ময়ূখ পর্ব -০৬+৭

#ময়ূখ
#পর্ব-৬
#লেখিকা_আনিকা_রাইশা_হৃদি

১৬.
নাজমুল সাহেব ফার্মগেটের একটা কোচিংয়ে মৌনকে ভর্তি করিয়ে দিয়েছেন। সাথে প্রয়োজনীয় সকল বই খাতাও কিনে দিয়েছেন। মৌন অনেক খুশি। বিয়ের পরে পড়াশোনা করা হবেনা ভেবেই হাল ছেড়ে দিয়েছিলো সে। নতুন করে পড়াশোনার সুযোগ পেয়ে যারপরনাই অনেক খুশি মৌন।

মৌন ‘একগুচ্ছ সুখ’ নামক বাড়িটিতে আছে আজ প্রায় তিনমাস। বাবা-মায়ের সাথে খুবই সুন্দর সম্পর্ক গড়ে উঠেছে তার। বাড়ির প্রতিটা কোণা যেন তার অস্তিত্বের সাথে মিশে গিয়েছে।

‘এই গ্রামারগুলো তোর বাড়ির কাজ।’
‘ঠিক আছে।’

শাশুড়ী মায়ের কাছে পড়া বুঝে রাতে যখন মৌন ঘরে এলো তখন প্রায় নয়টা বাজে। নিচে বিছানা করে বইখাতা নিয়ে পড়তে বসেছে সে। এমনিতেই অনেক গ্যাপ গিয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে হলে প্রচুর পরিশ্রম করতে হবে। রাত জেগে হলেও পড়াগুলো শেষ করতে হবে। মৌন হালকা আওয়াজে পড়ছে। বিছানায় বসে ল্যাপটপে কাজ করছিলো নিভৃত। মৌন পড়ছে আর আড়চোখে নিভৃতকে পর্যবেক্ষণ করছে। একটু পরেই ছাইপাঁশ গিলবে তারপর তাকে কোলে নিয়ে বিছানায় ওঁরই বুকে মাথা রেখে ঘুমাবে। সারাদিন ভাবখানা এমন যেন মৌনকে চিনেই না। যখনই কথা বলবে তখনই তা হবে ঝগড়া। নিভৃতের পাগলামি আগের থেকে কমেছে। যদিও এটা সম্ভব হয়েছে কেবল কাজে ফিরে যাওয়ায়। ব্যস্ততায় এখন পাগলামিগুলো কমিয়ে করে। তবে রাত হলে ঠিকই ছাইপাঁশ গিলবে। মৌন গুনগুন করে পড়েই যাচ্ছে। হঠাৎ করেই ঠাস করে ল্যাপটপটা বন্ধ করলো নিভৃত। মৌন জিঘাংসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।

‘এই মেয়ে কানের কাছে এমন মশার মতো ঘ্যানঘ্যান করছো কেন?’
‘অদ্ভুত তো! আমি কোথায় ঘ্যানঘ্যান করছি। আমি তো পড়ছি।’
‘পড়া বন্ধ। আমার সমস্যা হয়।’
‘এহ্, বললেই হলো। আমার পরীক্ষাটা আপনি দিবেন?’
‘তুমি এবং তোমার থার্ড ক্লাস পরীক্ষা!’
‘দেখুন আপনি কিন্তু বেশি করছেন। আমি বাবাকে বিচার দিবো।’
‘তোমার বাবাকে তো আমি খুব ভয় পাই। বিশ্বাস করো তোমার থ্রেটে আমি প্রচুর ভয় পেয়েছি।’
‘হুম, ভয় পেলেই ভালো।’
‘তুমি তো আচ্ছা বেয়াদব মেয়ে। আমার ঘরে থাকতে দিয়েছি এটাই বেশি। আমাকে ডিসটার্ব করলে সোজা বের করে দিবো।’
‘আপনি বললেই হলো।’
‘তোমার তো খুব সাহস। অফিসে স্টাফরা আমার ভয়ে কাঁপে আর তুমি এই টুকু একটা মেয়ে আমার সাথে পায়ে পা লাগিয়ে ঝগড়া করছো!’
‘আমি খুব সাহসী। গ্রামের লোকে আমাকে সাহসের জন্য সাহসী বুড়ি খেতাব দিয়েছে।’
‘একদম উল্টাপাল্টা কথা বলবেনা আমি এখন ঘুমাবো তাই লাইট অফ থাকবে।’
‘আলহামদুলিল্লাহ। আজ ছাইপাঁশ গেলবেন না।’
‘কি বললে তুমি?’

মৌন আস্তে করে বইটা নিয়ে উঠে দাঁড়ালো তারপরে বারান্দার দিকে দৌঁড়ে যেতে যেতে বললো,
‘বলেছি মদ গিলে নিজেকে ধন্য করবেন না। এতদিন তো পাগল ছিলেন আজ এতো সভ্য কেন?’
‘এই মেয়ে দাঁড়াও। বেয়াদব!’

১৭.
তার আগেই মৌন বারান্দার দরজা বন্ধ করে দিয়েছে। বাইরে নিভৃত রাগে গরগর করছে আর পায়চারি করছে।
‘ননসেন্স মেয়ে। একবার হাতে পাই তোমার বেয়াদবির মজা বুঝিয়ে দিবো।’

দেয়ালে হেলান দিয়ে বসে আছে মৌন। আজ বড় বাঁচা বেঁচে গেছে সে। নিভৃত সামনে পেলে নিশ্চিত থাপ্পড় খাওয়া লাগতো। অতঃপর হেসে উঠে মৌন।
আজ নিভৃত নেশাদ্রব্য খায়নি। লাইট নিভিয়ে বিছানায় শোয়ে পড়লো সে। অনেকটা সময় ধরে এপাশ ওপাশ করলো তবুও ঘুম ধরেনা। কি আশ্চর্য! কি যেন নেই। কিছু তো একটা নেই! সেই কিছু একটার অভাবে ঘুম আসছেনা তার।

মৌন বারান্দায় হালকা আলোয় পড়ছে। ছিটেফোঁটা আলোয় যদিও একটু কষ্ট হচ্ছে। তবুও সে পড়ছে। একসময় ঘুমিয়ে গেলো। তবে একটা অভাববোধ রয়েই গেলো। নেশার ঘোরে হলেও মানুষটা তার বুকে মাথা রেখে ঘুমাতো। মিষ্টিমুখটা দেখেই রাত কেটে যেতো মৌনর। আজ সেই সুযোগ নেই। তার সম্পর্কটাই এতো ব্যাতিক্রম, এতো অদ্ভুত কেন!

___________________

মৌনর আজ রেজাল্ট দিয়েছে। ৪.৯৬ পেয়েছে সে। আর্টস থেকে এই রেজাল্ট করাও অনেক কঠিন। বাড়ির সবাই খুশি। মৌন নিজের বাবা-মাকে ফোন করেও কথা বলেছে। বোনদের সাথে কথা বলেছে।

সোফায় বসে আছেন নাজমুল সাহেব। পুত্রবধূর ফলাফল শুনে আজ তার মনটা বেজায় খুশি। নিভৃত রেজাল্ট শুনে বিরক্তের সাথে বলেছে,
‘এতো খুশি হওয়ার কিছু নেই। আমি গোল্ডেন পেয়েও এতো লাফালাফি করিনি। যতসব।’

মৌন একটা ভেংচি কেটে দৌঁড় দিয়েছে। এই লোকটা যে তার রেজাল্টে জ্বলছে তার ভালো করেই জানা আছে।

‘মৌন মা। তুই কি চাস? যা চাওয়ার চেয়ে নে। আজ তোর বাবা তোকে সব দিবে।’
‘বাবা, আমি বাড়ি যেতে চাই।’
‘কিন্তু তোর কোচিং?’
‘কয়েকদিনে কিছু হবেনা। আমার বড়বোন নিতুর বিয়ে। বাবা-মা অনেক জোর করে বলেছেন আপনাদের সবাইকে নিয়ে যেনো আমি ফরিদপুর যাই। বাবা হয়তো বিকালের দিকে ফোন দিতে পারে আপনাকে।’
‘আমার আর তোর শাশুড়ীরও ইচ্ছে ছিলো গ্রামে যাবো। তবে নিভৃত যাবে কিনা…..
‘সবাইকে নিয়ে গেলে বাবা অনেক খুশি হতেন।’
‘আচ্ছা, আমি দেখছি। কবে যেতে চাস?’
‘বিয়ে শুক্রবার আমরা কালকে সকালে রওনা দেই?’
‘ঠিক আছে মা। তাই হবে।’

বিকালে নিভৃত বাড়ি ফিরেছে। তার সাথে তার দুই বন্ধু মহিন আর আয়মানও এসেছে। তিনজন একসাথেই পড়াশোনা করেছে বুয়েটে। এখন নিজেদের মতো চাকুরী করছে। নিভৃতের দ্বিতীয় বিয়ের ব্যাপারটা বন্ধুমহলে কারো জানা নেই। সোফায় বসে নানা রকম গল্প করছে, কথা বলছে তারা। প্রাণপ্রিয় বন্ধুর স্বাভাবিক রূপ দেখে অনেকটাই খুশি দুজনে। নয়তো রুহানির মৃত্যুর প্রথম তিনমাস একেবারে জীবন্ত লাশের মতো ছিল নিভৃত।

১৮.
দুজনে অনেক বুঝিয়েছে। তবে নিভৃত কোনো কথাই কানে তুলেনি। জুলেখা বাড়ি নেই আর শরিফা কাজ করছে তাই মৌন অতিথিদের জন্য চা, মিষ্টি আর আপেল কেটে নিয়ে এসেছে। চুপচাপ টি-টেবিলে খাবার দিয়ে আবার চলে এসেছে। মহিন একধ্যানে হলুদ বর্ণের সুন্দরী রমণীর দিকে তাকিয়ে ছিল। মেয়েটা অনেক সুন্দর। বেগুনি থ্রি-পিস পরনে মাথায় উড়নাটা ঘুমটার মতো দেওয়া। কোমড় সমান চুলে বেণী করা। মহিন হা করে মেয়েটার চলে যাওয়া দেখছে। পাশে বসে আয়মান মিটিমিটি হাসছে। নিভৃত যারপরনাই বিরক্ত। এই মেয়েকে নাস্তা আনতে কে বলেছিল!

‘এই পরী কে কেরে?’

মহিনের কথায় কপাল কুঁচকে গেলো নিভৃতের। মুখটা বিকৃত করে সে বললো,
‘হবে নতুন কাজের লোক। বাবা-মা তো রাস্তা ঘাটে যাকে পায় তাকেই ধরে বাড়িতে নিয়ে আসে।’

মৌন উপরে যাচ্ছিল। নিভৃতের এই কথাটায় থমকে যায় সে। তাহলে তার পরিচয় সে এই বাড়ির কাজের লোক! দৌঁড়ে ছাদে উঠে যায় সে। খুব কাঁদতে ইচ্ছে করছে। খুব। মানুষের কথার চেয়ে বিষাক্ত বিষ হয়তো এই পৃথিবীতে দ্বিতীয়টি নেই। এই বিষ অন্যজন মানুষের মনকে মেরে ফেলতে সক্ষম। মৌন চোখ মুছে ঘরে আসে। আলমারির নিজের কাবার্ড থেকে একটা ডায়েরি বের করে সে। বারান্দায় বসে দুটো লাইন লেখে তাতে।

‘প্রিয়,
তুমি তো আমায় কতো ভালোবাসতে!
আদো কি সেটা ভালোবাসা নাকি আমার কিশোরী মনের ছলনা!’

ডায়েরিটা বন্ধ করে আবার যথাস্থানে রেখে দেয় মৌন। এই ডায়েরির প্রতিটা পাতায় পাতায় কেবল সে এবং তার প্রিয়কে নিয়ে লেখা এলোমেলো ভাবনা আছে।

‘কি বলিস! এতো সুন্দর মেয়ে কাজের লোক!’
‘কেনো তোর কোনো সন্দেহ আছে?’
‘না,তবে মেয়েটা সত্যিই পরীর মতো দেখতে।’

নিভৃত আবার বিরক্ত হয়। কপাল কুঁচকে তাকিয়ে থাকে কেবল।
#ময়ূখ
#পর্ব-৭
#লেখিকা_আনিকা_রাইশা_হৃদি

১৯.
‘কিছু বলবে আম্মু?’
‘তোর বাবা তোকে ডাকছে।’

কথাটা শুনে কপালে ভাঁজ ফেলে তাকায় নিভৃত। হঠাৎ তাকে কি প্রয়োজন!
‘যাক অবশেষে আমার কথা মনে হলো তোমাদের। আমি তো ভেবেছি ভুলেই গিয়েছো।’
‘এসব কেমন কথা বাবুই?’
‘ঐ মেয়েটাই তো এখন তোমাদের সব।’
‘এমন বলতে নেই বাবা। ও এখানে নতুন এসেছে। বাবা-মা, বোনদের ছেড়ে থাকাটা কি এতোই সহজ!সারাদিন একা থাকে। এখন আমরাও যদি খারাপ ব্যবহার করি মেয়েটা যাবে কোথায় বাবুই?’
‘বুঝেছি। রুহানির জায়গা দিয়ে দিয়েছো তাকে। তাই না?’
‘তুই ভুল বুঝছিস বাবুই। রুহানির জায়গা কেউ নিতে পারবে? রুহানি আমাদের মেয়ের মতোই ছিল। তাই বলে অন্য একটা মেয়ের প্রতি তো আমরা অন্যায় করতে পারিনা। জীবন তো কারো জন্য থেমে থাকেনা।’
‘আমার যে আছে আম্মু। আমার জীবনটা যে একেবারে পরম স্থির বস্তুর মতো থেমে আছে।’
‘রুহানিকে তো ভুলে যাওয়ার প্রয়োজন নেই। রুহানি থাকুক তার জায়গায়। মৌনকে কি একটু জায়গা দেওয়া যায়না?’
‘অসম্ভব।’
‘আমার কি মনে জানিস বাবুই?’
‘কি?’
‘তুই একদিন আফসোস করবি। আর সেই আফসোসের মূলে থাকবে মৌন। মৌনকে অবহেলা করার জন্য তুই অনেক আফসোস করবি।’

নিভৃত হো হো করে হেসে উঠে। মিরা রহমান তাকিয়ে থাকেন। ছেলের হাসি দেখে তিনি খুশি হতে পারছেন না। কারণ এটা তাচ্ছিল্যের হাসি।

__________________

‘বাবা, আসবো?’
‘আসো।’

নাজমুল সাহেব বারান্দায় বেতের সোফায় বসে আছেন। তার দৃষ্টি মানি প্ল্যান্ট গাছটার দিকে। সবুজ, হলদে পাতার রং। এঁকেবেঁকে গাছের মূল লতাটা বেড়ে উঠছে। কি সুন্দর আল্লাহর কারুকার্য! প্রকৃতির প্রতিটা জিনিসই সুন্দর।

নিভৃত পাশের সোফায় বসে বাবার দৃষ্টি অনুসরণ করে তাকালো। সেখানে সে মানি প্ল্যান্ট গাছ ছাড়া আর কিছুই আবিষ্কার করতে পারেনি। তার বাবা এমনই। খামখেয়ালি।

‘বাবা’
‘হুম?’
‘আমাকে ডেকেছিলে?’

মানি প্ল্যান্ট থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নাজমুল সাহেব ছেলের দিকে তাকালেন। বাইরের মিষ্টি রোদ ছেলের মুখে পড়েছে। দেখতে সুদর্শন লাগছে। চোখের নিচে কালোদাগটা কিঞ্চিৎ কমেছে। শরীরটাও একটু রুষ্টপুষ্ট। মনেমনে হাসলেন নাজমুল। স্ত্রীর পছন্দের প্রশংসাও করলেন। মেয়েটার আগমনে ছেলেটা কিঞ্চিৎ হলেও পরিবর্তন হয়েছে।

‘আমরা আগামীকাল ফরিদপুর যাচ্ছি।’
‘তো যাও।’
‘তুমিও আমাদের সাথে যাচ্ছো।’
‘মানে। আমি কেন যাবো?’
‘আলম সবাইকে দাওয়াত করেছে।’
‘তোমার বন্ধু দাওয়াত করেছে তোমরা যাও। আমাকে এর মাঝে টানছো কেন?’
‘দেখো তোমাকে টানতাম না। তবে না টেনেও উপায় নেই। বিয়ের পর মৌন এই প্রথম বাবার বাড়ি যাচ্ছে। এখন সে যদি একা যায় তাহলে গ্রামের লোকে নানান কথা বলবে। আলমের সম্মান ক্ষুণ্ণ হবে। সেই সাথে আমাদের রহমান বাড়িরও।’
‘বাবা, এসব ঝামেলায় কেন আমাকে জড়াচ্ছো। আমি আগেরবার কেবল গিয়েছিলাম মায়ের ওয়াদা রাখতে। কিন্তু এইবার আমি যেতে চাইনা। আমার যে রুহানিকে ছাড়া কোথাও থাকতে ভালোলাগেনা।’
‘তুমি তো রুহানিকে ভালোবাসো তাই না?’
‘তোমার কোনো সন্দেহ আছে?’
‘ভালোবাসার মানুষ দূরে সরে গেলেই যে ভালোবাসা কমে যায় তা কিন্তু নয়। সবসময় মানুষটির স্মৃতি আঁকড়ে বাঁচাটা কি খুব জরুরি? মনের স্মৃতিই হলো আসল। পৃথিবীর যেকোনো জায়গায় থেকেও প্রিয় মানুষটিকে ভালোবাসা যায়, অনুভব করা যায়।’
‘তুমি কি সত্যিই আমাকে না নিয়ে যাবেনা?’
‘এটা তোমার ব্যাক্তিগত ইচ্ছে। তবে তুমি আমাদের সাথে গেলে আমরা খুশি হতাম।’

নিভৃত বাবার যুক্তির কাছে হার মেনে যেতে রাজি হলো। ছোটবেলা থেকে এমনই হয়ে আসছে। তার বাবা তাকে কখনো বকেনি, ধমক দেয়নি, মারেনি। কোনো ভুল করলে আদর করে কাছে টেনে নিয়ে বুঝাতো।

২০.
বারান্দায় দাঁড়িয়ে টিপটিপ বৃষ্টি দেখতে মগ্ন মৌন। মাঝেমাঝে হাত বাড়িয়ে ছুঁয়েও স্বচ্ছ বৃষ্টির ফোঁটাগুলো দুহাত পেতে নিচ্ছে। কখনো ছিটিয়ে বাইরে দিচ্ছে আবার কখনো নিজের শরীরে।
নিভৃত বিরক্তি নিয়ে বারান্দায় প্রবেশ করলো। উদ্দেশ্য বেয়াদব মেয়েটার সাথে একদফা ঝগড়া করা।
‘এই মেয়ে।’

নিভৃতের কর্কশ আওয়াজে পিছনে ফিরে তাকায় মৌন। মুখে ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টির পানি। সামনের ছোট ছোট অবাধ্য চুলগুলো এলোমেলো হয়ে বৃষ্টির ফোঁটায় ভিজে মুখে লেপ্টে আছে। চিবুকের লাল তিলটা যেন বর্ষণের নির্মল ফোঁটায় আকর্ষণীয় হয়ে গেছে কয়েকগুণ। নিভৃত বিরক্তি নিয়ে অনেকটা সময় তাকিয়ে রইলো। মুখটা অনেক মায়াবী আর স্নিগ্ধ। নিজের ভাবনায় নিজের উপর রাগ হয় তার। নিজের চুল ছিঁড়তে ইচ্ছে করে। নিভৃতকে তাকিয়ে থাকতে দেখে মৌন গলা উঁচিয়ে বলে,
‘কিছু বলবেন?’

উচ্চশব্দে ধ্যান ভাঙ্গে নিভৃতের। মেয়েটা তো আচ্ছা বেয়াদব। এভাবে কেউ চেঁচায়! নিভৃতের কান তব্দা লেগে আছে। কিছু সময় আগের মোহ কেটে যায় তার। মাথায় পুরানো ভাবনাগুলো ফিরতেই রাগ উঠে যায়।

‘এই মেয়ে তুমি বাবাকে ফুসলিয়েছো আমাকে ফরিদপুর নিয়ে যেতে?’
‘আমার তো আজাইরা থেকে কাজ নেই যে বাবাকে বলবো আপনাকে নিয়ে যেতে।’
‘এসব কি ভাষা! প্রথমে ভাষা ঠিক করো। দ্বিতীয়ত আমি সিউর তুমিই বাবাকে বলে আমাকে ফাঁসিয়েছো।’

মৌন চোখ ছোট করে তাকিয়ে থাকে। এই লোকটার কি তার সাথে ঝগড়া না করলে হয়না।
‘আরেকটা কথা এমন সং সেজে আমার বন্ধুদের সামনে গিয়েছিলে কেন? বাসায় কি কাজের লোক নেই।’
‘কেন? আমি না এই বাড়ির নতুন কাজের লোক তাহলে আমি নাস্তা নিয়ে গেলে সমস্যা কি?’

মৌনর কন্ঠে কিঞ্চিৎ রাগ, অভিমান। নিভৃত থমকে যায়। জবাব খুঁজে পায়না। প্রসঙ্গ পাল্টে বলে,
‘বের হও তো তুমি। আমার ঘর থেকে বের হও।’
‘যদি বের না হই?’
‘তুমিসহ তোমার চৌদ্দগোষ্ঠী বের হবে?’

নিভৃত তেড়ে এলো মৌনর দিকে। মৌন ভয়ে দৌঁড় দিতে গিয়ে ধপাস করে পড়ে গেলো। ব্যথায় কুঁকিয়ে উঠেছে মৌন। অসহায় দৃষ্টিতে তাকালো নিভৃতের দিকে। নিভৃত তাকে উঠানো তো দূরে থাক হো হা করে হাসছে। মৌন রাগে কটকট করছে কেবল। বদলোক!

‘ছোটআফা, হায়হায় আফনে ধপাস করলেন কেমনে?’

জুলেখার কথা শোনে আরো জোরে হেসে দেয় নিভৃত। জুলেখা অবাক চোখে সে হাসি দেখে। প্রায় দেড়বছর পর তার ভাইজানকে এভাবে হাসতে দেখেছে সে।
‘বুঝলি জুলেখা তোর ছোটআফা দৌড়াদৌড়ি খেলছিলো। আহারে বেচারি দৌড়ে জিততেও পারলোনা আবার পড়েও গেলো। আহারে!’

বলতে বলতে বারান্দা থেকে বাইরে বেরিয়ে গেলো নিভৃত। জুলেখা কিছু না বুঝেই নিভৃতের যাওয়ার পানে তাকিয়ে বললো,
‘জ্বে ভাইজান?’

২১.
‘আসসালামু আলাইকুম ভাবি?’
‘ওয়ালাইকুম আসসালাম। কে?’
‘ওমা, আমায় চিনেন নাই ভাবি?’

মিরা ফোনটা নামিয়ে নাম্বারে চোখ বুলালেন। তিনি সত্যিই চিনতে পারেননি।
‘জ্বি, কে বলছেন?’
‘আমি মহিনের আম্মু।’
‘ওহ্, রুনা ভাবি কেমন আছেন? কত বছর পর ফোন দিলেন।’
‘আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি। একটা দরকারে ফোন দিয়েছিলাম ভাবি।’

মিরার কপালটা খানিক কুঁচকে গেলো। এই রুনা হলো এক অদ্ভুত মহিলা। প্রায় বছর দুয়েক আগে নিভৃতের বিয়েতে কথা হয়েছিল। এরপর আর কোনো যোগাযোগ হয়নি। হঠাৎ কি দরকার পড়লো?

‘কি দরকার ভাবি?’
‘আসলে ছেলেটার তো বিয়ের বয়স হয়েছে।’
‘মহিনের কথা বলছেন?’
‘হ্যাঁ।’

মিরা যারপরনাই আরো অবাক হলেন। অদ্ভুত তো উনার ছেলের বিয়ের বয়স হয়েছে তাতে তার কি করার আছে।

‘আমি আর মহিনের বাবা একটু আপনাদের বাড়িতে আসতে চাই।’
‘ভাবি আসলে আমরা তো কাল সকালেই ফরিদপুর রওনা দিবো।’
‘ও তাহলে কবে নাগাদ ফিরবেন?’
‘সামনের রবিবারে।’
‘আচ্ছা, তাহলে আমরা রবিবার বিকেলে আসি?’
‘আচ্ছা, আসেন ভাবি। এতো ফর্মালিটির কিছু নেই।’

কিছুক্ষণ কথা বলে কল কেটে দিলেন মিরা। বিষয়টা নিয়ে আর মাথা ঘামালেন না। ফরিদপুর যাওয়ার প্রস্তুতিতেই ব্যস্ত হয়ে পড়লেন।

_________________

নিভৃত রীতিমতো বাবার উপর চরম বিরক্ত। এই বেয়াদব মেয়েকে তার গাড়িতে বসিয়ে নিজেরা আগেভাগেই কেটে পড়েছে। গাড়ি ড্রাইভ করছে নিভৃত। মৌন একধ্যানে বাইরে তাকিয়ে আছে। বাতাসে তার লম্বা চুল উড়ে নিভৃতের চোখে মুখে বারি খাচ্ছে। হঠাৎ গাড়ি থামায় মৌন জিঘাংসু দৃষ্টিতে নিভৃতের দিকে তাকালো। নিভৃত মৌনের কাছে এগিয়ে আসছে। নিভৃতের হঠাৎ এমন কান্ডে মৌন চোখমুখ খিঁচে বন্ধ করে ফেলেছে। কিছুসময় পর কিছু অনুভূত না হওয়ায় চোখ মেলে তাকায় সে। নিভৃত নিশ্চিত মনে গাড়ি ড্রাইভ করছে। মৌন জানালার দিকে তাকিয়ে দেখে বন্ধ। এরমানে লোকটা জানালা বন্ধ করেছে!
‘এই আপনি জানালা বন্ধ করলেন কেন?’
‘আমার গাড়ি। আমার ইচ্ছা।’

মৌন রাগীদৃষ্টিতে নীল টি-শার্ট পরিহিত বদলোকটার দিকে তাকিয়ে থাকে। আগবাড়িয়ে কিছু বলেনা সে। যদি গাড়ি থেকে নামিয়ে দেয়!

‘এই মেয়ে চুল বাঁধো। নয়তো কেটে ফেলবো।’
‘এ্যাহ্, বললেই হলো। আমার চুল। আমার ইচ্ছা। হুহ্।’

নিভৃত এই অসহ্য মেয়ের সাথে কথা না বলে গাড়ি ড্রাইভে মন দিলো। মেয়েটা যথেষ্ট ঘাড়ত্যাড়া।

(চলবে)……
(চলবে)…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here