রঙ বেরঙের খেলা পর্ব -০২

#রঙ_বেরঙের_খেলা
#আলিশা
#পর্ব_২

রাত যাচ্ছে রাতের মতো। অপমানের অসহ্য খোঁচায় পুড়ছে সভ্যর বুক। এই অপমান নিয়ে না দাড়ানো যায় প্রভুর কাছে, আর না দাড়ানো যায় অপমান করে যাওয়া হীন মানসিকতার মানবদের কাছে। ত্যাক্ত উত্তপ্ত গরমের সাথেই যোগ হয়েছে যন্ত্রণা। সভ্যর দেহ স্থির কিন্তু মন অস্থির। এক তলা বাড়ির ছাদে নিগূঢ় অন্ধকারকে সঙ্গে নিয়ে দাড়িয়ে আছে সে ছাদে। বাজে হয়তো রাত তিনটার মতো। বাড়ির সবাই নিজ নিজ ঘরে। সাবিহাও হয়তো বাসর ঘরে বসে এখনও ছটফট করে যাচ্ছে কেন তার বর কালো হলো বলে। সভ্য হাসলো। ঠোঁট বাঁকান হৃদয় পোড়া হাসি। নিঃসঙ্গতা আর একাকীত্বের মাঝে চোখে জল আসতে সঙ্কোচ করলো না। দুমড়ে মুচড়ে যেন যাঁতাকল বুকের মাঝে সব পিষিয়ে দিচ্ছে। সভ্য আক্রোশে রাগে দুঃখে একটা আঘাত করলো রেলিঙের ইট বাঁধা দেওয়ালে। সঙ্গে সঙ্গে চোখের জল নাক বেয়ে ভূমিতে গমন করলো। হাতে ব্যাথা পেলেও মস্তিষ্ক রাখলো না সে খোঁজ। সত্যিই কি সভ্য অনেক কালো? নিগ্রদের মতো? সবাই তো বলে সভ্যের গায়ের রং মলিন হলেও সে রাজপুত্র। নাক, মুখ দেহের গড়নে সে ফর্সা মানুষকেও হার মানায়। হয়তো সাবিহার পাশে দাঁড়ালে তাকে অনেক বেশিই কালো মনে হয়। তাই বলে কি সে মানুষ না? এতো দেমাগ কেন সাদা চামড়ার মানুষদের? সভ্যরও একদিন সময় আসবে। সে মলিন,সাবিহা রঙিন তাই তো? থাকবে না বিভেদ। রং নিয়ে খেলার অব্দ এখন ইতিতে। এখন অব্দ, যুগ হলো যোগ্যতার। সভ্য সাবিহার অহংকার টেনে হিঁচড়ে নামিয়ে আনবে একদিন। আনবেই সে। রূপ দিয়ে নয়। পরিশ্রম আর যোগ্যতা দিয়ে সে একদিন রঙিন হবে। সেদিন সাবিহার স্থান হবে তার পায়ের নিচে। ঠিক জুতোর তলে।

এমনই সব জেদ বিগড়ে উঠলো মনে। সভ্য ভিজে যাওয়া চোখ আর আটকে আসা দম নিয়ে আকাশপানে চাইলো। মিটিমিটি তারার মাঝে একটা এক ফালি চাঁদ হাসছে। সভ্য খেই সরিয়ে নিলো। হঠাৎ ভাঙা মন নিয়ে সে সৃষ্টিকর্তার কাছে অভিমান লুকিয়ে রেখে বলে উঠলো

— আমায় কেন কালো বানিয়েছেন এই কৈফিয়ত আমি চাইবো না আপনার কাছে। যে যাই বলুক। আমি খুশি আমার বর্ণ নিয়ে। শুকরিয়া আমি সুস্থ সকল, আমার হাাত পা অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ত্রুটিহীন। তবে আমার একটা আবদার রাখবেন আল্লাহ? আমার অপমানের জবাব দেওয়ার মতো একটা সুযোগ আমায় করে দিন।

বড্ড মায়াবী ছিল সভ্যর কন্ঠ। প্রভুর প্রতি তার গাঢ় বিশ্বাস, সন্তুষ্টি আর একবুক যন্ত্রণা নিয়ে বলে ওঠা বাকিগুলো যে অন্ধকার চিঁড়ে পৌঁছে গেছে আরো একটা মানুষের কানে তা কি সভ্য জানে? ফারজানা বেগম কেঁদে উঠলেন অচিরেই। কিন্তু ভুলেও শব্দ করলেন না। শুধু ছেলের কথার পিঠে নীরবে বলে গেলেন ” আমিন, আমিন, আমিন ইয়া রব” এরপরই মুখে হাত চেপে অবাধ্য কান্না আটকানোর প্রচেষ্টা। এক পা দু পা করে পেছানো। ডাকতে আসলেও ডাকা হলো না আর ছেলেকে। তিনি টর্চ হাতে নিঃশব্দে ছেলের অগোচরে প্রস্থান করলেন। পরে রইলো বেদনা নিয়ে সভ্য।

.
তন্দ্রা এলো না গত রাতে। সে সুযোগই পায়নি। ছাদ থেকে সভ্য তখনই নেমে এলো যখন আকাশে বাতাসে লেপিয়ে দেওয়া হলো প্রথম আজান। ফজরের আজান কানে আসতেই সে বেখেয়ালি মনে চলে যায় মসজিদে। নামাজ পরে মন একটু হালকা হলে সে চলে আসে বাসায়। আশরাফুল ইসলামও গিয়েছিলেন মসজিদে। লজ্জায় মেয়ের জামাইয়ের সাথে কথা বলতে পারেননি। সভ্য তাকে দেখলেও এড়িয়ে চলে এসেছে। অন্য দিন হলে চাচার সাথে গল্পে গল্পে আসা হয় মসজিদ হতে।

— আজই চলে যাচ্ছিস সভ্য?

— হুম। কালকে আমার চাকরির ভাইবা আছে।

সভ্য মায়ের কথার উত্তর অত্যন্ত ব্যাস্ত ভঙ্গিতে দিলো। ফর্মাল ড্রেসে সে পরিপাটি। ব্যাগ গোছাচ্ছে। রাজশাহী থেকে ঢাকা যেতে হবে। যদিও দিনভর সময় লাগবে না কিন্তু এই সাত সকালেই তার যাওয়ার তাড়া। সহ্য হচ্ছে না এবাড়ির ছায়াও।

— এটা কিন্তু তেরও বাড়ি সভ্য। তোর বাবার ভিটা। মুখ লুকিয়ে থাকার মতো ছেলে কিন্তু আমি জন্ম দেইনি।

সভ্যর হাত থমকে গেলো। মা ঠিকই তার মনে বিচারণ করে নিয়েছে। ফারজানা বেগম কথাটা বলে ছেলের দিকে স্থির নয়নে তাকিয়ে রইলেন ক্ষণকাল। অতঃপর হনহন করে চলে গলেন ঘর থেকে।

মায়ের ওমন একটা কথার পরপরই সভ্য বাড়ি ত্যাগ করতে পারলো না। নিজ ঘরেই বসে রইলো। ন’টা বাজাতে চলল যখন তখন তার শাশুড়ি এসে ডেকে গেলো তাকে। খাবারের টিবিলে। সভ্য খুঁত খুঁত করা মন নিয়ে চলে গেলো। খাওয়ার টেবিলে সাবিহাও ছিল। নাক মুখ কুঁচকে সে খাচ্ছে। সভ্যর জন্য বিশেষ ভাবে বিশেষ কিছুর আয়োজনও করা হয়েছে। জামাই আদর যাকে বলে। খাওয়ার টেবিল জুড়ে শুধু হরেক পদের খাদ্য। টেবিলে আশরাফুল ইসলাম, সাবিহা আর সাবিহার ভাই ব্যাতিত কেউ নেই। সভ্য দলা দলা অস্তিত্ব নিয়ে বসে যায় চেয়ারে। নেহায়েত সাবিহার মায়ের জোরাজুরিতে।

— সভ্য ভাই আপনার সাথে আমার আমার কথা আছে। আগেই খেতে বসবেন না।

চেয়ার টেনে বাতে না বসতেই সাবিহার তিক্ত মুখের কথা। রাহেলা ইসলাম আপত্তি জানিয়ে বললেন

— আগে খেয়ে নে তারপর কথা বলিস।

সাবিহা শুনলো না। ত্যাড়ামো আর বেয়াদবির উচ্চ পর্যায়ে উঠে সে চলে গেলো বেসিং-এ। হাত ধুয়ে দু মিনিটের মাথায় আবার ফিরে এলো। সভ্য কপালে দু আঙ্গুল চেপে টেবিলে উবু হয়ে ছিল। সাবিহা পেছন থেকে বলে উঠলো

— শুনলাম আপনি চলে যাবেন। তা যাওয়ার আগে আমায় তালাক দিয়ে যান।

সাবিহার সহজ সরল গলা। উপস্থিত সকলে চমকে উঠলো। রান্নাঘর হতে রান্না ফেলে ছুটে এলো ফুফু, খালারা। সকলেই বাক হারিয়ে ফেলেছে। সভ্য মাথা তুলল না। নিজ অবস্থানে অটল থেকে সে বলে উঠলো

— ডিভোর্স দিতে অন্তত তিন মাস লাগে।

— আরে ডিভোর্স তো দিবেনই। এখন শুধু মুখে তিন তালাক দিয়ে যান। বিয়ের বন্ধনটা কেটে উঠুক।

সকলে দমে দমে বিচলিত হচ্ছে। কিন্তু সভ্য স্থির। সে এবার উঠে দাড়ালো। সাবিহার থেকে দু হাত দূরে দাড়িয়ে বলল

— তালাক নিবা?

সাবিহা খুশি মনে বলল

— হ্যা। আমার জন্য ছেলের অভাব নেই। লাইন লেগে আছে। আর তালাক না নিলে বলা তো যায় না আপনি কখন আবার স্বামী হয়ে আমার সামনে এসে দাড়ান।

— হুম ঠিক।

কথাটা বলে সভ্য বেশ স্মার্টলি দাঁড়ালো। নড়ে চড়ে দাড়িয়ে প্রস্তুতি নিলো আপন কর্মের। একবার চোখ ঘুরিয়ে নিলো ঘরের উপস্থিত সদ্যদের উপর। সবাই আছে মোটামুটি। বলা যায় মোরোব্বিরাই আছে। সভ্য আবার চোখ ফেলল সাবিহার দিকে। রয়ে সয়ে অদ্ভুত সুরে তার কন্ঠ হতে উঠে আসছে

— এক তালাক…

এখানেই বাঁধা দিয়ে চেচিয়ে উঠলো রাহেলা ইসলাম। কম্পিত, ভিত কন্ঠে বললেন

— সভ্য বাপ ওর কথা শুনিস না। ও একটা অবুঝ, পাগল।

সভ্য শুনলো না। বরং সে নিজের নজরেরই হেরফের করলো না। তার ছোট মার গলার উপর গলার স্বর তুলে উঁচু কন্ঠে বলল

— দুই তালাক…

সাবিহা চরম খুশি। আনন্দে সে যেন ভেসে যাচ্ছে। ভাইরাল টিকটকার সাবিহার মানসম্মান বেঁচে যাচ্ছে। ভাবনা তার উড়াল দিচ্ছে। সভ্য হাসলো। প্রচন্ড রাগ হয়েছে তার। সকলকে আশ্চর্যের চূড়ায় নিয়ে গিয়ে সে আচমকা সজোরে একটা থাপ্পড় দিয়ে বসলো সাবিহার গালে। মুখে বলে উঠলো

— ক্যান্সেল সব তালাক।

সব কিছু এক থাপ্পড়ের শব্দে স্তব্ধ। যেন বোবা হয়েছে সব। সাবিহা তাল সামলাতে না পেরে পিছয়ে গেছে কয়েক কদম। মস্তিষ্ক ফাঁকা। কি হলো এটা?

— আমার সংসারই তোমার করতে হবে। আমার বাচ্চার মাি তোমার হতে হবে। বেয়ার ইন মাইন্ড সাবিহা। তোমার স্বামী সভ্যই থাকবে।

সাবিহা হুঁশ ফিরে পেলো। চোখে তার জল। গড়াগড়ি খেলছে তারা গালে। তীব্র জেদ, রাগ নিয়ে সে এগিয়ে এলো সভ্যর কাছে। হুট করে শার্টের কলার চেপে ধরলো। তেজ আর ঝাঁঝ নিয়ে বলল

— আমায় থাপ্পড় মারার অধিকার আপনাকে কে দিয়েছে? আমার উপর জোর করার কে আপনি?

সভ্য সাবিহার কথার পিঠে নিজের কলার হতে ছাড়িয়ে নিলো সাবিহার হাত। মৃদু ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলো। অতঃপর হুট করে আবারও থাপ্পড়। সকলের সম্মুখে। সাবিহার বাবা মা এবার এগিয়ে এলেন। সভ্য বলছে

— এই যে থাপ্পড়ের উপর থাপ্পড় মারছি এগুলো আমার অধিকার।

চলবে….

( ভালো হচ্ছে কি গল্প?)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here