ময়ূখ পর্ব -০২+৩

#ময়ূখ
#লেখিকা_আনিকা_রাইশা_হৃদি
#পর্ব-২

৪.
নারী অবয়বটা স্পষ্ট হতেই নিভৃত দৌঁড়ে গিয়ে তাকে দেয়ালের সাথে চেপে ধরলো। মৌন ছাড়া পাওয়ার জন্য ছুটাছুটি করছে। তবে নিভৃতের তুলনায় মৌনর শক্তি ক্ষীণ। চোখদুটো খিঁচে বন্ধ করে রাখলো মৌন। তার হাত কাঁপছে। তার দুইহাত এখন নিভৃতের দখলে।

বাড়িতে ফিরেই শ্বাশুড়ির কথায় ভয়ে, আতঙ্কে এই ঘরে প্রবেশ করেছে সে। হাতে আরো চাপ পড়ায় মৃদু আর্তনাদ করে চোখ খুলে ভয়ে ভয়ে সামনে তাকালো মৌন। সারাঘর অন্ধকার। বাইরের আলোর ছিটেফোঁটার খেলায় ভয়ংকর লাগছে ঘরটা। এই ভয়ংকর আলোর খেলায় মৌনর চোখে পড়লো দুইটা লাল চোখ। মাথার চুলগুলো এলোমেলো।

নিভৃত হঠাৎ করে হো হো হেসে উঠে। মৌন অবাক চোখে তাকিয়ে আছে কেবল। দেয়ালে দেয়ালে ঝংকার তুলছে সে হাসি। হাসিতে মিশে আছে খানিকটা ক্রোধ, খানিকটা কষ্ট আর খানিকটা দহন জ্বালা। নিভৃত নেশালো কন্ঠে কিঞ্চিৎ অভিমানে বললো,
‘রুহানি। তুমি এসেছো। তুমি খুব পঁচা রুহানি জান।’

অতঃপর একটা ফুঁ দিলো মৌনের মুখে। উত্তপ্ত নিঃশ্বাসের দহনে কেঁপে উঠলো মৌন। শিরদাঁড়া বয়ে গেলো একটা নতুন শিহরণ। তবে রুহানি নামটা তীরের মতো গিয়ে বিধঁলো বুকে। কিন্তু কেন? স্বামীর মুখে তার প্রাক্তন স্ত্রীর নাম শুনে? নাকি অন্যকারণ। হঠাৎ করেই একটা ধাক্কায় স্তম্ভিত ফিরে মৌনর। নিভৃত তাকে ধাক্কা দিয়ে নিচে ফেলে দিয়েছে। ঘটনার আকস্মিকতায় নিজেকে রক্ষা করতে পারেনি মৌন। নিভৃত মাথা চেপে চিৎকার করে বলে,
‘এই মেয়ে এই। আমার ঘরে কি তোমার? বের হও। বের হও।’

ফ্লোরের কাঁচের টুকরোতে লেগে ছিন্ন বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় মৌনর হাত। মৌন হাতটা নিজের চোখের সামনে ধরে তাচ্ছিল্যের হাসি হাসে। সবাই বলতো সে নাকি প্রখর আত্মসম্মানবোধসম্পন্ন। হায়! আজ কোথায় গেলো সেই আত্মসম্মান!

নিভৃত টেনে তুলে মৌনকে। টানতে টানতে নিয়ে যায় বারান্দায়। লালবেনারসির আঁচল ঝুঁলছে ফ্লোর নামক কৃত্রিম মাটিতে। আরেকটা ধাক্কা দিয়ে বারান্দায় ছুঁড়ে ফেলা হয় তাকে। নিভৃতের পায়ে জুতা ছিলো তবে মৌনের খালি পা ঝাঁঝড়া হয়ে যায় কাঁচের টুকরোতে লেগে। ফ্লোর সাদরে গ্রহণ করে নববধূর পায়ের তরতাজা রক্ত। রক্তে রক্তে বিলীন হয়ে যায় সাদা টাইলসের ফ্লোরটা। বিছানায় হেলান দিয়ে বসে কনিয়াকের একটা বোতল নিয়ে চুমুক লাগায় নিভৃত। ডুবে যায় অতীতে। সেখানে কেবল আছে রুহানি, রুহানি আর রুহানি।

৫.

ছোটথেকে ভালোবাসতো কেবল নিভৃত। রুহানি পাখি তো ছোট, বোকা। ভালোবাসা কি বুঝতোনা। শুধু জানতো মাথার উপর বাবার পরে আরেকটা হাত আছে। ভরসার হাত। তার বাবুই পাখি। স্কুল, কলেজে কোনো ছেলে রুহানিকে ডিসটার্ব কিংবা প্রপোস করলেই মেরে হসপিটাল পাঠিয়ে দিতো নিভৃত। সবারবেলা সে লাজুক, নরম। রুহানিকে কিছু বললেই নিভৃত হয়ে উঠতো পাগলাটে। উজ্জ্বল শ্যামবর্ণের গজদন্তিনীর মুখটায় এতো মায়া। কুঁকড়া চুলগুলোর সুঘ্রাণে মাতোয়ারা হয়ে যেতো নিভৃত। বন্ধুমহলে লাভবার্ডস বলে খ্যাতি ছিলো তাদের। সব ভালো চলছিলো।

রুহানি জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনার্স কমপ্লিট করলো। নিভৃত বুয়েট থেকে ইন্জিনিয়ারিং পাস করলো।বাবার অফিসে নিজের যোগ্যতায় চাকরি নেয়। আহা! কি সুন্দর দিন তাদের। মুভি দেখা, রবীন্দ্র সরোবর ঘুরে বেড়ানো, একসাথে হাতে হাত রেখে হাঁটা। পারিবারিক সম্মতিতে তাদের ভালোবাসা পবিত্রতা পায়। বিয়ে নামক সুন্দর একটা বাঁধনে বাঁধা পড়ে প্রেমিকযুগল। একসাথে ঘুরে বেড়ায় সুইজারল্যান্ড, ব্যাংকক, মালদ্বীপ। কি সুন্দর সেসব দিন!

______________

‘আহা রুহানি জান চোখ ধরেছো কেন?’
‘এই তো বাবুই পাখি একটু।’

চোখ খুলে একটা বক্স হাতে পেলো নিভৃত। প্রশ্নবিদ্ধ চোখে রুহানির দিকে তাকাতেই দেখে তার দুষ্টু পাখি মিটিমিটি হাসছে। সে চোখ ফিরিয়ে বক্স খুলতেই যা দেখলো তাতে ধপ করে পাশে বসে পড়লো। একজোড়া ছোটবাচ্চার জুতা। পাশে বড় বড় করে লেখা, ‘নিভৃত সাহেব আপনার ভালোবাসায় ভাগ বসাতে কেউ একজন আসছে।’

সেদিন খুশিতে রুহানিকে কোলে নিয়ে পুরোবাড়ি ঘুরেছিলো নিভৃত। আশেপাশের সবাই, আত্মীয় স্বজনদের বাড়িতে মিষ্টি পাঠানো হয়েছিলো। ওদের খুশিতে হেসেছিলো এই বাড়ির গাছের প্রতিটা পাতা। তবে সে খুশি বেশিদিন স্থায়ী হলোনা।

রুহানির জ্বর, মাথাব্যথা লেগেই থাকতো। প্রথমে ডক্টর প্রেগ্ন্যাসির সময় এসব হয় বলে চালিয়ে দিতেন। তবে আস্তে আস্তে সমস্যা বাড়তে থাকে। খিচুঁনি হতো প্রচুর। দৃষ্টিশক্তি হ্রাস হয়ে যাচ্ছিলো। প্রেগ্ন্যাসির তখন দুইমাস। ডক্টর মোহরাম সব শুনে কয়েকটা পরীক্ষা দিলেন। ইলেকট্রো এনকেফালোগ্রাফি, ইলেকট্রোমায়োগ্রাফি, এম আর আই সব পরীক্ষা করে রিপোর্টে ধরা পড়ে রুহানির ম্যালিগন্যান্ট ব্রেনটিউমার। যা ক্যান্সারাস।

মাথার উপর আকাশ ভেঙে পড়ে যেন নিভৃতের। পায়ে তলা থেকে মাটি সরে যায়। এবরশন করানো হয় রুহানিকে। রুহানি প্রচুর ভেঙে পড়ে। নিভৃতের সাথে কথা বলা বন্ধ করে দেয়। নিভৃতের কি কষ্ট হয়নি? প্রচুর কষ্ট হয়েছে।বাচ্চাটা তো তারও ছিলো। তবে তার কাছে রুহানি বেশি গুরুত্বপূর্ণ।

রুহানিকে নিয়ে ছুটে যায় সেই সুদূর আমেরিকা। সাথে ছিলেন রুহানির বাবা-মা।

৬.
একটা ঘটনা আজো খুব মনে পড়ে নিভৃতের। চোখের জলটা মুছে আবারো কল্পনায় ডুব দেয় নিভৃত।
অপারেশনের তিনদিন আগে বোধহয়,

হসপিটালের বেডে শুয়ে রুহানি। শুকিয়ে জীর্ণ শীর্ণ হয়ে গিয়েছে তার শরীর। পাশেই তার হাত ধরে মাথা নিচু করে বসে আছে তার বাবুইপাখি। রুহানি মৃদু স্বরে ডাকে,
‘বাবুই পাখি।’

নিভৃত হকচকিয়ে বলে,
‘হ্যাঁ, হ্যাঁ জান বলো। কি?’
‘আমার সারাদেহ গানটা শুনাবে বাবুইপাখি?’
‘রুহানি!’
‘প্লিজ বাবুইপাখি।’

নিভৃত ভগ্ন কন্ঠে গান ধরে,
আমার সারা দেহ খেয়ো গো মাটি, ও ও ও
এই চোখ দুটো মাটি খেয়ো না
আমি মরে গেলেও তারে দেখার সাধ মিটবে না গো, মিটবে না
তারে একজনমে ভালোবেসে ভরবে না মন, ভরবে না
ওরে, ইচ্ছে করে বুকের ভেতর লুকিয়ে রাখি তারে
যেন না পারে সে যেতে আমায় কোন দিনও ছেড়ে
আমি এই জগতে তারে ছাড়া থাকবো না গো, থাকবো না
তারে একজনমে ভালোবেসে ভরবে না মন, ভরবে না
ওরে, এই না ভুবন ছাড়তে হবে দু’দিন আগে পরে
বিধি, একই সঙ্গে রেখো মোদের একই মাটির ঘরে
আমি ওই না ঘরে থাকতে একা পারবো না গো, পারবো না
তারে একজনমে ভালোবেসে ভরবে না মন, ভরবে না।

গলা ধরে আসে নিভৃতের। ছুটে কেবিন থেকে বাইরে বেরিয়ে হাত কামড়ে কাঁদে সে। ভিতরে কাঁদে তার জান। আল্লাহর কাছে দোয়া চায় নিভৃত যেনো তাকে নিয়ে হলেও তার জানটাকে বাচাঁয় রাখে। স্বাভাবিক হয়ে আবার ফিরে আসে কেবিনে।

__________

অপারেশনে যাওয়ার আগের দিন প্রচুর কাঁদে দুজনেই। রুহানি নিভৃতের বুকে মাথা রেখে সিক্ত কন্ঠে বলে,
‘বাবুইপাখি আমি মরে গেলে তুমি বিয়ে করে নিও। বউকে কষ্ট দিয়োনা।’
‘রুহানি চড় খাবে।’

রুহানি শুনেনা সে কথা। তার মতো বলে যায়,
‘এই বুকের বাঁ পাশটায় কেবল আমার জায়গাটা রেখো। কাউকে দিয়োনা।’

পরে আবার বলে,
‘না, দিয়ো। যদি কখনো দেখো কেউ তোমাকে আমার মতো করে ভালোবাসে তাহলে তাকে এই বাঁ পাশটায় জায়গায় দিয়ো।’

‘রুহানি চুপ করো। জান।’
‘আমাকে মনে রেখো। এই পাগলীটা তার বাবুইপাখিকে অনেক ভালোবাসে। আর তুমি কিন্তু ওয়াদা করেছো নিজের কোনো ক্ষতি করবেনা।’

কিছুক্ষণ নিরবতা। ওয়াশিংটনের বাতাস ভারী হয় তাদের নিঃশ্বাসে। রুহানি নিরবতা ভাঙে,
‘ভালোবাসা বড়ই অদ্ভুত। কেউ কখনো ভালোবাসা চেয়েও পায়না আবার কেউ পেয়েও হারিয়ে ফেলে। কাউকে আবার প্রকৃতি পেতে দেয়না। ভালোবাসা চলনশীল। কখনো থেমে থাকেনা। একসময় পুরানো মায়া কাটিয়ে নতুন মায়ায় জড়ায়। সেই মায়া থেকে প্রেম। প্রেম থেকে ভালোবাসা আর ভালোবাসা থেকে প্রণয়। ভালোবাসা হারিয়ে তিমিরে ডুবলেও আবার সবার জীবনে ময়ূখ আসে।’
‘আমার জীবনে আসবেনা। আমার সব আলো তুমি।’
‘আসবে দেখো। তোমার জীবনেও আসবে।’

________________

রুহানির লাশ নিয়ে এক অন্য নিভৃত দেশে ফিরে। অপারেশনের মাঝপথেই এই পৃথিবীর সব বন্ধন, মায়া ত্যাগ করে পরপারে পাড়ি জমায় রুহানি।

চিৎকার করে আবার বর্তমানে ফিরে নিভৃত। একটা গানের লাইন আওড়ায়,
‘তারে একজনমে ভালোবেসে ভরবে না মন, ভরবে না।’

দেয়ালে হেলান দিয়ে আছে নববধূ। চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়ে জল। নিকষকালো অন্ধকার চারপাশে। মৌনের খুব কষ্ট হচ্ছে। কেন হচ্ছে? স্বামীর অবহেলা? হাতে পায়ের ব্যথা? অনিশ্চিত জীবন? অন্যের জন্য স্বামীর ভালোবাসা? কেন?

দূরে থেকে হুতুম পেঁচা ডাকছে। অদ্ভুত! ঢাকার ধানমন্ডির মতো শহরেও হুতুম পেঁচা আছে!
#ময়ূখ
#লেখিকা_আনিকা_রাইশা_হৃদি
#পর্ব-৩

৭.
মুখের সামনে কারো গরম নিঃশ্বাস টের পেয়েও ঘুম ভাঙলো না মৌনর। চারঘন্টা জার্নির ক্লান্তি, তীব্র শরীর ও মন ব্যথা নিয়ে সে গভীর ঘুমে। চোখ খুলে সামনে তাকানোর শক্তি হয়তো তার নেই। তবে থেমে থেমে নিজের হাত পায়ের জখমগুলোতে তীব্র যন্ত্রণা অনুভব করলো সে। মনে হচ্ছে কাঁচগুলো কেউ টেনে টেনে খুলছে।

বেলা এগারোটা। নীল আকাশে রাজত্ব করছে তেজস্বী সূর্য। সূর্যের তেজে হতাশ চোখে তাকিয়ে পৃথিবীর মানবজাতি। সূর্যের সে খেয়াল আছে নাকি! সে তো নিজের তেজ দেখিয়ে মহাখুশি।

‘মৌন, মা। উঠো মা।’

শাশুড়ীর ডাকে ঘুম ভাঙে মৌনর। আস্তে আস্তে চোখ খুলে নিজেকে ধাতস্থ করে সে কোথায়। এটা কোন জায়গা? আশেপাশে তাকিয়ে খুঁজে তার চৌকি, পড়ার টেবিল, তার বোন রথি। কোথায় সব!

খানিক সময়বাদে মনে পড়ে এটা ফরিদপুর নয় এটা তার শশুড় বাড়ি ঢাকা ধানমন্ডি।

‘মৌন, বাবুই তোমার গাঁয়ে হাত তুলেছে?’

নিজেকে সামলিয়ে মৌন বলে,
‘না, মা।’

মৌনের হাত দুটো সামনে টেনে ধরেন মিরা রহমান। এলোমেলো ব্যান্ডেজ পেঁচানো।
‘এগুলো কি করে হলো মা।’
‘আসলে, ঘরে অনেক কাঁচের টুকরো ছিলো যে। লেগে কেঁটে গেছে।’

মিরা রহমান বিষয়টি আর ঘাটলেন না। উনি জানেন এগুলো তার ছেলেরই করা। উনি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন,
‘খাটে তোমার জন্য শাড়ি রেখেছি। ফ্রেশ হয়ে ডাক দিয়ো আমি পরিয়ে দিবো।’
‘সমস্যা নেই মা। আমি পারবো।’
‘আচ্ছা, আসো। হাঁটতে পারবে?’
‘জ্বি।’

শাশুড়ী বেরিয়ে যেতেই দেয়াল ধরে ঘরে আসে মৌন। অবিশ্বাস্য হলেও সত্য তার হাত,পায়ে কোনো কাঁচ বিঁধে নেই। এবং ব্যথাটাও কম।

________________

হাত, পায়ের এলোমেলো ব্যান্ডেজ খুলে ফেলে মৌন।ফ্রেশ হয়ে নীল রঙা শাড়িটা পরে নিচে আসে সে। সোফায় বসে পেপার পড়ছেন নাজমুল। সাথে চা খাচ্ছেন। মিতু পাশে বসেই টিভি দেখছে। বিশাল ড্রয়িং রুম। মৌনকে দেখে মিতু ইশারা করলো পাশে এসে বসতে। মৌন ধীর পায়ে এগিয়ে গিয়ে সোফায় বসলো।

‘তুমি কিন্তু আমার অনেক ছোট। আমি তোমায় ভাবি ডাকবো আর তুমি আমাকে আপু ডেকো। কেমন?’
‘ঠিক আছে আপু।’
‘আসো, খাবারটা খেয়ে নাও। আম্মু সকালেই ডাকতে চেয়েছিলেন। আমিই না করেছি। এতো জার্নি করেছো একটু রেস্ট প্রয়োজন।’

নাজমুল মেয়েটার দিকে তাকিয়ে আছেন। মেয়েটা বড়ই মিষ্টি, নম্র, ভদ্র। নাজমুল বলেন,
‘মা, তুমি কি আমার উপর রাগ করে আছো? কিংবা তোমার শাশুড়ীর উপর?’
‘না, বাবা।’
‘আচ্ছা, তুমি ব্রেকফাস্ট করে আমার ঘরে এসো। কিছু কথা বলা প্রয়োজন।’
‘জ্বি।’

ডাইনিং টেবিলে অসহায় ভাবে বসে আছে মৌন। হাতের যে অবস্থা! নিজ হাতে খাওয়া সম্ভব না। তখনই মিরা একটা প্লেট নিয়ে এসে চেয়ার টেনে মৌনর পাশে বসেন। গরম ভাত আর মুরগির মাংস লেবু দিয়ে মাখিয়ে একটা লোকমা মৌনের সামনে ধরেন। মৌন ছলছল চোখে তাকিয়ে আছে। মিরা ইশারা করেন লোকমাটা খেতে। মৌন হা করে মুখে পুরে নেয়। অবাক চোখে তাকিয়ে মমতাময়ী শাশুড়ীকে দেখছে। ফরিদপুরে মিরার অনেক সুনাম আছে। প্রত্যেক ইদে, শীতে মানুষকে হাত ভরে দান করতেন। মৌন প্রায়ই উনি ঢাকা থেকে গেলে উনাদের বাসায় যেতো। নিম্নবিত্ত বলে কখনোই অবহেলা করতেন না। উজ্জ্বল ফর্সা, খোঁপা করা, ক্রিম কালার শাড়ি পরিহিতা মহিলাটিকে মৌনের খুবই আপন মনে হচ্ছে। খুব!

‘শোনো মৌন মা। আমার ছেলেটাকে একটু সময় দাও। মাত্র একটা ট্রমা থেকে উঠেছে। রুহানিকে ও সত্যিই অনেক ভালোবাসতো। আমার নরম ছেলেটা কেমন পাগলাটে হয়ে গেছে। ওঁর মন অনেক ভালো মা। একটু মানিয়ে নাও। আমাদের ভুল বুঝোনা। ছেলেকে সুখী দেখতে কে না চায়? আমরা কি বেশি স্বার্থপর হয়ে গেছি? আমি জানিনা। তবে তোমার চোখে কি যেন দেখেছি। আমার মনে হয়েছে। হ্যাঁ, এই মেয়েটাই পারবে আমার বাবুইটাকে সুখি করতে। পারবেনা মা?’
মৌন চুপ করে আছে।মিরা রহমান নিরবে অশ্রু বিসর্জন দেন। তার চশমা ঝাপসা হয়ে উঠে। উনি বাঁ হাতে শাড়ির আঁচল দিয়ে তা মুছে নেন।

৮.
‘বাবা, আসবো?’
‘আসো।’

নাজমুল ইজিচেয়ারে হেলান দিয়ে বসে আছেন। ছেলের চিন্তায় তার চোখের তলা কালো হয়ে গেছে। বাড়িটার সবচেয়ে বড় ঘরের এটি বোধহয় একটি। বিশাল খাট, পাশে ইজি চেয়ার, দেয়ালে সেট করা আধুনিক টেলিভিশন, নিভৃতের ঘরের মতো একটা ডিভান। আর পাশেই বিশাল বুকসেলফে বইয়ের সমাহার।

মৌন দাঁড়িয়ে রইলো। হাতে পায়ে মাঝেমাঝে চিনচিন ব্যথা হয়। ছোট কাঁচ বোধহয় রয়ে গেছে ভিতরে। একটু আধটু চুলকায়। নরম পায়ে কাঁচগুলো তীব্রভাবেই ডেবেছিলো।

‘খাটে বসো।’

কিছুক্ষণ নিরবতা। বারান্দা দিয়ে রোদ এসে পড়ছে নাজমুলের মুখে। পুত্রের চিন্তায় লোকটা যে অনেক হতাশ তা যেন রোদের আলোয় আরো গাঢ় করে প্রস্ফুটিত হচ্ছে।

‘মৌন মা।’
‘জ্বি,বাবা।’
‘আমার ছেলেটা কিন্তু খারাপ না, মা। অধিক শোকে সে হিতাহিতজ্ঞানশূন্য হয়ে পড়েছে। আমি বাবা হয়ে কিছুতেই তা মেনে নিতে পারছিলাম না। নিভৃতের মা বললেন ছেলেকে আবার বিয়ে দিলে কেমন হয়?’

নাজমুল থেমে আবার বলেন,

‘আমি প্রথমে না মানলেও ছেলের দুর্দশা দেখে মানতেই হলো। মিরা তোমার কথা বললো। আমিও আমার বাল্যবন্ধু আলমের কাছে অন্যায় আবদার করে বসলাম। ব্যাংকের টাকা শোধ করতে ও যখন টাকা চাইতে আমার কাছে এলো আমি বিনিময় তোমাকে পুত্রবধূ হিসেবে চেয়ে নিলাম। আমি জানি কাজটা ভালো হয়নি। তবে আমি অপারগ ছিলাম মা। এই অসহায় বাবাকে ক্ষমা করে দিও মা।’

মৌন মাথা নিচমুখী করে এতক্ষণ সব শুনছিলো। এবার মুখ তুলে চেয়ে বললো,
‘এভাবে বলবেন না বাবা। আমার নিজেকে ছোট মনে হয়।’
‘বাবা বলে ডেকেছো যেকোনো দরকার হলে আমাকে জানাবে। এই টাকাটা রাখো। আর পড়াশোনার ব্যাপারে কি সিদ্ধান্ত নিয়েছো? পাবলিকে পরীক্ষা দিবে? কোচিংয়ে ভর্তি করিয়ে দিবো?’

নাজমুল একহাজার টাকার পাঁচটা নোট গুঁজে দিলেন মৌনর হাতে। মৌনের না তিনি শুনেননি।
‘আপনি যা ভালো করেন বাবা।’
‘দোয়া করি সুখি হও মা।’

৯.
দাদিশাশুড়ি দিলারার সাথেও বেশ জমলো মৌনের। তিনি হাঁটতে পারেন না। হুইলচেয়ারে চলাফেরা করেন। দিলারার একটা কথা খুবই মনে ধরেছে মৌনর।
‘নারীই পারে পুরুষের ক্ষত ভুলাতে। পুড়তে পুড়তে অঙ্গার, ছাই হয়ে যাওয়া বুকটাকে আবার বাগানে রুপান্তরিত করতে। কেবল প্রয়োজন মায়ায় জড়ানো। ভালোবাসা নামক পবিত্র বাঁধনে আটকে দেওয়া।’

এ বাড়িতে দুইজন বুয়া আছেন। একজন ছুটা বুয়া আরেকজন স্থায়ী। তাদের সাথেও কথা হলো। এবাড়ির প্রতিটা সদস্যই ভালো। অমায়িক তাদের ব্যবহার। তবে আসল লোকটাই যে মৌনকে মানেনা। আদোও মানবে কিনা মৌনের জানা নেই।

______________

মৌন নিভৃতের ঘরে ডিভানে বসে ঘরটা পর্যবেক্ষণ করছে। এই বাড়িটা একটা দুইতালা ডুপ্লেক্স বাসা। দুতালায় দক্ষিণ পাশে ঘরটাই নিভৃতের। বাড়ির প্রতিটা কোণায় কোণায় আভিজাত্যের ছোঁয়া। এঘরটায়ও তেমনি। বিশাল রাজকীয় খাঁট, রাজকীয় ডিভান, শখের জিনিসে ঠাসা প্রতিটা কোণায়। খাটের সামনের দেয়ালটায় রুহানির ছোট থেকে শুরু করে তাদের বিয়ের সকল ছবি। সবচেয়ে বেশি মন কাড়ে রুহানির হাসোজ্জল ছবিটা। কি সুন্দর হাসি! পাশেই বিশাল দেয়াল ঘড়ি। মৌন মিতুর মুখে শুনেছে এই ঘরের প্রতিটা জিনিস নিজের হাতে সাজিয়েছে রুহানি। ওঁর রাজকীয় ঘর, পুরানো সু-পিস বেশ পছন্দ ছিলো। তাই এমন রাজকীয়ভাবে ঘর সাজিয়েছিলো সে। মৌনর হঠাৎ খারাপ লাগছে। সে কি স্বার্থপর হয়ে গেলো? কারো সাজানো গুছানো সংসারে সে কি পরগাছা? নাকি কোনো পরিযায়ী পাখি? হায়! কত স্বপ্ন নিয়ে দুজনে মিলে নিজের ছোট সংসার সাজিয়েছিলো। আজ কোথায় গেলো সেই সংসার। একজন মাটির নিচে আরেকজন মাটির উপরে তার দহনে পুড়ছে। এ কোন খেলা নিয়তির! রুহানিকে মৌন একবার দেখেছিলো। তাদের গ্রামে গিয়েছিলো সে। অনেক হাসি-খুশি একটা মেয়ে ছিলো।

ঘরে প্রবেশ করে বিধ্বস্ত নিভৃত। পরনে কালো টাউজার, সাদা টি-শার্ট। মৌনকে দেখেই তেড়ে গেলো তার কাছে। মৌন ভয় পেলেও তা প্রকাশ করলোনা। একদৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখলো একসময়ের তার দেখা সুদর্শন পুরুষটার বিষণ্ণতা, হতাশা, প্রেয়সীর মৃত্যুর শোকে শরীর, চেহারার বেহাল দশা।

‘এই বেয়াদব মেয়ে। তুমি আবার আমার ঘরে এসেছো। তুমি কি ভেবেছো আমার রুহানির জায়গা নিবে? জীবনেও না। স্বার্থপর, ছোটলোক মেয়ে।’

মৌন কিছুই বলছেনা দেখে আরো মাথা খারাপ হয়ে যায় নিভৃতের। তাকে পাশের দেয়ালে নিয়ে চেপে ধরে। হাতের ব্যথা প্রাপ্ত স্থানে আঘাত লাগায় ‘আহ্’ করে উঠে মৌন।

মৌনকে দেয়াল থেকে শরীরে দরজার দিকে টেনে নিচ্ছে নিভৃত।
‘আপনি আমার সাথে এমন ব্যবহার করতে পারেন না। আমারও এই ঘরে অধিকার আছে। আমি আপনার অর্ধাঙ্গিনী।’

ছোট মেয়েটার মুখে এরূপ কথা শোনায় থেমে যায় নিভৃত। মাথা গরম হয়ে যায় তার। আবারো চড় বসিয়ে দেয় মৌনের গালে। মৌন চোখে জল, মুখে তাচ্ছিল্যের হাসি নিয়ে তাকিয়ে আছে কেবল।

‘একদম অধিকার দেখাবিনা।এটা আমার আর রুহানির ঘর। তুই একটা ছোটলোক। তোর বাবাও….

‘ব্যস, অনেক বলেছেন। আমাকে যত যাই বলুন আমার বাবাকে একটা বাজে কথা শুনালে আমি ভুলে যাবো আপনার সাথে আমার সম্পর্ক। বিয়ে করে এই বাড়িতে এসেছি। উড়ে এসে জুড়ে বসেনি। এই ঘরেই থাকবো।’

তেজস্বিনীর গলায় থমকে যায় নিভৃত। বাথরুমে গিয়ে ঠাস করে দরজাটা লাগিয়ে দেয়। রাগে মাথা দপদপ করছে মৌনের।

(চলবে)……
(চলবে)…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here