“লুকোচুরি”
পর্ব- ২
(নূর নাফিসা)
.
.
রিজোয়ানা রুমে এসে আবার কল করলো ইভানের ফোনে,
“কোথায় তুমি?”
“কেন, ছাদে।”
“চলে এসো। আমি আসতে পারছি না। মা আটকে দিয়েছে। কাল সকালে দেখা করবো।”
রিজোয়ানা কল কেটে দিলো। অতঃপর বই নিয়ে বসলো। একটু পর বারান্দার গ্রিলে শব্দ হতে লাগলো। রিজোয়ানা জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখলো ইভান লাঠি দিয়ে তাদের বারান্দা থেকে রিজোয়ানার বারান্দায় আঘাত করে শব্দ করছে। রিজোয়ানা বারান্দায় এসে বললো,
“এসব কি হ্যাঁ? হাতে লাঠি কেন?”
ইভান অন্য হাতের কফি কাপে চুমুক দিয়ে লাঠিওয়ালা হাত নিজেদের গ্রিলের বাইরে ঝুলাতে ঝুলাতে বললো,
“তোমাকে পেটানোর জন্য। অফিস থেকে ফিরতে না ফিরতেই আমাকে দৌড়ে ছাদে তুলেছো। আবার নামিয়ে এনেছো। শাস্তি পাওয়া দরকার না?”
রিজোয়ানা গ্রিলে হেলান দিয়ে বললো,
“ইশ! আপনার শাস্তি যে অনেক জমা আছে, সেটা?”
ইভান এক গাল হেসে বললো,
“কেনো দেখা করতে চেয়েছো? জরুরী কিছু?”
“বিয়ে করছেন কবে?”
ইভান কফি খেতে গিয়ে ছোটখাটো বিষম খেয়ে বললো,
“আরও!”
“আরও মানে কি! বিয়ে করেছেন নাকি?”
“তুমি কে?”
“আমি আবার কে? আমার কোনো অস্তিত্ব আছে নাকি? বিয়ের পরও যে মেয়ে বাবার ঘরে থাকে, সে আবার কে?”
“তোমার ফ্যামিলিই তো আসতে দেয় না। আমার কি করার?”
“চুপ থাকুন! বেশি কথা বলবেন না। আমার পরিবার আসতে দেয় না নাকি আপনার মা নিতে চায় না?”
“কিভাবে নিবে? সারাক্ষণ ঝগড়া করো তোমরা।”
“ও, আমরা ঝগড়া করি আর আপনারা চুপচাপ বসে থাকেন। সাধু লোক। শুরুটা তো আপনার মা’ই করেছে। আমার বাবাকে ঘরজামাই কেন বলবে?”
“ভুল কি বললো, ঘর জামাই ই তো।”
“কিহ! আমার বাবার খুব ঠেকা পড়েছে তো ঘরজামাই থাকার! আপনার দাদা জোর করে এখানে রাখলো কেন? বাবা তো চেয়েছিলোই গ্রামে চলে যেতে। নাহ, মেয়েকে চোখে চোখে রাখবে। তো এখন কোথায় গেলো সেই চোখ? বাড়িতে আরেক ঝগড়ুটে এনে রেখে গেছে, সেটা কিছু না।”
রিজোয়ানা রাগান্বিত গলায় কথা বললেও ইভান ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটিয়ে বলে যাচ্ছে,
“মুখ সামলে কথা বলো। উনি তোমার শ্বাশুড়ি মা হয় কিন্তু।”
“কিসের শ্বাশুড়ি মা? শ্বাশুড়ি মা হলে ছেলের বউকে এভাবে অস্বীকার করে? আসছে আবার শ্বাশুড়ি মা বলতে! সব দোষ আপনার ওই বদ দাদার। কথা নেই বার্তা নেই, হুট করে এসে নাতি নাতনির বিয়ে দিয়ে দিলো। নাতনিকে ঘরে তুলে দিয়ে যেতে পারলো না কেন? যাওয়ার আগে দুটো পরিবারকে এক করে দিতে পারলো না?”
“ভুল কি করলো? এটাই তো ভালো হয়েছে। তা না হলে কি এভাবে প্রেম জমতো?”
“হ্যাঁ, ভুল কেন করবে? মহৎ কাজ করে গেছেন। এজন্যই না আবার আমার কাছে এসে কান্না করেন, তুমি কবে আসবে আমার কাছে…?”
“আস্তে কথা বলো। লুকিয়ে লুকিয়ে এসেছি তো এখানে।”
“পারবো না আমি আস্তে কথা বলতে। যেমন দাদা, তেমন নাতি।”
ইভান মুখ টিপে হাসলো। রিজোয়ানা হনহনিয়ে চলে গেলো রুমে। ইভান ডাকলো,
“রিজু…? এই শুনো…”
রিজোয়ানা শুনলো না। রুমে এসে জানালার পর্দা টেনে দিলো। ইভান আরও দু-তিনবার ঠকঠক শব্দ করলো গ্রিলে। ওদিকে ইয়াসমিনের ডাক পড়লে সে-ও চলে গেলো। রাতে আর কথা হলো না তার সাথে।
রিজোয়ানার অনার্স ফাইনাল ইয়ারের এক্সাম শেষ হলো গত সপ্তাহে। ইভান ইঞ্জিনিয়ারিং কমপ্লিট করে বেকারই বসে ছিলো কিছুদিন। দুতিন মাস যাবত চাকরি করছে। বয়সে সে রিজোয়ানা থেকে প্রায় চার বছরের বড়। সম্পর্কে তারা মামাতো ফুপাতো ভাইবোন। রিজোয়ানা যখন অষ্টম শ্রেণিতে পড়ে আর ইভান একাদশ শ্রেণিতে তখনই তাদের বিয়ে দিয়ে দেয় ইভানের দাদা। খুবই কঠোর ব্যক্তিত্বসম্পন্ন ব্যক্তি ছিলেন তিনি। তার জীবন রীতিও ছিলো কঠিন। এক কথা দ্বিতীয়বার বলতে পছন্দ করতেন না। যা বলতেন, তা করেই ছাড়তেন। তার কথার উপর কথা বলার সাহস ছিলো না পরিবারের সদস্যদের। রিজোয়ানার বাবা গ্রাম থেকে শহরে এসেছিলো চাকরির উদ্দেশ্যে। যথেষ্ট সামর্থ্যবান হয়ে যখন বিয়ের জন্য পাত্রী খুজতে লাগলো, লুবনাকে পছন্দ করলো। রিজোয়ানার নানারও মেয়ের জামাই হিসেবে পছন্দ হলো এবং মেয়ের বিয়ে দিয়ে দিলেন। কিন্তু গ্রামে যেতে দিলেন না। বাড়িটাকে দুই ভাগ করে একভাগ মেয়েকে অন্যভাগ ছেলেকে দিয়ে দিলেন। সমানভাবে ভাগ হওয়ায় ইভানের বাবা নারাজ ছিলেন। তারউপর আবার রিজোয়ানা ও ইভানের বিয়ে দিয়ে দিলেন। কারো কোনো মতামতের প্রয়োজন মনে করেননি। এজন্য সময়ে অসময়ে পরিবারের লোকজন তাকে ঠিকই বকে যায় প্রকাশ্যে কিংবা মনে মনে। কেননা তিনি মারা যাওয়ার পর তাদের ননদ ভাবির মধ্যে বিন্দুমাত্র মিল নেই। ইয়াসমিন চায় না ছেলের বউ হিসেবে রিজোয়ানাকে ঘরে তুলতে, ভাই ভাবির আচার ব্যবহারের কারণে লুবনাও চায় না ইভানকে জামাই হিসেবে মানতে! দুই পরিবারের বিরোধিতায় এদিকে তাদের সংসার গড়ার আগেই ভেঙে যাচ্ছে!
রিজোয়ানা সাধারণত বই পড়ুয়া মেয়ে ছিলো। বই থেকে যেনো মাথা তুলতে চাইতো না। ইভানও মোটামুটি শান্তশিষ্ট স্বভাবের। মাত্রাতিরিক্ত দুষ্টুমি তার দ্বারা হতো না। স্মৃতিতে থাকলেও প্রথম প্রথম বিয়ের ব্যাপারটা নিয়ে তাদের কারোরই কোনো ইন্টারেস্ট ছিলো না। এমনকি একে অপরের প্রতি আকর্ষণও ছিলো না। যে যার পরিবারে যারযার মতো বেড়ে উঠেছে। রিজোয়ানা যখন দশম শ্রেণিতে পড়ে, তখন ইভান দুষ্টুমি করে মাঝে মাঝে “বউ” বলে ডাকতো। রিজোয়ানা বিরক্তবোধ করতো। তার বিরক্তিকর চেহারা দেখে ইভান আরও উৎসাহ পেতো তাকে বিরক্ত করার। কলেজে ভর্তি হওয়ার পর পড়াশোনার চাপে আর তেমন দেখাই হতো না ইভানের সাথে। ইভানও তার পড়াশোনায় ব্যস্ত ছিলো। রিজোয়ানা যখন অনার্স দ্বিতীয় বর্ষে পরীক্ষা দিবে, হঠাৎ তার কোনো একদিন ইভান প্রপোজাল পাঠায়। তখন থেকেই ইভানের জন্য মনে অন্যরকম এক অনুভূতির সৃষ্টি হতে থাকে। আশেপাশে নজর পড়ে বিভিন্ন প্রেমিক প্রেমিকার উপর। দৃষ্টির সম্মুখে ভাসতে শুরু করে রঙিন দুনিয়া। সাথে সাথে ইভানের প্রপোজালে সাড়া না দিলেও বই থেকে মাথা ঠিকই উঠতে থাকে তখন থেকেই। ইভানকে দেখলে লজ্জা লজ্জা বোধ করতো। মন চাইতো একটু কথা বলুক, কিন্তু সময় সুযোগ ইচ্ছা কোনোটাই আয়ত্তে আসতো না। পুরো এক বছর ভাবতে ভাবতেই অবশেষে অনার্স ফাইনাল ইয়ারের শুরুর দিকে সাড়া দিয়ে ফেললো। আগে ভাইয়া ডাকলেও তখন থেকে ভাইয়া সম্মোধন পুরোপুরিভাবেই ছেড়ে দিলো। একটু আধটু চলতে চলতে এখন পুরোপুরিই চলছে তাদের লুকোচুরির সংসার। শুধু এক হতে পারছে না পরিবার। সব দোষ কেবল তাদের দাদা/নানার। অর্ধেক কাজ করে কেন পালিয়ে গেলো! হয় পুরোটাই করে যেতো, নাহলে করারই বা কি প্রয়োজন ছিলো?
সকালটা খুব সুন্দর। আজ ফজরের নামাজের পর ঘুমায়নি রিজোয়ানা। একটু হাটাহাটি করার উদ্দেশ্যে ফ্ল্যাট ছেড়ে বেরিয়ে এসেছে ছাদে। প্রথমত মৃদু বাতাস, অতঃপর সকালের ঝিলমিল রোদের আলো এসে সতেজ করে দিলো দেহ মন। সারাটাদিন যদি পরিবেশটা এমন থাকতো, কতোই না স্বচ্ছ থাকতো মানব মন! কিন্তু না, পরিবেশের তীক্ষ্ণতায় তীক্ষ্ণ হয়ে যায় মেজাজ।
পেছনে দুহাত রেখে ছাদে পায়চারি করতে করতে গুনগুন করতে লাগলো রিজোয়ানা। কিছুক্ষণ পরেই ইভানের দেখা পাওয়া গেলো ছাদে। ছাদের দরজা খুলে এপাশে রিজোয়ানাকে দেখে এসেই একটা মুচকি হাসি দিলো সে। তার এতো সুন্দর হাসির বিপরীতে রিজোয়ানার মুখেও ফুটে উঠলো সামান্য হাসির রেখা। ইভান দরজা চাপিয়ে রেখে এগিয়ে আসছে তাদের ছাদের দিকে। তার ফোল্ড করা প্যান্ট দেখে রিজোয়ানা বললো,
“সকাল সকাল কোত্থেকে হাবুডুবু খেয়ে এলেন?”
ইভান নিজের দিকে একবার তাকিয়ে বললো,
“কেন, ভিজে গেছি কোনোদিক থেকে?”
“নাহ! স্যরি, হাডু ডুডু খেলে এসেছেন কোত্থেকে?”
ইভান এক রেলিং ছেড়ে অন্য রেলিং ধরে তাদের ছাদ থেকে আড়াই ফিট দুরত্বে রিজোয়ানাদের ছাদে ডিঙিয়ে এসে এক গাল হেসে বললো,
“শব্দটা হাডু ডুডু না, হাডুডু। আর খেলে আসিনি, বাজার করে এসেছি। বাজার থেকে ফেরার পথে তোমার ছায়া দেখলাম নিচে। উপরে তাকিয়ে দেখলাম এই মাথাটা দেখা যায়। তাই বাজারের ব্যাগ রেখে আবার দৌড়ে চলে এলাম উপরে।”
“তাই?”
“ঠিক তাই।”
“কেন এসেছেন?”
“কি আশ্চর্য! বউয়ের কাছে আসতেও কারণ লাগবে! এখন ঝগড়া করো না। বেশ ফ্রেশ মুডে এসেছি। তোমার মুডটাও ফ্রেশ দেখাচ্ছে। এতো তারাতাড়ি ঘুম ভেঙে গেলো, আমাকে নিয়ে সুন্দর স্বপ্নটপ্ন দেখেছো নাকি?”
রিজোয়ানা রেলিংয়ে হেলান দিয়ে মুচকি হাসলো। ইভান তার পাশেই রেলিংয়ের উপর বসে বললো,
“কি দেখেছো স্বপ্নে?”
“জানি না।”
“জানোটা কি?”
“স্বপ্ন কি আর সবসময় মনে থাকে! তুমি এভাবে ছাদের এপাশে ওপাশে আসাযাওয়া করো, আমার তো ভয় হয়। কবে না জানি মাঝখান দিয়ে চলে যাও।”
“ব্যাপার না। কাজটা ইজি, তবে তুমি ট্রাই করতে যেয়ো না আবার। কাঁপতে কাঁপতেই নিচে চলে যাবে।”
“ইশ! আমার এতো শখ নেই এভাবে যাওয়ার। গেলে মেইন দরজা দিয়েই যাবো। নয়তো না।”
“তোমার ভয় দূর করতে ভাবছি, ইট সিমেন্ট রড দিয়ে আসাযাওয়ার ভালো একটা ব্যবস্থা করবো। এর আগে যে তক্তাটা দিয়েছিলাম সেটা বেশ মজবুত ছিলো। মা উঠিয়ে নিয়ে কাকে যেন দিয়ে দিলো।”
“ইট সিমেন্ট দিয়ে দিলেই যে থাকবে তার গ্যারান্টি কি? দেখবে কেউ না কেউ হাতুড়ি দিয়ে ভাঙতে শুরু করেছে।”
“তাহলে আর কি? যেমন আছে তেমনই ভালো।”
“তারা এক হবে কবে? ভালো লাগে না এসব। পারলে প্রতিদিনই ঝগড়া করে। একটা না একটা নিয়ে তাদের ঝগড়া করতেই হবে। দেখবে এমন করতে করতে তুমি আমি বুড়ো হয়ে গেছি।”
ইভান হেসে রিজোয়ানার পেছনে রেলিংয়ে হাত রেখে বললো,
“কাল কি নিয়ে এমন ঝগড়া হলো?”
“মোরগামুরগি নিয়ে শুরু, যার শেষ আর নেই।”
“মানে?”
“আমাদের মোরগ ও মুরগি দুইটা নাকি কদিন যাবত তোমাদের ছাদে চলে যায়। আর তা এক ভাড়াটিয়া আন্টি দেখে মামীর কানে পৌছে দিয়েছে। সেই হয়েছে শুরু মামীর বকবক। এতো বকবক শুনে মা দুইটা ডিম পাঠিয়ে দিয়েছে ভাড়াটিয়া পিচ্চির হাতে। ডিম দুটো সাথে সাথে ছুড়ে মারলো জানালার বাইরে। সেই ক্ষেপে গেছে মা-ও। টানা তিন ঘন্টা আমি পাগলাগারদে ছিলাম।”
ইভান হেসে রেলিং থেকে নেমে দাঁড়িয়ে বললো,
“আহারে! বেচারা ডিম দুটো! শ্বাশুড়ি মা মায়ের কাছে না পাঠিয়ে ভাজি করে আমাকে দাওয়াত করলেও তো হতো।”