিন।পিওর ব্ল্যাক কফি।”
“আমি এখনি আনছি ম্যাম।আপনি প্লিজ একটু বসুন।”
তনিমা আবারো সেই মিস্টি হাসি টা দিলো।
প্রলয় চলে গেলো কিচেনে।দ্রুত দুই কাপ কফি তৈরি করে ড্রয়িংয়ে ফিরে এলো।তনিমা তখন ফটোফ্রেম হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলে।এক হাতে ফ্রেম টা অন্য হাতে টিস্যু নিয়ে সেটাকে মুছছেন।যেন এই কাজটা উনি প্রতিদিন করেন।
“এই নিন ম্যাম।আপনার কফি।”
তনিমা ফ্রেমটাকে যত্নের সাথে জায়গা মতো রাখলো।তারপর প্রলয়ের হাত থেকে কফির কাপ টা হাতে নিলো।ফ্রেমটার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
“হু ইজ সি?”
“মাই ফিওন্সে ম্যাম।”
“আর ইউ এনগেজড? ”
“নো ম্যাম।বাট সামথিং লাইক দ্যাট।আই লাভ হার এন্ড আই রিয়েলি লাইক টু ম্যারি হার।”
“ভেরি গুড।খুব সুন্দর তো মেয়েটা।কি করে?”
প্রলয় কিছুটা অবাক। তনিমা ম্যাডামের এই রুপ টা ওর একদমই অপরিচিত। তাছাড়া উনি কথাও একদম মেপে মেপে বলেন।সেই মানুষ ওর বাসায় এসেছেন আর এতো পরিচিত ভঙ্গিতে কথা বলছেন।যেন এরকম টা হয়েই থাকে।ভেতরে ভেতরে টেনশনে শেষ হয়ে যাচ্ছে।না জানি কি কথা বলতে এসেছে।মেইন টপিকে এখনো আসছে না কেন?ওদিকে তনিমাও ওর দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।
“ম্যাম ও পড়াশোনা করছে।ডু ইউ নো এবাউট রাজশাহী? সেখানকার ইউনিভার্সিটিতে ট্রিপল ই তে পড়ছে।”
“ইউ মিন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়?”
“ইয়েস ম্যাম।”
“আমি চিনি।আপনি হয়তো জানেন না আমার ছোট ভাই সেখান থেকেই পড়াশোনা শেষ করেছে এই কিছুদিন আগে।আর ট্রিপল ই এর স্টুডেন্ট তার মানে অবশ্যই ব্রিলিয়্যান্ট।তো এমন একটা মেয়ের বয়ফ্রেন্ড হয়ে এমন বোকার মতো কাজ কিভাবে করলেন?”
প্রলয় চুপ করে রইলো।কি উত্তর দিবে ভেবে পেলো না।সত্যি তো বোকার মতোই কাজ হয়েছে।ওর আরো সতর্ক থাকা উচিত ছিলো।বেঈমান রা সব জায়গায় থাকে এটা মাথায় রাখা উচিত ছিলো।
“সরি ম্যাম।”
“সরি বললে তো কাজ হবে না মিঃ আহমেদ। এতো গুলো টাকার বিষয় তো এমনি এমনি ছেড়ে দেওয়া যায় না।তবে একটা উপায় আছে যদি আপনি তাতে রাজি থাকেন তাহলে সব দিক দিয়ে আপনারই ভালো হবে।”
প্রলয়ের চোখ জ্বলজ্বল করে উঠলো।
“কি উপায় ম্যাম?”
“আমাকে বিয়ে করতে হবে।”
কথাটা বেশ ঠান্ডা মাথায় তনিমা বললো।আর প্রলয় হা হয়ে গেলো। এর থেকে যদি কানের আস্ত একটা এটম বোম ও ব্লাস্ট হতো তাও বোধহয় কম অবাক হতো।
“মানে?”
“বিয়ে মানে বোঝো না?বিয়ে করতে হবে আমাকে।”
“কিন্তু কেন ম্যাম?আমিই কেন?আমি তো আপনার উপযুক্ত কেউ নই।আপনি আরো ভালো কাউকে ডিজার্ব করেন।আমি তো কোন দিক দিয়েই আপনার যোগ্য না।”
তনিমা কফিতে আরো একটা চুমুক দিলো।
“সেটা ঠিক।তবে আমার তোমাকেই লাগবে।আরো দুয়েক জনকে প্রপোজ করেছিলাম তারা রাজি হয় নি।তাই সিদ্ধান্ত নিয়েছি তোমাকেই বিয়ে টা করবো।”
তনিমার তুমি করে বলাটায় আরো অবাক হয় প্রলয়।উনি কি ইচ্ছে করেই ওর অসহায়তার সুযোগ নিতে চাইছেন?ধীরে ধীরে বললো,
“আপনার মতো মেয়ে কে বিয়ে করতে কে রাজি হবে না ম্যাম?আপনি তো সব দিক থেকেই ঠিক আছেন।কিন্তু আমার তো গার্লফ্রেন্ড আছে।আমি ওকে কথা দিয়েছি।”
“আমাকে কেউ বিয়ে করতে রাজি হয় নি কারন এটা হবে একটা কন্ট্রাক্ট ম্যারেজ।”
“মানে?”
ফের অবাক হলো প্রলয়।
“আর বলো না।আমার বাবার না কি বাঙালী মেয়ের জামাই ই লাগবে।এদিকে রিকির সাথে আমার এগারো বছরের সম্পর্ক। ওকে ছাড়া আর কাউকে নিয়ে আমি সংসার করতে পারবো না।আচ্ছা, তুমিই বলো যাকে আমি ভালোইবাসি না তার সাথে সংসার করবো কিভাবে। ওদিকে বাবাও রাজি হচ্ছে না।কিছু দিন আগে বলে দিয়েছেন আমি যদি রিকিকে বিয়ে করি তবে নাকি আমাকে উনার যাবতীয় সম্পদ থেকে বঞ্চিত করবেন।সব না কি আমার ছোট ভাইকে লিখে দেবেন।একমাত্র বাঙালি কোন ছেলেকে বিয়ে করে তার সাথে কমপক্ষে ছয়মাস সংসার করলেই আমাকে আমার প্রাপ্যটুকু লিখে দেবেন। তুমিই বলো এটা কোন কথা?
তাই আমিও একটা প্ল্যান করেছি।একটা বাঙালি ছেলেকে বিয়ে করে তার সাথে একবছর থাকবো।ততদিনে বাবার কাছ থেকে সম্পত্তি লিখে নেবো।তারপর ডিভোর্স। এরপর আমি আবার রিকির কাছে ফেরত যাবো।”
“রিকি রাজি হবে?অন্য একজনের সাথে সংসার করবেন তারপর ডিভোর্স দিয়ে ওকে বিয়ে করবেন?”
“ও তো রাজিই।এই প্ল্যান টাও তো ওর মাথা থেকেই প্রথমে বেরিয়েছে।আর বিয়ে করছি বলে তো তার সাথে আমি বিছানায় যাচ্ছি না।রাজি হবে না কেন?”
“ও।”
ছোট্ট করে বললো প্রলয়।
“তো তুমি কি করবে?রাজি হবে?ভেবে দেখো।যদি রাজি হও তাহলে এই তিন কোটি টাকার ঝামেলা থেকে তুমি মুক্ত। আর ডিভোর্সের পর বেশ মোটা অংকের টাকা আমি তোমাকে দেবো।তাতে করে বাকি জীবন পায়ের উপর পা তুলে খেতে পারবে।মাথার ঘাম পায়ে ফেলে টাকা উপার্জন করতে হবে না।তোমার গার্লফ্রেন্ড কে বিয়ে করে বাকি জীবন সুখে কাটাতে পারবে।”
“আর আপনাকে বিয়ে করলে ওকে আমি এমনিতেই হারিয়ে ফেলবো।আপনার প্রস্তাব টা যথেষ্ট লোভনীয় কিন্তু আমি সরি ম্যাডাম।আমি রাজি হতে পারলাম না।”
“ভেবে দেখো।তিন কোটি টাকার ক্ষতিপুরন দেওয়ার ক্ষমতা কিন্তু তোমার নেই। জেলে পঁচে মরবে।”
প্রলয়ের কানে কানে ফিসফিস করে বললো তনিমা।
“আমাকে সময় দেওয়া হয়েছে ম্যাম।আমি আপ্রান চেষ্টা করবো যাতে দোষীকে ধরতে পারি।”
প্রলয় শক্ত সুরে বললো।
“দেখা যাক।”
কাঁধ ঝাকিয়ে বললো তনিমা।
“তবে আমার প্রস্তাব টা ভেবে দেখো।আসি।”
বলেই চলে গেলো তনিমা।ও চলে যেতেই দরজা বন্ধ করে সোফায় বসে পরলো প্রলয়।দু হাত তুলে খোদার কাছে বললো,
“খোদা, তুমি পথ দেখাও।আমাকে সাহায্য করো।”
বলতে বলতেই দু চোখে পানি চলে এলো প্রলয়ের।
________
“কি হয়েছে আপনার?এভাবে কথা বলছেন কেনো?কোন সমস্যা? ”
বললো রুপসা।
“কই? কিছু হয়নি তো।কি হবে?”
বললো প্রলয়।
“তাহলে গলা এমন শোনাচ্ছে কেন?”
“কেমন শোনাচ্ছে? ”
“কেমন ভাঙা ভাঙা।মনে হয় কেঁদেছেন।”
“ধুরর্ পাগলী। কাঁদবো কেন?কাঁদার মতো তো কিছু হয় নি।ঘুমিয়ে ছিলাম।তাই হয়তো এমন শোনাচ্ছে। ”
নিজেকে স্বাভাবিক রাখার খুব চেষ্টা করছে প্রলয়।কিন্তু তারপরও কিভাবে বুঝে যাচ্ছে রুপসা?
“ঘুমিয়ে ছিলেন মানে?আপনি আজ অফিসে যান নি?এই যে আপনার শরীর ঠিক আছে তো?”
উদগ্রীব হয়ে জিজ্ঞেস করলো রুপসা।
“আরে পাগল কিছু হয় নি আমার।একদম ঠিক আছি।অফিস ছুটি আছে তিনদিনের।”
“ও।সত্যি বলছেন তো?”
“একদম।”
এরপর আরো কিছুক্ষন কথা বলে ফোন রেখে দিলো প্রলয়।মেয়েটার ফাইনাল পরীক্ষা চলছে এর মধ্যে কিছুতেই এই কথা জানানো যাবে না।তাহলে পড়াশোনা শিকেয় তুলে কাঁদতে থাকবে।হাতে এখনো দশদিন সময় আছে এর মধ্যে আল্লাহ নিশ্চয়ই কোন একটা ব্যবস্থা করে দেবেন।একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ছেড়ে দিয়ে ফের কম্পিউটারের সামনে বসলো প্রলয়।সুক্ষাতিসুক্ষ ভাবে খতিয়ে দেখছে সবকিছু। একটা না একটা ক্লু অবশ্যই পেয়ে যাবে।
আর ওদিকে প্রলয় ফোন কেটে দিলেও চিন্তা দুর হলো না রুপসার।কিছু একটা এই ছেলের অবশ্যই হয়েছে। কিন্তু ওকে বলছে না।কে জানতে পারে এ ব্যাপারে ভাবতেই নুরের কথা মনে হলো।নুর অবশ্যই কিছু জানবে।নুরের কাছেই তো প্রলয় নিজের সব কথা শেয়ার করে।সেটা হোক সমস্যার বা আনন্দের।
এ চার বছরে নানা ভাবে রুপসাকে হেল্প করেছে নুর।যখনই কোন প্রয়োজনে ডেকেছে বিনাশর্তে হাজির হয়ে গেছে। বন্ধুর প্রেমিকার এমন খেয়াল কজন বন্ধু রাখে?
তাই তো নুর শুধু প্রলয়ের নয় রুপসারও একজন বন্ধু তে পরিনত হয়েছে।
তাই কোন কিছু না ভেবেই নুর কে কল দিলো রুপসা।
“হ্যালো,আসসালামু আলাইকুম ভাই।কেমন আছেন?”
“ওয়ালাইকুমুস সালাম।ভালো আছি রুপসা।তুমি কেমন আছো?”
“এই তো আছি কোনরকম।”
“কোনরকম কেন?”
রুপসা সে কথার উত্তর দিলো না
“আপনার সাথে আমার কথা আছে। ”
“খুব জরুরি কিছু কি?”
“হ্যাঁ।”
“তাহলে কাল শুনি।কাল আমি তোমাদের ওখানে আসছি অফিসের একটা কাজে।”
“ও।তাই?তাহলে তো ভালোই হয়।সামনাসামনি কথা হবে। রাখি তাহলে?”
“আচ্ছা। কাল দেখা হবে।”
চলবে……..
মুনিরা মেহজাবিন।