রৌদ্র কুয়াশা পর্ব ২৫+২৬

#রৌদ্র_কুয়াশা
Suvhan Årag(ছদ্মনাম)
পর্ব ২৫

(লেখা ভালো হচ্ছে কি খারাপ হচ্ছে বুঝতে পারিনা ।গঠনমূলক মন্তব্য করবেন সবাই।)

রাস্তার দিকে তাকিয়েই মাহির অবাক হয়ে গেল।সামনে মাইশা দাঁড়িয়ে।সামনে বললে ভুল হবে একটু দূরে। মাইশাকে দেখে একটুও স্বাভাবিক মনে হচ্ছে না।অনেক ঢুলে ঢুলে সে হাঁটছে।মাইশার পাশেই রিদন রয়েছে।রিদনের কাঁধের উপর মাইশা একটা হাত উঠিয়ে রিদনকে ধরে ধরে হেঁটে আসছে।রিদন এক হাত দিয়ে মাইশার কোমড় পেচিয়ে ধরেছে।আরেক হাত দিয়ে মাইশাকে বিভিন্ন ভাবে স্পর্শ করছে।মাহিরের ভেতরটা যেন জলে যাচ্ছে এ দৃশ্য দেখে।

ফুচকা খেতে খেতে ইলার চোখ যায় মাহিরের দিকে। মাহির বেশ কৌতুহল নিয়ে সামনের দিকে তাকিয়ে আছে। ইলার ও বেশ কৌতূহল জাগে মাহিরের তাকানো দেখে।মাহির কে অনুসরণ করে ইলা সামনের দিকে তাকায়।সামনের দিকে তাকিয়ে ইলার মাথা গরম হয়ে যায়। মাহির একটা মেয়ের দিকে তাকিয়ে আছে। ইলা ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে মাহিরের দিকে তাকায়।

বলে ওঠে,

-মাহির!

মাহির মাইশার দিকে তাকিয়ে এতোটাই মগ্ন যে ইলা ডেকেছে সেটাও তার কানে যায়নি।ইলার আরো বেশি রাগ উঠলো।ইলার তো মন চাইছে ফুচকার টকের মধ্যে ই মাহির কে চুবাতে।নিজেকে সংবরণ করে ইলা এবার বেশ রাগি গলায় একটু চেচিয়েই বললো,

-মাহির।

মাহির যেন কেঁপে উঠলো হঠাৎ এমন ডাক শুনে। মাহির পেছনে ঘুরে ভ্রু কুচকে তাকালো ইলার দিকে।

-কি হয়েছে? এভাবে চেচাচ্ছো কেন ?
-হ্যাঁ এখন তো আমি চেচাই।আমার গলা তো এখন বাঁশঝাড় মনে হবে আপনার কাছে।আর আওয়াজ ফাটা বাশ।আর ঐ মেয়েটার আওয়াজ ভাঙা রেডিওর মতো লাগবে।

ইলার কথা শুনে বোকা বনে গেল মাহির।

-কি বলছো কি তুমি?মাঝরাতে মাথা খারাপ হয়নি তো?
-ঠিকই বলছি আমি।কে ঐ মেয়েটা?
-কোন মেয়েটা?
-ঐ যে।

ইলা আঙুল ইশারা করে মাহিরকে সামনের দিকে তাকাতে বললো।মাহির পেছনে ঘুরে দেখে ইলা মাইশার কথাই বলছে।মাইশা কে নিয়ে রিদন গাড়িতে তুলছে।একদিক থেকে মাহিরের মনে কিছু সান্ত্বনা আসলো।সে ভেবেছিল মাইশা আবার তাকে দেখে ফেললো কিনা?মাইশা যদি ইলাকে সব বলে দেয়!সেটা হয়নি।কিন্তু মাহিরের মনে এখন অন্য ভয় জেগেছে।ইলা যদি মাইশার কথা জেনে যায়?

-আরে কি হলো?কে ও ?বলুন না।
-মাইশা।

মাহিরের কথা শুনে ইলার চোখ বের হয়ে আসার উপক্রম।মাহির মেয়েটার নাম ও জানে!এদিকে মাহির আরেক বিপদে পড়লো।মুখ ফসকে মাইশার নামটা বলেই ফেললো সে।

-এই।আপনি কি করে জানলেন ঐ মেয়েটার নাম?
-আরে।আমার বাবার বিজনেস পার্টনার এর মেয়ে।খুব উচ্ছৃঙ্খল।অফিসের পার্টিতে অনেকবার দেখেছি তাই চিনি।

ইলা ভ্রু কুচকে আবার মাহিরকে প্রশ্ন করলো,

-সত্যি তো?
-আরে হ্যাঁ।মিথ্যা কেন বলব?
-সত্যি হলে ভালো।না হলেও ভালো।
-না হলে কিভাবে ভালো?
-আপনাকে আমি টকের মধ্যে চুবিয়ে মারব সেদিক থেকে ভালো।
-কিহ!

ইলা আর মাহিরের সাথে কথা বললো না।খাওয়াতে মনোযোগ দিল।মাহির হা হয়ে দাড়িয়ে ইলার কান্ড দেখছে।

দিন দিন যেন সেই দিন ঘনিয়ে আসছে।অতীতের দিন গুলো।এই ইলাকেই এতোদিন ধরে খুঁজে চলেছিল মাহির।এই শহর, দায়িত্ব,কর্তব্য সবকিছুর আড়ালে যেন বালুচাপা পড়ে গেছিল এই ইলা।জন্ম নিয়েছিল অন্য ইলা।এখন যেন সব ফিরে যাচ্ছে তার আগের জায়গায়।ঠিক যেমন গাছের ফুল গাছেই মানায় হাতে না।

৭৬

-মামা অনেক ভালো লেগেছে আপনার ফুচকা।
-আবার এসো মা।

ফুচকা ওয়ালা কে তার বাড়ির সামনে নামিয়ে দিল মাহির।তাকে আরো খুশি করে বিদায় দিয়ে আবার বাড়ির উদ্দেশ্যে চললো।

-শুনুন।
-হু।
-ওনাকে এ তো টাকা কেন দিলেন?
-এতো রাতে ফুচকা খাওয়ালো।একটু বেশি দিলাম এজন্য।
-এটাকে একটু বেশি বলে!
-তোমার জন্য।
-আমার জন্য!
-হুম।উনি চলে যাচ্ছিলেন।ধরে বেধে ওনাকে থামিয়েছিলাম।
-না হয় অন্য একদিন খেতাম।এ তো খরচ করার দরকার ছিল না।
– আমি আমার বউয়ের পেছনে খরচ করেছি।তোমার সমস্যা থাকলে গিয়ে এলারজির ওষুধ খাও।
-আজব!
-আরেকটা কথা।
-কি?
-পানিজল সব সময় অন্য দিনের অপেক্ষা করতে নেই।
– কেন?
-অন্য দিন আসতে পারে।কিন্তু পাশের অন্য মানুষটা নাও থাকতে পারে।

মাহিরের কথা শুনে ইলার বুকটা ধক করে উঠলো।

-মানে?
-অনেক মানেই আছে।কোনটা বলব?
-আপনি এই কথা দ্বারা যেটা বুঝিয়েছেন সেটা বলবেন।
-ইলা তুমি এই পৃথিবীতে কাকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসো?
-কাকে ভালোবাসি সেটা বলার কি প্রয়োজন আছে?
– কেন?
-মানুষ তাকেই বেশি ভালোবাসে যার জন্য সে সবচেয়ে বেশি করে।
-যেমন?
-আমার পরিবার।মা,আপু, আলিশা।ওদের জন্য সব করেছি।আর এখনো করি।ওদের জন্য দোয়া করি।লুকিয়ে কাদি।খুব কষ্ট হয় ওদের জন্য।
-সবকিছু ই ঠিকাছে ইলা।কিন্তু একটা কথা কি জানো?তোমার এই সব করার মাঝেও আমি শব্দ টা নেই।
-মানে?
-এই যে আমি নেই।হাহ।কি নিষ্ঠুর দুনিয়া বলো।আমরা যার জন্য করি তারাই আমাদের কথা ভাবে না।তারাই আমাদের না।

মাহির একটা তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে গাড়ি চালানোয় মনোযোগ দিল।অন্ধকার রাত,অন্ধকার পথ,মাহিরের চোখের কোনের পানিটা চোখ বেয়ে পড়লো ঠিকই।কিন্তু সেটা ইলার অদেখায় হয়ে রইলো।

মাহিরের কথা শুনে ইলা চুপচাপ মাথা নিচু করে বসে আছে।বড্ড অপরাধবোধ কাজ করছে তার মাঝে।সে কি তবে স্বার্থপর হয়েই গেল?মাহিরের প্রত্যেকটি কথার অর্থ যে তার মনের হাজারো বেদনা কে ঘিরে সেটা বুঝতে পেরেছে ইলা।

-মাহির।
-হুম।
-একটা কথা বলব?
-না বললে হয় না?
– কেন?বললে কি অসুবিধা?
-সুবিধা অসুবিধার কথা নয়।সব সময় কথা জিনিসটা ভালো লাগে না।সহ্য হয়না।মাঝে মাঝে বিতৃষ্ণার কারণ হয়ে দাড়ায়।ব্যথার কারণ হয়ে দাড়ায়।
-আমি যদি বলি আপনি নিশ্চয়ই শুনবেন।
-উহুম।শুনব কান দিয়ে মন দিয়ে নয়।কান দিয়ে শুনলে সেটা ঐ কান আর মস্তিষ্ক এর কিছু অংশের মধ্যে ই সীমাবদ্ধ।যখন কান মন দুটো দিয়েই শোনা হয় তখনি কথার তাৎপরয থাকে।না হলে নেই।

মাহিরের কথাতে বেশ অভিমান তাচ্ছিল্যের সুর।ইলাকে বেশ কষ্ট দিচ্ছে বিষয়টা।ইলা চুপ করেই রইলো।মাহির সামনের দিকে তাকিয়ে ড্রাইভ করছে।তার সামনে বার বার যেন ঐ দৃশ্যটাই ভেসে আসছে।রিদন কি বাজে ভাবেই না মাইশাকে জড়িয়েছিল।মাহির একটুও ভুলতে পারছে না দৃশ্যটা।চোখের সামনে যেন পর্দার মতো ঝুলে আছে।

৭৭

আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে ঘুরে ঘুরে দেখছে অনু।সে খুশি না অখুশি কিছুই বুঝতে পারছেনা।আজ তার আরেকটা জীবন শুরু হতে যাচ্ছে।কিন্তু এ জীবনের স্থায়িত্ব কতদিন সেটা নিয়েই অখুশি সে।

-আচ্ছা উনি কি আমাকে ভুলে গেছেন?মা কেমন আছে?উনি কি আমাকে খুঁজেছেন একবারের জন্যও?

গভীর চিন্তায় ডুব দিল অনু।ইসমাত বেগমকে খুব মনে পড়ে তার।মা মরার পর থেকে ইসমাত বেগম ই তার জীবনের একমাত্র ব্যক্তি যিনি শুধু তাকে ভালোবাসা দিয়েছে।আগলে রেখেছে।আর সবার কাছে তো ঝাটা লাথিই পেয়ে এসেছে সে।নিবিড়ের কথা মনে পড়তেই আঁতকে ওঠে অনু মাঝে মাঝে।এই বোধ হয় নিবিড় আসলো।তার চুলের মুঠি ধরলো আর বেঢপ মার শুরু করলো তাকে।

-অনু তুমি তৈরী তো?

কথা বলতে বলতে ঘরে ঢুকলো তুলি।তুলির গলা শুনে পেছনে ফিরলো অনু।তুলি বেশ খুটিয়ে দেখছে অনুকে।অনু তো জামাকাপড় কিছুই এনেছিল না।তুলির জামা পড়ে যা ছিল।গতকাল আরিয়ান আশার সময় তুলিকে ফোন করে এটা ওটা কিনে এনেছে।অনু বোরখা পড়ে বলে ওর জন্য সুন্দর একটা খিমার সেট ও এনেছে।

-বাহ!অনু তোমাকে তো অনেক সুন্দর লাগছে।

তুলির কথা শুনে ম্লান হাসি দিল অনু।

-ধন্যবাদ।
-শোনো একটুও ভয় পাবে না।আমার ইচ্ছে ছিল তোমার সাথে যাওয়ার।কিন্ত জার্নি করলে যদি সমস্যা হয়।ভাইয়া আর যেতে দিল না।
-ভালো হয়েছে।তুমি এই অবস্থায় এতো চলাচল করো না।
-হুম।যাই হোক।দোয়া করি তোমার জীবনটা যেন এবার খুব সুন্দর ও সুখের হয়।
-আল্লাহ জানেন কি আছে আমার জন্য।তোমাদের এখানে ও পড়ে থেকে তোমাদের বোঝা হয়ে থাকতে হচ্ছে।

অনু কথা শেষ করে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো।

-এই তুলি।তুই কিন্তু বলে দিস এতো বেশি কথা বাড়াবাড়ি আমার পছন্দ না।এক কথা বার বার কেন?এতো সমস্যা হলে বলতে বল হয় ঐ মাঝরাতে যেখান থেকে এনেছিলাম ওখানেই রেখে আসব নয়তো তার সেই গুনোধর বরের কাছে।

ঘরের ভেতর ঢুকতে ঢুকতে বেশ কঠোর গলায় কথা গুলো বললো আরিয়ান।আরিয়ানের গলা শুনে দরজার দিকে তাকিয়ে আবার চোখ নামিয়ে ফেললো অনু।আরিয়ান ইউনিফর্ম পরেই এসেছে।হয়তো অনুকে ভর্তি করিয়েই সে থানায় যাবে।

-ভাইয়া তুই?
-হুম।দেরী হচ্ছে দেখে নিজেই এলাম।
-ও।
-আমি বার বার তোকে বলেছি তুলি ওনাকে বোঝাতে এই এক কথা পছন্দ নয় আমার।
-ও আর বলবে না ভাইয়া।বুঝিস তো এই অবস্থায় কি বলবে ও?
-আমি বাইরে গাড়িতে অপেক্ষা করছি।

আরিয়ান চলে গেল।অনু কাঁচুমাচু হয়ে দাড়িয়ে আছে।

-বলেছি না বার বার একথা বলবে না।
-উনি এতো রাগি কেন?
-ও যতো রাগি।ততোটাই আবেগি।দেখো অনু একটা সুযোগ পেয়েছো।সেটাকে কাজে লাগাও।এভাবে বার বার নিজের অতীত টেনে এনে নিজেকে ক্ষুদ্র মনে করলে তুমি কখনোই সামনে এগুতে পারবে না।বুঝেছো?
-হুম।
#রৌদ্র_কুয়াশা
Suvhan Årag(ছদ্মনাম)
পর্ব ২৬

তুলির কথা শুনে অনুর বেশ ভয় হচ্ছে।আরিয়ান নিশ্চয়ই তার ওপর খুব রেগে আছে।কি জানি আজ তাকে কলেজে ভর্তি করাবে কি না?অনুর মাথায় এক রাশ চিন্তা।মাথা থেকে খুশির ভুত একটু আগে ও চাড়া দিয়ে উঠেছিল।কতোই না আশা করেছিল সে হাসি মুখে কলেজ যাবে।তা না আরিয়ানকে নিজে তো রাগিয়ে দিলোই সাথে ফ্রিতে একটু ঝাড়িও খেল।

অনু গুটিগুটি পায়ে আরিয়ানের গাড়ির কাছে গিয়ে দাঁড়ালো।অনু এদিক ওদিক তাকিয়ে খুঁজছে আরিয়ানকে।

-এটা কি হলো?আরিয়ান সাহেব কোথায় গেলেন?আমাকে গাড়ির কাছে আসতে বলে নিজে উধাও!যাক বাবা।

গাড়ির মধ্যে বসে আরিয়ান ড্রাইভিং সিটের ওপর পাশের জানালা দিয়ে অনুর দিকে তাকিয়ে আছে।কোমড়ে হাত দিয়ে অনু এদিক ওদিক দেখছে।অনুর চোখ দুটো ছাড়া আর কিছুই দেখা যাচ্ছে না।চোখ দুটো যেন আরেক দফা আরিয়ানকে ঘায়েল করছে।আরিয়ান জোরে জোরে হর্ন বাজালো।অনু কেঁপে উঠলো একদম।অনু এদিক ওদিক তাকানো বন্ধ করে সামনের দিকে তাকালো।আরিয়ান এগিয়ে গিয়ে অপর পাশের জানালা খুলে দিল।

-গাড়ির সামনে কি দাড়িয়ে থাকার জন্য আপনাকেও ডেকেছি?না কি পাহারা দেওয়ার জন্য?আপু প্লিজ দেখবেন আমার গাড়ির ওপর যেন ডাকাত না হামলা করে।

আরিয়ান বেশ রেগে কথা গুলো বললো।অনু আরো ভয়ে কেঁপে উঠলো।

-আআমমি,,।
– না তোতলিয়ে দয়া করে পেছনের সিটে গিয়ে বসুন।আমার থানায় যেতে হবে।

অনু মাথা নাড়িয়ে পেছনের দরজা খুলে বসে পড়লো।আরিয়ান ও গাড়ি স্টার্ট করলো।

৭৮

সকাল দশটা বাজে।ইলা চায়ের কাপ হাতে বিছানার পাশে দাড়িয়ে আছে।মাহির বালিশ জড়িয়ে ঘুমিয়ে আছে এখনো।ইলা বার বার ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছে ।আজ সকালে নামাজ পড়ে ই মাহির আবার ঘুমিয়ে পড়েছে।সচরাচর এমন করেনা সে।অফিসের জন্য ও মাহির সব সময় নয়টার আগেই বের হয়।কিন্তু আজ তার সেই খেয়াল ও নেই।এলাম টা ও বন্ধ করে রেখেছে সে।গতকাল রাতে বাড়ি ফেরার পর থেকেও মাহির একটা কথাও বলেনি ইলার সাথে।

-মাহির।মাহির।আর কতো ঘুমাবেন আপনি?মাহির।

ইলা না পেরে চায়ের কাপটা বিছানার পাশের ছোট্ট টেবিলের ওপর রেখে মাহিরের গায়ে হাত দিয়ে ডাকতে লাগল।

-মাহির।উঠুন না আপনি।
-উউম।

মাহির একটু মুখে শব্দ করেই আবার আড়মোড়া দিয়ে ঘুমিয়ে পড়লো।

-আরে আজব তো!কি হলো এই লোকটার।এতবার ডাকছি তাতেও হুশ নেই তার!

ইলা আবার মাহিরকে ধাক্কা দিতে লাগল।মাহির এবার এমন একটা কাজ করলো সেটা ইলার ধারণার বাইরে।মাহির এবার ইলার হাতটা বেশ জোরেই ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিল গায়ের ওপর থেকে।উঠে বসলো।

-সমস্যা কি ইলা?ঘুমোচ্ছি এভাবে সেই তখন থেকে কানের কাছে ঘ্যান ঘ্যান করছো কেন?

মাহির বিরক্তি নিয়ে কথাগুলো বলে হাই তুলতে লাগলো।ইলা অবাক চোখে মাহিরের দিকে তাকিয়ে আছে।মাহিরের এমন ব্যবহার কেন যেন তার হজম হচ্ছে না।কোথাও একটা কষ্ট হচ্ছে।

মাহির হাই তুলতে তুলতে বিছানা থেকে নেমে ওয়াশরুমের দিকে গেল।

-কোন এক মহাপুরুষ বলেছিলেন,বিয়ের প্র থম দিন গুলো স্বামী স্বামী না প্রেমিক থাকে।তুমি দুটো গালি দিও তবুও তার কাছে অমৃত মনে হবে।কদিন যাবে তখন দেখবে অমৃত গুলোই উচ্ছের রস থেকেও মারাত্মক হবে।একদম বিষক্রিয়া শুরু করবে।স্বামী গুলো যে তখন প্রেমিক থেকে একদম নাকানি চুবানি খেয়ে স্বামীর রঙ ধারণ করে।

মাহির থেমে গেল।পেছনে ঘুরে তাকালো।

-কি বললে তুমি?
-আপনার যে কানে সমস্যা আগে বলেন নি তো?
-আমার কেন কানে সমস্যা হবে?
-শোনা কথা দুবার জিজ্ঞাসা করলে তাকে কানে সমস্যা ই বলা হয়।
-ও তাই।

ইলা মুখ ঘুরিয়ে বিছানার দিকে ঘুরে বালিশ ঠিক করতে লাগলো।

-তোমার কোন মহাপুরুষ এই কথা গুলো বলেছে একটু যদি নাম খানা বলতে।অতি উপকার হতো।

ইলা এবার আরেক বিপদে পড়লো।এগুলো যে মহাপুরুষ না তার মনের কথা।যদিও অনেকেই স্বামী স্ত্রী নিয়ে অনেক উক্তিই করেছেন।কিন্তু আপাতত ইলার মাথায় সেগুলো নেই।নিজের মনের কথা যা মনে হলো বলে দিল।

-বললে না?
-যে যেমন তাকে সেখানেই সেভাবে মানায়।
-এই কথা কেন?
-আপনি বলেন বেশি।আপনি জানেন এজন্য।

ইলা বিছানা ছেড়ে উঠে মুখ ঘুরিয়ে মাহিরের পাশ কেটে বেরিয়ে গেল।মাহির কিছুক্ষণ দাড়িয়ে থেকে আবার ওয়াশরুমের দরজায় পা বাড়ালো।

ওয়াশরুমের দেয়ালে লাগানো আয়নার দিকে তাকিয়ে নিজেকে দেখছে মাহির।বার বার চোখে মুখে পানির ঝাপটা দিচ্ছে।

-অনেক বড় ভুল করে ফেললাম আমি।অনেক বড় ভুল।

মাহির আরেকবার পানির ঝাপটা দিয়ে বেসিনের দু পাশে হাত রেখে আয়নার দিকে তাকিয়ে আছে।একটা কথা সত্য যে গতকাল রাতে মাহিরের দু চোখে ঘুম ছিল না।বার বার এপাশ ওপাশ করলেই যেন মাইশার আর রিদনের ঐ দৃশ্য ভেসে আসছিল।এখনো মাহির কেন যেন নিজেকে স্থির করতে পারছে না।

-আমি তো সব ভুলেই গিয়েছিলাম।অনুভূতি গুলোকে মাটির নিচে পুঁতে দিয়েছিলাম।বিবাহ বন্ধন টাকে সম্মান করেছিলাম।তুমি যেন বঞ্চিত না হও শুধু তারই যেন ফেলে এসেছিলাম সব অতীত।খোঁজ নেওয়ার প্রয়োজন মনে করিনি।কথা একটাই ছিল তোমার ওপর অন্যায় হবে।আমি তো নিজেকে তোমার জন্য প্রস্তুত করেই ফেলেছিলাম।নিজের সর্বস্ব তোমাকেই দিয়েছিলাম।আঁকড়ে বাঁচতে চেয়েছিলাম।তুমি কেন এমন করলে মাইশা?না হয় আমি ভুল। না তুমি ঠিক।তবুও তোমার ভুলটা বেশিই ছিল বরাবর।তবুও মেনে নিয়েছিলাম।একটু ভালোবেসে থাকতে পারলে না!অবশ্য তুমি তো আমাকে ভালোই বাসোনি।তোমার পথ তো আরো সহজ হয়ে গেল আমার এই এক সমস্যা র জন্য।তুমি বিনা বাধায় চলে যেতে পারলে।

মাহিরের চোখের কোনায় পানি চলে এসেছে।মাহির চোখের পানি মুছে ফেললো।

-নাহ।আর কাদব না।আমার চোখের পানি গুলো ইলার জন্য।সেটা আর কারোর জন্য নষ্ট হতে দিতে পারব না।আমি গতকাল ইলার প্রতি অন্যায় করেছি।সকালে ও ইলা আমার কথাতে মন খারাপ করেছে।ওর কথা গুলো বুঝি আমি।ও আমাকে কাছে টেনে না নিলেও আমি কেন নেব না!আমি ইলাকে সময় দেব।

হাত মুখ ধুয়ে নিজেকে ঠিক করে আয়নায় আবার তাকালো মাহির।নিজের প্রতিচ্ছবি দেখে বড্ড হাসি পায় তার।কি তার জীবন!

টাওয়েল দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে ঘরে ঢুকলো মাহির।এদিক ওদিক তাকালো।বিছানা গোছানো।কিন্তু ঘরে ইলা নেই।

-এই মেয়েটাও না!আরেক বোম্বাই মরিচ।নিশ্চয়ই রান্নাঘরে কি ঐ ঘরে বসে আছে মুখ গোমড়া করে।সবই ঠিকাছে।মরিচের ঝালে শুধু জ্বলাতেই পারে।মিষ্টি কিছু তো দিতে পারে না।

হঠাৎ করেই মাহিরের ফোন বেজে উঠলো।মাহির বিছানায় গিয়ে বসে ফোন হাতে নিল।স্ক্রিনে ভেসে উঠছে “বাবা”।মাহিরের মুখে আরেকটা তাচ্ছিল্যের হাসি ফুটে উঠলো।মাহির ফোনটা রিসিভ করে কানে তুললো।

-আসসালামু আলাইকুম বাবা।
-কি শুরু করেছো কি তুমি হ্যাঁ?বউয়ের আঁচল ধরে ঘুরে বেড়াচ্ছো নাকি!নাকি ঐ মেয়ে তোমাকে বশ করে উঠতে বসতে নাচাচ্ছে?

আলফাজ সাহেব কড়া গলায় চেঁচিয়ে কথাগুলো বললেন।

-সালাম এর উওর দেওয়া ওয়াজিব এটা তোমাকে কতো বার বলতে হবে?
-আগে আমার প্রশ্নের উওর দেও।
-আমার বউয়ের আঁচল ধরে ঘুরে বেড়াব তো কি হয়েছে?বেশ করেছি।আরো বেশি করে ঘুরব।নিজে বউ নিয়ে তো সংসার ও করতে পারলে না।অন্যের টা দেখে কি হিংসা হয় তোমার?
-মাহির!
-চেঁচিয়ে লাভ নেই বাবা।তুমি আমাকে এখন সেই আগের মতো দুর্বল পাও নি যে তোমার ধমকে চুপ হয়ে যাব।
-কয়টা বাজে এখন?অফিসে কেন আসোনি?
-আমার শরীর টা ভালো লাগছে না।আজ একটু রেস্ট নেব।অফিসে যাব না।
-কি এমন হয়েছে শুনি?মরে তো আর যাও নি।না হসপিটালে এডমিট হয়েছো।আহামরি কিছু হয়নি।তোমার জন্য আজ আমার এতো টাকার টেন্ডার যদি আটকে যায় তোমাকে ছাড়ব না বলে দিলাম।অফিসে এসো।
-একবার বলেছি যাব না।তো যাব না।আমার বাচা মরাতে তোমার কিছু আসে যায়না।তোমার টেন্ডার যাওয়াতেও আমার কিছু এসে যায়না।আল্লাহ হাফেজ।

মাহির আলফাজ সাহেবকে আর কিছু বলার সুযোগ দিল না।ফোন সুইচড অফ করে দিল।

বাবা শব্দ টার প্রতি ঘৃনা হয় মাহিরের।এতোটা নিষ্ঠুর স্বার্থপর কিভাবে হতে পারে মানুষ!মাহির ভেবে পায়না।

৭৯

-আম্মাজান।
-বলো।

ইসমাত বেগম বসে সেলাই করছেন।এর মধ্যে নিবিড়ের আগমন।নিবিড়ের দিকে এক নজর তাকিয়ে চোখ নামিয়ে নিজের কাজে মনোযোগ দিলেন ইসমাত বেগম।

-আম্মাজান।
-চুল এলোমেলো কেন?কাকের বাসা দেখা যাচ্ছে।
-সব অনুর দোষ।ঐ মেয়েটার দোষ।

নিবিড়ের কথা শুনে ইসমাত বেগম সেলাই বন্ধ করে নিবিড়ের দিকে তাকালেন।

-আবার কেন ঐ মেয়েটাকে টানছো তুমি?
-অনু রোজ আমার চুল আচড়ে দিত তিনবেলা।মাথা ধরলে তেল মালিশ করে দিত।গোসল করার সময় পিঠে সাবান লাগিয়ে দিত।দেখুন আমার গা দিয়ে ও গন্ধ বের হচ্ছে।আপনি বলুন আম্মাজান এগুলো সব অনুর দোষ না?
-অবশ্য ই দোষ।মেয়েটা স্বামী হিসেবে তোমার সেবা করতো এটাই তার দোষ।
-আপনি সব সময় ওর পক্ষ নেন।
-না নেওয়ার কারণ আছে কি?
-আম্মাজান আমি ডালের হালুয়া আর রুটি খাব।
-আচ্ছা রাতে বানিয়ে দেব।ঘি নেই ।অফিস থেকে আসার সময় ঘি কিনে আনবে।
-উহুম।
-কি হয়েছে?
-আপনার বানানো রুটি অনেক শক্ত।চিবুতে পারিনা।
-ছোট থেকে তো আমার হাতের রুটি ই খেয়ে এসেছো।
-অনু খুব ভালো রুটি বানায়।ছোটোছোট ছোটো করে।ফুলকো রুটি।
-নিবিড় তোমার অফিস আছে।নিচে খাবার রেখেছি টেবিলে।খেয়ে বেরিয়ে যাও।

নিবিড় এবার দৌড়ে গিয়ে ইসমাত বেগমকে জড়িয়ে ধরলো।হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো।

-কাদছো কেন বাবা?
-আম্মাজান অনু খুব খারাপ।খুব খারাপ।ও আমাকে ফেলে চলে গেল কেন।ও খুব বাজে মেয়ে।আম্মাজান আমাকে অনু এনে দিন।ঐ ছোট্ট পুতুল টা। গোলগাল মুখ।লাল শাড়ি পড়ে বউ সাজা পুতুল টা।

নিবিড় কেঁদেই চলেছে।ইসমাত বেগম নিবিড়ের গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন।তার কেন যেন খুব শান্তি লাগছে নিবিড়ের চোখের পানি দেখে।প্রতি টা পানির ফোটা যে অনুর চোখের পানির মূল্য।

সময় গেলে সাধন হবে না।হোক সেটা কর্ম হোক প্রিয়জন।

চলবে———-

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here