মেঘের বিপরীতে পর্ব ৫+৬

#মেঘের_বিপরীতে
(পর্বঃ ৫+৬)

নন্দিতা ঘুম ও জেগে থাকার মাঝামাঝি অবস্থায় আছে। যাকে বলে কাকঘুম। তার মাথা রেহালের কাঁধে। অপর হাত দিয়ে রেহাল তার চুলে বিলি কেটে দিচ্ছে। মেয়েটার মোশন সিকনেস আছে। মানুষ কত অদ্ভুত! অদৃশ্য জিনিস দেখতে না পারার মধ্যেও তাদের শারিরীক সমস্যা দেখা দেয়। গতি কি দেখার জিনিস? গতি আমরা অনুভব করি কিন্তু দেখতে পারি না বলেই উৎপত্তি হয়েছে মোশন সিকনেস নামক সমস্যার। সাদা টয়োটা গ্রামের সরু এক রাস্তায় এসে থামলো। রেহাল শান্ত স্বরে নন্দিতাকে ডাকলো,
_ নন্দিতা, উঠো। আমরা চলে এসেছি।

নন্দিতা ভ্রু কুঁচকে আস্তে আস্তে চোখ মেললো। রেহালের চোখে চোখ পড়তেই মিষ্টি করে হাসলো।
গাড়ি থেকে নামতে নামতে সে বললো,
_ তুমি তো আজকেও সময় মতো অফিস যেতে পারলে না।
_ আগামীকাল যাবো। আজ তোমার সাথে থাকতে ইচ্ছে করছে।
নন্দিতা বাচ্চাদের মতো উত্তেজিত হয়ে বললো,
_ তুমি সত্যি থাকবে?
রেহাল নন্দিতার চোখের দিকে তাঁকালো। তার চোখ দুটি জ্বলজ্বল করছে। বোঝাই যাচ্ছে রেহালের উত্তর জানার সে জন্য মরীয়া হয়ে উঠেছে। নন্দিতার এই অপ্রকৃতিস্থ ভাব রেহালের একটি “না” তেই শান্ত হয়ে যাবে। তবে সে এটা চাইছে না। গাড়ির পেছন থেকে ড্রাইভার নন্দিতার লাগেজ আর মিষ্টির প্যাকেট এনে সামনে রাখলো। রেহাল মানিব্যাগ থেকে ২০০ টাকার নোট বের করে ড্রাইভারকে দিলো।
_ কামরুল, তিনটে ব্যানসন নিয়ে আসবে। আর বাকি টাকা দিয়ে তুমি দুপুরে খেয়ে নিও। আমরা বিকালে ঢাকার উদ্দ্যেশ্যে রওনা হবো। ইনশা’ আল্লাহ।
_ আইচ্ছা স্যার।
কামরুল ব্যানসন আনতে চলে গেলো। রেহাল মিষ্টির প্যাকেট নন্দিতাকে দিয়ে লাগেজ হাতে নিয়ে বললো,
_ চলো আমরা এগোই।
নন্দিতা তীক্ষ্ণ কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
_ তুমি থাকবে না?
রেহাল উত্তর দিলো না। অন্যমনস্ক হয়ে পকেটে হাত ঢুকিয়ে দরকারি কিছু খুঁজতে লাগলো। সবসময়ই তার পকেটে বাড়তি সিগারেট থাকে। আজও তো থাকার কথা! অবশেষে ডান পকেটের কোনায় এর অস্তিত্ব পাওয়া গেলো। সিগারেট মুখে পুরে লাইটার বের করে আগুন জ্বালালো রেহাল। নন্দিতা কথা না বলে হাঁটা শুরু করলো। সিগারেটের ধোঁয়ার মাঝ দিয়ে মেয়েটার চলে যাওয়া দেখতে ভালো লাগছে।
রেহাল দ্বিতীয় টান দিলো। সাথে ধীর পায়ে নন্দিতার পিছে পিছে এগোতে লাগলো।

বারান্দায় শারমিন বেগম পাথরের মতো দাঁড়িয়ে আছেন। তার মুখে হাসি। চোখ ভিজে। নন্দিতা উঠোন পেরিয়ে বারান্দায় গিয়ে মার পা ছুঁয়ে তাকে জড়িয়ে ধরে। চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়ছে তার। ভাঙ্গা গলায় শারমিন বললো,
_ কেমন আছিস মা?
নন্দিতা আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো তাকে।
_ ভালো আছি, মা। তোমাকে দেখার জন্য মন কেমন করছিলো। তাই চলে এসেছি।
_ অনেক ভালো করেছিস। বছর পর দেখলাম তোকে! কত শুকিয়ে গেছিস রে মা তুই।
_ তাহলে এ’কয়দিনে মোটা বানিয়ে দিও।
মা মেয়ে দুজনেই হেসে উঠলো। রেহাল উঠোনে দাঁড়িয়ে দেখছে তাদের। তার ভালো লাগছে। শারমিন বেগম চোখ মুছলেন। রেহালের দিকে চোখ পড়তেই লজ্জামিশ্রিত স্বরে বললেন,
_ বাবা, তুমি ওদিকে দাঁড়িয়ে কেনো? এদিকে আসো। এতদিন পর মেয়েকে পেয়ে ছেলেকেই ভুলে গেছি।
রেহাল উচ্চস্বরে হাসলো।
_ না মা, ঠিক আছে।
রেহাল উবু হয়ে শাশুড়ির দোয়া নিলো।
স্ত্রীর কন্ঠস্বর শুনে রফিক সাহেব ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন।
_ কি ব্যাপার! এত হৈ চৈ কিসের?
নন্দিতা আবেগে আপ্লুত হয়ে বললো,
_ বাবা!
মুহূর্তেই চোখ ঝাপসা হয়ে এলো রফিক সাহেবের।
_ নন্দিতা! মা আমার। আয় মা বুকে আয়।
নন্দিতা একছুটে বাবার বুকে জায়গা করে নিলো। কেউ কোনো কথা বলছে না। চোখ দিয়ে অঝোরে পানি ঝরছে। বাবার প্রতি নন্দিতার দুর্বলতা বরাবরই বেশি। ছোটবেলায় যখন কেউ তাকে প্রশ্ন করতো তোমাকে কে বেশি ভালোবাসে বাবা নাকি মা? সে নির্দিধায় উত্তর দিতো – বাবা।

রেহাল চিন্তিত মুখে বিছানায় বসে আছে। দুপুরে খাওয়ার সময় অসাবধানতা বশত রুই মাছের ঝোল তার শার্টে লেগেছে। এই অবস্থায় জার্নি করাটা খুবই দৃষ্টিকটু। পথও দেড় ঘন্টার। জ্যাম এ পড়লে দুই থেকে আড়াই ঘন্টা। গায়ে ঝোল নিয়ে এতদূর রাস্তা পারি দাওয়ার বিষয়টা মোটেই সুখকর নয়। এমনসময় নন্দিতা ঘরে ঢুকলো। তার হাতে চকচকে ইস্ত্রি করা কালচে খয়েড়ি রঙ্গের শার্ট। রেহাল অবাক হয়ে বললো,
_ এই শার্ট কোথায় পেলে?
_ সাথে করে নিয়ে এসেছিলাম।
_ বাহ! তোমার মাথায় তো অনেক বুদ্ধি।
_ এগুলো কে বুদ্ধি বলা হয় না। বলা হয় Common sense, যেটা তোমার নেই।
_ তা অবশ্য ভুল বলো নি। আচ্ছা নন্দিতা।
_ হুম বলো।
_ আমাকে ছেড়ে থাকতে খারাপ লাগবে না?
_ সত্যি বলবো নাকি মিথ্যে?
_ অবশ্যই সত্যি বলবে। আমি মিথ্যা পচ্ছন্দ করি না।
নন্দিতা ঠান্ডা গলায় বললো,
_ না লাগবে না। সত্যিটা সবসময় শুনতে ভালো লাগে না জানি, তবুও মন খারাপ করো না।
রেহাল কিছুক্ষন চুপ করে থেকে বললো,
_ খারাপ না লাগার পেছনে বিশেষ কোনো কারন আছে কি?
নন্দিতা কিছু বললো না। রেহালের পাশে বসে তাচ্ছিল্যের হাসি হাসলো।
_ তুমি তৈরি হয়ে নাও। তোমার যাওয়ার সময় হয়ে এসেছে।
_ আমাকে এগিয়ে দিতে যাবে না?
_ যাবো।
রেহাল উঠে দাঁড়ালো। একটা একটা করে শার্টের বোতাম খুলতে শুরু করলো। আঁড়চোখে একবার নন্দিতার দিকে তাঁকালো। তার চোখে মুখে দুষ্ট হাসি। সে এগিয়ে এসে রেহালের শার্টের বোতাম ধরে বললো,
_ আমি খুলে দিচ্ছি।
রেহাল কোনো কথা বললো না। নন্দিতার উৎসুক চেহারার দিকে তাঁকিয়ে রইলো।
(চলবে….)
#মেঘের_বিপরীতে
পর্বঃ ৬

অর্চিতা তার বসের সামনে বসে আছে। লোকটি সুদর্শন এবং রুচিশীল। একবার দেখে বোঝা সম্ভব না তিনি বিবাহিত। কি জানি হয়তো খোঁজ নিলে দেখা যাবে উনার বাচ্চাও আছে। প্রতিদিন যখন অফিস থেকে বাসায় ফিরেন তখন তার দেড় বছরের মেয়ে গুটি গুটি পায়ে বাবার কাছে এসে ভাঙ্গা গলায় জিজ্ঞেস করে,
বাবা তক্কেট এনেতো?
চকলেট তো এনেছি, কিন্তু গালে একটা আপ্পি না দিলে তো দিবো না!
বাচ্চা মেয়েটা আনন্দে বাবার গালে চুমু এঁকে দেয়। বউ আড়াল থেকে তাঁকিয়ে দেখে আর মুচকি হাসে।

অর্চিতার অস্বস্তি লাগছে। বসের বাচ্চা যে মেয়েই হবে তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। এর চেয়েও বড় কথা কল্পনায় বসের স্ত্রীর জায়গায় সে নিজেকে দেখতে পাচ্ছিলো! কেনো এমন হলো? এসি রুমে বসেও অর্চিতা ঘামতে শুরু করলো।
টেবিলের ওপর পানির গ্লাস রাখা। রেহাল কোনো কথা না বলে গ্লাসের ওপর থেকে ঢাকনা সরিয়ে অর্চিতার দিকে পানির গ্লাসটা এগিয়ে দিলো। অর্চিতা এক নিশ্বাসে পুরো গ্লাস খালি করে ফেললো।
“আপনি ঠিক আছেন তো?”
অর্চিতা চমকে উঠলো। কি সুন্দর ভরাট কণ্ঠস্বর।
“জ্বি স্যার।”
“আপনাকে দেখে নার্ভাস মনে হচ্ছে।”
“একটু নার্ভাস লাগছে।”
রেহাল হেসে বললো,
” তাহলে তো সমস্যা। নার্ভাস লাগা যাবে না। সব সময় নিজের ক্ষেত্রে আত্মবিশ্বাসী হতে হবে।”
” জ্বি স্যার। ”
অর্চিতাকে দেখে কোনোভাবেই মনে হচ্ছে না সে আত্মবিশ্বাসী। তাকে দেখে যথেষ্ট বিচলিত বলে মনে হচ্ছে। প্রসঙ্গ পালটে রেহাল জিজ্ঞেস করলো,
” আপনার পরিবারে কে কে আছে?”
” মা, আমি এবং আমার ছোটভাই।”
রেহাল নিচু স্বরে জিজ্ঞেস করলো,
” আপনার বাবা?”
” বাবা দ্বিতীয় বিয়ে করেছেন। তিনি আমাদের সাথে থাকেন না।”
রেহাল অপ্রস্তুত হয়ে বললো,
” আই এম সর‍্যি, মিস. অর্চিতা।”
” নো স্যার! ডোন্ট বি সর‍্যি। ইটস টোটালি ওকে।”
” তাহলে পরিবার পরিচালনার দায়িত্ব আপনার মা একা হাতে সামলিয়েছেন?”
“জ্বি। মা প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষিকা। এছাড়া টিউশনি করে থাকেন। এভাবেই আমাদের সংসার চলছে।”
রেহাল টেবিলের ওপর এলোমেলো ভাবে পড়ে থাকা ফাইল গুলো গুছিয়ে রাখতে রাখতে বললো,
“এখন আপনিও সংসারে কন্ট্রিবিউট করতে চান তাই তো?”
অর্চিতা হেসে বললো,
” জ্বি স্যার।”
রেহাল একটি ফাইল হাতে নিয়ে অর্চিতার দিকে এগিয়ে দিলো।
” শুনেছি আপনি এমএক্সেলে পারদর্শী। আজ সেটা দেখতে চাই।”
অর্চিতা চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। ফাইল হাতে নিতে নিতে বললো,
” অবশ্যই স্যার। আমি চেষ্টা করবো।”
“মিস. অর্চিতা, মেয়েরা সব পারে। সৃষ্টিকর্তা নারীদের সৃষ্টিই করেছেন অত্যন্ত যত্নের সাথে। তাদের ঐশ্বরিক ক্ষমতা আছে। সেই ক্ষমতাকে কাজে লাগান। দেখবেন জীবনে কারো সাহায্য ছাড়াই অনেক দূরের পথ পারি দিতে পারবেন। উদাহরণ_ আপনার মা”
” থ্যাংক ইউ, স্যার।”
” ইউ আর ওয়েলকাম।”
রেহাল দেয়াল ঘড়ির দিকে তাঁকালো। এগারোটা বেজে দশ মিনিট। গুছিয়ে রাখা ফাইল গুলো থেকে একটি ফাইল বের করে রেহাল মনোযোগ দিয়ে পড়তে শুরু করলো। তাকে হঠাৎ করে অনেক বেশি ব্যস্ত দেখাচ্ছে। অর্চিতা ফাইল হাতে নিয়ে নিজের রুমের দিকে এগোতে থাকলো। এমন সময় রেহালের ভরাট কন্ঠ আরেকবার শোনা গেলো,
” মিস. অর্চিতা, ইন্টারকমে কালুকে বলে দিবেন আমাকে এক কাপ চা দিয়ে যেতে।”
” ওকে স্যার। আমি বলে দিচ্ছি।”
অর্চিতা থাই গ্লাস লাগিয়ে দিলো। ইন্টারকমে কালুকে দুই কাপ চায়ের কথা বললো। এক কাপ তার নিজের জন্য। কম্পিউটার অন করলো। ফাইল খুলে সেও কাজে ব্যস্ত হয়ে গেলো। কিন্তু এই ব্যস্ততার মাঝেও বেশ কয়েকবার অর্চিতার সামনে সেই একই চিত্র ভেসে উঠতে লাগলো। রেহাল তার দেড় বছরের মেয়ের সাথে খুনসুটি করছে। অর্চিতা বাপ মেয়ের কান্ড দেখছে আর মুচকি হাসছে!

চারিদিকে সন্ধ্যা নেমে এসেছে। অর্চিতা হাতির ঝিল এক নাম্বার সার্কুলারে দাঁড়িয়ে আছে। হাতে একটি ছোট্ট গিফট বক্স। ব্রিজের ওপর ঠান্ডা বাতাস। সূর্য একটু আগে পশ্চিমে গিয়ে মিলেছে। বেশ ভীড় এই জায়গাটায়। আজকে তার বেস্ট ফ্রেন্ডের রিলেশনশিপ এনিভার্সারি। সেলিব্রেশন করা হবে। এই যুগের মেয়েদের কাছে রিলেশনের চেয়ে রিলেশন সম্পর্কিত দিনগুলি বেশি গুরুত্বপূর্ণ। প্রথম দেখা কবে হয়েছিলো, হাত ধরা কবে হয়েছিলো, রিক্সায় ঘোরা কবে হয়েছিলো ইত্যাদি। মিনিট দশেক অপেক্ষা করার পর শাহরিনকে দেখা গেলো। আজ সে কালো এবং সাদা কম্বিনেশনের একটি শাড়ি পড়েছে। অসম্ভব সুন্দরী লাগছে তাকে। অর্চিতা এগিয়ে আসলো। গিফট বক্সটি এগিয়ে দিয়ে বললো,
” হ্যাপি এনিভার্সারি।”
শাহরিন হেসে বললো,
“থ্যাংক ইউ! তুই এখানে দাঁড়িয়ে আছিস কেনো? সামনেই তো রেস্টুরেন্ট। চল যাই।”
“নারে। আমি যাবো না। শরীরটা ভালো লাগছে না। তোর জন্যই এতক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিলাম। এখন বাসায় চলে যাবো।”
“পাগল নাকি? তুই আমার একমাত্র বেস্টফ্রেন্ড, আজ আমার এনিভার্সারি, আমরা সেলিব্রেট করবো আর সেখানে তুই থাকবি না? অসম্ভব। তুই আমার সাথে যাবি।”
” কিন্তু..”
“কোনো কিন্তু না। তাছাড়া আজকে তোর অফিসে ফার্স্ট দিন ছিলো না? সে সম্পর্কেও তো কিছু শোনা হয় নি।”
” ফার্স্ট দিন না সেকেন্ড দিন ছিলো।”
” সে যাই হোক। বসকে তো আজকেই ফার্স্ট দেখেছিস। সব শুনবো আমি। চল তুই।”
অর্চিতা বাঁধা দিলো কিন্তু কাজ হলো না। শাহরিন অর্চিতার হাত ধরে প্রায় টানতে টানতে রেস্টুরেন্টের দিকে এগোতে থাকলো।
চলবে…

লিখাঃ #Atia_Adiba

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here