#মেঘে_ঢাকা_আকাশ
#পর্ব_১
কলমে রোকেয়া পপি।
পলি যখন অফিস ছুটির পর ক্লান্ত শরীটা টেনে হিঁচড়ে পায়ে হেঁটে বাসায় ফিরছে। তখন সন্ধ্যা ঘনিয়ে চারদিকে অন্ধকার হতে শুরু করেছে। ওদের গলির মুখের ল্যাম্প পোস্টের লাইটটা আজ কয়দিন ধরে নষ্ট। অস্পষ্ট আলোয় পলি দেখলো ল্যাম্প পোস্টের নিচে একটা ছেলে একটা মেয়েকে জড়িয়ে ধরে চুমু খাচ্ছে। মেয়েটা বাঁধা দেওয়ায় চেষ্টা করছে, কিন্তু ছেলেটার শক্তির কাছে পেরে উঠছে না।
পলির মনটা খারাপ হয়ে গেল। এমন ভর সন্ধ্যায় ছেলে মেয়েরা রাস্তা ঘাটে দাঁড়িয়ে এমন আকাম কুকাম করে। ইচ্ছে করছিলো কষে একটা চড় দিতে। কিন্তু অকারণ ঝামেলা এখন আর ওর ভালো লাগে না। নিজের অজান্তেই একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে মাথা নিচু করে পলি চলে যেতে যেতে ভাবলো মেয়েটা দেখতে ঠিক জলির মতো। যদিও সে মুখটা দেখতে পায়নি ভালো করে। তবু ও মনের মধ্যে কেমন যেন একটা খচখচে ভাব।
আবার নিজেই নিজেকে স্বান্তনা দিয়ে বললো, কি যা তা ভাবছিস পলি! তোর ছোট বোন জলি মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষা দিয়েছে। কতো ব্রিলিয়ান্ট স্টুডেন্ট। দেখতে সুন্দর। ও কেন এমন রাস্তায় দাঁড়িয়ে বখাটে ছেলের সাথে জড়াজড়ি করবে।
পলি ক্লান্ত শরীর নিয়ে ঘরে ঢুকেই আগে জলিকে খোঁজ করলো। মলি এক গ্লাস পানি হাতে নিয়ে রুমে ঢুকে ওর বড়োপাকে দিতে দিতে বললো, কি ব্যাপার বড়োপা? বাসায় ঢুকতে না ঢুকতেই জলিকে খোঁজ করছো! কিছু লাগলে আমাকে বলো। জলি মোড়ের দোকানে চিনি আনতে গেছে।
মলির কথা শুনে পলির বুকটা ধরাস করে উঠলো। তাহলে কি ও যা ভেবেছে তাই সত্যি!
পলি রাগ দেখিয়ে বললো, এই ভর সন্ধ্যায় চিনি আনতে বাইরে যাওয়া কি খুব জরুরী? চিনি না খেলে কি সবাই মরে যাব!
আপা রাগ করছিস কেন?
তুই কতো ক্লান্ত হয়ে ফিরিস। তোর জন্য এক কাপ চা যদি না হয়, তাহলে আর তোর এতো কষ্ট করে কি লাভ। তোর কথা চিন্তা করেই তো চিনি আনতে পাঠালাম। আজকে সকালে ও কেউ চা খায়নি চিনির জন্য।
আচ্ছা ঠিক আছে। জলি আসলে আমার সাথে দেখা করতে বলবি।
ঠিক আছে আপা। তুই হাত মুখ ধুয়ে রেস্ট নে। আমি চায়ের পানি বসাই।
মলি দরোজার কাছে চলে গিয়েছে, এই সময় পলি পেছন থেকে ডেকে উঠল। এই মলি মা কোথায় রে? কোন সাড়া শব্দ পাচ্ছি না।
মায়ের দাঁত ব্যাথা বাড়ছে। পেইন কিলার খেয়ে চুপচাপ শুয়ে আছে।
পলি একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ওয়াশ রুমে চলে গেল হাত মুখ ধুতে।
পলিরা তিন বোন। তিন বোনই অসম্ভব রকমের সুন্দরী এবং মেধাবী। মলি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে পড়ড়ছে। নিজের পড়াশোনার খরচ নিজেই টিউশনি করে চালিয়ে নেয়।
আর পলি যখন এস এস সি পরীক্ষার পর রেজাল্ট পাওয়ার অপেক্ষায়। সেদিন ওর বাবা হঠাৎ করেই হার্ট অ্যাটাকে মারা যায় অফিসে বসেই।
তারপর পলিদের সংসার কিভাবে চলবে এই চিন্তা করে পলির মায়ের রিকোয়েস্টে পলির চাকরি হয় বাবার অফিসে।
জিগাতলায় বাবার করে যাওয়া এক তলা টিনশেড বাসাটা আছে জন্য রক্ষা। পলির স্বল্প আয়ে সংসার টা কোন রকম চলে যাচ্ছে।
জলি পা টিপে টিপে আস্তে আস্তে রান্না ঘরে ঢুকে একটা পিড়ি নিয়ে মলির পাশে বসতে বসতে বললো, এই মেজপা বড়োপা কি আমাকে খোঁজ করেছে?
হুম করছে। মেজাজটা খারাপ মনে হয়। অফিসে হয়তো কিছু হয়েছে। তোকে দেখা করতে বলেছে। এক কাজ কর। একটু মুড়ি মাখা কর। পেঁয়াজ, কাঁচা মরিচ, ধনিয়া পাতা কেটে রাখছি। এক গ্লাস পানি ও নিস। আমি চা নিয়ে আসতেছি। তিন বোন আজ মুড়ি মাখা দিয়ে চা খেতে খেতে ইচ্ছে মতো আড্ডা দিব।
আমি মুড়ি মেখে দিচ্ছি। মেজপা তুই নিয়ে যা। আমি চা বানাই।
ওমা সেকি কথা! তোকে দেখা করতে বলছে। তুই যাবি। আমি নিয়ে যাব কেন!
আমার ভয় করছে।
কেন তুই কি করছিস? ভয় করবে কেন শুধু শুধু?
আমি আবার কি করবো? কি যে বলিস না মেজপা।
আচ্ছা যা আমি নিয়ে যাচ্ছি। তুই তাড়াতাড়ি আয়।
আপা আসব?
আয়।
মেজপা তোমার জন্য চা নিয়ে আসতেছে। এসো আমরা মুড়ি মাখা খাই। তোমার জন্য ঝাল বেশি দিয়ে মুড়ি মাখা করছি।
টেবিলে রাখ। পরে খাব। আমার পাশে এসে বোস।
জলির গলা শুকিয়ে কাঠ কাঠ। মুখে কথা বের হচ্ছে না। ও তোতলাতে তোতলাতে বললো আপা মুড়ি নরম হয়ে যাবে। এসো আগে খাই।
হোক নরম। আমার পাশে বসতে বলছি। এসে বোস।
জলি ভয়ে ভয়ে পলির পাশে একটু দূরত্ব রেখে বসল।
ছেলেটার নাম কি?
কো..কো…কোন ছেলে বড়োপা?
একটু আগে যে ছেলেটা নষ্ট ল্যাম্প পোস্টের নিচে তোকে জড়িয়ে ধরে চুমু খাচ্ছিল।
জলির গলা দিয়ে কন্ঠস্বর বের হতে চাইছে না। ও মনে মনে ভাবছে আজ আমি শেষ। এই আপা নিজের পড়াশোনা বন্ধ করে আমার পড়াশোনার খরচ চালাচ্ছে। সংসারের কথা চিন্তা করে একের পর এক বিয়ে ভেঙে দিচ্ছে। আর আমি কিনা বড়ো দুবোন রেখে প্রেম করে বেড়াচ্ছি!
কিরে চুপ করে আছিস কেন? আমি তোকে একটা প্রশ্ন করেছি। উত্তর দে।
আপা আমার মনে হয় তুমি ভুল দেখছো। অন্য কাউকে দেখে আমাকে ভাবছো।
মলি যখন চা নিয়ে রুমে ঢুকছে, তখন ও থমকে দাঁড়িয়ে গেল। ওর শান্ত শিষ্ঠ আপা এভাবে জলিকে চড় মারতে পারে ও কল্পনাও করতে পারে না। আপা সবচেয়ে বেশি ভালোবাসে জলিকে। জলি পড়াশোনার পাশাপাশি টিউশনি করতে চাইছিল। আপা দেয়নি। আপার কথা হলো তোকে বড়ো ডাক্তার হতে হবে। তুই ভালো করে পড়াশোনা কর।
আপা নিজে হাতে গোনা চার পাঁচটা শাড়ি উল্টায় পাল্টায় পরে অফিস করে। কিন্তু জলি চাওয়া মাত্রই জলির সব আব্দার পূরণ করে। সেই আপা কিনা আজ জলির গায়ে হাত তুলছে!
মলি বিস্মিত হয়ে বললো, কি হয়েছে আপা? জলি কি করেছে?
পলি মুড়ি মাখা মুখে দিয়ে বললো কিছু না। দে চা দে। মাথাটা ধরেছে খুব।
জলির চোখ দুটো ছলছল করছে। ও ছুটে রুম থেকে বের হয়ে গেল লজ্জায় অপমানে।
মলির খুব খারাপ লাগছে। গলা দিয়ে মুড়ি মাখা নামছে না। চায়ে চুমুক দিয়ে দেখে চা টাও খুব বিস্বাদ লাগছে। ইচ্ছে করছে জলির কাছে গিয়ে আদর করে দুটো কথা বলতে। কিন্তু বড়োপার ভয়ে জলি চায়ের কাপ হাতে নিয়ে চুপচাপ বসে বসে বড়োপার কান্ড কারখানা দেখছে। ওর বড়োপা কি স্বাভাবিক ভাবেই না মুড়ি মাখা খাচ্ছে আর গরম চায়ে ফু দিয়ে চুমুক দিচ্ছে। যেন একটু আগে কিছুই হয়নি এ বাসায়।
রাতে খাওয়ার জন্য মলি বেশ কয়েকবার ডাকলো জলিকে। কিন্তু জলি নিজের রুমের দরজা খুললো না।
রাতে খেলো শুধু ওরা দু বোন। ওদের মা দাঁতের ব্যাথার ঔষুধ খেয়ে মরার মতো পরে আছে। সে জানিয়ে দিয়েছে তাকে যেন কেউ ডাকাডাকি না করে।
মলি রাতের খাবার ওর বড়োপার সাথে খেয়ে খাবার গুছিয়ে পলির রুমে এসে বললো, আপা আজ তোমার সাথে ঘুমাই?
কেন তোর রুমে কি হয়েছে?
জলি দরোজা খুলছে না। বললো আজ রাতে ও একা থাকতে চায়।
আচ্ছা ঠিক আছে শো।
মলি খুশিতে পলির পাশে শুয়ে শক্ত করে চেপে ধরে বললো, থ্যাংকু বড়োপা।
আরে কি করছিস। ছাড়। এভাবে কেউ ধরে। দম বন্ধ হয়ে মরে যাব তো।
মলি ওর বড়োপাকে খুব বেশি পছন্দ করে। আর রাতে ঘুমাতে তো আরো বেশি। মাঝরাত পর্যন্ত আপা অনেক মজার মজার গল্প করে। কিন্তু কিছুক্ষণ পর পর বলে এবার ঘুমাত মলি। সকালে আমার অফিস আছে।
জলি সারারাত কান্না করে চোখমুখ ফুলিয়ে ফেলেছে। ওর বারবার শুধু মনে হচ্ছে এ মুখ কিভাবে আপাকে দেখাব? আপা আর আমাকে বিশ্বাস করবে না। ওর কাছে একটা লুকানো বাটন ফোন আছে। সজিব ওকে গিফট করেছে। শুধু সজিবের সাথে কথা বলার জন্য। জলি এই ফোনটা সুইচ অফ করে রাখে। ওর সুযোগ মতো অন করে সজিবের সাথে কথা বলে আবার অফ করে রেখে দেয় লুকিয়ে। ফোনের ব্যালেন্স ও সজিব দেয়।
ও ফোন টা অন করে সজিব কে ফোন দিয়ে বললো, সজিব তুমি আমাকে আগামীকাল সকালে বিয়ে করতে পারবে?
সজিবের মনে হলো সে ভুল শুনছে। কারণ সজীব এর আগে অনেক বার বিয়ের কথা বলেছে। কিন্তু জলি রাজি হয়নি ওর বড়ো দু বোনের কথা বলে।
জলির এক কথা, আমার আপা আমাকে ডাক্তার হিসেবে দেখতে চায় জন্য নিজের ভালো ভালো বিয়ের প্রপোজাল রিজেক্ট করছে। সেই আপাকে রেখে আমি কিছুতেই লুকিয়ে বিয়ে করতে পারব না।
সজিব জানে জলির মতো ব্রিলিয়ান্ট স্টুডেন্ট ডাক্তার হয়ে গেলে আর কখনো ওকে বিয়ে করবে না। তাই সে চায় বিয়ে করে জলিকে ঘরবন্দি করে ফেলতে।
একবার যদি বিয়ে করে নিজের কাছে আনতে পারে, তাহলে ওর কথাই শেষ কথা। ও খুব ভালো করেই জানে জলির মতো ব্রিলিয়ান্ট সুন্দরীকে নিজের করে পেতে হলে বিয়ে করে পায়ে শিকল পরানোর কোন বিকল্প নেই।
চলবে…..