মেঘের পরে মেঘ-৩২

মেঘের পরে মেঘ -৩২

“শায়ু?”

“হু।”

“নুর আজও এসেছিল।”

চুলের হাত খোঁপা করে নিয়ে নাবিলের মুখোমুখি বসলো শায়েরী। নাবিলের চোখে চোখ রেখে জিজ্ঞাসা করলো,

“আপনি কি বললেন?”

দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে দিয়ে নাবিল বললো,

“কি আর বলবো বলো?রুপসার মনের অবস্থাটা তো বুঝি।ওকে চাপ ও দিতে পারছি না।কিন্তু আমার মনে হয় ওর বিয়ে টা হলে খারাপ হয় না।নতুন পরিবেশ, নতুন মানুষের সাথে সবকিছু আবার শুরু করলে এমনিতেই সব ঠিক হয়ে যাবে।এমন তো হতে পারে নুর ওকে এতোটাই ভালো রাখলো যে পুরনো ঘাঁ আপনাআপনি শুকিয়ে গেলো।আর খুব সুখী হলো।”

“যদি এমনটা না হয় তাহলে কি করবে?”
সন্দিহান মনে প্রশ্ন করে শায়েরী।

“এমন টাই হবে। তুমি দেখে নিও।একজন ভালো জীবনসঙ্গী তার স্ত্রীর সমস্ত ভালোলাগা মন্দলাগাকে সম্মান করে।আর এতে করে সেই মেয়েটাও একসময় সব ভুলে নতুনের পথে পা বাড়ায়।জীবনে সুখী হওয়ার চেষ্টা করে।নুর একজন ভালো মানুষ। এটা আমার বিশ্বাস। আর ও একজন ভালো জীবনসঙ্গী হবে তাতে আমার কোন সন্দেহ নেই। ”

“হলে তো ভালোই হয়।আপনি বলে দেখেন আপনার মেয়ে কে।আমি কিছু বলতে পারবো না।আমি কিছু বললেই অসহায়ের মতো ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকবে।ওর অসহায়ের মতো চাহনি আমার সহ্য হয় না।”

গলা ধরে এলো শায়েরীর।নাবিল ওর হাতে হাত রেখে হালকা চাপ দিয়ে ভরসা দেয়ার চেষ্টা করলো। ততক্ষণে শায়েরীর চোখ অশ্রুসজল হয়ে উঠেছে।নাবিলের বুকে ঝাপ দিলো শায়েরী। হু হু করে কেঁদে উঠলো।

“আমাদের মেয়েটার সাথেই কেনো এমন হলো বলতে পারেন?কেন এতো কস্ট পাচ্ছে মেয়ে টা?ওর এই ক্ষত কিভাবে ভরবে?ওতো কোনদিন এ কস্টের কথা ভুলতে পারবে না।যত মনে হবে ততো কস্ট পাবে।”

শায়েরী কে শক্ত করে জড়িয়ে রাখলো নাবিল।
“কেঁদো না শায়ু।দেখবে একদিন সব ভুলে ও খুব সুখে আছে।সন্তানের জন্য বাবা মায়ের দোয়া তো কবুল হয়।তুমি আর আমি মিলে আল্লাহর কাছে ওর সুখের জন্য সবসময় দোয়া করবো।”

নাবিলের স্বান্তনায় শায়েরীর কান্না থামে না।ধীর গতিতে বেয়েই চলে কপোল জুড়ে।

_______

বারান্দার ফুল গাছে পানি দিচ্ছিলো রুপসা।গন্ধরাজ গাছে সাদা কয়েকটা গন্ধরাজ ফুটেছে। আরো কয়েকটা গাছে কুঁড়ি এসেছে।কতগুলোতে ফুল ফুটেছে। কত গুলো ফুটবো ফুটবো করছে।গন্ধরাজ ফুলে আলতো করে হাত বুলিয়ে দিলো রুপসা। প্রলয়ের খুব পছন্দের ফুল এই গন্ধরাজ।ওর সাথে তো তেমন ভাবে কোথাও যাওয়া হয়নি মাঝে মধ্যে কলেজ থেকে দুরের এক রেস্টুরেন্টে বসে কথা হতো।সে সময় মাঝে মধ্যেই প্রলয় ওর হাতে তুলে দিতো গন্ধরাজের মাদকতা।
ওর কথায়,গন্ধরাজের মতো এমন মাদকতার ঘ্রান নাকি আর কোন ফুলে নেই। না রজনীগন্ধায়, না গোলাপে।বিয়ের পর জোৎস্না রাতে ছাদে বসে দুজন গল্প করবে।রুপসার চুল গুলো ছেড়ে দেওয়া থাকবে আর কানের পাশে গুঁজে দেওয়া থাকবে গন্ধরাজ। গন্ধরাজের মাদকতায় ওরাও হারিয়ে যাবে ভালোবাসার অন্য এক রাজ্যে।
এতো স্বপ্ন দেখানো মানুষ টাই রুপসার জীবনে আর নেই।এটা মেনে নেওয়া যে কতোটা কস্টের।কাউকেই তা বুঝাতে পারবে না রুপসা। চোখের জলের ধারা ওর গাল বেয়ে গন্ধরাজের উপর পরলো।লাইটের আলোয় সাদা গন্ধরাজের উপর চোখের জল মুক্তোর মতো চিকচিক করছে।

“কি করিস মা?”

পেছনে বাবার গলা পেতেই চোখের জল মুছে নিলো রুপসা। বাবাকে কিছুতেই বুঝতে দেওয়া যাাবে না ও কাঁদছিলো।তাহলে কস্ট পাবে ভীষণ।

“এই তো গাছে পানি দিচ্ছিলাম বাবা।”

ফুলগাছের দিকে উঁকি দিয়ে নাবিল বললো,

“বাহ্,খুব সুন্দর ফুল ফুটেছে তো।আরো কতো কুঁড়িও হয়েছে। তোর বারান্দা তো ফুল দিয়ে ভরে গেলো রে মা।”

জবাবে রুপসা মৃদু হাসলো।

“এ্যা রুপসা?”

“বলো বাবা।”

“বলছিলাম কি…”

“বলো না।তুমি এতো ইতস্তত করছো কেন তাই তো বুঝতে পারছি না।”

“আসলে নুর ছেলেটা কালও এসেছিল।তোকে সরাসরি কিছু বলতে ও লজ্জা পায়।তাই আমাকেই বলেছিল।এখন তুই যদি বলিস…..।ছেলেটা এর আগেও একবার এসেছিল।তখন তোকে কিছু জানাই ন।তুই ডিপ্রেসড ছিলি।একটু সময়ের প্রয়োজন ছিল তোর এটা আমি বুঝি।কিন্তু এবার যে একটা সিদ্ধান্তে আসতে হয় মা।নুর কে অপছন্দ হলে অন্য কোন ছেলে দেখি?”

নুর কিছুদিন আগে রুপসাকে ওর পছন্দের কথাটা জানিয়েছিল।রুপসা হ্যাঁ, না কিছু না বলে বলেছে ওর মা বাবার সাথে যোগাযোগ করতে।তারই প্ররিপ্রক্ষিতে এমন একটা কিছু হবে সেটা রুপসা অনুমান করতে পেরেছিল।তাই অবাক হলো না।

“তোমাদের যা ভালো মনে হয় করো বাবা,আমার কোন আপত্তি নেই।”

নাবিল একটু সাফাই গাওয়ার চেষ্টা করলো।
“নুর ছেলে হিসেবে ভালো। ফ্যামিলি ব্যাকগ্রাউন্ড ও তো ভালো। আল্লাহর দুনিয়ায় সবাই তো খুব রুপবান হয় না।একজন ভালো জীবনসঙ্গী পাওয়াটাই হলো বড়ো কথা।তাছাড়া ও দেখতেও তেমন খারাপ না।”

“আমি কখন বললাম,উনি দেখতে খারাপ। আর এতো সুদর্শন দিয়ে কি করবো বলো বাবা?রুপ ধুয়ে তো আর পানি খাবো না।গুন টাই আসল।রুপবান তো একজন এসেছিল জীবনে, কি লাভ হলো?উল্টো আমার সাজানো জীবন টাকে তছনছ করে দিয়ে গেছে। ”
গলাটা ধরে আসে রুপসার।

“তাহলে কাল আসতে বলে দেই?”

“বলো।”

“আচ্ছা। ঠিক আছে। তুই তোর কাজ কর আমি আসি।”
রুপসার মাথায় হাত বুলিয়ে নাবিল চলে গেলো।

_________

একটু আগেই নুরের সাথে রুপসার এনগেজমেন্ট হয়ে গেলো।একদমই ঘরোয়া ভাবে।শুধু নুরের পরিবার আর রুপসার পরিবারের কিছু আত্নীয় স্বজন উপস্থিত ছিলো।রুপসা, একটা রানী গোলাপি রঙের কাতান শাড়ি পরেছে।সাথে হালকা সাজ আর গয়না।তাতেই ফিট হয়ে পরে যাওয়ার জোগাড় নুর সাহেবের।মনের মধ্যে খুশি ঘন্টা বেজে চলেছে অবিরাম।এই জলজ্যান্ত মানবী টি এখন ওর বাগদত্তা। নুর যেন বিশ্বাস করতে পারছে না ওর এতোদিনের লালিত স্বপ্ন পূরন হতে চলেছে। নিজের হাতের অনামিকার আংটি টা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখতে লাগলো নুর।এই আংটিটাই রুপসা ওকে পরিয়ে দিয়েছে।
এখন থেকে রুপসা ওর।আর কোন বাঁধা নেই ওকে আপন করে পাবার পথে।খুশিতে একটা জোর নিঃশ্বাস ছাড়লো নুর।
রুপসা মাথা নিচু করে আছে। মনের ভাব বোঝা যাচ্ছে না।রুপসা কি খুশি? খুশি হওয়ার তো তেমন কোন কারন নেই। কিন্তু নুর আজীবন ওর সবটা দিয়ে চেষ্টা করে যাবে ওকে সুখে রাখার।

রুপসা সবাইকে বলে নিজের ঘরে চলে আসলো।নিজেকে একটু সময় দেয়া প্রয়োজন।বুক ভার ভার লাগছে।নুরের পরিবার একটু পরেই চলে যাবে।খাওয়া দাওয়া শেষ হয়ে গেছে।এখন গল্প গুজব চলছে।
খুব সম্ভবত সামনের মাসে বিয়ের ডেট রেখেছেন।
সবটা জেনেও রুপসার ভালো লাগছে না।কিন্তু এখন ওকে সব কিছুই ভালো লাগাতে হবে।প্রলয়ের হাসি হাসি মুখটা ভুলতে হবে।
দরজায় টোকা পরছে।কে এলো ভাবতেই পরিচিত গলার আওয়াজ পেলো রুপসা।নুর।

“আসবো?”

“আসুন না।”
মুখ টা হাসি হাসি রাখার চেষ্টা করলো রুপসা।

নুর ধীর পায়ে রুমে ঢুকে রুপসার খাটের এককোনায় বসলো।

“চলে আসলে যে?”

“মাথাটা একটু ধরেছিল।আসলে এতো ভারী সাজে তো কখনো থাকিনি।তাই কেমন যেন লাগছিল। ”
কৈফিয়ত দেয়ার চেষ্টা করলো।

“ভালোই করেছো।”

“কি?”
না বুঝেই জিজ্ঞেস করলো রুপসা।

“এই যে রুমে চলে এসেছো।ভালো করেছো।তোমাকে এতো সুন্দর লাগছে অথচ এতো লোকের ভীরে তোমাকে ভালো ভাবে দেখতেই পারছিলাম না।একটু তাকালেই দেখি সব আমার দিকেই তাকিয়ে আছে। লজ্জা লাগে না বলো?এখন মন ভরে দেখা যাবে।”

রুপসা হেসে ফেললো।

“এই তো আকাশে চাঁদ উঠে গেছে। এভাবেই থাকবে সবসময়। হাসিখুশি। গোমড়া মুখে তোমাকে একদমই মানায় না।”
মুগ্ধ চোখে চেয়ে থেকে বললো নুর।

রুপসা এবারো মৃদু হাসলো। লোকটা তো কখনো এতো কথা বলে না।আজ এতো কথা বলছে কেন?এ বাড়ির জামাই হওয়ার সার্টিফিকেট পেয়ে গেছে বলে?

“রুপসা?”

রুপসা তাকিয়ে দেখে নুর ওর দিকে এখনো এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। মাথা নিচু করে নিলো রুপসা।

“কি?”

“তোমার হাত টা একটু ধরি?তোমার আপত্তি থাকলে দরকার নেই।”

রুপসা ভাবলো এক মুহূর্ত। একটু যেন দ্বিধা। তারপর দ্বিধা কাটিয়ে ধীরে ধীরে নুরের দিকে হাত বাড়িয়ে দিলো।নুর কাঁপা কাঁপা হাতে রুপসার হাতটা ধরলো।
গাঢ়স্বরে বললো,

“আমি আজীবন এই হাতটা ধরে থাকতে চাই রুপসা।আজীবন। ”

চলবে…….

মুনিরা মেহজাবিন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here