লাবণ্যপ্রভা পর্ব ৫

লাবণ্যপ্রভা
পর্ব-৫
৮.
তুনিড়ের বিয়ে হয়ে গেল। বিয়ের দশদিন পর প্রগতি কে নিয়ে মালয়েশিয়া চলে গেল। এই দশদিন প্রতি রাতে আমি বারান্দা থেকে ওদের বিল্ডিং এর দিকে তাকিয়ে থাকতাম। কি জন্য যে তাকিয়ে থাকতাম সেটা আমি জানতাম না। দশদিন পার হওয়ার পর সন্ধ্যাবেলা ঘুমের ওষুধ খেয়ে ঘুমাতাম আর উঠতাম সকাল ১১ টার পর। এভাবে কিছুদিন কাটলো। মা বাবা দুজনের কেউই আমার সাথে কথা বলতেন না। মোটকথা আমার কোনো ব্যাপারেই কোনো কথা বলতেন না।

বাবা মায়ের কষ্ট উপলব্ধি করতে পেরেছিলাম এক রাতে। সেদিন রাতে আমি ঘুমের ওষুধ খাইনি। অনেক দিন বাইরে যেতে পারিনি। আর হাতে টাকা পয়সাও ছিলো না। তাই একদিন রাতে মায়ের গুন গুন করে কান্না শুনতে পাই। মা বাবাকে কি বলেছিল শুনতে পাইনি। তবে বাবার কথা শুনতে পেয়েছিলাম। বাবা বলেছিল,
-একসময় যারা আমাকে প্রফেসর সাহেব বলে ডাকতেন তারা আজ আমাকে লাবণ্যর বাবা বলে ডাকে। যদি আমার মেয়ে কোনো ভালো কাজ করতো আর সেজন্য যদি লাবণ্যর বাবা ডাকত তবে আমার বুক টা গর্বে ভরে উঠতো। কিন্তু আফসোস এখন কেউ লাবণ্যর বাবা বললে আমাকে মাথানিচু করতে হয়।

বাবার কথায় সেদিন আমি মুখ চেপে কেঁদেছিলাম কেননা পাশে আমার ছোট বোন ঘুমাতো। বাবা মানুষ টা রাগী ছিলেন তবুও আমার সব জেদ মেনে নিয়েছিলেন আমার খুশির জন্য। অথচ সেই আমার জন্যই তার বাইরে চলা কষ্টকর হয়ে গিয়েছিল।

মা অবশ্য মুখে কিছু বলতেন না। তবুও আমি তার মুখ দেখে বুঝতাম। তার মলিন মুখ, হেরে যাওয়া মুখ।

আমি বাবা মায়ের প্রথম সন্তান। আমাকে নিয়ে তাদের অনেক স্বপ্ন ছিলো। হ্যাঁ একসময় তারা ঠিকভাবে আমার খেয়াল করেনি কিন্তু সেটার কারন তারা ভেবেছিলেন আমি বড় হয়ে গেছি, বুঝদার হয়েছি এখন নিজের ভালো বুঝব তাই আমাকে স্বাধীনতা দিয়েছিল পুরোপুরি। আর আমি কি করলাম! তাদের বিশ্বাস আর স্বাধীনতার অপব্যবহার করলাম। আমার এই অবস্থার জন্য আমি নিজেই দায়ী ছিলাম। কেন আমি তাদের কথা শুনলাম না! এসব ভেবেই পুরো রাত পার হয়ে গেছিল। সকালে উঠে চিন্তা করলাম বাবার কাছে ক্ষমা চাইবো।

ভাবনামতো প্রথমে মায়ের কাছে ক্ষমা চাইলাম। মা ক্ষমা করেছিল কি না জানিনা তবে দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে বলেছিল,
-ক্ষমা চাইলেই কি সব ঠিক হয়ে যাবে লাবণ্য?? আমরা কি আগের সম্মান ফিরে পাব??
আমি কিছু বলতে পারিনি। বাবার পায়ে ধরে ক্ষমা চাইলাম। আর এও বলেছিলাম যে এখন থেকে তাদের কথা শুনবো আর নিজের ক্যারিয়ারের দিকে ফোকাস করবো।

বাবা কিছুক্ষণ ভ্রু কুচকে তাকিয়ে বললেন, সত্যিই কি আমাদের কথা শুনবে?? নাকি আবার কোনো নতুন নাটক??
আমি কান্না নিয়েই বললাম, সত্যিই তোমরা যা বলবে সেটাই শুনবো।
আমাকে অবাক করে দিয়ে বাবা বললেন,
-তোমার কাছ থেকে আমি আর নতুন করে কিছু আশা করছি না। আর তোমার ওইসব মিষ্টি কথায় ও আর ভুলছি না। আমি চাই না যে তুমি আমার চোখের সামনে থাকো। পড়াশোনা, ক্যারিয়ার এসব কিছুই যে তোমার জন্য নয় সেটা আমি এতদিনে বুঝে গেছি ভালোভাবে। তাই আমি চাই তুমি বিয়ে করো। কারন তুমি ঘরে থাকা মানে আমার অন্য মেয়ের জন্যই ক্ষতি।

আমি কেন যেন সেদিন আর বাবার কথায় দুঃখ পেলাম না। আর তাছাড়া আমি হয়তো অনুভূতি শুন্য একজন মানুষ ও হয়ে গিয়েছিলাম ওই ঘটনার পর।

বাবা আমার বিয়ের জন্য উঠে পড়ে লাগলেন। কিন্তু স্বাভাবিক ভাবেই আমার জন্য কোনো পাত্র পাওয়া গেল না। যাও পাওয়া গেল তারা আমার সম্পর্কে লোকমুখে সব শুনে আর রাজি হলো না। আর আমার বাবা পন করেছিলেন যে করেই হোক বিয়ে দেবেন ই।

প্রায় একমাস হয়ে গেল কিন্তু সেরকম পাত্র পাওয়া গেল না। বাবা তারপর একজন বেকার গরিব ছেলে যোগাড় করলেন যে কিনা টাকার জন্য আমাকে বিয়ে করবেন।

বিয়ের আগে আমি সেই ছেলের সাথে দেখা করলাম। তুনিড়ের সাথে সম্পর্কের কথা বললাম। সব শুনে সেও বিয়ে করতে রাজি হলো না। মায়ের হাতে প্রচুর মার খেলাম। মা এক পর্যায়ে ক্লান্ত হয়ে গিয়ে বললেন, এর চেয়ে তোর মরে যাওয়া উচিত।

কিন্তু আমার একটুও মরতে ইচ্ছে করেনি। বরং বাঁচতে ইচ্ছে করতো।

একসময় যে লাবণ্য রুপের অহংকার করে রুপসা কে অনেক কিছু শুনিয়েছিল সেই রুপ দেখেও কোনো ছেলে বিয়ে করতে চায়নি। তখন আমি ভেবেছিলাম কেন এসব আমার সাথেই হচ্ছে। কিন্তু এখন আমি জানি একশন এর রিয়েকশন বলেও একটা কথা আছে।

আমার দুঃসময়ে হঠাৎ আমার পাশে এসে দাঁড়ালেন আমার বড় খালা। সব শুনে বড় খালা আমাকে তার সাথে নিয়ে গেলেন কলকাতায়। আমার বাবা খালাকে বলে দিয়েছিলেন যে কানা, বয়রা যা পান বিয়ে দিয়ে দেবেন। আমার ঘরে আর যেন না আসে।

বড় খালা অবশ্য সেটা করেনি। বরং তার হাত ধরেই আমার জীবনের নতুন অধ্যায়ের শুরু হয়েছিলো।

৯.
বড় খালা আমাকে কলকাতা নিয়ে প্রথমেই একজন সাইক্রিয়াটিস্টের কাছে নিয়ে যান। সাইক্রিয়াটিস্টের নাম ছিলো ফারজানা মাহবুব। দেখে একদম পরিপাটি হাউজওয়াইফের মতো লেগেছিল। খালা ছিলেন আমার একমাত্র ভরসা। তাই তার খুশিতেই আমি ওনার কাছে গিয়েছিলাম। উনি আমাকে ওনার চেম্বারে না ডেকে বাড়িতে ডেকেছিল। গল্পচ্ছলে আমি ওনাকে সব বলেছিলাম। উনি সব শুনে সাতদিন পর আমাকে আবার যেতে বলেছিলেন।

সাতদিন পর আমি ওনার কাছে গেলাম আবারও। উনি আমাকে দেখে প্রথমেই জিজ্ঞেস করলেন, লাবণ্য আপনার কি মিথ্যা বলা রোগ আছে।
আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, সেটা আবার কেমন রোগ???
যেসব মানুষ কারনে অকারণে মিথ্যে বলে তাদের একধরনের মানসিক রোগ থাকে যাকে বলে প্যাথলজিকাল লায়িং ডিসঅর্ডার।
আপনার কি এই ধরনের সমস্যা আছে? নাকি শুধু তুনিড়ের ব্যাপার টা শুধু মিথ্যে বলেছেন??
আমি একটু গাবরে গেলাম। স্বাভাবিক ভাবেই তুনিড়ের ব্যাপারে যা ঘটেছিল তার থেকে একটু বাড়িয়ে বলেছিলাম আর নিজের দোষ চেপে গিয়েছিলাম কিন্তু উনি সেটা ধরে ফেলেছিলেন।

আমি নিজেই মিনমিন করে বললাম, আমি সবসময় মিথ্যা বলিনা। আমার এই রোগ নেই।

উনি হেসে বললেন, লাবণ্য এটা মানুষের কমন স্বভাব যে দোষ বলার সময় অন্যের টা বাড়িয়ে আর নিজের টা কমিয়ে বলা। আপনি যখন বলছিলেন তখন আমি আন্দাজ করতে পেরেছিলাম কিছুটা। কারন যখন তুনিড়ের কথা বলছিলেন তখন আপনার চোখ মুখে তীব্র ঘৃনা আর ক্রোধ মিশে ছিলো কিন্তু নিজের কথা বলার সময় আপনি চোখ নামিয়ে কথা বলছিলেন।

আর সেজন্যেই আমি আপনার ব্যাপারে খোঁজ খবর নিতে একটু সময় নিলাম। অবশ্য নির্ধারিত সময়ের আগেই সব জেনেছিলাম।

আমি জিজ্ঞেস করলাম, কিভাবে??
তখন সে হেসে বলল, আপনার ব্যাপারে একমাত্র সব সত্যি একজন ই জানত। যাকে আপনি সব সত্যি বলেছিলেন তার কাছ থেকে জেনেছি।
উনি বলার আগেই আমি বললাম, রুপসা!!
উনি বললেন, হ্যাঁ।

খালার জন্য ওনার কাছে যাওয়া ওনাকে সহ্য করলেও সে সময় ওনার কথা শুনে আমি নিজের রাগ কন্ট্রোল করতে পারলাম না। উনি আমাকে অনেক ভাবে বোঝালেন কিন্তু আমি বুঝলাম না। রেগেমেগে ওখান থেকে চলে আসছিলাম। ফারজানা মাহবুব একটা কথা আমাকে বলেছিল,
যেটা সহ্য করা আমার পক্ষে সম্ভব ছিলো না। যেটা মেনে নিতে না পেরে আমি আত্মহত্যা করার চেষ্টা করেছিলাম। সেটা হলো, লাবণ্য আপনার সাথে যা হয়েছে তার জন্য আপনি দায়ী ছিলেন। তুনিড় যা খারাপ করেছে সেটাও আপনার প্রশ্রয় পেয়ে। আর সবচেয়ে নির্মম সত্যি ছিলো যে আপনি তুনিড় কে কখনো ভালোই বাসেন নি। আপনি ভালোবেসেছিলেন তুনিড়ের আউটলুক অর্থাৎ আপনার ভাষায় তুনিড়ের রাজপুত্রের মত চেহারা।
চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here