মেঘে ঢাকা আকাশ পর্ব -২০+২১

#মেঘে_ঢাকা_আকাশ
পর্ব_২০
কলমে রোকেয়া পপি

জলি আজ রিকশায় করে বাসায় ফিরছে। রিকশা চালক আকাশে মেঘ জমতে দেখে শর্টকাটে যাওয়ার জন্য এমন নিরিবিলি গলিতে রিকশা ঢুকাইছে, জলির কেমন যেন গা ছমছম করছে। ও ইচ্ছে করেই ওর শশুরকে আজ আসতে নিষেধ করে দিয়েছিল। ওদের বাসা থেকে কলেজের দূরত্ব খুব বেশি নয়। শুধু শুধু প্রতিদিন ওর জন্য কাজের ক্ষতি হোক জলি সেটা চায় না। এখন ওর মনে হচ্ছে না বলে খুব ভুল করছে। গাড়ি আসলে এতোক্ষণ বাসায় পৌঁছে যাওয়া যেতো।

আবার আকাশেও বেশ মেঘ জমেছে। একটু পর পর বিজলী চমকানোর শব্দে ও নিজেও চমকে উঠছে।
ও ভয়ে ভয়ে বললো, মামা আস্তে চালান।

রিকশা চালক জলির কথা শুনে যেন খুব মজা পেয়েছে। সে বত্রিশটা দাঁত বের করে ঘাড় ঘুরিয়ে বললো, আফা টাইট হইয়া বহেন। মতি পাগলার রিকশায় যখন উঠছেন। রিকশা অহন উড়াল পক্ষীর লাগান উইড়া উইড়া যাইব।
আকাশের অবস্থা দেহেন গো আফা। এই বৃষ্টি নামলো বলে।

মতির কথা শেষ হবার আগেই ঝিড়িঝিড়ি বৃষ্টি পড়া শুরু হয়ে গেল। মতি রিকশা থামিয়েছে সিটের ভেতর থেকে পলি বের করবার জন্য। সাথে সাথে চার পাঁচ জন ইয়াং ছেলের দল এসে জলির রিকশা ঘিরে ধরলো।

এমনিতেই ভর দুপুরে রাস্তায় লোকজন নেই। তার ওপরে শুরু হয়েছে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি। জলির সত্যি সত্যি খুব ভয় করছে। তারপরও ও ওপরে ওপরে ভয় না পাওয়ার অভিনয় করে বললো, কি ব্যাপার, কি চাইছেন আপনারা? এভাবে রিকশার চারপাশ আটকে দাঁড়ানোর মানে কি?

দলের ভেতর থেকে বাচ্চা মতো একটা ছেলে, যার মাত্র দাড়ি, গোফ বের হওয়া শুরু হয়েছে। দেখলেই বোঝা যায় ভালো ঘরের ছেলে। সে পকেট থেকে ক্ষুর বের করে বললো, আপু আপনার কানে গলায় যা আছে সব খুলে আমাদের দিয়ে দিন। তা না হলে এই ক্ষুরটা আপনার পেটের ভেতর চালান করে দিব।

জলি হাসি মুখে কানের দুলটা খুলতে খুলতে দেখলো দুই জন এদিক ওদিক চাইছে আর আগে পিছে নজর রাখছে, কেউ চলে আসলো কিনা।

জলি দুল আর চেন খুলে ছেলেটার হাতে দিতে দিতে বললো, তোমরা এই এমিন্টেশনের জিনিস গুলো নেওয়ার জন্য এভাবে রাস্তায় দাঁড়িয়েছো!
নিয়ে যাও ভাই। গতো মাসে টিউশনির টাকা দিয়ে নিউ মার্কেট থেকে দেড়শো টাকা জোড়ায় এই দুল কিনছিলাম। আর চেনটা হকারের কাছে আশি টাকা দিয়ে কিনছি। থাক ভাই তোমরা নিয়ে যাও। আমি আবার বেতন পেয়ে না হয় আরেক সেট কিনে নিব।
স্বর্নের জিনিস পরার তো আর আমাদের সামর্থ্য নেই। এগুলো পরেই শখ মেটাই।

ছেলেটা জলির কথা শুনে দাঁত কিড়মিড় করে রাগ দেখিয়ে বললো, ভালো জিনিস পরতে পারেন না! পরেন যতোসব দেড়শো দুইশো টাকার জিনিস।

দুল আর চেন জলির গায়ে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে গজগজ করতে করতে চলে গেল।
শুধু শুধু সময় নষ্ট। আজকের দিনটাই‌ মাটি। কি যে সব হাবিজাবি জিনিস দেশে বের হয়েছে। আসল, নকল চেনার উপায় নেই !

ছেলে গুলো চলে যাওয়া মাত্র মতি পাগলা ছুটে এসে পর্দা বের না করেই রিকশা প্যাডেল টানা শুরু করলো। সে ভয়ে একটু দূরে দাঁড়িয়ে ছিল এতোক্ষণ।

রিকশা চালাতে চালাতে মতি জিজ্ঞেস করল আফা একখান কতা জিগাই?

জলি চেন আর দুল জোড়া ব্যাগের পকেটে রেখে বললো, বলো মতি ভাই।

এগুলো কি আসলেই নকল জিনিস?

না মতি ভাই। এগুলো আসল সোনা। খাঁটি সোনার তৈরি। আমার শশুর বাবা আমাকে সব সময় পরে থাকার জন্য দিয়েছিলেন। আমি আমার শশুরের দেওয়া ভালোবাসার উপহার হারিয়ে ফেলতে চাই না। তাই একটু মিথ্যের আশ্রয় নিলাম।

আফা আপনে শুধু দেখতেই সুন্দর না, আপনার মাথায় বুদ্ধি ও অনেক। কিন্তু আফা আপনে তো ভিজা শেষ। ঠান্ডা না লাগে। হুডটা উঠায় দেই আফা?

হুড উঠাতে হবে না মতি ভাই। আমার খুব ভালো লাগছে টিপটিপ বৃষ্টি তে ভিজতে। তাছাড়া চলেও এসেছি প্রায়। একটু পরেই নামব।

আফা আমার এই জীবনে অনেক প্যাসেন্জার আমার রিকশায় উঠছে। ছিনতাইয়ের ঘটনাও কম ঘটেনি। কিন্তু আফনের মতো প্যাসেন্জার আমি আর একটাও পাইনি। আর এতো সুন্দর কইরা মতি ভাই বইলা কেউ সন্মান দিয়াও কতা কয় নাই। আল্লাহ আফনের অনেক বালা করবো আফা।

মতি ভাই সামনের গেটটায় থামান।

জলি বাসায় ফিরে দেখে নাটোর থেকে ওর রেবু ফুপি এসেছে। ফুপিকে নিয়ে সবাই খেতে বসেছে।

রেবু জলিকে দেখেই হৈ হৈ করে উঠে বললো, এ কি রে! তুই এমন ভিজছিস কেন? বাড়িতে একটা অনুষ্ঠান। অসুখ বিসুখ লাগায় বিছানায় পড়তে চাস নাকি!

জলি ব্যাগটা রেখে মিষ্টি করে হেসে বললো, আমার এতো অল্পতেই কিছু হয়না ফুপি। তোমরা খাও। আমি গোসল করে আসি।

কিরে তুই তো আমাকে এতো বছর পর দেখেও একটু সালাম করলি না! কেমন আছি সেটা ও জানতে চাইলি না!

ফুপির কথা শুনে জলি, মলি দুই বোনই ফিক করে হেসে ঠোঁট কামড়ে ধরলো।

জলি হাসিটা গিলে ফেলার চেষ্টা করে বললো, ফুপি খাওয়ার সময় তো সালাম করতে হয় না। তুমি খাওয়া শেষ করো। আমি ও গোসল সেরে আসি। তারপর তোমার পা দুটো ধরে বসে থাকবো।

এবার জলির মা ও মিটমিট করে হাসতে হাসতে বললো, তুই কিছু মনে করিস না রেবু। ছোটদের কথা ধরতে হয় না।

ছোট কোথায় ভাবি? মেয়ে ডাক্তারি পড়ছে। বড়ো দুবোন রেখে একাই বিয়ে করে ফেলেছে। এখন আর ছোট বলে কি পার পাবে!

জলি ওয়াশ রুমে ঢুকতে ঢুকতে ওর ফুপির কথা গুলো শুনতে পেলো। এসব কথা শুনতে এখন আর ওর ভালো লাগে না। ও যতো চেষ্টা করছে সজীবকে ভুলে থাকার। ততোই সবাই মিলে আঙ্গুল দিয়ে মনে করিয়ে দিচ্ছে।

খুব মন খারাপ নিয়ে ও বড়োপার ওয়াশ রুমে গোসল করতে ঢুকলো। ওয়াশ রুমে ঢুকেই মনটা একদম ভালো হয়ে গেল। কি সুন্দর ঝকঝকে তকতকে পরিষ্কার বাথরুম। এমন সুন্দর শুকনো বাথরুমে পানি ঢেলে ভিজাতেও কষ্ট লাগে। ওর বড়োপার একটু পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার বাতিক আছে। অফিস করেও সে বাসায় এসে সবকিছু পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করে সাজিয়ে গুছিয়ে রাখে।

জলির ও অসুন্দর কোন কিছুই ভালো লাগে না। যদিও তাকে বসবাস করতে হয় অসুন্দরের মাঝেই।
চারদিকে আরেকবার তাকিয়ে দেখলো, কি সুন্দর করে সাজানো বাথরুম। আপা শশুর বাড়ি চলে যাওয়ার সাত দিনের মধ্যেই এই বাথরুম হয়ে যাবে অপরিস্কার বাথরুম।

জলি একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে গায়ে পানি ঢালতে লাগল। ঠান্ডা পানি গায়ে ঢালতে খুব আরাম লাগছে। সারাদিনের ক্লান্তির পর এতো আরামে চোখে ঘুম এসে যাচ্ছে। ইচ্ছে করছে পানি ঢালতে ঢালতে বাথরুমেই ঘুমিয়ে পড়তে। জলি গুন গুন করে গান ধরলো,

অলির ও কথা শুনে বকুল হাসে
কই তাহার মতো তুমি আমার কথা শুনে হাসো না তো।।
ধরার ও ধুলিতে যে ফাগুন আসে
কই তাহার মতো তুমি আমার কাছে কভু আসো না তো।।

জলি মাথায় গামছা পেঁচিয়ে খাবার টেবিলে এসে দেখে সবার খাওয়া শেষ। রেবু ফুপি মায়ের বিছানায় বসে জমিয়ে গল্প করছে। ও গিয়ে ওর ফুপির পা দুটো চেপে ধরে বললো, এই তোমার পা ধরলাম, সালাম করলাম। এখন সালামী না দেওয়া পর্যন্ত আর পা ছাড়ছি না।

দেখতে শুনতে তো ভালোই সুন্দর হয়েছিস। তা মাথা ভর্তি এতো দুষ্টু বুদ্ধি কেন রে? আমি কি টাকার গাছ সাথে করে নিয়ে এসেছি নাকি। ছাড় ছাড় পা ছাড়।

জলি হাসতে হাসতে পা ছেড়ে ফুপিকে জড়িয়ে ধরে বললো, সালাম নিবা অথচ সালামী দিবা না, তাহলে তুমি আমার কেমন ফুপি বলো তো?

রেবু পান মুখে দিয়ে বললো, হয়েছে হয়েছে আর পাকনামি করতে হবে না। সেই ছোট্ট বেলা থেকেই তো খালি পাকা পাকা কথা।

ওমা তাই। আমি ছোট থেকেই পাকা পাকা কথা বলি বুঝি? তা একটা গল্প বলো না ফুপি আমার ছোট বেলার গল্প গুলো খুব শুনতে ইচ্ছে করে।

শোন তোরা তিন বোন যখন খুব ছোট ছিলি, একদম শরীরে কোন মাংস ছিল না। পাট খড়ির মতো শুকনা ছিলি। আমি যখনি জিজ্ঞেস করতাম কিরে তোদের মা এতো মোটা, তোরা এমন শুকনা কেন? সব খাবার কি তোর মা একাই খায়?

তখন তুই বলতি, মা আমাদের তিন বোন কে প্লেটে ভাত দিয়ে নিজে খায় গামলাতে। তাই আমরা প্লেটের মতো শুকনা। আর আমার মা গামলার মতো মোটা।

ফুপির কথা শুনে জলি আর মলি হাসতে হাসতে গড়াগড়ি। রেবু হুট করে হাসির মাঝে প্রশ্ন করে বসলো, শুনলাম তো খুব টাকা ওলা ঘরে বিয়ে করছিস। তা চলে এলি কেন?

রেবুর এমন আকর্ষিক প্রশ্নে ঘরের মধ্যে নিরবতা নেমে এলো।

জলি ঠোঁটের কোণে হাসি ঝুলিয়ে রেখেই বললো, ফুপি তেল আর জল কখনো একসাথে মিশে না। মেশানোর জন্য অনেক ঝাঁকা ঝাঁকি করতে হয়।
আমার এতো ঝাঁকা ঝাঁকি করতে ইচ্ছে করেনি। তাই নিজের থেকেই চলে এসেছি।

আর শোন আমি এখন একটু ঘুমাব। কেউ আমাকে ডাকাডাকি করবে না।

জলির মা আৎকে উঠে বললো, সে কি রে খাওয়া দাওয়া না করে ঘুমাবি মানে কি! সেই সকালে দুটো রুটি খেয়ে কলেজে গেছিস। চারটা ভাত খেয়ে তারপর ঘুমা। কেউ তোকে ডাকবে না।

মা আমার খিদে নেই। আমি ঘুমাতে গেলাম। যদি ভূমিকম্প ও হয়ে যায়, তবুও কেউ আমাকে ডাকবে না।

চলবে…#মেঘে_ঢাকা_আকাশ
পর্ব_২১
কলমে রোকেয়া পপি

জলি সন্ধ্যা পর্যন্ত ঘুমালো। ঘুম থেকে ওঠা মাত্র ওর মা এক কাপ চা নিয়ে রুমে ঢুকলো। এই মেয়েটা তার বড়ো আদরের নাড়ি ছেঁড়া ধন। এই বয়সেই মেয়েটা সমাজের কতো কঠিন রুপ দেখে ফেলেছে। এসব ভেবে তিনি মনে মনে একটা দীর্ঘশ্বাস গোপন করলেন। মেয়েটা সারাদিন না খাওয়া সেটা নিয়েও তার মন খারাপ হয়ে আছে। রেবুটা ওভাবে সরাসরি কথা না বললে মেয়েটা হয়তো তখন খেতে বসতো।

এই রেবুও পরিবারের খুব আদরের ছোট মেয়ে। বিয়ের পর বছরে দুই তিন বার করে আসতো এ বাড়িতে। জলির বাবাও বোন বলতে অজ্ঞান ছিল। রেবুর সংসারে সব সময় আর্থিক টানাপোড়ন লেগেই থাকতো। আর টাকার দরকার পড়লেই চলে আসতো ভাইয়ের কাছে। জলির বাবার যে খুব টাকা পয়সা ছিল তা নয়। তবুও সে কিভাবে কিভাবে বোনকে টাকা ম্যানেজ করে দিতো। আর বোন আসলেই বাজার করে ঘর ভরে ফেলতো।

সেই রেবু, ভাই মারা‌ যাওয়ার পর এ বাড়িতে আসা বন্ধ করে দিলো। প্রথম প্রথম দুই একবার যদিও এসেছে। কিন্তু যখন দখলো তিনটা বাচ্চা নিয়ে আমি খেয়ে না খেয়ে দিন কাটাই। তখন তার এ বাড়িতে আসার ইচ্ছেটাই মরে গেল। হয়তো নিজের পকেটের টাকা খরচ করে এসে হাবিজাবি খাবার খেয়ে তার আর পোষাচ্ছিল না। কারণ ভাই তো যাওয়া আসার ভাড়াটাও দিয়ে দিতো।

এতো বছর পরও হয়তো আসতো না। যদি না বিয়ের দাওয়াত না দেওয়া হতো।

জলি নরম সুরে বললো, মা কি ভাবছো চায়ের কাপ হাতে নিয়ে?

না কিছু না রে মা। মায়েদের ভাবনার কি আর শেষ আছে। চা টা বোধহয় জুড়িয়ে গেছে। আমি গরম করে নিয়ে আসি আবার।

কিছু করতে হবে না মা। আমি এখন আর বেশি গরম চা খেতে পারিনা। দাও চা দাও। জলি হাত বাড়িয়ে চায়ের কাপ নিয়ে চুমুক দিলো।

দুপুরে তো ভাত খেলি না মা। ফ্রিজে এক প্যাকেট কাচ্চি আছে সেদিনের। গরম করে দেই?

তোমাকে কিছুই করতে হবে না মা। খিদে পেলে আমি নিজেই গরম করে নিব। তুমি কি কিছু বলতে চাও?
তোমার মুখ দেখে মনে হচ্ছে কিছু বলতে এসেছো।

না মানে, বলছিলাম কি তোর মামার বাড়ি যাবি নাকি একবার। বাসায় গিয়ে দাওয়াত দেয়া দরকার না?

কেন ফোনে বললেই তো হয়?

ফোনে তো দাওয়াত দিছি। আমার ভাগের সম্পত্তির অংশ বিক্রি করে টাকা দেওয়ার জন্য আবারো বলছিলাম। তখন কথার সুর কেমন যেন লাগলো। রাগ করে যদি না আসে, বিষয়টা খারাপ দেখাবে না।

হুম বুঝলাম। কিন্তু যাবে কে?

চল না আমি আর তুই মিলে কাল সকালে চলে যাই। তোর ফুপি আছে, এদিকটা না হয় সে সামলে নিবে। বিয়ের কনেদের তো আর নিজের বিয়ের দাওয়াত দিতে পাঠানো যায় না।

তোমার এই শরীর নিয়ে সেই মানিকগঞ্জ গিয়ে কাজ নেই মা। আমি একাই যাব।

তুই পারবি একা যেতে?

না পারার কি আছে! তোমার মেয়ে এখনো কি সেই ছোট্ট খুকিটি আছে নাকি।

আচ্ছা বেশ, তবে তাই হোক। হাতে তো আর সময় ও নেই।

বিয়ের কথা পাকাপাকি হবার পর থেকেই মারুফের মা প্রতিদিন শপিং মলে দৌড়াতে দৌড়াতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। তারপরও যেন‌ কেনাকাটা শেষ হচ্ছে না।
আজকে তিনি মারুফ কে বললেন, বাবা মারুফ বলছিলাম কি, সব কেনাকাটা তো আমিই করলাম আমার পছন্দ মতো। তুই যদি এখন বিয়ের শাড়ি টা টুকটুকের মাম্মাম কে সাথে নিয়ে কিনতি তাহলে খুব ভালো হতো।

মা আমাকে আবার এসবের মধ্যে জড়াচ্ছো কেন?
তুমি নিজেই তো কিনতে পারো!

আমি তো পারি। কিন্তু সব মেয়ের বিয়ে নিয়ে একটা স্বপ্ন থাকে। বিয়ের শাড়ি কেমন হবে সেটা নিয়ে ও তাদের প্লান থাকে। আর তাছাড়া বিয়ের আগে তোরা দুজনে একটু নিজেদের মতো ঘুরলি, কথা বললি।

মারুফের যদিও খুব ইচ্ছে করছে মলির সাথে সময় কাটাতে। চোখের সামনে মিষ্টি মুখটা ভেসে ওঠা মাত্র ওর কেমন যেন এক শিহরণ খেলে গেল পুরো শরীরে। কিন্তু মুখে বললো অন্য কথা।

আমার আলাদা করে কথা বলার কোন দরকার নেই মা। তুমি টুকটুক আর ওর মাম্মামকে নিয়ে কিনে ফেলো যা যা বাকি আছে।

জলিকে দেখে ওর বাবু মামা ব্যাতি ব্যাস্ত হয়ে পড়লেন কি থুয়ে কি করবেন সে নিয়ে। হৈচৈ করে‌ বাড়ি মাথায় তুললো। পারু কোই রে? দেখে যা কে এসেছে।
তারপর কোমল গলায় বললেন, জলি বোস মা। আমার কাছে এসে বোস।

মামা বাসায় কেউ নেই? এতো চুপচাপ কেন?

আছে মা সবাই আছে। তোর মামি গেছে বিনুকে নিয়ে স্কুলে। কি কাজ টাজ আছে নাকি। স্কুলে ঢুকিয়ে দিয়ে কাজ শেষ করে বিকেলে একবারে বিনুকে সাথে নিয়ে ফিরবে বলে গেছে।

আর বলিস না , এই মহিলা একটা বজ্জাত মহিলা। আমার জীবনটা তেনা তেনা করে দিলো। যতোক্ষণ বাসার বাইরে থাকে, ততোক্ষণ আমার শান্তি।আর পারু বাসায় আছে।

মামার কথা শেষ হবার আগেই পারু এসে দাঁড়ালো দরজা ধরে। স্মিত হেসে চুপ করে রইলো। মুখে কোন কথা নেই।

বাবু মামা বললেন এভাবে দেবের চাটির মতো দাঁড়িয়ে আছিস কেন? জলির জন্য চা বানা। দেখ ঘরে কি আছে না আছে। ভালো মন্দ রান্না কর। কতোদিন পর আসলো আমার মা টা।

একটা সময় এই বাবু মামা ওদের তিন বোনকে খুব স্নেহ করতেন। প্রতি ঈদে তার দুই মেয়ের সাথে জলিদের তিন বোনের জন্য ও নতুন জামা কিনতেন।
চাঁদ রাতে মানিকগঞ্জ থেকে ঢাকা চলে আসতেন জামা দিতে। আর জলির জামাটা সব সময় সবার চেয়ে বেশি সুন্দর হতো।

দিন কিভাবে বদলে যায়, বদলে যায় মানুষ। নানা বাড়ির সম্পত্তির অংশ যেদিন মা চাইলো, সেদিন থেকে সম্পর্কের অবনতি।

মামা আমি তো বেশিক্ষণ থাকবো না। বাসায় অনেক কাজ। মা সুস্থ থাকলে নিজেই আসতো। তোমরা বৃহস্পতিবার সবাই মিলে চলে এসো আমাদের বাসায়। বুঝোয় তো একসাথে দু দুটো বিয়ে। কতো প্রেসার যাচ্ছে আমাদের ওপর দিয়ে।

তোদের বাসায় সবাই মিলে গিয়ে থাকব কোথায় শুনি? পাখির বাসার মত ছোট ছোট তিন কামড়া। ঐ তিন কামড়া তো আমাদেরই লাগবে। হা হা হা।

আমি শুক্রবার সকালেই চলে আসব।
অনেক প্যারার মধ্যে থাকি বুঝলি মা। সবচেয়ে বড় কথা সংসার অচল। তার ওপরে পারু তার দুই বাচ্চা নিয়ে এ সংসারে উঠে এসেছে। আয় নাই, ব্যায় বাড়ছে বহুগুণ।
কতো বড়ো ঘর দেখে মেয়ে বিয়ে দিলাম। মেয়েটা পড়াশোনা করতে চাইলো। আমি জোর করে টাকা আলা ছেলে দেখে বিয়ে দিয়ে দিলাম। পাঁচটা বছর সংসার করতে না করতেই মেয়ে আমার বিধবা হয়ে মাছুম দুই বাচ্চার হাত ধরে বাপের বাড়ি এসে উঠলো।

এখন তুই বল, তোর মা যে সম্পত্তির অংশ বিক্রি করে টাকা দিতে বলে। আমি কোথা থেকে দেই। দুই চার গন্ডা যা জমি আছে, এই দিয়েই তো বেঁচে আছি।

তা তোর খবর কি রে মা?
কিছু কিছু শুনলাম।

কিসের খবর মামা?

তুই নাকি একবারে চলে এসেছিস। আর ফিরবি না।

হুম।

কেন? কি এমন হয়েছিল যে চলে আসতে হলো?

সে অনেক কথা মামা। আরেকদিন বলবো।
আজ উঠি। মামির সাথে দেখা হলো না।

সে কি রে! এখনি উঠবি কি! কিরে পারু চা বানাতে কয় বছর লাগে? চা বানাতে কি আসমানে গেছিস? এদের দিয়ে কোন কাজ ঠিক মতো হয় না। সব কয়টা অকর্মার ঢেকি।

মামা তুমি থামবে। আমি চা নাস্তা খেয়েই বের হয়েছি।

পারু চুপচাপ সামনে দু কাপ চা আর একটা পিরিচে চারটা টোস্ট বিস্কুট রেখে সরে গেল।

পারু আপু বসো না। তুমি এভাবে দূরে দূরে থাক কেন?

জলির কথা শুনে পারু হাসলো ঠিকই। কিন্তু সে হাসিতে কোন প্রাণ নেই। কি মলিন মুখ খানা। দেখলেই মায়া হয়।

জলির বুক চিরে একটা দীর্ঘশ্বাস বের হয়ে আসলো।
মানুষের কতো রকম কষ্ট! একেক জন মানুষের একেক রকম কষ্ট! কারোটা দেখা যায়, কারোটা দেখা যায় না।
আর আমরা দূর থেকে ভাবি মানুষটা কতো সুখি!

চলবে.…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here