মেঘে ঢাকা আকাশ পর্ব -১৪+১৫

#মেঘে_ঢাকা_আকাশ
#পর্ব_১৪
কলমে রোকেয়া পপি

রাতে ঘুমুবার সময় মমতা মুখে ফেসপ্যাক দেয়। সারা মুখে হলুদাভ আস্তরণ, শুধু চোখ আর ঠোঁট বের হয়ে থাকে। তাকে তখন ভয়ঙ্কর দেখায়। সাহাবুদ্দিন আহমেদ চেষ্টা করেন এই সময়টা পেপারে মুখ ঢেকে রাখতে। বিছানায় শুয়ে পেপার পড়ার চেয়ে ও তার বেশি মনোযোগ থাকে স্ত্রীর দিকে না তাকানোতে।

মমতা প্রায় সময় রাগারাগি করে শোবার আগে মুখের সামনে পত্রিকা ধরে রাখতে দেখলে। মমতাকে দশ থেকে পনেরো মিনিট এই ফেসপ্যাক মুখে দিয়ে অপেক্ষা করতে হয়। এই সময়টা সে তার স্বামীর সাথে গল্প করতে খুব ভালবাসে। এতে তার সময়টাও দ্রুত কাটে।

সে অবশ্য একাই বকবক করে। সাহাবুদ্দিন আহমেদ মুখের সামনে পত্রিকা ধরে রেখে হু হা করে। ভুল করে ও সে তখন মমতার মুখের দিকে তাকাতে চায় না।

পেপারে পড়ার মতো কিছু না পেয়ে সাহাবুদ্দিন আহমেদ সিগারেট হাতে শোবার ঘরের বারান্দায় গিয়ে বসলো। বারান্দা তার পছন্দের জায়গা গুলোর মধ্যে একটা। মমতা অনেক সুন্দর সুন্দর টব দিয়ে বারান্দা ভরে ফেলেছে। টবভর্তি নানান ধরনের ফুলের গাছ। গাছগুলি যত্নে আছে বোঝা যায়। সতেজ পাতা আর নানান রকমের ফুলে ঝলমল করছে বারান্দা।

সাহাবুদ্দিন আহমেদ মমতার সাথে কিছু জরুরী পরামর্শ করতে চান। কিভাবে শুরু করবেন তা ঠিক বুঝতে পারছেন না। তিনি বারান্দা থেকে বললেন, মমতা চা খাওয়াতে পারো?

মমতা মুখ ধুয়ে তাওয়াল দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে বললো, না। এই মাঝ রাতে চা খেতে হবে না। ঘুমাতে আসো।

আমার খেতে ইচ্ছা করছে। তুমি যদি আমার সাথে খাও তাহলে বারান্দায় বসে এককাপ চা খাওয়া যায়।
চা খেতে খেতে তোমার সঙ্গে একটা জরুরি বিষয় নিয়ে ডিসকাস করব।

এখনই করতে হবে?

হ্যাঁ এখনই। জরুরি বিষয় নিয়ে আলাপের জন্যে নিশ্চয়ই পঞ্জিকা দেখে দিনক্ষণ ঠিক করার প্রয়োজন নেই।

না তা নেই।

মমতা দু কাপ চা নিয়ে এসে বারান্দার বাতি নিভিয়ে বারান্দা পুরোপুরি অন্ধকার করে দিলেন। তাতে অবশ্য পুরোপুরি অন্ধকার হলো না। চাঁদের মিষ্টি আলোয় আলোকিত হয়ে রইলো চারপাশ।

মমতা চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বললেন এবার বলো তোমার জরুরী কথা।

বলছিলাম শুদ্ধর পরীক্ষা শেষ। কিছু দিন পর রেজাল্ট ও হয়ে যাবে। আমি চাইছিলাম আগামীকাল মলিদের বাসায় বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে যেতে।
তুমি কি বলো?

বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে যাওয়ার সাথে রেজাল্টের কি সম্পর্ক! সব সময় কথা এতো ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে বলো কেন?

আহ্ মমতা তুমি বুঝতে পারছো না। রেজাল্টের পর ওরা দেশের বাইরে চলে যাবে পি এইচ ডি করতে।
আমাদের ও তো ইচ্ছে করে ছেলের বউ কে কিছুদিন নিজেদের কাছে রাখতে। সময় একটা বিশাল ফ্যাক্ট, এটা বোঝ না কেন!

তুমি যা ভালো মনে করো, তাই করো। আমার মতামত তো দরকার নেই।

কি বলছো মমতা! তোমার একমাত্র আদরের ছেলের বিয়ে, তোমার মতামত অবশ্যই দরকার আছে।

ঢং করবে না একদম। তুমি খুব ভালো করেই জানো, এ বিয়েতে আমার মত নেই। তারপর ও আমার সাথে ঢং করতে আসো! চলো ঘুমাতে চলো। আমার ঘুম পাচ্ছে।

জ্বর থেকে উঠে লায়লা বেগমের মুখের রুচি নষ্ট হয়ে গেছে। কিছুই খেতে পারেন না। সারাদিন মুখের সামনে গল্পের বই ধরে শুয়ে থাকেন। মলি আজ কতোটুকু খেসারির ডাল ভিজিয়েছিল। সেই ডাল পাটায় বেটে পেয়াজু ভাজতে বসেছে। ওর ধারণা জ্বরের মুখে মা পেয়াজু খেতে খুব পছন্দ করবে।

অনেকক্ষণ ধরে দরজার কড়া নড়ছে। মলি উঠতে পারছে না। কড়াইয়ে তেল গরম হয়েছে। ডালের সাথে বেশি করে পেঁয়াজ কুচি, কাঁচা মরিচ আর ধনিয়া পাতা দিয়ে মেখে তেলে ছেড়েছে। একপাশ লাল লাল হয়ে গেছে, এখন উল্টে দিতে হবে। এমন সময় দরোজায় কড়া নাড়ছে কেউ।

পেঁয়াজু গুলো উল্টে দিতে দিতে মলি বললো, কে?

যে কড়া নাড়ছিল সে জবাব দিল না। আরো জোরে কড়া নাড়তে লাগল। মনে হচ্ছে আপা আজ আগে আগেই চলে আসছে। পেঁয়াজুটা সোনালি বর্ণ ধারণ করে ফুলে উঠছে। এখন সামনে থেকে সরে যাওয়া মানেই পুড়ে নষ্ট হবে।

এখন শুধু যে কড়া নড়ছে তা-না, দরজায় ধাক্কাও পড়ছে। মলি তেমন পাত্তা দিল না। একটু রাগ ও হলো। আপা জানে মা অসুস্থ, জলি হোস্টেলে। আমি তো ওয়াশ রুমে ও থাকতে পারি। দুই টা মিনিট ওয়েট করলে কি মহা ভারত অশুদ্ধ হয়ে যাবে!

পেয়াজু কড়াই থেকে নামিয়ে দরজা খোলার জন্যে ও রওনা হলো। আপাকে আজ দুটো কঠিন কথা বলতে হবে মনে মনে ঠিক করে ফেললো।
দরজা খোলার পর মলির মাথা চক্কর দিয়ে উঠল, তার মনে হচ্ছে এক্ষুণি মাথা ঘুরে হুড়মুড় করে পড়ে যাবে। কড়া নাড়ছিল শুদ্ধ! সাথে ওর বাবাও আছে।

শুদ্ধ মিটিমিটি হাসছে আর বলছে, এতক্ষণ ধরে কড়া নাড়ছি দরজা খুলছিলে না কেন?

মলি সালাম দিয়ে বোকার মতো দাঁড়িয়ে রইল।

শুদ্ধ ঠোঁট টিপে হেসে বললো, আমাদেরকে কি দরোজার সামনে দাঁড় করিয়ে রাখবে, না ভেতরে ঢুকতে দেবে?

এসো, ভিতরে এসো।

মলিদের আলাদা করে কোন ড্রয়িং রুম নেই। বারান্দায় ডাইনিং টেবিল ফেলা। সেখানেই সে শুদ্ধ আর ওর বাবাকে বসতে দিলো। ও সত্যিই খুব আন ইজি ফিল করছে। এভাবে কোন খবর না দিয়ে শুদ্ধ ওর বাবাকে নিয়ে সরাসরি বাসায় এসে উপস্থিত হবে, সেটা ও বুঝতে পারেনি। তাও ভালো ওর মাকে সাথে নিয়ে আসেনি। তাহলে তো এতোক্ষণ নাক মুখ ছিটকে বের হয়ে যেতো ঐ মহিলা।

এরমধ্যে ড্রাইভার এসে মিষ্টি, ফল আর বিভিন্ন ধরনের নাস্তা আইটেম প্যাকেট গুলো নামিয়ে রেখে গেছে।

সাহাবুদ্দিন আহমেদ নরম সুরে বললেন, মাগো এতো ব্যাস্ত হয়ো না। বাসায় মুরব্বি কে আছে? ডাক দাও। একটু কথা বলি।

জলি ওর মাকে দ্রুত শাড়িটা চেন্জ করে তাদের সামনে এনে বসিয়ে পরিচয় করিয়ে দিল।
মা আমার বন্ধু শুদ্ধ। উনি শুদ্ধর বাবা। তোমরা কথা বলো। আমি চা করে আনি।

মলি শুদ্ধ দের আনা হরেক রকমের নাস্তার সাথে ফল, মিষ্টি আর নিজের ভাজা পেঁয়াজু গুলো সাজিয়ে দিয়ে সামনে থেকে সরে যাওয়া মাত্রই পলিও অফিস থেকে এসে হাজির।

পলি খুব মনোযোগ দিয়ে সাহাবুদ্দিন আহমেদ সাহেবের কথা শুনলো। তারপর শুধু এইটুকু বললো দেখুন আপনার প্রস্তাব সত্যিই খুব লোভনীয়।
আর আমার বোন যখন নিজের পছন্দের মানুষ ঠিক করেই রেখেছে, সেখানে তো আমার আর কিছুই বলার থাকে না।

তবে এইটুকু বলতে পারি আপনার লিখে দেওয়া এ্যাপার্টমেন্টে আমরা উঠব না। বিয়ের অনুষ্ঠান ও করা আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়। আপনার ছেলে যখন গরীব ঘরের মেয়েকে পছন্দ করেছে, তখন আমার যা আছে তার মধ্যেই বিয়েটা করতে হবে।
তারপর আপনারা আপনাদের মতো করে বড়ো সরো অনুষ্ঠান করুন। আমাদের কোন আপত্তি নেই।

সাহাবুদ্দিন আহমেদ জানেন যে, গরীব মানুষের মান-সম্মান বোধ খুব টনটনে থাকে। এমন কিছু এদের কাছে শুনতে হবে, সেই প্রিপারেশন আগে থেকে নিয়েই তিনি এসেছেন। তাই মন খারাপ হলেও হাসি মুখে বললেন ঠিক আছে মা, তোমার কথাই ঠিক। তবে বিয়ের অনুষ্ঠানটা যদি আমাদের ঠিক করা কমিউনিটি সেন্টারে হয় তাহলে খুব ভালো হতো। আমরাই সব আয়োজন করবো। তোমরা শুধু তোমাদের আত্মীয়-স্বজন নিয়ে উপস্থিত থাকবে।
বুঝোই তো মা আমাদের কিছু আত্মীয়-স্বজন তো আনতেই হবে বিয়েতে। এখানে তো তুমি তাদের ঠিক মতো বসতে দিতে পারবে না।

কিছু মনে করবেন না প্লিজ। আমার মনে হয় খুব কাছের চার পাঁচ জন আত্মীয় এনে এখানে বিয়ে পড়িয়ে নিয়ে যাবেন। তারপর যা করার করুন। সেটাই ভালো হবে। আমরা গরীব হতে পারি। কিন্তু কারো দয়া গ্রহণ করি না।

এরপর আর কোন কথা থাকে না। সাহাবুদ্দিন আহমেদ মন খারাপ করে বললেন ঠিক আছে তাহলে আগামী শুক্রবার বাদ জুমা আমরা কাজি সাহেব সাথে করে এনে বিয়ে পড়িয়ে মলি মাকে নিয়ে যাব। আর আমাদের আনুষ্ঠানিকতা কোথায় কি হবে তা তোমাদের পরে জানিয়ে দিব।

আমরা আজ তাহলে উঠি।

মারুফ অফিসে চলে যাওয়ার পর মারুফের মা রুম গোছাতে এসে দেখে টেবিলের ওপর হাট করে ডায়রি খোলা। ছেলে যথেষ্ট বড়ো হয়েছে। তিনি কখনো ছেলের ব্যাক্তিগত কোন জিনিস ছুঁয়ে দেখেন না। তিনি ডায়রিটা বন্ধ করে গুছিয়ে রাখতে গিয়ে কিছু কথা না চাইলে ও চোখে পড়ে গেল। ইচ্ছের বিরুদ্ধে গিয়ে তিনি পড়তে শুরু করলেন ছেলের লেখা ডায়রির পাতা।

এরপর মিটিমিটি হাসছেন আর মনে মনে ভাবছেন না আর দেরি করা যাবে না।
পলি মেয়েটা সত্যিই খুব মিষ্টি দেখতে। আর মনটাও কতো ভালো। এতো অল্প সময়ের মধ্যে আমার টুকটুক কে যেভাবে আপন করে নিয়েছে। আবার আমার ছেলে ও মনে মনে মেয়েটার প্রেমে পড়ে হাবুডুবু খাচ্ছে। তাহলে আজ সন্ধ্যার পর নামায পড়ে ঐ বাসায় যেতে হবে বিয়ের কথা পাকাপাকি করতে।

উনি মারুফ কে ফোন দিয়ে বললেন, বাবা মারুফ অফিস থেকে ফেরার পথে ঢাকার সব চেয়ে ভালো মিষ্টির দোকান থেকে দশ কেজি মিষ্টি নিয়ে এসো তো।

মারুফ বিস্মিত হয়ে বললো, এতো মিষ্টি দিয়ে কি হবে মা?

আছে কাজ আছে। পাশের বাসায় এতো সুন্দর একটা মেয়ে থাকতে আমি পুরো ঢাকা শহরে মেয়ে খুঁজে বেড়াই। আজকে টুকটুকের জন্য মা ঠিক করতে পাকা কথা বলতে যাব।
তুই তাড়াতাড়ি আসিস বাবা।

মায়ের কথা শুনে লজ্জা আর ভালো লাগায় মারুফের গাল দুটোতে লাল, নীল, বেগুনি রঙের আভা খেলে গেল!

চলবে….#মেঘে_ঢাকা_আকাশ
#পর্ব_১৫
কলমে রোকেয়া পপি।

মারুফের আজ অফিসে যথেষ্ট কাজের চাপ ছিল। তারপরও সে পাঁচটা বাজার আগেই এম ডি স্যারের রুমে এসে ছুটির পারমিশন চাইলো।

স্যার আমার আজকে একটু সকাল সকাল বাসায় যেতে হবে। মারুফ অবাক হয়ে খেয়াল করলো, এই ছোট্ট একটা লাইন বলতে গিয়ে ওর কথা জড়িয়ে গেল, স্বরটাও কেমন অন্য রকম শোনাচ্ছে!

এম ডি সাহেব মুখ না তুলেই বললেন ব্যাপার কি?

স্যার পারিবারিক একটা জরুরী কাজ আছে।

এম ডি মতিউর রহমান বিস্ময় প্রকাশ করে বললেন জরুরী কাজ থাকলে যাবেন। এখানে এতো লজ্জা পাওয়ার কি আছে? আপনি তো দেখছি লজ্জায় মাটির সাথে নুইয়ে যাচ্ছেন!

মারুফ আর কথা না বাড়িয়ে দ্রুত বেরিয়ে গেল এই বলে, আচ্ছা স্যার। আমি তাহলে আসি।

মারুফ অফিস থেকে বের হয়েই ড্রাইভারকে বললো, বসুন্ধরা সিটি যেতে।
মারুফ ঘুরে ঘুরে একটা একটা ডায়মন্ড রিং কিনে ফেললো। কেনার পর বারবার মনে হতে থাকলো আংটি কেনাটা বোধহয় বাড়াবাড়ি হয়ে গেল। মলি যদি এ বিয়েতে রাজি না হয়, তাহলে খুব লজ্জা পেতে হবে। হাজার হলেও সে অবিবাহিত একটা সুন্দরী, শিক্ষিত, স্মার্ট মেয়ে। তার স্বপ্ন থাকতেই পারে তার মত অবিবাহিত কোন পুরুষ কে জীবন সাথী করার।

আংটি টা হাতে নিয়ে কিছু দিন আগে ঘটে যাওয়া একটা ঘটনা হঠাৎ করেই মনে পড়ে গেল।
কিছুদিন আগে ওর ফুপাত বোনের মাধ্যমে সাভারে গিয়েছিল মেয়ে দেখতে। খুব আহামরি সুন্দর না হলেও চেহারায় কি যে স্নিগ্ধ একটা ভাব। চোখ দুটো কি মায়া মায়া। দেখলেই মনে হয় এ মেয়ের মনটা খুব নরম হবে। ওর টুকটুককে দেখে শুনে রাখবে।
নরমাল বি এ পাস করে সাভার বিশ্ববিদ্যালয়ে মাস্টার্সে পড়তেছে। ওর জন্য পাত্রী হিসেবে খুব সাধারণ। তারপরও মারুফ রাজি হলো। আংটি ও পরানো হলো।

পরের সপ্তাহে শুনে মেয়ের নাকি এখানে বিয়েতে মত নেই। খুব কান্নাকাটি করছে। সে এক বাচ্চার বাবাকে কিছুতেই বিয়ে করবে না। মারুফ খুব অবাক হয়েছিল ওর মতো প্রতিষ্ঠিত ইয়াং হ্যান্ডসাম ছেলে কে এমন সাধারণ একটা মেয়ে রিজেক্ট করতে পারে!

সেলস ম্যানের ডাকে মারুফ চমকে উঠলো।

স্যার আর কিছু লাগবে?

না না শুধু রিং টাই প্যাক করে দিন।

মারুফ মনের মধ্যে হাজারো দ্বিধা নিয়ে মায়ের বলা দশ কেজি মিষ্টির পাশাপাশি কিছু ফলমূল ও কিনে ফেললো।

বাসায় ফেরার পর ওর মা যখন ছেলেকে বললেন বাবা ফ্রেস হয়ে আসো। চলো আমরা সন্ধার চা টা আজ ঐ বাড়িতেই খাই। দেখি টুকটুকের মাম্মামের হাতের চায়ের স্বাদ কেমন।

মারুফের যেতে সত্যিই খুব ইচ্ছে করছে। কিন্তু কিছুদিন আগের ঘটনা মনে পড়ে যাওয়াতে এখন কেমন যেন অস্বস্তি বোধ করছে। ও পকেট থেকে আংটির বক্সটা বের করে মায়ের হাতে দিয়ে বললো, মা অফিস করে আমি খুব ক্লান্ত। তুমি আর টুকটুক যাও। ওরা যদি রাজি থাকে তবেই আংটি পরিয়ে বিয়ের ডেট ফাইনাল করে এসো। আর রাজি না থাকলে রিং বের করার দরকার নেই।

মারুফের মা ছেলের লজ্জায় লাল হওয়া মুখ দেখে মিটিমিটি হাসছেন। অনেক কষ্ট করে হাসি চাপা দিয়ে বললেন আমার এতো সুন্দর ছেলেটাকে পছন্দ হবে না, তাই কি হয়।
আমি পাকা কথা দিয়েই আসব।

আরেকটা কথা মা। কোন রকম কোনো অনুষ্ঠান হবে না কিন্তু। খুব সাধারণ ভাবে কাজি নিয়ে গিয়ে বিয়ে পড়িয়ে নিয়ে আসা হবে। আমি চাই না আমার দ্বিতীয় বিয়েতে কোন রকম কোনো আনুষ্ঠানিকতা হোক।

মারুফের মা বসে আছে পলির রুমে। পলির রুমটা সবসময় গোছানো পরিপাটি থাকে। ওর মধ্যে একটু পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার সুচিবায়ু রোগ আছে।

মলি ইচ্ছে করেই প্রতিবেশী খালাম্মাকে পলির রুমে বসাইছে। মেয়ে মানুষ কে তো আর বারান্দায় বসানো যায় না। তাছাড়া উনি যেভাবে মিষ্টি, ফলমুল নিয়ে প্রথম এ বাড়িতে এসেছেন। নিশ্চয়ই কোন সুখবর আছে। মলি একটা জিনিস খেয়াল করে দেখেছে, যখন একটা সুখবর পাওয়া যায়, তখন চারদিক থেকে একটার পর একটা সুখবর আসতে থাকে।

ও টুকটুক কে কোলে নিয়ে আদর করে গাল টিপে দিয়ে বললো, খালাম্মা আপনি বসুন আমি মাকে ডেকে দিচ্ছি।

টুকটুক মলির গলা জড়িয়ে ধরে আদর আদর গলায় বললো, আমার মাম্মাম কোথায় মলি? আমি মাম্মামের কাছে যাব।

টুকটুকের কথার ধরন দেখে ওরা দুজনেই শব্দ করে হেসে উঠলো।

টুকটুকের এ বাড়িতে অবাধ যাতায়াত। পলিকে মাম্মাম বললেও, মলিকে সে নাম ধরেই ডাকে।
বাচ্চারা খুব অনুকরণ প্রিয় হয়।
মলিকে যেহেতু ওর মা আর পলি নাম ধরে ডাকে। তাই টুকটুক ও ওদের দেখাদেখি নাম ধরেই ডাকে।

মলি হাসতে হাসতে বললো, যাবে তো সোনা। তুমি তোমার মাম্মামের কাছেই যাবে। তোমার মাম্মাম মনে হয় নানুর রুমে। ওষুধ খাওয়াচ্ছে। চলো আমরা তোমার নানু আর মাম্মামকে ধরে নিয়ে আসি।

মারুফের মা যে রুমটায় বসে আছে। খুব ছোট একটা রুম। তিনি চারদিকে এক নজর বুলিয়ে নিলেন। ছোট্ট একটা রুমে সেমি ডাবল খাট। খাটের সাথেই দেওয়াল ঘেঁষে একটা আলনা। পাশেই একটা পড়ার টেবিল আর চেয়ার। টেবিলের পাশে ছোট্ট একটা বুকসেল্ফ। সেল্ফ ভর্তি বিভিন্ন ধরনের রাইটার দের লেখা বই। দেখেই বোঝা যায় এ বাড়ির সবাই পড়তে খুব ভালোবাসে।

রুমটা ছোট হলেও সুন্দর করে গোছানো দেখে তার বেশ ভালো লাগলো। তাছাড়া কোথাও এক ফোঁটা ধুলোবালি নেই। এটাও ভালো লাগার আরেকটা কারণ।

জলি মেডিকেল কলেজের ফাস্ট ইয়ারে ভর্তি হয়েছে। এখনো হলের সিট পায়নি। চার বান্ধবী মিলে একটা বাসায় মেছ করে থাকে। মেছে দুপুরে আর রাতের খাবার মিল হয়। সকালে নাস্তা যে যার মতো করে খেয়ে নেয়। জলির শশুর বেশ কিছু শুকনো খাবার কিনে দিয়ে গেছে। সাথে একটা সিঙ্গেল আলমারি। আলমারির একটা তাকে শুধু শুকনো খাবার দিয়ে ভরা। ও বিস্কিট পানি খেয়ে সাধারণত কলেজে চলে যায়। কিন্তু ওর খুব ইচ্ছে করে পেট ভরে পরোটা ডাল খেতে। তারপর গরম এক কাপ ধোঁয়া ওঠা চা।

ওর বাসা থেকে কলেজের দূরত্ব মাত্র পাঁচ মিনিটের পথ। সেই পথে একটা খুব চালু হোটেল আছে। সকালের এই সময়টাতে খুব সরগরম থাকে। প্রচুর কাস্টমার আসছে, যাচ্ছে, খাচ্ছে।

জলির খুব ইচ্ছে করে ঐ রেস্টুরেন্টে ঢুকে নাস্তা খেতে। কিন্তু সাহস হয় না। ইদানিং ও খেয়াল করেছে বেশ কিছু বখাটে ছেলে ঐ রেস্টুরেন্টে বসে চা আড্ডা দেয়, তাস খেলে। জলিকে দেখলেই গলা ছেড়ে গান ধরে জ্বালাইয়া গেলি মনের আগুন, নিভাইয়া গেলি না।
জলির অবশ্য শুনতে খারাপ লাগে না। কয়েক জনের গলা সত্যিই খুব সুন্দর।

একবার একটা এক্সিডেন্ট ঘটে যাওয়াতে ও এখন খুব বেশি সাবধানী। বখাটে ছেলে গুলোর কন্ঠস্বর শুনলেই ও হাঁটার গতি বাড়িয়ে দিয়ে খুব দ্রুত কলেজ চলে যায়। কলেজ গেটের ভেতরে ঢুকে বড়ো করে একটা স্বস্তির শ্বাস ফেলে।

ফেরার পথেও একি ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটে অধিকাংশ দিন। ও চেষ্টা করে একা একা না ফিরে কারো সাথে ফেরার জন্য। প্রয়োজনে বিশ, পঁচিশ মিনিট অপেক্ষা করে কাউকে পাওয়ার জন্য। তবুও একা আসতে চায় না।
ওর কেন যেন মন বলে ঐ বখাটেদের দলে সজীব ও আছে।

চলবে…..

বি: দ্র: পারিবারিক বিভিন্ন ব্যাস্ততায় লেখাটা ১৪ পর্ব দেওয়ার পর লেখা অফ হয়ে গেছিলো। সেজন্য আমি আন্তরিক ভাবে দুঃখিত।
লেখাটা এতোটা পাঠক জনপ্রিয়তা পাবে আমি ভাবতেও পারিনি।
অনেকেই ইনবক্সে এবং পোস্ট কমেন্টে লেখার নতুন পর্ব দেওয়ার জন্য অনুরোধ করছিল।
আজ সব কাজ ফেলে রেখে লিখতে বসলাম। কারণ আমি খুব ভালোবাসার কাঙাল।

আশা করবো কেমন লাগছে তা কমেন্ট বক্সে জানিয়ে দিয়ে লেখার আগ্রহ বাড়িয়ে দিবেন প্রিয় পাঠকরা।
আর কোন ভাবেই কপি করা যাবে না।
শেয়ার দেওয়া যাবে।
ধন্যবাদ সাথে থাকার জন্য।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here