#ময়ূখ
#লেখিকা_আনিকা_রাইশা_হৃদি
#পর্ব-৪
১০.
ডিভানে বসে আছে মৌন। লোকটা পেয়েছে কি! মৌন মানে প্রিয় মানুষের অকাল মৃত্যুতে খারাপ লাগাটা স্বাভাবিক। মৌনরও অদ্ভুতভাবে খারাপ লাগছে। লোকটাকে সময় দেওয়া প্রয়োজন। মৌনর এরূপ ব্যবহার ঠিক হয়নি।
বাথরুম থেকে এলোমেলো ভিজা চুলগুলো মুছতে মুছতে বেরিয়ে এলো নিভৃত। মেয়েটাকে দেখে আবার তেড়ে গেলো তার দিকে। ঘটনার আকস্মিকতায় মৌন পাথরের ন্যায় বসে রইলো।
‘এই মেয়ে তুমি তো অতিরিক্ত বেহায়া। বলেছিনা এই ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে।’
হঠাৎ করেই থমকে গেলো নিভৃত। হাত বাড়িয়ে মৌনর চিবুকের লাল তিলটায় আঙুল ছুঁয়ালো। শীতল স্পর্শে কেঁপে উঠলো মৌন। নিভৃত হাতের তালু দিয়ে ঘষতে লাগলো ঐ লাল তিলটি। শক্ত হাতের ঘষায় লাল হয়ে গেছে মৌনর চিবুক। হলদে সাদা মুখটা লালচে বর্ণ ধারণ করেছে। নিভৃতের ভিজা চুলের ছিটেফোঁটা পানি ছিটকে ভিজিয়ে দিচ্ছে মৌনর মুখ। মৌন নিভৃতের হাতটা জোর করে সরিয়ে বললো,
‘কি করছেন আপনি?’
‘এই মেয়ে তোমার চিবুকে লাল তিল কেন?’
মৌন হতভম্বের ন্যায় তাকিয়ে আছে। অদ্ভুত তো! ওঁর চিবুকে লাল তিল আছে কেন এর উত্তর ও কি দিবে?
‘আমি কি জানি।’
‘এই তুমি এটা নকল বানিয়েছো। তাই না? নয়তো আমার রুহানির মতো তিল তোমার মুখে কেন? দেখো যতই তুমি রুহানি সাজার চেষ্টা করো না কেন। জীবনেও ওঁর মতো হতে পারবেনা।’
‘আজব তো! কিসব আবোল তাবোল কথা বলছেন? এটা আমার বাস্তব তিল। রুহানি আপুর যে তিল ছিল তাই তো জানতাম না।’
‘তুমি মিথ্যা বলছো।’
মৌন অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। এই লোকটা তো আস্ত পাগল।
‘আমার মিথ্যা বলার কোনো প্রয়োজন আছে কি? নিজেই তো এতক্ষণ আমার চিবুক ঘষে লাল বানিয়ে দিলেন। তাও আপনার স্বাদ মিটেনি। নিন আরো পরীক্ষা করে দেখুন। নিন।’
নিভৃতের সামনে এগিয়ে গেলো মৌন। নিভৃত বিরক্তির সুর তুলে বললো,
‘এই মেয়ে বের হও তো তুমি। কোথা থেকে এসব আপদ আসে!’
‘প্রথমে তো আমার নাম এই মেয়ে না। আমার নাম মৌনতা সুবহা মৌন।’
নিভৃত লাল চোখ করে এক ধমক দিলো। মৌন বেচারি পায়ের ব্যথা নিয়ে ছুটে পালিয়েছে। এই সাইকোর সাথে কিভাবে সারাজীবন কাটাবে! অদ্ভুত লোক!
১১.
বিকালের আকাশটা বড়ই অপূর্ব। সাদা, নীলের কি সুন্দর কারুকার্য! নীল রঙা সমুদ্রে যেন সাদা মেঘের দল বৈঠা বিহীন ভেলা ভাসিয়েছে। কালো কালো কিছু পাখির দল ছুটে যাচ্ছে নিজেদের নীড়ে। মৌন একমনে আকাশ দেখছিলো। তার স্তম্ভিত ফিরে মিতুর ডাকে। দোলনায় পাশেই বসে মিতু।
‘কোথায় হারালে?’
‘আকাশে।’
‘তুমি কিন্তু বড্ড মিষ্টি।’
‘আপু আর কতবার বলবে?’
‘মিষ্টি কে মিষ্টি না বললে হয় নাকি। এবার বলো কি খাবে তোমার ভাইয়া আসার সময় নিয়ে আসবে।’
‘না, আপু। কিছু খাবোনা।’
‘তা বললে তো হয়না। আমরা তো পরশুই সিঙ্গাপুর চলে যাবো। এই আপুটাকে আবার দেখতে পাবে একবছর পর। তোমাকে বাইরে নিয়ে ঘুরিয়ে আনতাম। তবে তোমার পা…
মন খারাপ হয়ে গেলো মিতুর। বাবা-মায়ের উপর রাগ হলো প্রচুর। এই ছোট মেয়েটার ভবিষ্যত নষ্ট করেছে তারা। মিতু নিজের ভাইকে চিনে। রুহানি তার ঠিক কতোটা জুড়ে ছিলো তাও জানে। তার ভাই কোনোদিন হয়তো এই মেয়েটাকে মেনে নিবেনা। কিংবা মেনে নিলেও তা কি মন থেকে হবে! একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে তার।
রাতুল হাতে একটা প্লেট নিয়ে ছাদে হাজির হয়। রাতুল মিতুর বর। সাথে শরিফা। শরিফার হাতে একটা প্লেট। শরিফা এ বাড়িতে কাজ করে। বয়স চল্লিশ হবে। চিকন গড়নের শ্যামলা গাঁয়ের রং। পান খেয়ে মুখ লাল করে রাখে সবসময়। মৌনর অনেক ভালোলাগে দেখতে। তার মাও পান খেয়ে মুখ রঙিন করে রাখতো।
‘কি পিচ্চি বোন নাকি ভাবি বলবো!’
‘আপনার যা ইচ্ছে ডাকেন ভাইয়া।’
‘ঠিক আছে তাহলে তোমাকে আমি পিচ্চি বোন বলেই ডাকি।’
দুইটা প্লেটে কিমা পুরি, মোগলাই আর খাসির চপ। শরিফা চলে গিয়েছেন। তবে তিনি যাওয়ার আগে মিতু জোর করে তার হাতে দুইটা চপ দিয়ে দিয়েছে। মৌনর খুবই লাগলো। উচ্চবিত্ত হয়েও ওদের ব্যবহার অনেক অমায়িক। হাসি, ঠাট্টায় কেটে গেলো বিকেল। মৌনর একটুও খারাপ লাগেনি। সব ভুলে প্রাণ খুলে হেসেছে সে।
১২.
ডাইনিং টেবিলে সবাই খেতে বসেছে। নিভৃতও সেখানে বসে খাচ্ছে। আড়চোখে মায়ের আহ্লাদীপনা দেখছে। অসভ্য মেয়েটাকে ভাত খাইয়ে দিতে দেখে তার চোয়াল শক্ত হয়ে আসছে। তবে বাবার জন্য কিছু বলছেনা। অর্ধেক খাবার খেয়েই উঠে হাত ধুঁয়ে নিজের ঘরে চলে এলো সে। আসার সময় একটা কাঁচের গ্লাস ভেঙে এসেছে। বাবা-মাকে তার নির্দয় লাগছে। এতো সহজে রুহানিকে তারা ভুলে গেলেন।
রুহানির ছবিগুলোর দিকে তাকিয়ে মলিন হাসলো নিভৃত।
মৃত্যু! কি অদ্ভুত একটা শব্দ! আজ থেকে একবছর আগেও এই বাড়িটা মাতিয়ে রাখতো রুহানি। কত খুনসুটি! হাসি ঠাট্টা। আর আজ তার মৃত্যুর ছয়মাসও হয়নি অন্য একটা মেয়ে এসে দখল করতে চাইছে সবকিছু। আর তার বাবা-মাও মেয়েটাকে প্রশ্রয় দিচ্ছেন। এতো সহজে সব ভুলে গেলেন তারা। দুই দিনের মেয়ের জন্য এতোগুলো বছরের সম্পর্ক ভুলে গেলেন। আলমারি থেকে অ্যাবসিনতের বোতলটা বের করলো নিভৃত। নিজের কষ্টটাকে কমাতে, বুকের জ্বালাটাকে কমাতে একটা ঝাঁঝালো কিছুর প্রয়োজন। কড়া কিছু। অন্যগুলোতে নেশা ধরেনা।
একচুমুকে অ্যাবসিনতের বোতলটা অর্ধেক করে দিলো সে। গলা জ্বলছে। মাথা ভনভন করছে। বিছনায় হেলান দিয়ে চোখ বুজলো নিভৃত।
ভয়ে ভয়ে ঘরে প্রবেশ করেছে মৌন। আজোও যদি নিভৃত গাঁয়ে হাত তুলে! শরিফার কাছ থেকে একটা মাদুর, কাঁথা আর বালিশ চেয়ে এনেছে। মৌন জানে নিভৃত তাকে জীবনেও বিছানায় জায়গা দিবেনা। মৌন ধীর পায়ে ঘরে ঢুকলো। নিভৃত নিশ্চুপ। এমন শান্ত নিভৃতকে দেখে ভরকে গেলো মৌন। এটা কি ঝড়ের আগের নিস্তব্ধতা! মৌন যতগুলো সূরা জানে বিড়বিড় করে সব পড়ছে। না, লোকটার কোনো হেলদুল নেই। একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে ফ্লোরে মাদুর পেতে সেখানে শুয়ে পড়লো মৌন।
গভীর রাতে হঠাৎ কারো স্পর্শে ঘুম ভেঙে যায় মৌনর। অন্ধকার ঘরে বারান্দা থেকে হালকা আলো আসছে। নিভৃত তো আসবেনা। এটা কি কোনো ভৌতিক কর্মকাণ্ড! ভয়ে ভয়ে যেই চিৎকার দিতে নিবে এমনি একটা শক্ত হাত মুখ চেপে ধরলো তার। বিস্মিত হয়ে হাতের মালিকের দিকে তাকিয়ে আছে মৌন। কারণ এটা নিভৃত!
মুখ দিয়ে অস্ফুট আওয়াজ করার চেষ্টা করছে মৌন। তবে তা সফল হচ্ছেনা। নাকে ঠেকছে বিশ্রি, ঝাঁঝালো গন্ধ। গন্ধে বমি আসার উপক্রম মৌনর। নিভৃত অস্ফুট সুরে বললো,
‘রুহানি।’
তারপর একটা কামড় বসিয়ে দিলো মৌনর লাল তিলটায়। সে অনবরত বিড়বিড় করেই যাচ্ছে,
‘এটা তোমার শাস্তি রুহানি। তোমায় আর কোথাও যেতে দিবোনা। আমার সাথে বেঁধে রাখবো।’
অতঃপর কোলে তুলে নিলো মৌনকে। খাটে নিয়ে শুইয়ে ঝাপটে ধরে তার বুকে মাথা রাখলো। মৌন চিৎকার করে বলছে,
‘আমি আপনার রুহানি না। আমি মৌন। এই যে শুনছেন আপনি। ছাড়ুন আমায়। আমি রুহানি না।’
তবে এসব কথা আদোও নিভৃতের কানে ঢুকছে কিনা সন্দেহ। সে শান্তির ঘুম দিয়েছে। মৌন অসহায় মুখে হালকা আলোয় নিভৃতের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো। সকালে উঠে তাকেই যে কথা শুনতে হবে! মৌন নিশ্চিত।
#ময়ূখ
#লেখিকা_আনিকা_রাইশা_হৃদি
#পর্ব-৫
১৩.
ফজরের আজানের সুমধুর ধ্বনিতে ঘুম ভাঙে মৌনর। চোখমেলে নিজেকে একটা শক্ত বাঁধনে আবিষ্কার করে সে। পাশে তাকাতেই দেখে নিশ্চিত মনে ঘুমিয়ে আছে নিভৃত। মৌনকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরে তার বুকে মাথা রেখে গভীর ঘুমে সে।
মৌন নিজেকে ছাড়িয়ে উঠে বসে।
বাথরুম থেকে অজু করে নামাজে বসে যায়। আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করে। কারণ নিভৃত নেশার ঘোরে থাকলেও তার উপর কোনো অধিকার ফলায়নি। আর মৌনও চায়না তাদের সম্পর্কের শুরুটা ভুল দিয়ে হোক।
নামাজ শেষে বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে মৌন। নির্মল বাতাস মনকে পরিশুদ্ধ করে দিচ্ছে যেন। ফজরের নামাজের পরের সময়টা অসম্ভব ভালোলাগে মৌনর কাছে। চারপাশে যেন কেবল বিশুদ্ধতা আর বিশুদ্ধতা।
হঠাৎ মৌনের চোখ যায় দূরে রুহানির কবরটাতে। সামনে লালগোলাপ বাগান। প্রায় শতখানেক গোলাপ গাছ। সবুজের মাঝে ফুটে উঠা লাল গোলাপগুলোকে মনোমুগ্ধকর লাগছে। নাকে হালকা ভেসে আসছে কচি গোলাপের সুঘ্রাণ। মৌন শুনেছে রুহানি লাল গোলাপ অনেক পছন্দ করতো। বিয়ের পর নিজের হাতে এই গোলাপ বাগান করেছিলো সে। তাই নিভৃতের জেদের কাছে হার মেনে রুহানির কবর দেওয়া হয়েছে তার প্রিয় গোলাপ বাগানের কাছে। মৌন একমনে তাকিয়ে আছে কবরটার দিকে। মনে মনে বলছে,
‘আপু তুমি আমাকে ভুল বুঝোনা। আমি তোমার স্বামী,ঘর,পরিবার দখল করতে আসিনি৷ তোমার জায়গাটাও আমার চাইনা। আমি কেবল তোমার জায়গার পাশে ছোট করে একটু জায়গা চাই। বেশি না। একটু। তুমি কি রাগ করবে আপু?’
কোনো জবাব আসেনা। মৌন একধ্যানে কেবল তাকিয়ে থাকে।
______________
ঘুম থেকে উঠে রাতের কোনো কথাই মনে নেই নিভৃতের। অ্যাবসিনতের সবুজ পানির কড়া ডোজে সব ভুলে বসে আছে সে। ঘুম থেকে উঠে মাথা চেপে বসে রইলো খানিকটা সময়। আশেপাশে চোখ ঘুরিয়ে ঐ মেয়েটাকে খুঁজে পেলোনা সে। রুহানির হাসোজ্জল ছবিটার সামনে গিয়ে খানিকটা সময় তাকিয়ে রইলো। কথা বললো।
সোফায় বসে চা-বিস্কিট খাচ্ছে আর গল্প করছে সবাই। নাজমুল, মিরা, মিতু, রাতুল, দিলারা আর মৌন। আগামীকাল মিতু, রাতুল সিঙ্গাপুর চলে যাবে। তাই এই আয়োজন। যদিও ‘একগুচ্ছ সুখ’ নামক বাড়িটিতে প্রতিদিন সবাই মিলে সকালবেলা এভাবেই ব্রেকফাস্ট করতো। বিগত মাসগুলোতে সব কেমন ফ্যাকাশে হয়ে গিয়েছিলো। রুহানির মৃত্যুতে সবাই অনেক কষ্ট পেয়েছে। তবে মৃত্যু হলো চরম সত্য। সবাইকেই একদিন মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতে হবে। সময়ের স্রোতে একসময় ভুলে যেতে হবে সেই আপনজন হারানোর ব্যথা। পুরানো মানুষের স্থানে জায়গা করে নিবে নতুন মানুষ। হয়তো আগেরজনের মতো পারবেনা তবে আস্তে আস্তে গাঢ় করবে নিজের উপস্থিতি। মুক্ত অণু প্রাথমিক অবস্থায় ছুটাছুটি করলেও একসময় সেও স্থির হয়ে যায়। বন্ধনটা সমযোজী হোক কিংবা আয়নিক। একটা বন্ধনে বাঁধা পরে তারা। মানুষের বেলায়ও অনেকটা তাই। তারাও পরিবার চায়। স্থির হতে চায়। তাদের মনের দগ্ধ অনুভূতি কাটিয়ে বন্ধনে আবদ্ধ হতে চায়।
নিভৃত সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে এসেছে। সবাইকে আবার আগের মতো ব্রেকফাস্ট করতে দেখে কিঞ্চিৎ ভালো এবং খারাপ মিলিয়ে একটা অনুভূতি হলো তার।
১৪.
তবে সবার মাঝে মৌনকে দেখে সহ্য হলোনা নিভৃতের। এই মেয়েটাকে তার স্বার্থপর ঠেকছে। বারবার মনে হচ্ছে এই মেয়েটা স্থান দখল করতে এসেছে। রুহানি নামক মানুষটাকে সবাই ভুলে যাচ্ছে। নিভৃতকে দেখে মিরা উঠে দাঁড়ালেন। হাসিমুখে জিজ্ঞেস করলেন,
‘বাবুই কফি খাবি?’
নিভৃত তাচ্ছিল্যের সুরে বললো,
‘কফি আমার গলা দিয়ে নামবেনা। ঐ মেয়েটাকে গেলাও।’
অতঃপর বেরিয়ে গেলো বাড়ি থেকে। উপস্থিত সবাই এতক্ষণ হাসিখুশি থাকলেও হঠাৎ করে যেনো একটা তিক্ততা এসে ভিড় করলো তাদের মাঝে।
______________
পেরিয়ে গেছে একটা মাস। মিতু, রাতুল চলে গিয়েছে সিঙ্গাপুর। মৌনের দিনগুলো একাই কাটে। মাঝেমধ্যে নিভৃতের সাথে ঝগড়া হয়। মৌন যে ছেড়ে কথা বলে তা কিন্তু নয়। মৌন নিভৃতের প্রত্যেকটা কথার জবাব খুবই পারদর্শিতার সাথে দেয়। সে তো কোনো ভুল করেনি। তাহলে নিভৃতের অহেতুক কথা কেন শুনবে। নিভৃতের মাঝে একটা জিনিসের উন্নতি হয়েছে সে আবার অফিস যাওয়া শুরু করেছে। এটা অবশ্য নিজের কষ্ট ভুলতে। নিজের মনের শান্তি জুগাতে সারাদিন কাজে ডুবে থাকে। আর রাতে মদ খেয়ে সেই মৌনের বুকে মাথা রেখেই ঘুমায়।
‘মৌন মা।’
‘জ্বি, বাবা।’
‘আজ বিকালে রেডি থাকিস। তোকে একটা কোচিংয়ে ভর্তি করিয়ে দিবো।’
‘আচ্ছা।’
‘তুই আর্টসে না?’
‘হ্যাঁ।’
‘পড়াশোনা কেমন লাগে তোর? জানিস আমি ছিলাম প্রচুর বাউণ্ডুলে। বাবা মেরে পড়াতেন। তারউপর আমার বাবা ছিলেন ব্যারিস্টার। বুঝতেই তো পারছিস কি কড়া!’
‘আমার পড়াশোনা খুবই ভালোলাগে। জানো বাবা আমার ইচ্ছে ছিলো সাইন্স নিয়ে পড়বো। তারপর বড় ডাক্তার হবো। ঢাকা মেডিকেল নিয়ে কত স্বপ্ন দেখতাম। তখন বাবার আর্থিক অবস্থা খারাপ। ছোটবোনদের খরচ। সবমিলিয়ে আর সাইন্সে পড়া হয়ে উঠেনি।’
মৌনের মনটা হঠাৎই খারাপ হয়ে গেলো। মানুষের কিছু কিছু চাওয়া মৃত্যুর আগ পর্যন্ত অপূর্ণ থেকে যায়।
‘মন খারাপ করিসনা। ঢাকা মেডিকেলে পড়তে পারবিনা তো কি হয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়বি।’
‘হ্যাঁ। তুমি দোয়া করো বাবা।’
‘আমার দোয়া সবসময় থাকবে।’
মিরা ট্রেতে করে চা নিয়ে ঘরে প্রবেশ করলেন। নাজমুল চায়ে চুমুক দিয়ে বললেন,
‘তোর শাশুড়ীমা কিন্তু এককালে ইডেন কলেজের শিক্ষিকা ছিলো। তুই কোচিংয়ের পাশাপাশি পড়াগুলো না বুঝলে তোর মাকে দেখাতে পারবি।’
‘আচ্ছা।’
‘এখনও সেই শিক্ষিকা ভাবটা যায়নি। সুযোগ বুঝে ফলিয়ে দেয়।’
কথাটা বলে আড়চোখে সহধর্মিণীর দিকে তাকালেন নাজমুল। যিনি চোখ লাল করে তাকিয়ে আছেন। মৌন হেসে কুটিকুটি। শশুড়-শাশুড়ীর দুষ্টু মিষ্টি সম্পর্কটা তার অনেক ভালোলাগে। মানুষগুলো বড্ড ভালো।
১৫.
‘এই মেয়ে তুমি আমার আলমারিতে নিজের জামা-কাপড় রেখেছো কেন?’
‘তাছাড়া কোথায় রাখবো?’
আলমারি থেকে মৌনর শাড়িগুলো নিচে ফেলে দিতে দিতে নিভৃত বললো,
‘প্রথম দিনই বলেছি। এইঘর কিংবা এই ঘরের কোনো জিনিসের উপর অধিকার দেখাবেনা।’
‘দেখুন আমার অধিকার দেখানোর কোনো ইচ্ছে নেই। আমি কাপড় কোথায় রাখবো? আপনিই বলেন?’
নিভৃতের প্রচুর রাগ লাগছে মেয়েটার উপর। মেয়েটা এতো বেহায়া! মৌন কাপড়গুলো তুলে আবার আলমারিতে রেখে দিলো।
‘আপনি যদি আবার আমার শাড়িগুলো ফেলে দেন। তাহলে আমি বাবাকে বিচার দিবো।’
‘হাহ্৷ আমি খুব ভয় পেয়েছি।’
‘আপনি ভয় পেয়েছেন। তা মুখে স্বীকার করছেন। যাক বুদ্ধিটা কাজে লাগলো।’
‘অদ্ভুত! মেয়ে তো তুমি।’
‘শুধু অদ্ভুত না গ্রামের লোকে আমাকে পাগলও বলতো। কারণ আমি বেশি রাগলে কামড়ে দেই।’
‘আজব!’
নিভৃত এই মেয়েটার কর্মকাণ্ডে একই সাথে বিরক্ত, বিস্মিত এবং স্তব্ধ! এই মেয়ে এসেছে রুহানির জায়গা নিতে! বাঁচাল একটা।
_________________
‘আফা, আফনে রান্নাঘরে কেল্লাই?’
‘রান্না করবো।’
‘ওমা, বড় আফা সব রান্না করছে তো।’
‘আমি মায়ের পারমিশন নিয়ে এসেছি। তোমাদের ছোট সাহেবের জন্য পোলাও আর বড়ই দিয়ে টক ডাল রান্না করবো।’
জুলেখা হাসি মুখে তাকিয়ে। ও এবাড়িতে ছুটা বুয়ার কাজ করে। বয়স বিশেক হবে। রোগা, পাতলা, ছিপছিপে গড়ন।
‘জানেন আফা ছোট সাহেব ডাল দিয়া পোলা খাইতে হেব্বি পছন্দ করেন। রুহানি আফা তো প্রতিদিন বানাইতো। আর সাহের চেটেপুটে খাইতেন।’
কথাটা বলেই জুলেখার মন খারাপ হয়ে গেছে। রুহানি আফাকে অনেক পছন্দ ছিলো তার। তবে এই নতুন আফাটাকেও তার ভালোলাগে। অনেক মিষ্টি দেখতে।
দুপুরে খাবার খেতে বসেছে সবাই। শুক্রবার বিধায় নিভৃত, নাজমুল সাহেব বাড়িতেই আছেন। নিভৃত পোলাও আর ডাল মেখে গাপুসগুপুস করে খাচ্ছে। পাশেই মিরা বসে খাচ্ছিলেন।
‘আম্মু, আজ খাবারটা অনেক মজা হয়েছে।’
‘আমি না আজকে মৌন রেঁধেছে।’
মৌন মাথা নিচু করে খাচ্ছিলো।নিভৃতের প্রশংসা শুনে লাজুক হাসলো সে। তবে কথাটা শুনে গলায় খাবার আটকে গেলো নিভৃতের। খাবার রেখে উঠে দাঁড়ালো সে। খাবারের প্লেটটা মাটিতে ছুঁড়ে ফেলে বললো,
‘জঘন্য হয়েছে।’
মৌনের এই অপমানটা খুবই গাঁয়ে লেগেছে। এতো কষ্ট করে রান্না করে এই প্রতিদান! চোখের কোণা বেয়ে একফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ে তার। এ কোন সম্পর্কে জড়িয়েছে তার জীবন! এর পরিণতি কি!
(চলবে)….
(চলবে)……