মোহ মেঘের আলাপন পর্ব – ২৩

❝মোহ মেঘের আলাপন ❞
লেখিকা: “নূরজাহান আক্তার আলো”
[২৩]

আদিত্য তার কথা শেষ না করতেই দেখে মেধা চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে। তাকে আরেকদফা অবাক করতে সে সত্যি সত্যিই গাড়ি থামিয়ে ফুল কিনে আনলো। আর এনেই ফুলগুলো রাখল মেধার কোলে। রজনীগন্ধা, গাঁদাসহ, লাল, সাদা, হলুদ, এবং গোলাপি রঙের গোলাপও এনেছে। সত্যি বলতে, গোলাপ মেধার ভীষণ পছন্দের ফুল। তবে এই মুহূর্তে ফুল দেখে খুশি হতে পারলো না সে। কারণ তার মনের মধ্যে চলছে নানান চিন্তা। চোখে ভাসছে সীমা বেগমের কান্নারত মুখখানা। এককথায় বলতে সে এই মুহূর্তে বিক্ষিপ্ত মেজাজে আছে। কিচ্ছু ভালো লাগছে না তার। সব দোষ আদিত্যের! কী দরকার ছিলো শুধু শুধু বাসা থেকে বেরিয়ে আসার? যা হওয়ার তা তো হয়েই গেছে। আর যা ঘটিয়েছে আমান তাতে অনুতপ্ত। যা ওর নজরেও পড়েছে। যখন ওর সঙ্গে তার দেখা হয়েছিলো আমান পারে নি দৃষ্টি তুলে কথা বলতে।অপরাধীর
ন্যায় নত মস্তকে শুধু এইটুকুই উচ্চারণ করেছে, ‘সরি বনু।’
চোখ মানুষের মনের আয়না। মনের আভাস চোখ দেয়।আর আমানের চোখ বলে দিচ্ছিলো সে প্রচন্ড আফসোসে পুড়ছে, অপরাধভোগে ভুগছে। এখন সবাই যদি তার দিকেই আঙুল তুলে তবে কীভাবে হবে? তাকে তো নিজেকে শুধরে নেওয়ার সুযোগ দেওয়া উচিত।বোঝানো উচিত ভালো মন্দের তফাৎ।
কিন্তু না, আদিত্য সেটা না করে করলো এর বিপরীত কাজ।
এভাবে বাসা থেকে বেরিয়ে আসাতে আমান না জানি কেমন
প্রতিক্রিয়া দেখায়। এখন সে নিজেকে অপরাধীর কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েকিছু একটা করে বসলে? তখন এই দায়ভার কে নিবে? আদিত্য তার সঙ্গে কথা না বলুক, এক টেবিলে নাহয় খেতেও না বসুক। তবুও মানা যেতো তবে তার কারণেই বাসা থেকে বেরিয়ে যাওয়া ওর কাছে উচিত মনে হচ্ছে না। কেমন
জানি লাগছে। নিজের কাছে নিজেকে খুব ছোট মনে হচ্ছে।
তাছাড়া সে কখনো কল্পনা করে নি আলাদা সংসারের কথা। শুধু সুখপূর্ণ একটা পরিবার চেয়েছিলো। অথচ…..! তার দুই পরিবারই আজ ছন্নছাড়া, সুখহারা। এসব কথা ভেবে প্রচন্ড মন খারাপ নিয়ে সে জানালার বাইরে তাকিয়ে রইলো। এখন ওর মনে হচ্ছে আদিত্যকে একটা খামচি মেরে শার্টের কলার ধরে টানতে টানতে বাসায় ফিরিয়ে নিয়ে যেতে। প্রয়োজনে দু’চার থাপ্পড় খেলোও নাহয়। কিন্তু এটা সে চায়লেও করতে পারবে না।কারণ আদিত্যের সঙ্গে পেরে ওঠা ওর পক্ষে সম্ভব নয়। মেধাকে নিশ্চুপ দেখে তখন আদিত্য বললো,

-”বাসরঘর সাজাতে আর কী কী যেনো লাগে?”

-”মানে?”

-”মানে আজ আমাদের ফাস্ট নাইট। সেজন্য রুম সাজাবো।
এখন তুমি বলো রুম সাজাতে কী কী লাগবে। ফুল, বেলুন, ক্যান্ডেল, আর কি?”

ওর কথা শুনে মেধা হতভম্ব হয়ে শুধু তাকিয়ে রইল। এহেন পরিস্থিতিতে এই লোক বাসরঘর নিয়ে পড়ে আছে! কীভাবে বাসরঘর সাজাবে এই পরিকল্পনায় ব্যস্ত সে! বিয়ে হওয়ার দু’ঘন্টা অতিবাহিত হতে না হতেই বাসরের জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে। একি ওর আদিত্য! যার মাঝে সামান্য হলেও লজ্জা অবশিষ্ট ছিলো? এসব ভেবে হতবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল।ওর হতভম্ব মুখ দেখে আদিত্য পুনরায় একই কথা জিজ্ঞাসা করল। জবাবে মেধা অস্বস্ত্বি নিয়ে উচ্চারণ করলো,

-”আদিত্য ভা..!”

-”এই মুহূর্ত থেকে আমার নামের সাথে ‘ভাই’ ডাকটা যদি যুক্ত করো তবে থাটিয়ে একটা থাপ্পড় মারবো। বিয়ের পরে অন্তত
ভাই! ভাই! করা থেকে বিরত থাকো।”

-”কেন?”

-”তোমার মুখে ভাই ডাক শুনতে বিয়ে করি নি নিশ্চয়ই? ”

-”অনেকদিন অভ্যাস সময় লাগবে।”

-”এই ব্যাপারে একবিন্দুও ছাড় দিবো না। আর না পাবে না সময়।

-”তাহলে কী বলে ডাকবো?”

-“আমার নাম ধরে নয়তো ভবিষ্যতে বাচ্চাদের নাম ধার নিয়ে।”

-”বাচ্চা! এর মধ্যে বাচ্চা কোথা থেকে এলো?”

-”এখন নেই তবে হতে কতক্ষণ? ”

মেধা আর কথা বাড়ালো না। সে বুঝে গেছে আদিত্য তাকে রাগিয়ে দেওয়ার প্ল্যান করছে। তবে আদিত্যের প্ল্যান সফল সাকসেস হতে দিবে না সে। তাই মুখে কুলুপ এঁটে বসে রইল। আর একটা টু শব্দও করলো না। প্রায় আধাঘন্টা পর, তারা
আদিত্যের নতুন ফ্ল্যাটে গিয়ে পৌঁছালো। এ ফ্ল্যাট সাজানোর কাজ শেষ হয়েছে গতমাসে। যদিও বা ওর পরিকল্পনা ছিলো ভাড়া দিয়ে দেওয়ার। সচারাচর যা করে সে। তবে ব্যস্ততার কারণে টু-লেট টানানো হয় নি। এজন্যই ফাঁকা ছিলো আর মেধাকে নিয়ে উঠতে পারল। নতুবা তাকেও ফ্ল্যাট ভাড়া করে বউ নিয়ে থাকতে হতো। এই কথা ভেবে সে একবার মেধার দিতে তাকালো। ভাবলেও খুব পাচ্ছে এই পিচ্চিটা তার বউ। যার হাইট তার বুক অবধি। একথা ভেবে মিটিমিটি হেসে সে
ফ্ল্যাটের দরজা খুলে মেধাকে প্রবেশ করতে ইশারা করলো। মেধা প্রবেশ করে চারদিকে দৃষ্টি বুলাতে ব্যস্ত। তখন আদিত্য মেইন দরজা আঁটকে মেধার গালে চট করে চুমু এঁকে বললো,

-”আমাদের ছোট্টো সংসারে তোমাকে সু-স্বাগতম বউ।”

_____________________________

অপরাধ যখন করেছে তখন তাকেই মাফ চায়তে হবে।কারণ
সে যা করেছে এটা অপরাধ, ঘোর অপরাধ। আর আদিত্যের
রাগ হওয়া স্বাভাবিক। তাকে যে মারতে মারতে মেরেই ফেলে নি এটাও তার ভাগ্য। সে আজই বাসায় ফিরে আদিত্যের পা জড়িয়ে ধরে মাফ চাইবে। প্রয়োজনে আরো দু’চার ঘা খেতে রাজি। তবুও ভাইয়ের সঙ্গে কথা না বলে থাকতে পারবে না সে। এই জন্য যা মূল্য দিতে হয় দিবে। এসব ভাবতে ভাবতে বাইক নিয়ে ফিরছিলো আমান।হঠাৎ ফুলের দোকানে নজর পড়লো তার। সাদা ও টকটকে লাল গোলাপ দেখে চট করে মনে পড়লো মেধা রাণী কথা। গোলাপ দেখলেই মেধার রাগ গলে জল। একথা ভেবে আমান অনেকগুলো গোলাপ কিনে নিলো। আর একটু সামনে এগিয়ে তিনটে চকলেটের বক্স নিতেও ভুললো না। তারপর সে একবুক আশা নিয়ে ছুটলো বাসার পথে। বাসায় গিয়ে ফুল চকলেট নিয়ে প্রথমেই গেল
মেধার রুমে। তাকে রুমে না পেয়ে আদিত্যের রুমেও উঁকি দিলো। কিন্তু কই, আদিত্য বা মেধা কাউকেই পেলো না সে।
অতঃপর ফিরে এলো নিজের রুমে। হাতের জিনিস গুলো ড্রেসিংটেবিলের উপর রেখে গেল ফ্রেশ হতে। আগে ফ্রেশ হয়ে নিক তারপর নাহয় আম্মুর কাছে যাবে আদিত্য আর মেধার খোঁজ নিতে। একথা ভেবে সে ফ্রেশ হয়ে গেল সীমা বেগমের কাছে। তখন উনি রান্নাঘরে ছিলেন, ওকে ফিরতেও দেখেছেন। আমান রান্নাঘরে গিয়ে মাকে জড়িয়ে ধরে বেশ কয়েকবার সরি বললো। এমন ভুল আর জীবনেও করবে না ওয়াদা করলো। তখন প্রত্যুত্তরে সীমা বেগম বললেন,

-”খেতে বসো।”

-”মেধাকে দেখছি না যে? ভাইয়ার সঙ্গে কোথাও গিয়েছে?”

-”হুম।”

-”কখন ফিরবে জানিয়েছে?”

-”হয়তো আর ফিরবে না। তারা বাসা থেকে একেবারেই চলে গেছে। যাওয়ার আগে তাদের বিয়েও সম্পূর্ণ করেছি। দুটোই ছেলে আমারই। একজনের দোষে আরেকজনকে তো আর
ভাসিয়ে দিতে পারি না।”

একথা শুনে আমান মাথা নত করে রইল। তার অশ্রু গড়িয়ে ভাতের সঙ্গে মিশে যাচ্ছে। তার কান্নার না আছে শব্দ আর না বর্ণ। সীমা বেগম একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন আমানের দিকে। পাশের চেয়ারে নজর পড়তেই নীরবে কেঁদে ফেললেন তিনি। আমানের গলা দিয়েও ভাত নামলো না। সে হাত ধুয়ে উঠে চলে গেল। আদিত্য বাসা ছেড়ে চলে যাবে সে ভাবতেও পারে নি। তার ভাইট সহজে রাগে না আর রাগলে পরিণতি খুবই পীড়া দেয়। অর্থাৎ তার রাগ সহজে ভাঙবে না। এখন তার জন্যও বাসায় থাকা মুশকিল হয়ে যাবে। এসব ভেবে সে রুমে গিয়ে শব্দ করে কেঁদে ফেললো। মায়ের মুখের দিকেও তাকাতে পারবে না৷ উনি উনার সন্তানের কতটা ভালোবাসে সে জানে, অনুভবও করে। সারারাত কোনোমতে কাটিয়ে সে সকালবেলা আদিত্যের ফ্ল্যাটে ছুটে গেল। ঘড়িতে তখন প্রায় সাড়ে আটটা। মেধা সকালবেলা উঠে রান্নাঘরে টুকটাক কিছু কাজ করছিলো। আদিত্য ঘুমে বিভোর। তার কথা ভেবে সে মিটিমিটি হাসছিলো। গতরাতের কিছু কথা মনে পড়ে গেল তার। মানুষটা যে এত ফাজিল তা ধারণারও বাইরে ছিলো।
যদিও প্রেমে পড়ার আগে মনে হতো আদিত্য একটু বেশিই ভদ্র। এর দ্বারা প্রেম ট্রেম হবে না। কিন্তু না সেই তার প্রেমে ডুবলো। তারপর বুঝলো না এর মধ্যে সামান্য হলেও রসকষ আছে। কিন্তু গতরাতে পুনরায় প্রমাণ পেলো সে যেনো তেনো না রোমান্টিকের ডিব্বা একটা। একথা ভাবতে ভাবতে মেধা ফিক করে হেসে দিলো। আদিত্য মুখটা তখন দেখার মতো হয়েছিলো। তারা ফ্ল্যাটে আসার পর ফ্রেশ হয়ে খেয়ে বিশ্রাম নিয়ে ঘুরতে বের হয়েছিলো। ফিরেছিলো অনেক রাত করে। রাতের খাবারও সেরেছিলো বাইরে থেকে। কিন্তু রাতে যখন ফিরলো ফ্রেশ হয়ে ঘুমাতে যাওয়ার সময় বিপত্তি বাঁধল। সে
সময় কাটাতে ফ্ল্যাট গোছাচ্ছিল। মূলত অপেক্ষা করছিলো আদিত্যের ঘুমিয়ে যাওয়ার। কিন্তু না ধরা পড়েই গেল। হঠাৎ আদিত্য তাকে ডেকে বলে উঠলো,

-”অহেতুক এক কাজ বার বার করে সময় নষ্ট না করলেই কী নয়? অপেক্ষা করছি, জলদি রুমে এসো।”

To be continue……!!

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here