লতাকরঞ্চ পর্ব ১০

#লতাকরঞ্চ (১০)

সকালে উঠে দেখলাম ফুফু ঘোমড়া মুখ করে বসে আছে। ব্যাপারটা কি তা আন্দাজ করার জন্য আম্মাকে জিজ্ঞেস করলাম। আম্মা বললেন আব্বার সাথে নাকি ফুফুর কিসব নিয়ে তুমুল কথা কাটাকাটি হয়েছে সকালে। তাই সকাল থেকে দানাপানিটাও মুখে না তুলে এভাবে মুখ গোমড়া করে বসে আছে ফুফু। ফুফা ব্যবসার কাজে প্রতি সপ্তাহে দুবার করে রাজশাহী যান। আজ ও গিয়েছে। প্রান্তিক ভাই ও বাড়িতে নেই, বন্ধু- বান্ধব নিয়ে ঘুরতে বের হয়েছে।
শোভা আপুও বাসায় গিয়েছে নিজ কর্মে।

আমি আম্মাকে বললাম,
– আব্বা সবেমাত্র সুস্থ হয়ে উঠেছে। ফুফু এখনি কি এমন গুরুতর কথা বলে যে আব্বা রেগে গিয়ে তাকে কথা শোনাবে? আর আপনিই বা থাকেন কোথায়? আব্বার এখন এগুলো সব মানা জানেন না? উত্তেজিত হওয়া, জোরে কথাবার্তা বলা পুরোপুরিভাবে নিষেধ।

আম্মা তরকারি রান্না করছে। নারকেল দিয়ে মাছের ঝোল। বললেন,
– জানিনা রে। তোর আব্বা আর তোর ফুফুর যে মাঝেমাঝে কি নিয়ে এত ঝামেলা হয়… সত্যিই জানিনা। আমাকে বলেনাতো তোর আব্বা,জানবো কি করে? আর কিছু জিনিস জানি যেগুলো তোকে বলা নিষেধ।

আমি জানতাম আমাকে বলা নিষেধই হবে। কারণ আমি ছোট মেয়ে না? তাই আমার জন্য সব না না আর না! আম্মাকে রেগে মেগে বললাম,
– ধেৎ! কিছুই জানতে চাইবো না আর।
এই বলে চলে আসলাম।

বারান্দায় চা বানিয়ে নিয়ে গেলাম।
চেয়ার টেনে বসবো তখনি দেখলাম লিমা আপু ফোন কানে দিয়ে উদাসভঙ্গীতে কথা বলছে।
আমি তাড়াতাড়ি চা নিয়ে আবার চলে এলাম নিজ রুমে।

এসে দেখি শোভা আপু বসে আছে আমার রুমে।
আমি তোয়াক্কা না করে হুমায়ূন আহমেদের “কে কথা কয়” বইটা হাতে নিয়ে আবার রুম ছাড়তে যাচ্ছিলাম। তখন শোভা আপু বললো,
– এই লতা! দাঁড়াও তো! শুনো, আজকে প্রান্তিক না আমাকে ট্রিট দিবে! উফ! আমি খুব এক্সাইটেড!
আমি বললাম,
– হুঁ।
– আবার হুঁ?
– না, কেন?
– আজ আমার জন্মদিন তাই! সকালে বাড়িতে গিয়েছিলাম একটু আগে আসলাম। আর আমার মাম্মামকেও তোমার আব্বা দাওয়াত করেছে বিয়েতে। জানো? ইনভাইটেশন কার্ড দিয়ে আসলাম।
– হুঁ।
– আচ্ছা শোন, আজকে বিকেলে আমরা একটা রেস্টুরেন্টে যাচ্ছি।
– হুঁ।
– বার বার হুঁ হুঁ করবা না তো। হুমায়ূনের বই পড়ে পড়ে একদম হুমায়ূনই তৈরী হচ্ছো দিনকে দিন।
যাক গে, প্রশ্ন হচ্ছে তুমি যাবা?
– না আপু।
– কেন?
– কাজ আছে। আমি যাচ্ছি।
– তুমি তো বড় স্বার্থপর মেয়ে হইছো! একাই চা খাচ্ছো, আমাকে একটা অফারতো এট-লিস্ট করতে পারতা নাকি!
– সরি। আমি আপনার জন্য নিয়ে আসছি,ওয়েট।
উনি হাসি দিয়ে বললেন,
– না। দাঁড়াও দাঁড়াও! আমি তোমার মত অত চা-টা খাইনা। স্কিন প্রব্লেম করে তো তাই।

আমি আবার হুঁ বললাম।
উনি নোটিস করেছে কিনা জানিনা। তবে এক প্রকার চাপিয়ে দিয়েই বললো,
– তুমি ড্রেস-আপ নিয়ে রেডি থাকবা। আমরা একসাথেই বেরোবো। কিশোর যখন আছে কিশোর ও যাবে। ওকেও বলবা রেডি হয়ে থাকতে। কেমন?
______________
__________

আমরা এখন বসে আছি একটা রেস্টুরেন্টে। বাংলাদেশে মেবি হেপ্টা স্টার হোটেলটা নেই নয়তো ওখানেই হয়তো নিয়ে যেত প্রান্ত ভাই উনার জীবনান্তকে। হালকা নীলাভাব আলো আর সামান্য ফ্যাকাসে অন্ধকার ভাবটা আমার মাথা গুলিয়ে দিচ্ছে। কি অসহ্যকর! দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছে একদম। এত নিরিবিলি জায়গা…
আমাদের বাড়ির পাশের চায়ের দোকানটাও এর থেকে অনেক ভালো।

খাবার দিলো।
চাইনিজ আর পাশাপাশি দেখা যাচ্ছে চিকেন দিয়ে কি কি যেন রান্না করে আনছে। কাঁচা মাংশই মনে হচ্ছে লবণ, হলুদ ছাড়া কষিয়ে সুন্দরমত কয়েকটা টমেটো, ধনে পাতা, পেঁয়াজ কলি দিয়ে সাজিয়ে উপরে সস দিয়ে সার্ভ করে নিয়ে এনেছে এরা!
বাহ্! সুন্দর!
আমি কাটা চামচ দিয়ে খেতে পারিনা।
হাত দিয়েই খাওয়া পড়েনা তেমন। কোনোদিন আম্মা খাওয়ায় তো কোনোদিন আব্বা।

সামনে বসে আছে কিশোর ভাই, তার পাশে প্রান্তিক ভাই। আর আমার পাশে বসে আছেন মহারাণী ভিক্টোরিয়া ওরফে শোভা আপু।

আমি চামচ বসাতেই মুরগীর একটা পিস উড়ে চলে গেলো প্রান্ত ভাইয়ার পকেটে!

ছি:! ছি:! ছি:! লজ্জ্বায় তো আমার মাথা হেট!
মুরগীটা পকেটে যাওয়ার আগে ভাইয়ার শার্টের কিছু অংশে বিচ্ছিরি কালার লেপ্টে দিয়ে গিয়েছে।
ভাই হাউমাউ করে কেঁদেই দিচ্ছিলো কারণ ওটা উনার ব্রেন্ডের শার্ট!

প্রান্ত ভাইয়া রক্তচক্ষু নিয়েও ফিসফিস করে বললো,
– ঐ বলদ! এটা কি করলি? তুই কি গাঁধা নাকি?
এই বলে হাপিত্যেশ জুড়ে দিয়ে বলতে লাগলো,
হায় আল্লাহ! এখন কি হবে! এটাতো আমার…

হঠাৎ লক্ষ্য করে দেখলাম আমার প্লেটে কেউ পানি ঢেলে দিচ্ছে। চোখ নিচে নামিয়ে দেখলাম হ্যাঁ, সত্যি সত্যিই!
শোভা আপু আমার প্লেটে পানি ঢেলে দিয়েছে।
কেন?
আমি কেন এই গর্হিত কাজটা করলাম। কেন প্রান্ত ভাইয়ার ইমেজটা নষ্ট করেছি তাই আমার এখন খাওয়া বারণ।

প্রান্ত ভাই শোভা আপুকে বলছে,
– এই, কি হলো এটা? এটা কি করলা? কেন করলা?

শোভা আপু স্ট্রেইটলি বলে দিলো,
– তুমি চুপ থাকো। যা করছি ঠিক করছি।
একটা সাবস্ট্যান্ডারড মেয়ে। রেস্টুরেন্টে ঠিকমত খেতে পর্যন্ত পারেনা। এ নাকি আবার.. যাও, গেট লস্ট। তোমার খেতে হবেনা। স্টুপিড কোথাকার।

আসলে সদ্য প্রান্ত ভাইয়ার যে শার্টটা আমি নষ্ট করলাম সেটা উনারই(শোভা আপুর) দেওয়া। গিফট করেছিলো উনি। কে জানে হয়তো শোভা আপুর গায়ের এই দামী ওয়েস্টার্ন লং স্কার্টটাও প্রান্ত ভাইয়ের দেওয়া।
হতেই পারে, অসম্ভব কিছু না।

আমি এই অপমান দেখে চুপসে আছি একদম।
তখন প্রায় রাত ঘনিয়ে আসছে।
শোভা আপু চলে যাওয়ার জন্য তাগিদ দিচ্ছে।
আমি যে অপমান গায়ে মেখে চলে যাবো মুখ ভেঙচিয়ে, তার সুযোগ ও নেই। কারণ আমি একদম কিচ্ছু চিনিনা।

কেউ একজনকে তো লাগবে।
তাছাড়া হুটহাট কোনো অপ্রীতিকর ডিসিশন আমি কখনোই নেই না। আমার ধৈর্য্য আর আস্তে আস্তে ডিসিশন নেওয়ার ক্ষমতাটা অনেকের নিকটই ঈর্ষণীয়।

আমার জায়গায় অন্য কেউ হলে ধুমধাম মেরে দিয়েই চলে যেত। কিন্তু আমি আস্তে করে মিনিয়েমিনিয়ে বললাম,
– এত রাতে একা একা কিভাবে যাবো? আপনারা সবাই খান, আমি বাইরে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছি। তাছাড়া এখান থেকে আমি বাড়িও চিনি না।

শোভা আপু বললেন
– প্লিজ! ডু দ্যট।
আমি উঠে পড়লাম।
সবাই তাকিয়ে আছে আমার দিকে। আপুর পানি ঢালার দৃশ্যটা সবাই_ই দেখেছে। সবার দৃষ্টি এখন সার্কাসের জোকারে দিকে। মানে আমি, আমার দিকে।

খাওয়াটা যে পন্ড হলো এতে আমার বিন্দুমাত্র ও আক্ষেপ নেই কারণ খাবারটা এক কথায় জঘণ্য ছিলো। ভালোই হইছে এক হিসেবে। এই অখাদ্য-কুখাদ্য তো আর আমায় খেতে হলোনা!কিন্তু অপমানটা বেশিই হয়ে গেছে একদম।

কিশোর ভাই শোভা আপুকে বললো,
– এক্সকিউজ মি মিস শোভা। আপনি বোধ হয় খুব অহংকারী তাইনা?
শোভা আপু হা করে তাকিয়ে আছে।
কিশোর ভাই বললো,
– ভদ্রতা বলে একটা জিনিস হয়। জানেন সেটা কি?

চলবে…

#ফারজানা_রহমান_তৃনা।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here