লুকোচুরি,পর্ব:৩

“লুকোচুরি”
পর্ব- ৩
(নূর নাফিসা)
.
.
“আহারে! বেচারা ডিম দুটো! শ্বাশুড়ি মা মায়ের কাছে না পাঠিয়ে ভাজি করে আমাকে দাওয়াত করলেও তো হতো।”
রিজোয়ানা মুখ টিপে হেসে তার দিকে তাকালো। হঠাৎ করেই ইভান বসে পড়লো এবং বাচ্চাদের ন্যায় হামাগুড়ি দিয়ে চলে যাচ্ছে সিড়ির দিকে। তার কর্মে রিজোয়ানা প্রথমে বিস্মিত হলেও পরক্ষণে দেখতে পেলো ইভানদের ছাদের দরজা ধাক্কা দিয়ে ইয়াসমিন এসেছে ছাদে। এদিক সেদিক তাকিয়ে রিজোয়ানাকে দেখে চলে গেলো পানির ট্যাংকের পাশে। ঢাকনা খুলে পানির পরিমাপ দেখে আবার লাগিয়ে দিয়ে নিচে নেমে গেলেন। একদিকে তিনি নামছেন, অন্যদিকে লুবনা রিজোয়ানাকে ডাকতে ডাকতে তাদের ছাদে উঠে আসছেন। মা চলে গেছে ভেবে যা-ই ইভান উঠে আসছিলো, তা আর হলো না। তাকে আরও আড়ালে গিয়ে লুকাতে হলো ইটের বস্তার চিপায়! রিজোয়ানা দৌড়ে এসে সিড়ির সামনে দাঁড়িয়ে বললো,
“একি মা, তুমি এখানে?”
লুবনা তাকে ঠেলে সামনে থেকে সরিয়ে বললো,
“সর, কখন থেকে ডাকছি তোকে? গলা ফেটে যাচ্ছে আমার, তা-ও মেয়ের কান পর্যন্ত পৌছায় না।”
বলতে বলতে তিনি চলে গেলেন মরিচ গাছের কাছে। রিজোয়ানা বললো,
“ওহ! মরিচ লাগবে সেটা আমাকে বললেই পারতে।”
“বলবো কি করে? প্রয়োজনের সময় তোর কোনো খোঁজ পাওয়া যায়? এখানে কি করছিস তুই? নিচে আয়।”
“আসছি।”
“আসছি মানে কি? এখন আয়।”
“এখনই আসছি, যাও।”
লুবনা কয়েকটা মরিচ নিয়ে চলে গেলেন। রিজোয়ানা ছাদের দরজা লাগিয়ে অপর পাশে এসে দেখলো সিমেন্টের খালি বস্তা মাথায় দিয়ে বসে আছে ইভান। রিজোয়ানা হেসে উঠলো। ইভান বস্তা ফেলে শরীর, মাথা ঝাড়তে ঝাড়তে উঠে বললো,
“ধ্যাৎ! ভেবেছি কিছুক্ষণ পর গোসল করবো, সব ভাবনা ভেস্তে গেলো!”
রিজোয়ানা হাসতে হাসতে বললো,
“বুঝলাম না, দুজন কি প্ল্যান করে এসেছে একসাথে?”
“তুমি হাসো? আমার শরীর চুলকাচ্ছে। মা বোধহয় আমাকে খুজতেই এসেছিলো।”
“যাও, গিয়ে গোসল করে ফেলো।”
ইভান টিশার্ট ঝাড়তে ঝাড়তে চলে গেলো তাদের ছাদে। এদিকে রিজোয়ানাও নেমে এলো। রুমে এসে দেখলো ফোন বাজছে। ইভান আবার কল করেছে কেন, ভাবতে ভাবতে রিসিভ করলেই ওপাশ থেকে ইভান বললো,
“কখন থেকে কল করছি!”
“কেন?”
“দরজা তো মা আটকে দিয়ে গেছে। আমি নামবো কিভাবে এখন?”
রিজোয়ানা খিলখিলিয়ে হেসে উঠে বললো,
“আজ আর নামতে হবে না। সেখানেই অফিস করো।”
“হাসো কম, কথাও বলো কম। তোমাদের ওদিক দিয়ে নামা যাবে? দেখে ফেলবে না তো কেউ?”
“দেখতেও পারে, আমি কিভাবে বলবো! বাবা, ভাইয়া সবাই বাসায়। চারটা ফ্লোর অতিক্রম করবে, কেউ দেখবে না? এই দাঁড়াও, দাঁড়াও…”
রিজোয়ানা জানালার বাইরে অয়নকে তাদের বারান্দায় দেখে দ্রুত পায়ে বারান্দায় গেলো এবং বললো,
“গুড্ডু…”
অয়ন তাকালেই সে বললো,
“তোমাদের ছাদে একটা জিনিস রেখে এসেছি তোমার জন্য।”
“কি?”
“সারপ্রাইজ, গিয়ে দেখো।”
“না, এখন স্কুলে যাবো। ছাদে গেলে আম্মু বকা দিবে।”
“বলবে কেন আম্মুকে? চুপিচুপি যাবে আবার চলে আসবে।”
“না, এখন সময় কম। স্কুল থেকে এসে নিবো।”
“আরে না! স্কুল থেকে এসে দেখবে কাক খেয়ে ফেলছে। আর নাহয় ভাড়াটিয়ারা নিয়ে গেছে।”
“কি? তোমাদের গাছের পেয়ারা?”
“বলেছি না সারপ্রাইজ! তুমি পেতে চাইলে যাও আর নাহয় সুড্ডুকে ডাকো।”
অয়ন বারান্দা ছেড়ে চলে গেলো। সে কি ছাদেই গেলো নাকি নিয়নকে ডাকতে গেলো বুঝতে পারছে না রিজোয়ানা। ওদিকে লুবনা ডাকছে তাকে পেয়াজ কেটে দেওয়ার জন্য। আসি আসি বলে সে অপেক্ষা করতে লাগলো। একটু পর অয়ন ফিরে এসে বললো,
“ভাইয়া ছাড়া তো ছাদে কিছুই নেই!”
“তোমার ভাইয়া কি তোমার জন্য বড় একটা সারপ্রাইজ না?”
“চিটার! আগে জানলে কাকের জন্যই রেখে আসতাম!”
“কি ছেলেরে বাবা! যাও ভাইয়াকে বলে দিবো তোমাকে একটা চকলেট খাওয়াতে।”
“খাবো না।”
“আচ্ছা, তাহলে আমাকে দিয়ে দিয়ো।”
অয়ন বিরক্তিকরভাবে তাকিয়ে চলে গেলে রিজোয়ানা মুখ টিপে হাসলো। অতঃপর কিচেনে এসে দেখলো লুবনা পেয়াজ কাটতে শুরু করে দিয়েছে। তাকে দেখে বললো,
“আল্লাহ মেয়ে একখান দিয়েছে আমার ঘরে। একটু যে মায়ের কাজে সাহায্য করবে সেই বোধটুকু নেই৷”
“এসেছি ই তো সাহায্য করতে। দাও।”
“দূর হো বলছি! সেই কখন ডাকছি, এতোক্ষণে তার সময় হয়েছে। এমনই করিস। পানি চেয়ে পিপাসায় মরে গিয়ে শুটকি হয়ে গেলে তারপর আসবি পানি নিয়ে।”
“কি অদ্ভুত কথা বলো তুমি, মা! তুমি কি আমার কাছে পানি চেয়েছো? বলেছো পেঁয়াজ কাটতে। পানি চাইলে তখনই দৌড়ে চলে আসতাম।”
“ঘ্যানঘ্যান করিস না, যা। কে কতটুকু করবি দেখা হয়ে গেছে।”
“চলে যাবো তাহলে?”
“তো কি করবি? দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে রূপ দেখাবি?”
“আচ্ছা, চলে যাচ্ছি কিন্তু তাহলে। ঘরটা গুছিয়ে ফেলি।”
ধীর পায়ে বেরিয়ে গেলো রিজোয়ানা। একে একে সব রুম ঝাড়ু দিয়ে বিছানাপত্র গুছিয়ে ফেললো। নিজের রুম গোছানোর সময় ইভান এলো অয়ন নিয়নের রুমের বারান্দায়। প্রথমে হালকা কাশি দিলো। রিজোয়ানা তাকাতেই বললো,
“আসছি তাহলে।”
“গুড্ডুকে একটা চকলেট কিনে দিয়ো। এত্তবড় উপকার করেছে বলে কথা!”
“লাভ ক্যান্ডি?”
“কিপ্টামিটা একটু ছাড়ো।”
রিজোয়ানার কথা শেষ না হতেই ইভান লুবনাকে দেখে নিজের মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বারান্দা ছেড়ে চলে গেলো দ্রুত। রিজোয়ানাও হঠাৎ তার মাকে দেখে চুপসে গেছে। লুবনা কড়া গলায় শুধু বলে গেলো,
“লিসান বেরিয়ে যাবে। নাস্তা দিয়ে যা। আমি মাছ কাটবো।”
রিজোয়ানা মাথা নত করে ঝটপট তার বিছানা গুছিয়ে বেরিয়ে এলো বাবা ও ভাইয়াকে নাস্তা দিতে। বাবা ভাইয়া চলে গেলে তাদের মা মেয়ের সময় কাটে অবসর আর অবসরে।
সবসময় ভার্সিটি কোচিং-এ দৌড়াদৌড়িতে অভ্যস্ত থাকায় এখন একদিন বাসায় থাকলেই বোরিং লাগে রিজোয়ানার। চারদিন পর আজ বিকেলে একটু সুযোগ হয়েছে বের হওয়ার। ব্যাস, বেরিয়ে গেলো ইভানের সাথে। এক-দেড় ঘন্টা যাবত ঘ্যানঘ্যান করে মায়ের মাথা ধরিয়ে অনুমতি নিয়েই ছেড়েছে। ফ্রেন্ডদের সাথে একটু সময় কাটাবে বলে সে বাসা থেকে একা বেরিয়েছে। ইভান অফিস টাইম শেষে বাসায় না ফিরে তার সাথে যোগ দিয়েছে। দুপুরে কল করেই প্ল্যানটা করেছে কিছুটা সময় একত্রে কাটানোর জন্য। নির্দিষ্ট কোনো স্থানে যাবে না তারা। বাড়ি থেকে কিছুটা দূর পথে বাদাম খেতে খেতে পাশাপাশি হাটছে একটু। রিজোয়ানা খোসা ছাড়িয়ে মুখে বাদাম দিতে দিতে বললো,
“আযব দুনিয়া! হাসব্যান্ড ওয়াইফ একটু দেখা করবে তা-ও বাসা থেকে লুকিয়ে লুকিয়ে করতে হবে! তা-ও নাকি আবার এরেঞ্জ ম্যারেজে!”
ইভান বাদামের খোসা ছাড়াতে ছাড়াতে মৃদু হাসলো এবং বললো,
“কাল রাতে বলেছিলাম মাকে তোমার কথা।”
“কি কথা?”
“বাসায় নিয়ে যাওয়ার কথা।”
রিজোয়ানা উৎফুল্ল হয়ে জিজ্ঞেস করলো,
“তারপর?”
তার কণ্ঠধ্বনির উৎফুল্লতায় ইভান একবার তার দিকে তাকিয়ে আবার বাদামের খোসা ছাড়ানোতে মনযোগ দিয়ে বললো,
“পায়ের জুতা হাতে তুলে নিয়েছিলো।”
মুহুর্তেই হতাশা নেমে এলো রিজোয়ানার চেহারায়। ইভান তার মুখের দিকে বাদাম এগিয়ে দিলে রিজোয়ানা মুখে নিয়ে বললো,
“উনারা আসলে চায় টা কি, আমি বুঝি না।”
“কি আর? আমাদের পৃথক করতে চায়। এছাড়া আর কিছু না।”
“তাহলে বিয়ের সময় নিষেধ কেন করতে পারলো না? তারা যেহেতু মেনে নিতে পারবেই না, তাহলে তখনই পৃথক হয়ে যেতো।”
“তুমি তো বেশ ভালোই! সারাটাদিন অফিস করে এসেছি, কোথায় একটু সেবাযত্ন করবে। উল্টো আমাকে খায়িয়ে দিতে হচ্ছে বাদামের খোসা ছাড়িয়ে!”
রিজোয়ানা চোখ পাকিয়ে নিজেই খোসা ছাড়িয়ে তুলে দিতে লাগলো ইভানের হাতে। ইভান বললো,
“মাথায় একটা প্ল্যান ঘুরপাক খাচ্ছিলো।”
“কি?”
“চলো, আমিও আমার মাকে জানিয়ে দেই তুমি প্রেগন্যান্ট। তুমিও তোমার মাকে জানিয়ে দাও। এরপর নিশ্চয়ই বাচ্চার কথা ভেবে তারা ডিসিশন চেঞ্জ করবে।”
“কি! আমি প্রেগন্যান্ট?”
“অভিনয়, অভিনয় করবে। দেয়ালেরও যেহেতু কান আছে, আশেপাশেও জানাজানি হবে। যতই হোক, লোকে মন্দ বলবে সেটা কি আর সহ্য হবে? এমনিতেই বিয়ে নিয়ে কিছু বললে কপাল চাপড়ায়!”
“শাট আপ! এসব হিটলারি চিন্তাভাবনা বাদ দাও। এরপর যখন ঝাটা মেরে বাড়ি থেকে বের করে দিবে তখন রাস্তায় সংসার করো।”
“তাহলে তো আরও ভালো। তুমি কাঁদতে কাঁদতে আমার বাড়িতে চলে আসবে আর আমি চলে যাবো তোমার বাড়ি।”
“লাভটা কি হলো শুনি?”
“যেমন আছি তেমনই…”

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here