মেঘে ঢাকা আকাশ পর্ব -১২+১৩

#মেঘে_ঢাকা_আকাশ
#পর্ব_১২
কলমে রোকেয়া পপি।

আমি চাইলেই আমার বাসায় রেখে মেয়েটার স্বপ্ন পূরণ করতে পারি। কিন্তু আমি সেটা চাই না।

কেন আপনার বাসায় থেকে পড়লে সমস্যা কোথায়?

সমস্যা আছে গো মা। ভয়ঙ্কর রকমের সমস্যা আছে।
মেয়েটা পড়াশোনা করবে ঠিকই। কিন্তু ভয়ঙ্কর রকম যুদ্ধ করে প্রতিটা দিন শুরু হবে ওর। মানসিক অশান্তির মধ্য দিয়ে শেষ হবে দিন। ওকে সুস্থ এবং স্বাভাবিক থাকতে দিবে না আমার ছেলে এবং ছেলের মা। কারণ ওরা চায় না জলি ডাক্তার হোক, নিজের পায়ে দাঁড়াতে শিখুক।

মাগো জীবনে অনেক টাকা ইনকাম করছি। খরচ করার পথ বন্ধ। একটা মাত্র ছেলে, অথচ হয়েছে অমানুষ। হাতে টাকা পেলেই মদ, গাজা খেয়ে রাস্তায় পড়ে থাকে।
তাই আজ যখন আমি টাকা খরচের পথ পেয়েছি, তখন জলির জন্য যা করনীয় সব আমি করবো।
তোমরা শুধু ওর পাশে থেকে একটু সাপোর্ট দিও তাহলেই হবে।

আজ আমি উঠি মা।

সে কি! উঠি মানে কি! কিছু মুখে না দিয়ে আপনি যেতে পারবেন না। মা শুনলে খুব কষ্ট পাবেন।

ওদের কথোপকথনের মাঝে জলি এসে বিনীতভাবে বললো বাবা আসেন। চা করেছি, চা খাবেন।

সরফরাজ খান দেখলেন অল্প সময়ের মধ্যে অনেক আয়োজন করে ফেলেছে এরা। মিষ্টি, ফল, ভাজা পোড়া দিয়ে সাত আট আইটেম। তিনি চেয়ার টেনে বসতে বসতে বললেন, মাগো আমি তো এখন এসব কিছুই খাব না। তুমি বরং আমাকে এক কাপ চা দাও।

চা আনতেছি বাবা। আপনি সবজি পাকোড়া টা খেতে থাকেন। এটা আমি ঘরে তৈরি করেছি।

জলির এখনো ক্লাস শুরু হয়নি। তারপরও মেডিকেল হোস্টেলে সিট পাওয়ার জন্য খুব চেষ্টা করছে। সজীব প্রতিদিন জলিদের বাসার সামনে এসে দাঁড়ায় থাকে ঘন্টার পর ঘন্টা। বাসায় মোটামুটি সবাই খুব বিরক্ত এই ব্যাপারটায়। জলি খুব ভালো ভাবেই বুঝতে পারছে সজীবের কারণে বাসা থেকে প্রতিদিন ক্লাস করা ওর জন্য কতোটা উদ্বেগের হতে পারে। এই ছেলে সহজে জলিকে ছাড়বে না।

সন্ধ্যার পর মলি জলি কে নিয়ে ছাদে উঠলো। ওদের দুটো রুমের ওপর ছাদ দেওয়া। বাকিগুলোর ওপর টিনের চাল। একটা মই আছে। বিশেষ কোনো প্রয়োজন হলে ছাদে ওঠা হয়। যেমন আচার বানাতে বা শীতের লেপ তোষক রোদে দেওয়ার দরকার পড়লে ছাদে ওঠা হয়।

আজ মলি ইচ্ছে করে জলিকে নিয়ে ছাদে উঠেছে। ইদানিং জলি সবসময় মনমরা হয়ে থাকে। আগের সেই প্রাণ চঞ্চলতা নেই। ও চায় জলির পেটের ভেতর জমে থাকা কথা গুলো বের করে আনতে।

তোর কি হয়েছে জলি?

কোই কিছু হয়নি তো মেজপা। আমার আবার কি হবে!

তাহলে সবসময় মুখটা এমন অন্ধকার করে রাখিস কেন?

কিছু ভালো লাগে না রে আপা। সবকিছু কেমন যেন পানসে লাগছে।

তা তো লাগবেই। বিয়ের এক সপ্তাহ না হতেই চলে এসেছিস রাগ করে। ওদিকে তোর মজনু সাহেব প্রতিদিন বাসার সামনে এসে অনশন করে। আশেপাশের মানুষরা এগুলো দেখে মজা নেয়। আমাদের তো এখন রাস্তায় বের হতেই লজ্জা লাগে।
তোর জন্য যে ছেলেটা এতো পাগল, তার কাছে ফিরে গেলেই তো হয়।
এতো নাটক করার কি দরকার?

তা হয় না মেজপা।

কেন হয় না? আমি তো দেখছি ছেলেটা তোকে সত্যি সত্যি খুব ভালোবাসে। সত্যি কারের ভালবাসা না হলে কেউ এমন করে রোদ বৃষ্টি মাথায় নিয়ে দিনের পর দিন রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না।

ওগুলো সব নাটক মেজপা।
আমি এই কয়দিনে এতো ভয়ঙ্কর ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়েছি যে সজীব কে দেখলেই আমার বমি আসে। ও আমাকে এতো বেশি শারীরিক কষ্ট দিয়েছে যে আমি ওকে কখনো ক্ষমা করতে পারবো না।

তারপরও আরেক বার ভেবে দেখ। ও হয়তো ওর ভুলটা বুঝতে পেরেছে। এখন হয়তো আর সেই ভুল করবে না।

মেজপা তুমি হঠাৎ করে সজীবের পক্ষে সাফাই গাইছো কেন?

সাফাই গাওয়ার কি আছে! মানুষ চেন্জ হয় না।
তাছাড়া সেদিন রাস্তায় যেভাবে এসে আমার হাত চেপে ধরে হাউমাউ করে কান্না শুরু করলো । আমি তো লজ্জায় শেষ। আশেপাশের মানুষরা তো এমনিতেই তিলকে তাল বানাতে ওস্তাদ। পরে আমরা একটা রেস্টুরেন্টে গিয়ে বসলাম কি বলতে চায় শোনার জন্য।

খুব কান্না করছিলো ছেলেটা। বারবার বলছিলো জলিকে এনে দিন আপা। আমি আর কখনো জলির অসন্মান হয় এমন কোন কাজ করবো না। তবুও আপনি আমাদের মিলিয়ে দিন। ও চলে আসার পর বুঝতে পেরেছি ও আমার জীবনে কি ছিল।

এখন তুই ভেবে দেখ, কি করবি। বিয়ে তো কোন ছেলে খেলা নয়। একবার যখন বিয়ে হয়ে গেছে, তখন তো ঐ ছেলের সাথেই তোর সংসার করতে হবে তাই না?

আপা ভিতুরা মরার আগেই বারবার মরে যায়। আমি ভিতু না। আমি যথেষ্ট সাহসী একটা মেয়ে। আমি একবার ভুল করে ওর ফাঁদে পা দিয়েছি। আর নয়।
জেনে শুনে আমি আর ঐ ভয়ঙ্কর খাঁচায় বন্দী হতে চাই না।

ও যে কতটা ভয়ংকর তুই কল্পনাও করতে পারবি না মেজপা। আমার যদি সুযোগ থাকতো তবে আমি ওকে চরম শাস্তি দিতাম।

মলি হালকা গলায় বলল, তাই শাস্তি দিতে চাস?
তোর যদি খুন করার কোনো পরিকল্পনা থাকে, আমি তোকে সাহায্য করতে পারি। আমার এক বান্ধবী আছে কেমিস্ট্রি ডিপার্টমেন্টে পড়ে। ওর নাম নবনী। ওকে বললেই সে পটাশিয়াম সায়ানাইড জোগাড় করে দিবে। তুই শুধু সজীবের খাবারের সঙ্গে মিশিয়ে দিবি। কেল্লা ফতে। পারবি না?

জলি মুখ কঠিন করে বললো, না।

তাহলে আর কি করার আছে। তোর সমস্যা তুই সমাধান কর। তবে কখনো যদি মনে হয় পটাশিয়াম সায়ানাইড লাগবে, তাহলে আমাকে একদিন আগে বললেই হবে। আমি জোগাড় করে রাখব।

জলি ক্লান্ত ভঙ্গিতে ওর মেজপার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে নিচে নেমে গেল। ওর কাছে মনে হচ্ছে অতিরিক্ত পড়তে পড়তে আর অভাব অনটনে থাকতে থাকতে ওর মেজপার মাথা সত্যি সত্যি খারাপ হয়ে গেছে। কোন সুস্থ মানুষ এ ধরনের আচরণ করতে পারে না।

আকাশ মেঘলা। একা একা ছাদে থাকলেই ও খুব মনোযোগ দিয়ে তারা দেখে। কিন্তু আজ মনে হয় তারা দেখা যাবে না। কেমন মেঘে ঢাকা আকাশ। কোথা থেকে যেন ঠান্ডা বাতাস ও আসছে। মনে হয় আশেপাশে কোথাও বৃষ্টি হচ্ছে। ওর ইচ্ছে করছে কেউ এক মগ কফি এনে ওর হাতে ধরিয়ে দিতো।
ছাদে হাঁটাহাঁটি করতে করতে কফি খাওয়ার মজাই আলাদা।

ও বেতন পেয়ে ছোট একটা কফির বৌয়ম কিনে ওর পড়ার টেবিলের ড্রয়ারে তালা দিয়ে রাখছে। যখন খুব খেতে ইচ্ছে করে তখন বের করে ঘরের দরজা বন্ধ করে চুপিচুপি খায়। কারণ ওর বড়োপা দেখলেই রাগ করে বলবে, যাদের কপালে তিন বেলা ঠিক মতো ভাত জুটে না তাদের আবার কফি খেতে ইচ্ছে করবে কেন!
ওর বড়োপা অবশ্য ইদানিং সবকিছুতেই রাগ করে। রিকশায় করে বাসায় ফিরতে দেখলে রাগ করে। ভালো একটা দামী ড্রেস পরতে দেখলেও রাগ করে। একটু দেরি করে ফিরলে রাগ করে। এই যে এখন ছাদে উঠে হাঁটাহাঁটি করছে, এটা টের পেলেও রাগ করবে।

তো এই যে অসময়ে মলির এখন কফি খেতে ইচ্ছে করছে, ও চাইলেই নিচে গিয়ে কফি বানিয়ে আনতে পারে। কফি ওর ঘরেই আছে। কিন্তু কফি বানিয়ে আবার ছাদে উঠতে হবে এই চিন্তা করে আর ইচ্ছে করছে না নিচে নামতে।
মলি মনে মনে ভাবলো, তারচেয়ে বরং শুদ্ধ কে নিয়ে ভাবা যায়। আর দুটো পরীক্ষা আছে। শুদ্ধ বলেছে পরীক্ষা শেষ হলেই ওর বাবা মা বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আমাদের বাসায় আসবে। আপা কি মেনে নিবে এই বিয়ে! আপাকে রেখে আমারো তো শশুর বাড়ি যেতে একদম ইচ্ছে করছে না।

হ্যালো এতো মনোযোগ দিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে কি দেখছেন?

মলির ভাবনার সুতো কেটে গেল অপরিচিত এক কন্ঠস্বর শুনে। ও তাকিয়ে দেখলো পাশের ছাদে বেশ হ্যান্ডসাম একটা ছেলে কফির মগে চুমুক দিতে দিতে ওকেই প্রশ্ন করছে?

আপনি কি আমাকে বলছেন?

জি আপনি ছাড়া তো আর কাউকে দেখছি না।

সরি আপনি কি জানতে চেয়েছেন আমি ঠিক খেয়াল করিনি।

এতো মনোযোগ দিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকলে তো খেয়াল না করারই কথা।
বলছিলাম কি দেখছেন?

মলি ম্লান হেসে বললো তারা দেখছি।

ওসব তারা ফারা দেখা কোন কাজের কথা নয়। তারচেয়ে আসুন আমরা গল্প করি। আমি খুব জমিয়ে আড্ডা দিতে পারি। আমার সাথে গল্প করলে আপনার অনেক ভালো লাগবে।

কি আশ্চর্য! আপনাকে চিনি না, জানি না, আপনার সাথে আমি কি গল্প করবো?
আমি এখন নিচে নামব।

আহা থাকুন না আরেকটু সময়। আপনার সাথে কথা বলতে খুব ভালো লাগছে।

অদ্ভুত তো! আপনার ভালো লাগলে আমাকে থাকতে হবে কেন? আজাইড়া!

ঠিক আছে থাকতে ইচ্ছে না করলে চলে যাবেন। তবে যাওয়ার আগে আপনার ফোন নাম্বার টা যদি দিতেন। তাহলে রাতে আমি ফোন দিতাম।

মলি মনে মনে বললো, ভালো পাগলের পাল্লায় পরেছি তো। ও তাড়াহুড়ো করে নেমে আসলো নিচে।

চলবে…#মেঘে_ঢাকা_আকাশ
#পর্ব_১৩
কলমে রোকেয়া পপি

আজকের দিনটা শুরু হয়েছে খুব খারাপ ভাবে। সকাল থেকেই বিরাট এক ঝামেলা। লায়লা বেগম জ্বরে অচেতন। তার মুখ দিয়ে লালা ভাঙছে। মলি আর জলি মিলে এসে মাকে এক রকম কোলে করে বিছানা থেকে নিচে নামিয়েছে। রিকশা করে হাসপাতালে নিয়ে যাবে। গায়ের সাথে হেলান দিয়ে জলি মাকে শক্ত করে ধরে রেখেছে। আর মলি পাগলের মত রিকশা খুঁজছে এদিক ওদিক তাকিয়ে।

মলি কে দেখে গতোকাল রাতের সেই ছেলেটি এগিয়ে আসলো। এক্সকিউজ মি, কোন সমস্যা?

মলির এখন আর ভাব নিতে ইচ্ছে করছে না। কারণ ওর মায়ের জ্ঞান নেই। ও খুব ক্লান্ত ভঙ্গিতে বললো আমার মা খুব অসুস্থ হয়ে পড়ছে। হাসপাতালে নিতে হবে। আমাকে একটা রিকশা ডেকে দিবেন প্লিজ।

কিছু মনে না করলে আমার গাড়িতে লিফট দিতে পারি। আপনি আপনার মাকে নিয়ে আসুন।

মলি ঠিক বুঝতে পারছে না এই মুহূর্তে তার কি করা উচিৎ। অপরিচিত একজন মানুষ যেচে এসে উপকার করছে। অথচ মলি তাকে চিনে না।

মলির ইতস্তত ভাব দেখে মারুফ নিজেই তার পরিচয় দিলো। আমি মারুফ। আপনাদের পাশের বাসার নতুন ভাড়াটিয়া। আছি ব্রাক ব্যাংকে।

চলুন আগে মা কে হাসপাতালে ভর্তি করি। তারপর না হয় ভালো ভাবে পরিচিত হব।

মারুফ নিজেই এগিয়ে গিয়ে জলি আর মলির সাথে হাত লাগিয়ে লায়লা বেগমকে গাড়িতে তুলতে সাহায্য করলো।

জলির মুখ ফ্যাকাসে হয়ে গেছে। ও ভীত স্বরে বললো, আমার কেন জানি ভয় লাগছে মেজপা। না হয় আমি ও সঙ্গে যাই।

তোর যাবার দরকার নেই। যা করার আমিই করতে পারব। তুই বরং বাসায় থাক। আপাকে কিছু জানানোর দরকার নেই। টেনশন করে ছুটে আসবে অফিস থেকে। বেশি খারাপ হলে আমি ফোন করবো।

জলির মনটা খারাপ হয়ে গেল। কি ধরনের কথাবার্তা। পরের বাড়ির একটা ছেলে। এত ছোটাছুটি করে হাসপাতালে নিয়ে গেলো অথচ আমাকে নিলো না। মায়ের যদি কিছু হয়? অবস্থা আরো খারাপ হলে তো আত্মিীয়জনদের খবর দিতে হবে। মেজপা কি পারবে একা একা সবকিছু করতে?

লায়লা বেগম কে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। এখন স্যালাইন চলছে। মারুফ কিছু সময় মলির সাথে থাকতে চাইলে ও মলি একরকম জোর করেই মারুফ কে অফিস যেতে বলেছে।
বিনীতভাবে অনুরোধ করে বলেছে আপনি যা করেছেন তার ঋণ শোধ করার মতো নয়। আপনি এখন আর সময় নষ্ট করবেন না প্লিজ। আপনি অফিস চলে যান। বাকিটা আমি সামলে নিতে পারব।
মারুফ যাওয়ার আগে ওর কার্ডটা মলিকে দিয়ে গেছে। সেই সাথে রিকোয়েস্ট করছে, যে কোন প্রয়োজনে নিঃসংকোচে আমাকে ফোন করবেন।

মারুফ যাওয়ার পর পরই শুদ্ধ এসে হাজির অনেক ফলমূল নিয়ে।

এতোক্ষণ যে মেয়েটা শক্ত হাতে সবকিছু হ্যান্ডেল করছিলো, সেই মেয়েটাই শুদ্ধ কে দেখে ছোট বাচ্চাদের মতো কান্নায় ভেঙে পড়লো।

দৌড়াদৌড়ি যা করার শুদ্ধই সব করলো। ডাক্তারের সাথে কথা বলা, ওষুধ কিনে আনা থেকে শুরু করে সবকিছুই নিজ দায়িত্বে করলো। খবর পেয়ে পলিও অফিস থেকে ছুটে আসলো। শুদ্ধর দায়িত্ব বোধ দেখে পলি কিছুটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়লো।

দুপুরের খাবার নিয়ে জলি এসেছিল। জলি আর পলি বিকেলে বাসায় চলে আসছে। ডাক্তার বলছে ভয়ের কোন কারণ নেই। কালকেই রিলিজ করে দিবে। হাসপাতালে বেশি লোকজন না থাকাই ভালো।

বিকেল হয়েছে। সূর্য ডুবে যাবার আগের মায়াবী আলো চারদিকে। পলি একা-একা বারান্দায় হাঁটছে। হঠাৎ কে যেন ডাকল—এই…এই। পলি চমকে তাকাল কেউ তো কোথাও নেই! কে ডাকল! পলি ভয়-পাওয়া গলায় বলল, কে ডাকছে আমাকে?

এই এই। আমি ডাকছি মাম্মাম। কোলে।

পলি দেখল, ওদের বারান্দার সাথে লাগোয়া পাশের বাসার বারান্দায় ছোট্ট একটা ফুটফুটে ছেলে গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে। সে হাত দুটো গ্রিলের বাইরে বের করে দিয়ে আদর আদর গলায় বলছে মাম্মাম কোলে।

নাম কী তোমার?

পিচ্চি টি নাম বলল না। খুব হাসতে লাগল।
যেন পলি খুব হাসির কথা বলছে। পিচ্চিটার পেছন থেকে মাঝ বয়সী একজন ভদ্রমহিলা এসে বললো, টুকটুক তুমি এখানে! ওদিকে আমি পুরো বাড়ি খুঁজে মরছি।

এবারো পিচ্চি টা দাঁত বের করে খুব হাসছে। ভদ্রমহিলা কোলে নিতে গেলেই পিচ্চি গলা ছেড়ে চিৎকার পেড়ে কান্না পলির দিকে হাত বাড়িয়ে বলছে মাম্মাম কোলে।

এবার ভদ্রমহিলা পলির কে দেখে স্মিত হেসে বললো, তুমি কিছু মনে করো না মা। এটা আমার নাতি। তোমাকে দেখে ও মা মনে করেছে।

ওর মা কোথায়?

ভদ্রমহিলা শাড়ির আঁচলটা চোখে চেপে ধরে বললো, ওর মা বেঁচে নেই গো মা। মায়ের ছবি দেখায় দেখায় খাবার খাওয়াতে হয়। আজ কি হয়েছে ঘুম থেকে উঠেই শুধু মাম্মাম মাম্মাম করছে। খাওয়াতেও পারছি না কিছু। ওর বাবা প্রতিদিন এই সময়ে বাসায় চলে আসে। বাপ ছেলের খুব খাতির। কিন্তু আজকে যে কি হলো, এখনো ফেরেনি। মারুফ আসলে তো টুকটুকের খাওয়া নিয়ে আমার আর টেনশন করতে হতো না।

টুকটুক এখনো কান্না করছে মাম্মাম মাম্মাম করে। পলির সত্যিই খুব খারাপ লাগছে বাচ্চাটার জন্য। ওর ইচ্ছে করছে ছুটে গিয়ে কোলে নিয়ে বাচ্চাটাকে আদর করতে।

পলিদের পাশের এই বাসাটা প্রায় ছয় মাস খালি পরে ছিল। বাড়ির মালিক দেশের বাইরে থাকে। অনেক বড়ো বাসা। সহজে ভাড়া হয় না। হঠাৎ করে নতুন এক পরিবার সে বাসায় উঠেছে। পলির যাওয়াটা ঠিক হবে কিনা ও ঠিক বুঝতে পারছে না।
তারপরও সংকোচ কাটিয়ে ও বললো খালাম্মা কিছু মনে না করলে বাবুটাকে আমার কাছে পাঠাতে পারেন। আমি ওকে খাইয়ে দিব। ওর বাবা আসলে না হয় নিয়ে যাবেন।

ভদ্রমহিলা পলির কথা শুনে খুব খুশি হলেন। তিনি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে হাক ছেড়ে কাজের মেয়ে টাকে ডাকলেন, রহিমা টুকটুক কে একটু পশের বাসায় নিয়ে যা তো। সাবধানে যাবি। তোর ভাইজান ফিরলে আমি বারান্দায় দাঁড়িয়ে ডাকলেই চলে আসবি।

পলির সাথে টুকটুকের খুব ভাব হয়েছে। প্রতিদিন আসা যাওয়া না হলে ও বারান্দায় দাঁড়িয়ে দুজনের খুব ভাবের আদান-প্রদান হয়। ছুটির দিনে সারাদিন পলি আর মলির কাছেই থাকে টুকটুক।

জলিকে ওর শশুর ঢাকা মেডিকেলের পাশেই একটা বাসা ভাড়া করে দিয়েছে। চার বান্ধবী মিলে থাকে। জলি পুরো দমে পড়াশোনা শুরু করে দিয়েছে। ওর জীবনের একমাত্র ধ্যান জ্ঞান এখন পড়াশোনা।

মলির সাথে মারুফের মাঝে মধ্যে অফিসে যাওয়ার সময় দেখা হলেও ইদানিং আর দেখছে না মলিকে।
মারুফ তো জানে না মলির পরীক্ষা শেষ। এখন আর মলি খুব প্রয়োজন ছাড়া বাসার বাইরে বের হয় না। কয়েক দিন ধরে মলিকে দেখতে না পেয়ে মন খারাপ করে ডায়রি লিখতে বসলো।

“আমি তাকে দেখেছিলাম এক জোৎস্না রাতে। সে ছিল ভোরের আলোর ন্যায় স্নিগ্ধ, সুন্দর।

সদ্য যৌবনা কিশোরীর দেহ যেন গোলাপের প্রতিটি পাঁপড়ির ন্যায় ভাজে ভাজে লুকিয়ে রেখেছে রহস্য। আমি খুব করে বলতে চাই তোমাকে প্রথম দেখার পর থেকেই “আমি জ্বলে পুড়ে শেষ হয়ে যাচ্ছি। আমাকে কি ঠাঁই দিবে একটু তোমার বুকে?

আমি তো চেয়েছিলাম আর কখনো কোন নারীর দিকে ফিরে তাকাবো না। কিন্তু তোমার ঐ হরিণের মতো মায়াবী চোখে কি এমন রহস্য লুকিয়ে আছে! যা দেখে আমার দিনরাত এক হয়ে গেছে।

তোমাকে বলেছিলাম ফোন করো। আজ ও তুমি একটাবার ফোন করলে না আমায়! তোমার নাম্বার টাও দিলে না কখনো!
এতো এতো মানষিক যন্ত্রণা নিয়ে কিভাবে বাঁচব আমি?

তবে কি তোমাকে আমি আমার করে পাব না কখনো?
মা বলছিলো তোমাকে নাকি টুকটুক মাম্মাম বলে ডাকে। তুমি ও নাকি খুব ভালোবাসো আমার টুকটুক কে।
তুমি কি আমার টুকটুকের মাম্মাম হবে?

চলবে……

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here