মেঘের পরে মেঘ-৩০

মেঘের পরে মেঘ -৩০

“প্রলয়ের কি হয়েছে ভাই?ওর সাথে কথা বলার পর কেমন যেন মনে হলো।আমার কিছু ভালো লাগছে না।ওর কোন সমস্যা হলো না তো?আপনি সেদিন ফোনে বললেন কাল আসছি আর এলেন আজ।এসেও কিছু বলছেন না।কি হয়েছে ভাই ”

“কিছু হয় নি তো।কি হবে?তার আগে তুমি বলো তোমার পরীক্ষা কেমন হলো?”

“ভালো।”
ছোট্ট করে উত্তর দিলো রুপসা।নুর কেও কেমন যেন লাগছে রুপসার কাছে। কোন কথা যেন মনোযোগ দিয়ে শুনছে না এমন একটা ভাব।রুপসা আবার বললো,

“নুর ভাই।কি হয়েছে আপনার?কথা বলছেন না কেন?কি ভাবছেন তখন থেকে?”

“কিছু না।তো প্রলয়ের সাথে তোমার কথা হয়েছে এর মধ্যে? ”

“এর মধ্যে বলতে গত পরশুর আগের দিন কথা হয়েছিল।আর কথা হয়নি।আমি গতকাল কল করেছিলাম কিন্তু আনরিচেবল বলছে।কি হলো কিছুই বুঝতে পারছি না।কোন সমস্যা হলো কি না? ”

“রুপসা?”

“হুম।”

“আমি এখন তোমাকে কিছু কথা বলবো সেটা মনোযোগ দিয়ে শুনবে।যা প্রশ্ন করার তার পর করবে।কেমন?”

“ঠিক আছে আপনি বলুন।”

রুপসা কিছুটা অবাকই হলো।কি এমন কথা যেটা বলতে উনি এতো সময় নিচ্ছেন?নুর আরো কিছু টা সময় নিলো।রুমাল দিয়ে কপালে জমে যাওয়া ঘাম মুছলো।সামনে রাখা পানির গ্লাস টা এক চুমুকেই শেষ করে দিলো।তারপর মুখ মুছে নিয়ে বললো,

“রুপসা?”

“হুম।”
রুপসা মনোযোগী শ্রোতার মতো তাকিয়ে আছে।

“প্রলয় বিয়ে করেছে।গত পরশু ঘটেছে এ ব্যাপার টা।আমি পরশু রাতেই শুনেছি।কিন্তু তোমাকে কিভাবে বলবো বুঝতে পারছিলাম না।”

“আপনি কি মজা করছেন আমার সাথে? ”
চোখের দৃষ্টি স্থীর রুপসার।যেন দৃষ্টি দিয়েই নুরের ভেতর টা পড়ে ফেলতে চাইছে।

নুরও কম যায় না।রুপসা বিশ্বাস করবে না এটা ও আগেই জানতো।তাই তো তৈরি হয়েই এসেছে। প্রমান সমেত।নিজের মোবাইলটা রুপসার সামনে মেলে ধরলো।তাতে প্রলয়ের পাশে একজন রুপসী মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে।সাদামাটা ড্রেস দুজনের।মুখগুলো হাসি হাসি।ছোট করে ক্যাপশন দেওয়া।ক্যাপশনে লেখা,
“অর্ডিনারী নিউলি ম্যারেড কাপল।”

প্রলয়?ওর প্রলয়?আজ অন্য কাউকে বিয়ে করে নিয়েছে?এই মেয়েটা ওর বৌ?
রুপসা ছবিটার দিকে স্থীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো অনেকক্ষন ধরে।নুরও তাকিয়ে ছিলো ওরই দিকে।তারপর হঠাৎ নুর খেয়াল করলো রুপসা হেলে যাচ্ছে একদিকে।কোনকিছু বোঝার আগেই জ্ঞান হারিয়ে মেঝেতে লুটিয়ে পরলো রুপসা।

_________

আজ কতোদিন হয়ে গেলো প্রলয়ের সাথে কোন যোগাযোগ নেই রুপসার।কতোদিন তার আর কোন হিসেব নেই এখন রুপসার কাছে।হয়তো অনেকগুলো মাস পেরিয়ে গেছে।কিংবা কয়েক বছর। রুপসা শুধু জানে হাজার দিন পেরিয়ে গেছে প্রলয়ের সাথে কথা না বলার।প্রথম দিন গুলো কি যে কস্টের ছিলো বলে বোঝানো যাবে না।রুপসা পাগল হয়ে গিয়েছিলো প্রায়।কতোভাবেই না চেষ্টা করেছে ওর সাথে যোগাযোগ করার।কিন্তু ব্যর্থ হয়েছে রুপসা।নুরও চেষ্টা করেছে খুব।কিন্তু কোন ফল হয়নি।বরং একটা ভয়ংকর কথা আবিষ্কার করেছে।
প্রলয় না কি বিয়ে করেছে সেখানে। আর সেটা ওর বস প্রলয়ের মা বাবাকে জানিয়েছে।
নুর এই তথ্য টা এনে দিয়েছে রুপসাকে।রুপসা প্রথমে বিশ্বাস করেনি।কিন্তু প্রলয়ের যোগাযোগহীনতায় বিশ্বাস করতে বাধ্য করেছে।
কেঁদেছিল রুপসা।খুব কেঁদেছিলো।এমনকি রাতের ঘন আধারে এখনো কেঁদে যায়।একটা প্রশ্নই শুধু ঘুরেফিরে মনে আসে,কেন এমনটা করলো প্রলয়?যাবেই যদি,এতো ভালোবাসার, এতো স্বপ্ন বোনার কি দরকার ছিলো?

বারান্দায় বসে কফির মগে চুমুক দিয়ে এখনো সে প্রশ্নটারই উত্তর খুঁজে ফিরছিল।ফলাফল শূন্য। বিয়ের পর প্রলয় আর দেশে আসেনি।যদি আসতো তবে উত্তর টা জেনে নিতো।

“কি রে মা,এই ভর সন্ধ্যায় এখানে কি করছিস?”

রুপসা নিজের ভাবনায় এতোটাই বিভোর ছিলো যে,কখন বাবা এসে পাশে দাঁড়িয়েছে খেয়ালই করেনি।

“এই তো বাবা,কফি খাচ্ছি। ”

মেয়ের মাথায় আলতো হাত বুলিয়ে দিলো নাবিল।

“মন খারাপ?”

রুপসা মৃদু হাসলো।

“না তো বাবা।এমনি, রাস্তা দেখছিলাম।এতো মানুষের চলাচল দেখতে খুব ভালো লাগে। ”

“এখানটায় বস।বসে কিছু কথা বলি।তুই তো এখন শুধু নিজের মতো থাকিস।আমাদের সাথে তো তেমন কথাও বলিস না।”

“ভালো লাগে না বাবা।সবকিছু কেমন যেন উলট পালট হয়ে গেছে। যখনি সে কথা মনে পরে সবকিছু অসহ্য লাগে। কারো সাথেই কথা বলতে ভালো লাগে না।শুধু মনে হয় যদি একটা প্রশ্নের উত্তর পেতাম তাহলে হয়তো বেঁচে থাকাটা সহজ হতো।এতো দমবন্ধ অনুভূতি হতো না।”

“কি প্রশ্ন মা?”

“ও আমার সাথে এমন কেন করলো বাবা?আমার সবকিছু কে এভাবে মাটি চাপা দিয়ে দিলো?আর আমি এতোটাই বোকা ওর বদলে যাওয়াটা আমার চোখে ধরা পরলো না।অন্য একটা মেয়ে কে বিয়ে করলো,অথচ যেদিন থেকে যোগাযোগ বন্ধ হলো তার আগের রাতেও কতো কথা বললো।এসব যদি ওর মনেই ছিলো তবে আমার সাথে এমন কেন করলো বাবা?”

“হয়তো কোন সমস্যায় পরেছিলো।এমন কোন ঘটনা যা তুমি আমি জানি না।”

“তুমি আমি নাই জানতে পারি কিন্তু ওর বাবা মা?ওনারা তো জানবেন?তাহলে কেন সবাই মুখে কুলুপ এঁটে বসে বসে আছে?কেন সবাই আসল কথা না বলে শুধু ওর বিয়ের কথাটাই বলছে?”

“হয়তো উনারাও সঠিক টা জানেন না।”

“কিন্তু আমি জানতে চাই বাবা।কেন ও ওর বাবা-মার সাথে পর্যন্ত যোগাযোগ করছে না?কোন কারন তো অবশ্যই আছে। আমি জানতে চাই বাবা,প্রলয় যদি বিয়েও করে থাকে তবে কেন করলো আমি জানতে চাই। ”
দৃঢ় স্বরে বললো রুপসা।

“কিন্তু মা,এটা কিভাবে সম্ভব? তুমি ঢাকায় বসে অস্ট্রেলিয়ার খবর কিভাবে পাবে?তার চেয়ে আমি বলি কি, তুমি সব ভুলে নতুন করে শুরু করো।এটাই সবথেকে ভালো হবে।”
রুপসাকে বোঝানোর চেষ্টা করলো নাবিল।

“না বাবা।এটা হবে না।আমার জায়গায় তুমি হলে কি করতে?যা আমি করছি অবশ্যই তাই তাই করতে।তুমি কি পেরেছিলে মা কে ভুলে যেতে?পারোনি।আমিও পারছি না বাবা।এতোগুলো দিন আমার কিভাবে গেছে তা শুধু আমিই জানি বাবা।আমার প্রশ্নের উত্তর চাই।আর এর জন্য হলেও আমি অস্ট্রেলিয়া যেতে চাই? ”

“কি বলছিস এসব?অস্ট্রেলিয়া তো যেতে চাইলেই যাওয়া যায় না মা।কাগজপত্রের ব্যাপার আছে। ভিসা প্রসেসিং অনেক সময়ের ব্যাপার।”

“সব কিছু হয়ে গেছে বাবা।”

“কি বলছিস?কখন হলো সব?তোর মা আমাকে তো কিছুই বললো না?”

“মা জানে না বাবা।মাকে বলিনি।তোমাকেই সবার আগে বললাম।সিডনির একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পনেরো দিনের ট্যুরে যাচ্ছে প্রায় পঁচিশ জনের একটা দল।আমিও সেই দলে মনোনিত হবার জন্য এতোদিন কাজ করে যাচ্ছিলাম।আল্লাহ আমার মুখ তুলে চেয়েছেন।আমার কাজ তাদের পছন্দ হয়েছে।আর গত সপ্তাহে ওই দলের একজন সদস্য হিসেবে আমিও মনোনিত হয়েছি বাবা।আমি যেতে চাই বাবা।”

“প্রলয় কি সিডনিতেই থাকে?”

“যখন যোগাযোগ ছিলো তখন তো ওখানেই থাকতো।এখনকার কথা বলতে পারি না।ওখানে গিয়ে বাঙালি কম্যুনিউটিতে যোগাযোগ করলেই না কি খোঁজ পাওয়া যাবে?”

“কে বললো তোকে? ”

“আমার এক ক্লাসমেট।ওর এক আত্নীয় সিডনিতে থাকে।ওই বললো সেদিন।”

“ও।কিন্তু তুই একা একা কিভাবে কি করবি মা?”

“আমি পারবো বাবা।তাছাড়া দলের লোকজন তো আছেই।”

নাবিল ভাবলো এক মুহূর্ত। তারপর হেসে উঠলো অল্প করে।

“ঠিক আছে।যাবি।কিন্তু আমার একটা শর্ত আছে।”

“কি শর্ত বাবা?”

“সেখান থেকে ফিরে তোকে তোর জীবন গুছিয়ে নিতে হবে।আর প্রলয়ের জন্য কস্ট পাবি না।ফিরে এসে বিয়ে করে নিজের জীবন টাকে গুছাবি।কথা দে?”

রুপসা হাসলো।
“কস্ট কি কেও ইচ্ছে করে পায় বাবা?প্রলয়কে ভুলতে আমার অনেক কস্ট হবে।কিন্তু তুমি যেহেতু আমার সব আবদার মেনে নিয়েছো,আমিও নেবো।”

“সত্যি বলছিস?”

“হ্যাঁ।কিন্তু মাকে বোঝানোর দায়িত্ব তোমার।এ দায়িত্বে একদম অবহেলা করবে না।প্রমিস?”

“প্রমিস।”

চলবে……..

মুনিরা মেহজাবিন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here