রংধনুতে প্রেমের বাড়ি পর্ব -০৩

#রংধনুতে_প্রেমের_বাড়ি

খাবার টেবিলে মুখোমুখি বসে আছে অক্ষর এবং চৈতালি। অক্ষরের মুখশ্রী গম্ভীর। সুগভীর শান্ত নেত্র , ওষ্ঠজোড়া নিবৃত্ত। নিগূঢ় দৃষ্টিতে মনযোগ সহকারে পর্যবেক্ষণ করে চলেছে চৈতালি। রুটির টুকরো মুখে তুলতে যাবে এই মুহূর্তে ঝুমুর উৎসুখ উৎফুল্লতায় জড়ানো গলায় বলে উঠল, আমি ভাবতেই পারছি না দাদাভাই আমার বাসায় এসেছে। আবার থাকবে কিছুদিন। পাঁচ বছরের বিবাহিত জীবনে কতবার রিকুয়েস্ট করলাম কিন্তু আসেনি। আম্মু যখন বলল দাদাভাই আমার বাসায় থাকবে আমি তো ‘থ’ হয়ে গিয়েছিলাম। আই ক্যান্ট বিলিভ দিস, দাদাভাই আমার বাসায়।

ঝুমুরের কথাকে উপেক্ষা করে চয়ন বলল, ভাইয়া আর কিছু লাগবে?
-” আমার যা দরকার আমি নিজেই নিতে পারি চয়ন। অনুমতি কিংবা জিজ্ঞাসাবাদের প্রয়োজন হবে না।

চয়ন অপমানবোধ মুখমন্ডল চৈতালির চিত্তে আ’ঘা’ত সৃষ্টি করল। আঁকুপাঁকু করে উঠল মন। বাচনভঙ্গি পরিবর্তন করে কর্কশ কন্ঠে বলল, অক্ষর ভাইয়া বয়স্ক মানুষ। খাবার দাবার বেশি হলে সমস্যা। এই বয়সে বেশি খেলে বদ-হজম হবে।

চক্ষু মেলে তাকাল অক্ষর। আবারও বয়স নিয়ে অপমান, হজম হলো না। বয়স কত হবে চৌত্রিশ। চৈতালির বয়স একুশ কী বাইশ। খুব বেশিই কী পার্থক্য? মোটেও না। তবুও বোন এবং বোন জামাইয়ের সামনে নির্বিকার ভঙ্গিতে খাবার খেল। ভাব-ভঙ্গি দেখে বুঝার উপায় নেই চৈতালির কথা শুনেছে কি শুনলো না।

ঝুমুর তাঁর দাদাভাইকে প্রচুর ভ’য় পায়। আশপাশ নজর বুলিয়ে হালকা গলায় চৈতালিকে শুধাল, চৈতি তুমি নিশ্চয় দাদাভাইয়ের সাথে মজা করেছ? তোমাদের সম্পর্কই তো ইয়ার্কি-মশকারির। কিন্তু যাই বলো না আমার দাদাভাই দেখতে ভীষন হ্যান্ডসম। সামনাসামনি দেখে বুঝার উপায় নেই দাদাভাইয়ের বয়স কত। লোকে ভাববে সবে ভার্সিটি শেষ করা তরুণ যুবক।

চৈতালি হাসলো। অক্ষর বাঁকা নয়নে দেখল সেই হাসি। মুখমন্ডলে রা’গের আভাস ফুটিয়ে খানিক তেজী গলায় হাঁক ছেড়ে বলল, আমায় নিয়ে রচনা তৈরি বন্ধ কর। আমি সাক্ষর নই যে আমার সাথে ইয়ার্কি-মশকারি করা হবে। আমি অক্ষর, দ্বিতীয়বার বলতে হবে না নিশ্চয়!

অক্ষরের কথার পৃষ্ঠে কথা বলা ঝুমুরের পক্ষে সম্ভব নয়। চুপচাপ প্লেটে মনোযোগ স্থির করে অপরাধীর মত বলল, স্যরি দাদাভাই। দ্বিতীয়বার ভুল হবে না। প্লিজ তুমি চলে যেও না।

অক্ষর কথা বাড়ালো না। চুপিচুপি নিজের প্লেটের খাবারটুকু শেষ করে উঠে দাঁড়াল। যাবার আগে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিপাত করতে ভুল হলো না।

***

চৈতালি রয়ে-সয়ে বসলো বিছানার মধ্যিখানে। মূলত সে ভাবছে অক্ষরকে নিয়ে। লোকটির মাঝে বিরাজ করছে দুটো সত্তা। প্রথম সত্তা হলো লোকটি ভীষন রা’গী, গম্ভির, শান্ত-শিষ্ট, একরোখা। দ্বিতীয় সত্তা হলো লোকটি বেশ চঞ্চল, ঠোঁটকাটা,অসহ্য। লোকটির আসল সত্তা কোনটি? ধীর কণ্ঠে শুধাল, লোকটির সত্তা যাই হোক না কেন কোনোটাই সুবিধার নয়। সকলের সামনে প্রথম সত্তা, শুধু আমার সামনেই দ্বিতীয় সত্তা। লোকটির মুখোশ তো আমি বের করেই ছাড়বো। যেকোনো মূল্যই হোক।

-” তুপ্পি তুপ্পি তুমি বিজি?

চাঁদকে দেখে মুখে হাসি ফুটলো চৈতালির। বাচ্চাটা একদম পুতুলের মত। তুলতুলে হাত পা, নরম মুখশ্রী, চোখের মণি লাল-কালো রঙের। কৃষ্ণ কালো কেশে দুটো জুটি। গোলাপি রঙের পাতলা ঠোঁট। রূপকথার সেই ছোট্ট রাজকন্যা। চৈতালি চাঁদের গালে হাত রেখে নরম গলায় বলল, না তো মামুনি আমি তো বিজি নই। তুমি কিছু বলতে চাও?

চাঁদ মাথা দুলিয়ে ‘হ্যাঁ’ বুঝাল। চৈতালি চাঁদকে নিজের কোলে বসিয়ে ছোট্ট হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বলল, কী বলতে চাও মামুনি?
-” আমি তল্প শুনব। নানা-নানীর তল্প।

জোড়ে হাসল চৈতালি। রাজা-রাণী উচ্চারণ করতে পারে না চাঁদ। সব সময় নানা-নানী বলবে। হাসি থামিয়ে বাচ্চাদের মত মুখ করে বলল, আমার চাঁদ রাজা-রাণীর গল্প শুনবে? ব্যাস আসো আজ আমরা গল্প করব।

চৈতালি ব্যাস্ত হয়ে পড়ল চাঁদকে নিয়ে……..!

***

আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে বারবার দেখে যাচ্ছে অক্ষর। হাতের চামড়া, মুখশ্রী, উদর সবকিছুতে মনযোগ দিয়ে খুঁত ধরার চেষ্টা করছে। কই শরীরের চামড়া তো ঢিলে হয়ে যায়নি, আরক্ত সুন্দর মুখশ্রী , উদরে ভুঁড়ি বাড়েনি, চোখের দৃষ্টি ঠিকঠাক তাহলে বুড়ো সে কীভাবে হলো? বলিউড অভিনেতা সালমান খানের বয়স তাঁর থেকে বেশি কই তখন তো কেউ বুড়ো বলে না বরং বিয়ে করার জন্য উঠেপড়ে লাগে। এসব ভাবতে ভাবতে ঝিম ধরে মাথায়। চিন্তা ভাবনাকে বহু দূরে সরিয়ে বাঁকা হেসে বিড়বিড় করে বলে, যতই বুড়ো বলো না চৈতি। আমার বুড়ি তুমিই হবে।
“- হ্যালো স্যার? তাড়াতাড়ি আসুন প্লিজ, একটা ঝামেলা হয়ে গেছে।

অক্ষর সবে চৈতালিকে ম্যাসেজ পাঠাতে যাবে তাৎক্ষণিক তার মুঠোফোনে জরুরি তলবে কল আসে। ফোনটা কানের কাছে ধরতেই শুনতে পায় সেক্রেটারি স্বর্ণবের আ’হত কন্ঠস্বর। তড়িঘড়ি করে রুম থেকে বের হয় অক্ষর। মেইন দরজায় পৌঁছাতে পৌঁছাতে ঝুমুরের উদ্দেশ্য বলে, আজ আমি বাসায় ফিরব না। চিন্তা করার প্রয়োজন নেই।
-” জি দাদাভাই।

অক্ষর বেরিয়ে পড়ল। সদর দরজা বন্ধ করল ঝুমুর। রুমে প্রবেশ করে চয়নকে ক্লান্ত মুখে বসে থাকতে দেখে হাত রাখল চয়নের কাঁধে। চিন্তিত কণ্ঠে বলল, আজকাল কাজের চাপ খুব বেশী? সমস্যা হয়েছে কোনো? দাদাভাইকে বলব!
-” সমস্যা হয়নি।

অকপটে বলল চয়ন। কিন্তু ঝুমুরের মুখের ভাব-ভঙ্গি পরিবর্তন হলো না। মাথা চয়নের কাঁধে রেখে হতাশ সুরে বলল, তোমায় চুপচাপ দেখতে আমার ভালো লাগে না। প্লিজ কাজের চাপ কাজেই রাখো। বাসায় এনো না।তোমার হতাশ দেখলে আমার ভীষন কষ্ট হয়।
-” তাহলে তোমার দাদাভাইকে বলো আমার বাসা থেকে চলে যেতে। হতাশ মুখ করে থাকবো না আর।

বিচলিত হলো ঝুমুরের নেত্র। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থেকে অবাক কণ্ঠে বলল, কী বলছো চয়ন? দাদাভাই চলে যাবে মানে?
-” তোমার দাদাভাইকে আমার এক বিন্দু সহ্য হচ্ছে না ঝুমুর। শিক্ষার বড্ড অভাব ওনার। বোন জামাইয়ের সাথে কীভাবে কথা বলতে হয় জানেন না। সামান্যতম জ্ঞান নেই।

মুখ ফুলিয়ে শ্বাস ছেড়ে ঝুমুর বলল, দাদাভাই তো ওমনিই। গুরুগম্ভীর স্বভাবের। সত্য বলে মুখের উপর। সে তো তোমার বাসায় ঝামেলা করছে না। তুমি কথা না বললেই হলো।

রা’গা’ন্বি’ত চয়ন এক ধাক্কায় ঝুমুরকে সরিয়ে দিয়ে ক্ষু’ব্ধ হয়ে বলল, আগামীকাল সকালেই তোমার দাদাভাইকে বলবে আমার বাসা থেকে বের হয়ে যেতে। আমি ওনার ছায়া দেখতে চাই না।
-” এই বাড়িটা আদৌ তোমার চয়ন?
-” কি বলতে চাইছো?
-” আমি যা বলতে চাইছি তুমি খুব সহজেই বুঝে ফেলেছো চয়ন। থাক সেসব কথা। বুঝেছি এ সমাজে মেয়েদের মূল্য নেই। একজন মেয়ে বিয়ের পর শশুর বাড়িকে আপন করতে পারলেও একজন ছেলে সেটা পারে না। আমি তোমার মাকে আপন করে নিতে চেয়েছিলাম কিন্তু তিনি আমায় মানেননি। এজন্য আমি ওনাকে দো’ষা’রো’প করব না। ওনার না মানার কারণ ছিল বলেই ওনি মানেননি। চৈতালিকে আমি ননদ কম ছোট বোন বেশি মনে করি। কিন্তু তুমি? আমার দাদাভাই কিছুদিনের জন্য এসেছে তাও আবার ইম্পর্ট্যান্ট কাজে কিন্তু তুমি সেটা মেনে নিতে পারছ না। আচ্ছা প্রবলেম নেই আমি দাদাভাইকে ফোন দিয়ে জানিয়ে দিবো সে যেন নতুন ফ্ল্যাট কিনে। আমার বাসায় তাঁর থাকার মত জায়গা হবে না।

শেষের বাক্য বলার সময় ধরে আসলো ঝুমুরের কন্ঠস্বর। অশ্রুবিন্দু গাল বেয়ে ঝড়ছে। চয়ন স্ত্রী-র মুখপানে তাকাল ছেদ করে উঠল বুকের ভিতর। ভালোবেসে বিয়ে করেছে। অর্ধাঙ্গিনীর ফর্সা মুখশ্রী অভিমানে লাল আভা ধারণ করেছে। গোপনে ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে ঝুমুরকে বুকে জড়িয়ে অপরাধীর মত বলল, সরি বউ। আর বলব না। তোমায় হার্ট করতে চাইনি। অক্ষর ভাইয়াকে কিছু বলতে হবে না। ভাইয়ার যতদিন ইচ্ছে থাকুক আমার আপত্তি নেই। তবুও কান্নাকাটি করবে না। আমার জীবনে চার নারীর কান্নার প্রতি আমি ভীষন দূর্বল। প্রথম মা সে তো আমায় ক্ষমা না করেই চলে গেল অনেক দূরে। চৈতালি যে আমার চোখের মণি। চাঁদ সে তো আমার দুনিয়া। ঝুমুর তুমি তো আমার হৃদয়ের রংধনু। আমার জীবনে আলোকবিন্দু। অন্ধকার থেকে বাঁচিয়েছ। তোমরা তিনজন ছাড়া আমি অপূর্ণ।

চয়নের কাঁধে মাথা রাখল ঝুমুর। সুখের রাজ্যেয় সে হলো রাণী। বিড়বিড় করে আউরালো, এই জীবনে যারে চেয়েছি অনেক আগেই আমি তারে পেয়েছি।

****

রাতের মধ্য প্রহর। চৈতালি নিদ্রায় মশগুল। ঘুমের ঘোরে মনে হলো কেউ একজন তাঁর সামনে বসে আছে। ষষ্ট ইন্দ্রিয় সজাক হলো। জানান দিল, বি’প’দে’র সম্মুখীন হতে চলেছে। পিটপিট করে তাকালো চৈতালি। ড্রিম লাইটের আধো-আধো আলোতে অক্ষরকে দেখতে পেয়ে যারপরান অবাক হলো । অস্থির হয়ে পড়ল মুখশ্রী। বিচলিত মনে প্রশ্ন করল, কল্পনা নাকি বাস্তব? ঘুমের ঘোরে ভুলভাল দেখছি না তো! চঁচল হৃদয় জানান দিল সে ভুল দেখছে না। অক্ষর মৃদু হেসে তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। ঝটপট ওড়না গলায় ঝুলিয়ে রা’গী গলায় হুংকার ছেড়ে বলল, আপনি আমার রুমে? যুবতী মেয়েদের করে আসার আগে নক করে আসতে হয় জানেন না?
-” ঘুমিয়ে ছিলেন তাই বিরক্ত করতে ইচ্ছে হলো না” অক্ষরের সহজ বাক্য।
-” আপনার মাঝে সামান্যতম লজ্জাবোধ নেই। এখন কী আমি বিরক্ত হয়নি?
-” আমি জানতাম নাকি আপনি জেগে উঠবেন। ঘুম ভীষন পাতলা আপনার।
-” ভাবি বলল আপনি আজ বাসায় আসবেন না। মিথ্যা বলাটা আপনার অভ্যাস বুঝি?
-” কাজ তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে গেছে তাই চলে আসছি। দেখলাম আপনার রুমের দরজা খোলা তাই ভাবলাম ঘুমানোর আগে আপনাকে দেখে চোখের তৃষ্ণা মিটিয়ে যাই। জানেন ঘুমানোর সময় আপনাকে ফুটন্ত পদ্ম ফুলের মত লাগছিল। নির্মল, নিষ্পাপ, শিশুসুলভ । বুঝার উপায় নেই জেগে থাকলে ঝ’গ’ড়া’ঝাঁ’টি’তে উস্তাদ।

-” আমি ঝগড়া করি?

স্মিথ হাসল অক্ষর। যাবার আগে চৈতালিকে রাগানোর জন্য ভ’য়ংকর কিছু বাক্য ব্যবহার করে চলে গেল। চৈতালি তখন লজ্জায়, অস্বস্তি, বিরক্তি নিয়ে মাথা নিচু করে রাখল। লোকটা এক নম্বরের ঠোঁটকাটা। চৌতালির ইচ্ছে করছে এই মুহূর্তে লোকটার ঠোঁট জোড়া সেলাই করে দিতে যেন এধরনের কথা আর বলতে না পারে। অথবা লোকটা বোবা হয়ে যাক, কণ্ঠস্বর থেকে শব্দভান্ডার হারিয়ে যাক এসব বলেও বিচার দিতে লাগল সৃষ্টিকর্তাকে। চৈতালির ভাবনার জগতে ছেদ ঘটিয়ে অক্ষর দরজার ওপাশ থেকে মুচকি হেসে বলল,
-” দরজাটা বন্ধ করবেন নাকি আমি আবার আসবো? আমার কিন্তু সমস্যা নেই। আপনাকে মন ভরে দেখার জন্য হাজারবার দাঁড়িয়ে থাকতে রাজি আমি। আসবো?

চৈতালি দিন দুনিয়াকে বাইরে ফেলে এক দৌঁড়ে অক্ষরের মুখের সামনে দরজা বন্ধ করে দিল। লোকটার বিশ্বাস নেই। সত্যি সত্যিই আবারও চলে আসবে।

##চলবে,
®ফারজানা মুমু

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here