লাবণ্যপ্রভা পর্ব ৪

লাবণ্যপ্রভা
পর্ব-৪
৬.
তুনিড়ের সাথে মারামারির ঘটনা পুরো পাড়ায় সবাই জেনে গেল। তুনিড়ের মা বাবা সহ কেউ একথা বিশ্বাস করছে না যে আমরা রিলেশনে ছিলাম। অবশ্য বিশ্বাস না করার কারন ছিলো। তুনিড়ের কথামতো রাস্তাঘাটে দেখা হলে আমি কথা বলতাম না। আমরা দেখা করতাম দূরে কোথাও গিয়ে।

তাই স্বাভাবিকভাবে সবাই আমাকে ভুল বুঝল। তুনিড় অস্বীকার করে গেল সব। বাবা মা তুনিড় কে প্রশ্ন করতে তুনিড় সেই একই কথা বার বার বলতে লাগল। বাবাকে বলল,
-আংকেল আপনার কেন মনে হয় লাবণ্যর সাথে আমার সম্পর্ক আছে??
বাবা বললেন, লাবণ্য আমাদের এরকম বলেছে তাই!
-লাবণ্য তো মিথ্যেও বলতে পারে। আর তাছাড়া ওর কাছে নিশ্চয়ই কোনো না কোনো প্রমাণ আছে! সেগুলো কি একবার সবাইকে দেখাতে বলবেন প্লিজ??
আমি অবাক হয়ে গেলাম। আমার কাছে সত্যিই কোনো প্রমাণ নেই। আমরা যে দীর্ঘ সময় মেসেজে প্রেমালাপ করতাম সেগুলোও তুনিড়ের কথামতো ডিলিট করে দিয়েছিলাম যেন কারো চোখে না পড়ে।

এছাড়া আর কোনো প্রমাণ ই নেই আমার কাছে। তবুও আমি হাল ছাড়লাম না। নিজের মতো গলাবাজি করে গেলাম। আর তুনিড় একদম ঠান্ডা। একটুও নার্ভাস হতে দেখা যায় নি। প্রত্যেকটা মিথ্যা কথা এমন ভাবে বলছিল যে বিশ্বাস না করে উপায় নেই।

কেউ বিশ্বাস করল না। বরং আমার দোষ হলো আমি সেজেগুজে তুনিড়ের সামনে যেতাম সেটা অনেকের ই চোখে পড়েছে। আর তুনিড় যে আমাকে পাত্তাই দেয়নি সেটাও সবাই দেখেছে তাই বিশ্বাস করার প্রশ্নই আসেনা।

আমি সব বললাম। প্রত্যেকটা ঘটনা বললাম। এমনকি মিথ্যে বলে ঢাকার বাইরে যাওয়ার ঘটনাও বললাম। তুনিড় তখন স্বাভাবিক গলায় বলল,
-তোমার কাছে কি প্রমাণ আছে লাবণ্য?
আমি বললাম, হ্যাঁ আছে।
আমি তখন বেড়াতে যাওয়ার টিকিট গুলো দেখালাম। কিন্তু তুনিড় উল্টে পাল্টে বলল,
-কই কোথাও আমার নাম তো লেখা নেই।
আমি হতাশ হয়ে গেলাম। সবাই আমাকে ভুল বুঝল। তুনিড় হলো ভদ্রলোকের ছেলে। সে ভালো সাবজেক্টে, ভালো ইউনিভার্সিটি তে পড়েছে। সে এরকম করতেই পারেনা।

আর আমি হলাম বেহায়া মেয়ে মানুষ। কয়েকদিন তুনিড়ের পেছনে পড়ে থেকে যখন বুঝলাম কোনো লাভ নেই তখন লোফার টাইপের কারো সাথে প্রেম করেছি। আর আমি আগে থেকেই খারাপ। তারপর আবার পড়েছি ইডেন কলেজে। খারাপ সঙ্গে মিশে আমার এই অবস্থা। এখন তুনিড়ের বিয়ের খবর শুনে এরকম সিনক্রিয়েট করছি।

তুনিড়ের বাবা আমার বাবাকে খুব কথা শোনালেন। আর সেই সাথে বললেন, এরকম ঘটনা পুনরায় ঘটলে উনি আইনি ব্যবস্থা নেবেন।

এরপর আমার জীবন টা হয়ে গেল দুর্বিষহ। মা একটু সাপোর্ট করেছিল এখন সেও মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। মিথ্যে বলে ঘুরতে যাওয়া ব্যপার নিয়ে বাবা তুলকালাম করলেন। আমাকে দুটো থাপ্পড় ও মারলেন।

শুরু হয়ে গেল রাত দিন অশান্তি। এই বিপদে যে মানুষ দুটো কে আমার সবচেয়ে দরকার ছিলো তারাও আমাকে ভুল বুঝল। অবশ্য তার জন্য পুরোপুরি আমি দায়ী ছিলাম। আমি তাদের অবাধ্য হয়েই তুনিড়ের সাথে মিশেছিলাম।

এতো কিছুর পর আমার মাথায় শুধু একটা ব্যাপার ঘুরতে লাগলো যে করেই হোক তুনিড়ের বিয়ে আটকাতে হবে। ওকে আর আমি চাইনি জীবনে শুধু চেয়েছিলাম ওর মান সম্মান সব শেষ হয়ে যাক আমার ই মতো।

আমি নিয়মিত নামাজ পড়তে শুরু করলাম। প্র‍তি মোনাজাতে আমি আল্লাহর কাছে চাইলাম তুনিড়ের বিয়ে যেন না হোক।

বিয়ের তিনদিন আগে আমার মাথায় হঠাৎ কুবুদ্ধি এলো। যার নাম রুপসা। হ্যাঁ একমাত্র রুপসা আপুই পারবে তুনিড়ের বিয়ে ভেঙে ওর মুখোশ খুলে দিতে।

৭.
বাড়ি থেকে বের হয়ে রুপসা আপু কে খুঁজতে যেতে খুব বেশী সমস্যা হলো না। কারন বাবা মা তখন আর আমাকে কিছু বলতেন না। আমি প্রথমে গেলাম রুপসা আপু যে হলে থাকতো সেখানে। সেখানে গিয়ে রুপসা আপুর খোঁজ পেলাম।

রুপসা আপু তখন একটা কলেজের ক্যামিস্ট্রির টিচার। আমাকে দেখে রুপসা আপুর বলা প্রথম কথা ছিলো,
-লাবণ্য না?? এই অবস্থা কেন??
আমি রুপসা আপুর দুই হাত চেপে ধরে বললাম,
-আমাকে তুমি বাঁচাও। তোমার সাহায্য ছাড়া আমি মরে যাব।
রুপসা আপু তীক্ষ্ণ চোখে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে বলল,
-কি হয়েছে লাবণ্য?
আমার মনে হয়েছিলো আগে নিজের সবকিছু বলার আগে রুপসা আপুর কাছ থেকে জেনে নেওয়া উচিত।
আমি রুপসা আপু কে জিজ্ঞেস করলাম, তুনিড় ভাইয়ের সাথে তোমার কি কারনে ব্রেক আপ হয়েছে??
রুপসা আপু ভ্রু কুচকে কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে বলল,
-আজ প্রায় সাড়ে তিন বছর পর এই প্রশ্ন?
-আমার জানা যে খুব দরকার রুপসা আপু!
আমার বলার ধরন দেখে হয়তো সেদিন তার একটু মায়া হয়েছিল। সে বলল,
-ভার্সিটিতে ভর্তি হয়ে আসার পর তুনিড় আর আমি ভালো বন্ধু ছিলাম। বন্ধুত্ব থেকে প্রেম। প্রেমের শুরু টা ভালোই কাটছিলো। যেহেতু একই ডিপার্টমেন্টে পড়তাম তাই প্রায় প্রতিদিন ই দেখা হতো, কথা হতো। এরপর আর ফোনে বলার মতো কিছু থাকতো না। তুনিড়ের ছিলো ইনসমোনিয়ার সমস্যা। ও রাত জেগে কথা বলতে চাইতো। যেহেতু কথা বলার টপিক ছিলো না তাই সে এডাল্ট কথা বলতে লাগলো।
এইটুকু শোনার পর আমার কান গরম হয়ে উঠেছিল। অনেক কষ্টে বলেছিলাম,
-তারপর?
-আমি এসব পছন্দ করতাম না। এটা নিয়ে শুরু হলো ভুল বোঝাবুঝি। সেই ভুল বোঝাবুঝি মিটিয়ে ফেলার জন্য বন্ধুরা প্ল্যান করলো সেন্টমার্টিন যাবে। আমরা দুজনেই গেলাম। প্রকৃতির কাছাকাছি যাওয়ার পর আমার মন ভালো হয়ে গেল। আমি তুনিড়ের সাথে ভালো ব্যবহার করলাম। আমাকে অবাক করে দিয়ে সেখানেই তুনিড় রিসোর্টে রুম বুকড করল।
একদম সরাসরি বলেই ফেলল, রাত কাটাতে চায়। আমি চিৎকার চেচামেচি করলাম। ও থেমে থাকল না। খুব বাজে ভাবে ঝগড়া হয়েছিল। ঝগড়ার এক পর্যায়ে সে বলল,
-আমি যদি রাজি না হই তাহলে সে অন্য মেয়ে দেখবে।
আমার মনে হলো মাথার উপর বজ্রপাত হচ্ছে। আমি বিরবির করে বললাম,
-সেই অন্য মেয়ে আমি ছিলাম!
রুপসা আপু শুনলো না। সে তার মতোই বলল,
-ও যে এরকম সেটা জানতাম না। কিন্তু একটু একটু বুঝেছিলাম। বাসে, রিকসায় গায়ের সাথে লেপ্টে বসতো। কিন্তু সেদিন যে এতো নিচে নামবে বুঝিনি।
বন্ধুরাও পরামর্শ দিলো সম্পর্ক কন্টিনিউ না করতে। তুনিড় অবশ্য অনেক বার মাফ চেয়েছে কিন্তু আমি আর রাজি হয়নি। ক্যারেক্টারলেস ছেলে যতই বলুক ভালো হবে সেটা বিশ্বাস করতে হয় না। কথায় আছে না কয়লা যায়না ধুইলে আর স্বভাব যায় না মরলে। ওর স্বভাব যে ভালো হবে তার গ্যারান্টি কি ছিলো!
রুপসা আপু একটু থেমে বলল, এবার বলও? তোমার সম্পর্কও ভেঙে গেছে এই কারনে??
আমি থম মেরে বসে রইলাম। রুপসা আপু বার বার জিজ্ঞেস করার পর আমি পুরোটা খুলে বললাম।
রুপসা আপু রেগে গিয়ে বলেছিল,
-তুমি কি পাগল? নাকি অন্যকিছু?
আমি বলেছিলাম, আমি বুঝতে পারিনি রুপসা আপু!
-তুমি বাবা মায়ের অবাধ্য হয়ে প্রেম করেছ, প্রেমিকের কথামতো বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্কে জড়িয়েছ আর বলছ বুঝতে পারছ না! স্ট্রেঞ্জ!
বোকা মেয়ে একবারও মনে হলো না যে, এরপর আর ওর বিয়ের ইচ্ছে নাও থাকতে পারে!
আমি কিছু বললাম না। কাঁদতে কাঁদতে বললাম,
-আমাকে বাঁচাও রুপসা আপু। প্লিজ তুমি আজ যা যা বলেছ সেটা সবাইকে বলবে তাহলে সবাই আমার কথা বিশ্বাস করবে।
রুপসা আপু সেদিন মুখের উপর না করে দিয়েছিল। বলেছিল, দুটো ব্যাপার আলাদা লাবন্য। আর তাছাড়া এখন আমি লাইফে মুভ অন করেছি। তুনিড় তো সেখানে কোনো ইন্টারফেয়ার করেনি। হ্যাঁ ওর ভুল ছিলো। আর সেজন্য আমি ওকে রিজেক্ট ও করেছি কিন্তু তাই বলে এখন ওর লাইফে ইন্টারফেয়ার করতে পারিনা।
আর তোমরা রিলেশনে থাকা অবস্থায় যা কিছুই ঘটুক সেটা নিয়ে কথা বলা আমার উচিত না। আর আমার একটা অর্জিত সম্মান আছে সেটাকে কয়েক বছর আগের নোংরা ঘটনার জন্য নষ্ট করবো না।

সেদিন রুপসা আপুর পা ধরে রিকোয়েস্ট করেও কোনো লাভ হয়নি। শেষে ফিরে এসেছিলাম হতাশ হয়ে।

বিয়ের একদিন আগে প্রগতির সাথে কথা বলার সুযোগ হয়ে গেল আমার। প্রগতি আমাকে দেখে ভয় পেল। আমি ওকে আশ্বস্ত করে বললাম যে কিছু কথা বলে চলে যাব।

আমি ওকে সব বললাম। এমনকি প্রেগন্যান্ট হওয়ার ঘটনা যেটা এর আগে কাউকে বলিনি সেটাও বললাম।
প্রগতি আমার কোনো কথা বিশ্বাস করল না। আমি বললাম যে হসপিটাল থেকে এবরশন করানো হয়েছে সেখানে গেলেও জানা যাবে।

তবুও প্রগতি বিশ্বাস করল না। বলল,
-লাবণ্য তুনিড়ের সাথে এক বছর ধরে আলাপ আমার। আর প্রেম নয় মাস ধরে। প্রেমের আগে একদিন আমার হাত ও ধরেনি। প্রেম হওয়ার পর যে কয়বার আমি ওকে জড়িয়ে ধরেছিলাম প্রত্যেকবারই ও হেজিটেট ফিল করেছে। বেশ কয়েকবার একসাথে আমরা বাসায় থেকেছি স্টাডির জন্য। কিন্তু কখনো আমার দিকে খারাপ ভাবে তাকায় ও নি। আর ও তোমার সাথে এতকিছু করেছে সেটা বিশ্বাস করতে হবে!! তুনিড় আমাকে তোমার ব্যাপারে সব বলেছে। ব্রেক আপের পর তুমি যে ওকে মেন্টালি সাপোর্ট দিয়েছিলে সেটাও বলেছে কিন্তু তুমি হয়তো বেশী কিছু এক্সপেক্ট করেছ!!

প্রগতি যে মিথ্যে বলছিল না সেটা বোঝা যাচ্ছিলো। কিন্তু আমি তখন ভাবছিলাম যে আচরণ আমার আর রুপসা আপুর সাথে করেছে, প্রগতির সাথে সেটা করেনি। প্রগতির বেলায় উল্টো। সেটা কেন!!!!

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here