লাবণ্যর সংসার পর্ব -০৩

#লাবণ্যর_সংসার
#পর্ব_3
#কৃ_ষ্ণ_ক_লি

রান্নাঘরের জানলার গ্রিল ধরে বাইরে তাকিয়ে আছে লাবণ্য। চোখের অবাধ্য অশ্রুকণা গুলো বয়েই চলেছে অনবরত। স্বামী নামক মানুষটার সাথে যে এখনও কোনও বনিবনাই হল না তো। ভালো করে কথাও তো বলছে না মানুষটা। তাহলে কি অচেনাই রয়ে যাবে স্বামী নামক মানুষটা! সবার সাথেই হাসি-খুশি অথচ তার বেলাতেই একরাশ বিরক্তি!

—“ বলি বাইরে তাকিয়ে লোকজন দেখলেই কি আমাদের খাওয়ার ব্যবস্থা হয়ে যাবে? ”

আচমকা শাশুড়ীর বাজখাঁই গলা শুনে লাবণ্য সামনে থাকায়। শাড়ির আঁচলে চোখের জলটা মুছে নিয়ে মুখে হাসি আনার চেষ্টা করে।

—“ কি রান্না করবো বুঝতে পারছিলাম না মা। আমি আপনার কাছেই তো যাচ্ছিলাম। রান্না কি করবো যদি জানাতেন? ”

—“ রান্নাঘরের দায়িত্ব যেমন নিয়েছো তেমন কি রান্না করে আমাদের খেতে দিবে সেটা তুমিই ঠিক করো। ”

শিউলি বেগম কথাগুলো বলেই দ্রুত ওখান থেকে বেরিয়ে যান। লাবণ্য একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে রান্নার কাজে লেগে পড়ে।

—“ মা আসতে পারি? ”
শিউলি বেগমের সম্মতি পেয়ে উনার রুমে আসে লাবণ্য। শিউলি বেগমের একবার মুখপানে চেয়ে মাথা নিচু করে ফেলে লাবণ্য। আসলে কাল রাতে নিবিড়ের বলা কথাগুলোয় বেশ অস্বস্তি হচ্ছে
লাবণ্য র । নতুন সম্পর্ক টাকে মজবুত করতে চাইছে। স্বামী, শাশুড়ী প্রত্যেকটা মানুষকে আপন করতে চাইছে। সুখে সংসার করতে চাইছে। তাই তো কোনও ভুল বোঝাবুঝি সম্পর্কের শুরুতেই রাখতে চাইছে না। জড়তা কাটিয়ে বলে উঠে,,,

—“ মা আমাকে মাফ করবেন। ”

শিউলি বেগম ভ্রু যুগল কুঁকড়ে লাবণ্যর দিকে তাকিয়ে আছে। লাবণ্য হাসি মুখে বলে,,

— “ মা কাল আপনাদের কোথাও ভুল হয়েছে। আমি আপনাদের নামে আমার বাপের বাড়িতে নিন্দা করিনি। আমি শুধু এটুকু বলেছি আপনি আমাকে রান্নাঘরের দায়িত্ব দিয়েছেন। যা শুনে আমার ভাবী ভীষণ খুশি হয়েছে। আপনাদের মন জয় করে চলার কথা বলেছে। আপনি বা আপনারা দয়া করে আমাকে ভুল বুঝবেন না। আমি আপনাদের বাড়ির বউ। নিন্দা করলে সেটা আমারই খারাপ লাগবে। ”

শিউলি বেগম চোখ মুখ শক্ত করে বসে রইলেন। মন চাইছে এই মেয়ের গালে এক্ষুণি কষিয়ে তিন চারটা থাপ্পড় মারতে। কিন্তু মনের রাগটা দমন করলেন। আর ছেলে আসার জন্য অপেক্ষায় রইলেন।

দুপুর গড়িয়ে বিকেল হল, লাবণ্যর এখনও খাওয়া হয়নি। অবশ্য খাওয়া হয়নি বলা ভুল ও কে খেতে দেওয়া হয়নি। শিউলি বেগম নিজের খাওয়ার শেষ করে বাকি খাবার টুকুতে হাত-মুখ ধোঁয়া পানি ঢেলে দিয়েছে। লাবণ্য ছলছল চোখে শিউলি বেগমকে করুণ স্বরে বললো, ‘ আমার যে সকাল থেকে খাওয়া হয়নি মা। আপনি খাবারে পানি ঢেলে দিলেন! ’ শিউলি বেগম তাচ্ছিল্য করে বলে ফেলেন, ‘ তুমি যে আছো আমার তা খেয়াল নেই। ’

বিকেলে এক কাপ চা নিয়ে আতীক সাহেবের স্টাডি রুমের দিকে গেলেন লাবণ্য। লাবণ্যকে দেখে ওর শ্বশুরমশাই হাসি মুখে ও কে চেয়ারে বসালেন।

—“ বাবা আপনার জন্য চা এনেছি। ”

—“ ভালো করেছো মা। এই চায়ের প্রয়োজন আমার এখন ছিলো , ধন্যবাদ তোমাকে মা। ”

—“ বাবা এটা আমার কর্তব্য, এভাবে বলবেন না।”

—“ মা তোমার এখানে কোনও অসুবিধা হচ্ছে না তো মা? নিবিড় তোমার সাথে ভালো ব্যবহার করছে তো? ”

শ্বশুরমশাইয়ের করা প্রশ্নে কি উত্তর দিবে বুঝে উঠতে পারছে না লাবণ্য। কাল রাতে নিবিড়ের করা ব্যবহার যে খুব কষ্ট দিয়েছে ও কে। আর শাশুড়ী মা ও তো ওর সাথে আজকে যে ব্যবহার করেছে তা যে খুব কষ্টকর। তবুও মুখে জোর করে হাসি টেনে এনে উত্তর করে,,

—“ হ্যা… হ্যা বাবা উনি খুব ভালো। আর আমার এখানে কোনও অসুবিধা হচ্ছে না। ”

আতীক সাহেব সবটাই জানেন। লাবণ্য যে মিথ্যা বলছে তা উনি বেশ ভালো মতোই বুঝতে পারছেন। তাই লাবণ্যর মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,,,

—“সংসার টা যুদ্ধের ময়দান মা, এখানে টিকে থাকতে গেলে তোমাকেও যুদ্ধ করতে হবে।ধৈর্য্য হারালে চলবে না। তোমাকে জিতে দেখাতে হবে। ”

শ্বশুর মশাইএর কথার সম্পূর্ণ অর্থ লাবণ্য বুঝতে না পারলেও , তবুও মনে অনেকটা সাহস পেলো।

শিউলি বেগম কিছুতেই শান্তি পাচ্ছেন না যতক্ষণ না ছেলে আসছে। নিবিড়কে দেখেই মনটা উনার উৎফুল্ল হয়ে যায়।

নিবিড়কে রুমে আসতে দেখে শোয়া থেকে উঠে বসে লাবণ্য। নিবিড়কে পানি দেওয়ার জন্য পা বাড়িয়ে নীচে নামতে গেলে নিবিড় ওর সামনে সশব্দে দরজাটা বন্ধ করে দেয়। লাবণ্য কেঁপে উঠে

—“ আপনার জন্য পানি আনতে যাচ্ছি। দরজাটা খুলে দিন প্লিজ। ”

নিবিড় নিজের রাগটা আর কন্ট্রোল করতে পারলো না। গায়ের সর্বশক্তি দিয়ে লাবণ্যর গালে থাপ্পড় মারে। লাবণ্য টাল সামলাতে না পেরে হুড়মুড়িয়ে মেঝেতে মুখ থুবড়ে পড়ে। ঠোঁটের কোণ বেয়ে তরল কিছ গড়িয়ে আসায় ওখানে হাত ছুঁইয়ে দেয় লাবণ্য। নিবিড় চুলের মুঠি ধরে লাবণ্যর গাল দুটো চেপে ধরে। লাবণ্য ব্যথায় কুঁকড়ে যায়।

—“ আমি তোকে স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছিলাম আমি যেনো দ্বিতীয় বার আর আমার মাকে অপমান করতে না দেখি। কিন্তু তুই তো আজ সীমা অতিক্রম করে ফেলেছিস। ”

লাবণ্যকে বিছানায় ছুঁড়ে ফেলে নিবিড় কোমড় থেকে বেল্ট খুলে হাতে নেয়। লাবণ্য বেশ বুঝতে পারছে কি হতে চলেছে।ও কিছু বলার আগেই নিবিড়কে মারতে শুরু করে। দু – চার ঘা মার খেয়ে চিৎকার করার পর ও নিবিড়ের পা দুটো জড়িয়ে ধরে নেয়।

—“ প্লিজ আমাকে আর মারবেন না। আমি সহ্য করতে পারছি না। আমার ভীষণ কষ্ট হচ্ছে । আপনি যা বলবেন আমি তাই করবো। কথা দিচ্ছি আর কখনো আপনার কথার অমান্য করবো না। এই আঘাত গুলো অনেক যন্ত্রণা দায়ক। ”

লাবণ্য যন্ত্রণায় ছটফট করছে। নিবিড় ও কে পা দিয়ে দূরে সরিয়ে দেয়। কাছে গিয়ে ওর চুলের মুঠি ধরে মেঝেতে মুখ চেপে ধরে। লাবণ্য ব্যথায় আরও বেশী গোঙাতে থাকে।

—“ আমি তোকে যে কথাগুলো বলেছি সেগুলো তুই আমার মা কে বলে কি প্রমাণ করতে চাইছিস? ”

নিবিড় চিৎকার দিয়ে ওর কানের কাছে কথাগুলো বলে। লাবণ্য চোখটা চেপে বন্ধ করে ফেলে। কাঁপা কাঁপা গলায় বলে,,

—“ আমি মায়ের কাছে ক্ষমা চেয়েছি শুধুমাত্র। উনি যেনো আমাকে ভুল না বুঝেন। ”

—“ তোকে এতো কিছু করতে কে বলেছে? স্বামী – স্ত্রীর মধ্যেকার কথা চার দেওয়ালের মধ্যে থাকে না? তুই মা কে শুনিয়ে অনেক বড়ো ভুল করেছিস।”

নিবিড়ের কথা শুনে লাবণ্য কান্নার মধ্যেও হেসে ফেলে।

—“ বেশ ভালো কথা বলেছেন নিবিড় সাহেব , স্বামী স্ত্রী র মধ্যের কথা চার দেওয়ালের মধ্যে রাখতে! আমি তো শুধু নাম মাত্র আপনার স্ত্রী। তার কোনও দায়িত্ব পালন আপনি করছেন কি? ”

নিবিড় লাবণ্যকে ছেড়ে ওর হাতটা টেনে ধরে দাঁড় করায় বেশ শক্ত হাতের মুঠোয়। চোখ জোড়া সরু করে কাঠ কাঠ গলায় বলে উঠে,,

—“ কিসের দায়িত্ব পালন করতে বলছিস? ”

লাবণ্য এবার নিজেকে জোর করিয়ে নিবিড়ের হাত থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নেয়। সশব্দে হেসে বলে ফেলে,,,,

—“ দু দিন হলো আমি আপনার স্ত্রী হয়ে এই বাড়িতে এসেছি। মুখেই বলছেন স্বামী! কোথায় একদিনও তো আমার সাথে বসে গল্প করলেন না। এসে থেকেই শুধু মারধোর আরম্ভ করেছেন। মানষিক ভাবেও আঘাত করছেন আপনি। ”

লাবণ্যর এমন কথায় নিবিড় আরও বেশী রেগে যায়।

—“ তুই যে কাজ গুলো করছিস সেগুলো তো আমাকেই শুধরে দিতে হবে । তাই না. আগাছা প
গোড়া থেকেই কেটে ফেলা উচিৎ। নয়তো পরে জঙ্গলের রুপ ধারণ করবে। ”

লাবণ্যর কানের সামনে মুখ এনে হিসহিসিয়ে কথাগুলো বলে নিবিড়। লাবণ্যর মনে একটা অন্যরকম ঝড় উঠে।

—“ আর বাকি রইলো গল্প ! ও টা আমি পছন্দের মানুষ ছাড়া আর কারুর সাথে করি না।”

নিবিড়ের শেষের বলা কথাগুলোতে লাবণ্য পুরোপুরি নিস্তব্ধ হয়ে যায়। নিবিড় লাবণ্যকে ছেড়ে দিয়ে ফ্রেশ হতে চলে যায়। লাবণ্যর শরীরের ব্যাথা থেকে মনের ব্যাথাটা প্রখর হয় বেশী। লাবণ্য মেঝেতে শুয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে। বেশ কিছুক্ষণ পর নিবিড়কে আসতে দেখে মেঝে থেকে উঠে বসে লাবণ্য।

—“ আপনার মা আমাকে দুপুরে খেতে দেননি। আমার খাবারে নিজের এঁটো হাত – মুখ ধুয়ে নিয়েছেন। আপনি আপনার মা কে এরপর কিছু বলবেন না। আমি তো আপনার স্ত্রী, আমার খেয়াল আপনি রাখবেন না। ”

লাবণ্য কাঁপা কাঁপা গলায় কথাগুলো বলে নিবিড়কে আরও বেশী উত্তপ্ত করে ফেলে। নিবিড় নিজের রাগ সংবরণ করতে না পেরে লাবণ্য সোজা বুক বরাবর সজোরে লাথি মারে। লাবণ্য ব্যথায় কুঁকড়ে উঠে।

চলবে,,

( 🙏)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here