ময়ূখ পর্ব -০১

#গল্প-ময়ূখ
#লেখিকা_আনিকা_রাইশা_হৃদি
#পর্ব১
১.
নববধূবেশে লালশাড়ি পরনে বসে আছে একটা মেয়ে। মেয়েটার গালে ঠাস করে থাপ্পড় বসিয়ে দিলো তারই হবুবর নিভৃত।
মেয়েটা গালে হাত দিয়ে ভাবলেশহীন ভাবে তাকিয়ে রইলো নির্নিমেষ। তার চোখের কোণা বেয়ে একফোঁটা জল গড়িয়ে পড়লো কি?

নিভৃত অপরদিকে মুখ ফিরিয়ে কেবল একটা শব্দ উচ্চারণ করলো, ‘ছোটলোক’।

অতঃপর বেরিয়ে গেলো ঘর থেকে। মেয়েটার কানে ‘ছোটলোক’ শব্দটা ঝিঁঝিপোকার ডাকের মতো একটানা বাজতে রইলো। মেয়েটি স্তব্ধ হয়ে বসে আছে তার ঘরের খাটের এককোণে।সত্যিই কি সে ছোটলোক? তখনই তার বোনেরা ঘরে ঢুকলো। তার সাথে ঠাট্টা, মশকরা করছে। তার দুইবছরের ছোটবোন রথি বললো,
‘কিরে আপা দুলাভাই তো বাড়িতে এসেই তোর ঘরে ছুটে এলো। কি সুন্দর দুলাভাই! কি বললোরে আপা। বলনা।’

মেয়েটা কথা বলেনা কেবল সামনের জানালা দিয়ে বাইরে নিমগাছের ডালটায় তাকিয়ে থাকে। দুইটা শালিক বসে আছে। নিজেদের মধ্যে বাকবিতন্ডায় জড়িয়ে কিচিরমিচির শব্দ তুলে ঝগড়া করছে। রথির কথায় ফোড়ন কাটে মেয়েটার বড়বোন নিতু,
‘রথি দিনদিন বেশরম হয়ে যাচ্ছিস। বড়বোনের সাথে এভাবে কথা বলে।’

বড়আপার কথা শুনে কপাল কুঁচকে আসে ষোলো বছরের রথির। এতক্ষণ চুপ করে থেকে মুখ খুলে পুষ্প। পুষ্প সবার ছোট।
‘আমার আপারে কত সুন্দর লাগছে। ইস্, নজর না লাগুক।’

পুষ্পের কথা শুনে নিতু, রথি হাসি মুখে তাকায় তাদের বোনের দিকে। হলদে রঙের গাঁয়ে লালবেনারসি।মাথায় ঘুমটা টানা। কোমড় সমান চুলগুলোকে মাঝ বরাবর সিঁথি করে খোঁপা করা। মুখে কোনো সাজ নেই। ডাগরডাগর চোখগুলোতে গাঢ় করে কাজল দেওয়া। সমুদ্রের মতো চোখগুলোর সৌন্দর্য বেড়ে গিয়েছে কয়েকগুণ।গাঁ ভর্তি গয়না। বোনদের মাঝে সবচেয়ে সুন্দরী মেয়েটা। বড়বোন নিতু মাশাআল্লাহ বলে বোনের কনিষ্ঠ আঙুলে কামুড় দিয়ে দেয়। যেন নজর না লাগে। মেয়েটি মলিন মুখে মৃদু হাসে। বোনদের জন্য আজ স্বেচ্ছায় সে বলি হবে। নাকি আরো কোনো কারণ আছে?

২.
টিনের ঘরটা ছোট। ছিমছাম।মাথার উপর সিলিং ফ্যান ঘুরছে। বেতের সোফায় বসে আছেন মকবুল আলম, মেয়েটার বাবা তিনি। অপরসোফায় বসে আছেন নাজমুল রহমান। তিনি নিভৃতের বাবা। এছাড়া এখানে উপস্থিত আছে মিরা রহমান। তিনি শান্ত ভঙ্গিতে বসে নিভৃতের দিকে অসহায় চোখে তাকিয়ে আছেন। মিতু, মিতুর বরও উপস্থিত। ওরা সম্পর্কে নিভৃতের বড়বোন আর দুলাভাই। কাজী সাহেব নিজের কাজ করে যাচ্ছেন।

রাগে, ক্ষোভে, অভিমানে নিভৃত নিচের দিকে তাকিয়ে বসে আছে। ফর্সা মুখটা লালবর্ণ। হাতদুটো মুঠ করা। তার বাবা, মা এতো পাষাণ কি করে হলো! নিভৃত কি করে বিয়েটা করবে একবার ভাবলোনা! নিজের আটবছরের ভালোবাসা হারিয়েছে ছয়মাসও হয়নি। এরমাঝেই আবার দ্বিতীয়বার বিয়ের পিঁড়িতে বসিয়ে দিলো তাকে। মায়ের প্রতি অভিমানটা গাঢ় হয় তার। আত্মহত্যার ভয় দেখানোটা কি খুব বেশি জরুরি ছিলো! রাগে মাথার রগগুলো ফুলে উঠে। ভেঙে গুঁড়িয়ে দিতে ইচ্ছে করে সবকিছু। তবে সে ওয়াদাবদ্ধ।

কাজী সাহেব কনের ঘরের দিকে যান। কবুল শব্দটা শোনে আর সিগনেচার নিয়ে ফিরে আসেন সাদা পাঞ্জাবি পরিহিত সোফায় বসা বরের দিকে। নিভৃত মায়ের দিকে অগ্নি দৃষ্টিতে তাকিয়ে কবুল শব্দটা উচ্চারণ করে। তার গলায় যেনো কেউ পাথর বসিয়ে দিয়েছে। অতি কষ্টে জীবনে দ্বিতীয়বার কবুল নামক শব্দটা উচ্চারণ করে সে। পার্থক্য একটাই আজ থেকে দেড় বছর আগে শব্দটা উচ্চারণ করেছিলো সে আনন্দে। আর আজ উচ্চারণ করছে রাগে, ক্ষোভে। সব রাগ গিয়ে পড়ে কনে বেশে মেয়েটার উপর। মেয়েটাকে না করার পরও কেনো সে বিয়েতে রাজি হলো।

কবুল বলার সাথেসাথে উঠে বাইরে এসে নিজের গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়ে নিভৃত। ছোটলোকদের তার জীবনে কোনো দাম নেই। তার বাবা যে মেয়েটার বাবাকে টাকা দিয়ে সাহায্য করেছে নিভৃত বেশ ভালো করেই জানে। ফরিদপুর থেকে সে রওনা দেয় ঢাকা ধানমন্ডি।

ছেলের ব্যবহারে নাজমুল হতাশার নিশ্বাস ছাড়েন। বন্ধু আলমের দিকে তাকিয়ে মলিন হাসেন। আলম পরিস্থিতি সামাল দিতে স্ত্রী মর্জিনাকে হাক ছেড়ে মিষ্টি আনতে বলেন। মর্জিনা মিষ্টি নিয়ে আসেন। তবে কারো গলা দিয়ে আদোও এই মিষ্টি নামবে কিনা সন্দেহ।

৩.
অবশেষে বেজে যায় বিদায়ের ঘন্টা। মেয়েকে জড়িয়ে ধরে আকাশ কাঁপিয়ে কাঁদেন মর্জিনা।
‘মৌন, মা। এই বাবা মারে ভুল বুঝিস না মা।’

কান্নায় গলা আটকে আসে মর্জিনার। আজ অভাবে পড়ে ফুলের মতো মেয়েটাকে একটা বিবাহিত ছেলের সাথে বিয়ে দেওয়া লাগছে। অভাব কি এতোটাই অসহায় করে তুলে মানুষকে। মকবুল কোন হিসেবে মেয়ের সামনে দাঁড়াবেন। সদ্য এইচএসসি দেওয়া মেয়েটাকে নিজের হাতে বলি দিয়ে দিলেন। তার যে আর কোনো উপায় ছিলোনা। নিতু,রথি, পুষ্প কাঁদছে। এতক্ষণ নির্বিকার থাকলেও এখন মৌন নামের মেয়েটি কাঁদছে। আকাশে, বাতাসে তার কান্নার শব্দ প্রতিফলন হচ্ছে। বাবাকে জড়িয়ে ধরে, মাকে জড়িয়ে ধরে সে। অতঃপর প্রাণের বোনগুলোর সাথে আলিঙ্গন করে পা বাড়ায় অনিশ্চিত এক ভবিষ্যতের দিকে। দুইটা গাড়ি রাখা। যদিও আজ ফরিদপুরে থাকার কথা ছিল। তবে ঢাকায় রওনা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন নাজমুল। একা বাড়িতে নিভৃত যদি কিছু করে ফেলে। ভাবতেই বুক ধক করে উঠে তার।যদিও বাড়িতে নাজমুলের মা আছেন । বড়ো আদরের একমাত্র ছেলে। স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে দেখেন তিনিও তাকেই দেখছে। দুজনের কপালে চিন্তার ছাপ। এভাবে বিয়ে দেওয়াটা কি ঠিক হলো!

গাড়িতে উঠে পিছনে ফিরে তাকায় মৌন। পাঁচটা মুখ অসহায়ভাবে তাকিয়ে আছে। টিনের ঘরটা, পাশে বড় আমগাছটা, প্রিয় পেয়ারা গাছটা,নিজের হাতে তৈরি কবুতরের টং, বারোটা কবুতর। সব ছেড়ে গ্রামের মেয়েটা পাড়ি জমায় ঢাকা। তবে মেয়েটা কি জানে দুইটা তৃষ্ণার্থ চোখ দূর থেকে অসহায়ভাবে তাকিয়ে তাকে দেখছিলো! এই অনিশ্চিত জীবনে কি হতে যাচ্ছে!

________________
চারঘন্টা গাড়ি চালিয়ে নিভৃত প্রবেশ করে তাদের ‘একগুচ্ছ সুখ’ নামক বাড়িটিতে।যদিও এখন সুখের লেশমাত্রও নেই। মাগরিবের আজান দিচ্ছে দূরে। আবছা আলো চারদিকে।নিস্তব্ধতা বিরাজমান। বিশাল বড় গার্ডেনের এককোনায় একটা কবরে দৌঁড়ে যায় নিভৃত। রুহানি। তার রুহানির কবর এটা। সিমেন্টে করা সাদা টাইলসের কবরটার পাশে বসে নিভৃত। হাতবুলায় কবরটায়। তার দুচোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ে। সে চিৎকার করে কাঁদে। ‘ছেলেদের কাঁদতে নেই’ এই বাণীকে ভুল অ্যাখা দিয়ে নিভৃত কাঁদছে। বাড়ির মালি, ড্রাইভার আনোয়ার অসহায় চোখে তাকিয়ে থাকেন। এরপরের ঘটনা তাদের জানা। প্রতিদিন এই কবরের পাশে অনেকটা সময় কাঁটায় নিভৃত। এখন সে ঘরে গিয়ে ভাঙচুর করবে। তাদের আফসোস হয় বুয়েট থেকে পাশ করা ইঞ্জিনিয়ার ছেলেটার একি দশা!

নিভৃত বারেবারে ক্ষমা চায়। কাঁদতে কাঁদতে বলে,
‘এই রুহানি। তুমি কি আমার সাথে রাগ করেছো? আমি ইচ্ছা করে বিয়ে করিনি তো! মাকে আমি কতটা ভালোবাসি তুমি জানোনা। মার অসুস্থতা দেখে আমি ভরকে যাই। বিশ্বাস করো রুহানি। ঐ মেয়েটাকে আমি কোনোদিন মেনে নিবোনা। কোনোদিন না।’

অপরপাশ থেকে কোনো জবাব আসেনা। আশেপাশের নিস্তব্ধতা ভেদ করে শুধু নিভৃতের কথাই বাজে। নিভৃত উঠে ঘরের দিকে পা বাড়ায়। বাড়ির দুইজন কাজের মহিলা ভয়ে তটস্থ থাকেন। নরম, লাজুক ছেলেটা এখন পাগলাটে। তাদের ভয় হয়। নিভৃত যদি তাদের কিছু বলে বা করে বসে। নিভৃত দুতলায় নিজের ঘরে ঢুকে ইচ্ছেমতো ভাঙচুর করলো। সামনে যা পেয়েছে সব। আলমারির ভিতর থেকে হুইস্কির বোতলটা নিয়ে ঢকঢক করে গলায় ঢালে সে। বেডের সামনে রুহানির হাসোজ্জল ছবিটার দিকে তাকিয়ে বলে,

‘এই রুহানি দেখো তোমার বাবুইপাখি ভালো নেই। তুমি হাসছো রুহানি! আমার কষ্ট তোমার নজরে পড়ছেনা। তুমি খুব খুব নিষ্ঠুর। এতো নিষ্ঠুর কি করে হলে রুহানি।’

হুইস্কির বোতলটা অর্ধেক শেষ। অদ্ভুত! নেশা ধরেনা। সে যে একজনের নেশায় ডুবে। সে তো পরপারে। কিভাবে পাবে তার দেখা, তার ছোঁয়া।

খাটের পাশে হেলান দিয়ে নিভৃত কপালে হাত দেয়। মাথাটা তার ভিষণ যন্ত্রণা করছে। অপরহাতে তার মদের বোতল। থমমেরে কতক্ষণ বসে থেকে উদভ্রান্তের মতো হাসে নিভৃত। আবার চুপ হয়ে কেঁদে দেয়। কেনো তার সাথে এমন হলো? ভালোবাসায় এতো কষ্ট কেনো? ভালোবাসা নামক বিষফোঁড়ার টনটন করা ব্যথাটা শরীর,মন, মস্তিষ্ককে অবশ করে দিচ্ছে। নিভৃত হারিয়ে যায় পুরানো সেই দিনগুলোতে। যেখানে সে ছিল, তার রুহানি ছিল। তাদের মধুর কিছু স্মৃতি ছিল।
______________

পাশের বাসাটাই রুহানিদের ছিল একসময়। নাজমুল রহমান আর রিজভী আহমেদ ছিলেন বিজনেস পার্টনার। তার পাশাপাশি খুবই ভালো বন্ধু। তখন নিভৃতের চারবছর বয়স। রিজভী রহমানের স্ত্রী অহনা জন্ম দেন একটা ফুটফুটে মেয়ে। নিভৃত হসপিটালে ছোট মেয়েটাকে দেখে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থাকে। নিজের ছোট ছোট হাতে কোলে নেওয়ার চেষ্টা করে মেয়েটাকে। আদোও আদোও বুলিতে বাবা-মাকে বলে এটা তার পুতুল। তার বউ পুতুল। রিজভী, নাজমুল তা দেখে হো হো করে হাসেন। সময় পেরিয়ে যেতে থাকে। নিভৃতের পাগলামি ততই বাড়তে থাকে। নবযৌবনা রুহানিও সায় দেয় তার পাগলাটে প্রেমিকের প্রেমে।
হঠাৎই একটা শব্দে বাস্তবে ফিরে নিভৃত। তার হাসি মিলিয়ে যায়। সে যখন অতীত হাতরায় তখন তার ঠোঁটে ফুটে মৃদু হাসি। ছুঁতে না পারলেও সে অনুভব করে তার রুহানিকে।

ঘরে ঢুকে একটা নারী অবয়ব। এটা কার অবয়ব?

(চলবে?)….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here