লুকোচুরি,পর্ব:৪

“লুকোচুরি”
পর্ব- ৪
(নূর নাফিসা)
.
.
ঘুরাঘুরি শেষে ইভানের সাথে রিকশায় চড়ে বাড়িতে ফিরেছে রিজোয়ানা। বাড়ির সামনে তারা নামতেই অপর দিক থেকে অন্য রিকশায় লিসান এসে হাজির! রিজোয়ানা দাতে দাত চেপে মাথা নত করে দ্রুত বাড়িতে প্রবেশ করতে লাগলো। ইভান একবার রিজোয়ানার দিকে তাকিয়ে আবার লিসানের দিকে তাকালো। অতঃপর চুপচাপ রিকশা ভাড়া দিয়ে নিজের বাড়িতে প্রবেশ করলো। রুমে এসে নানান ভাবনার সাথে চেঞ্জ করতে লাগলো। হাতমুখ ধুয়ে ফ্রেশ হওয়া মাত্র হাক পড়ে গেছে তার মায়ের! যে ভয়টা সে এতোক্ষণ যাবত পেয়ে যাচ্ছিলো ঠিক সেটাই হতে যাচ্ছে। সে বেরিয়ে আসা মাত্র লুবনার প্রশ্ন,
“তুই ইভানের সাথে দেখা করার জন্য বাসা থেকে বেরিয়েছিস?”
রিজোয়ানা মুখটা মলিন করে বললো,
“কি হয়েছে তাতে?”
“এমন নির্লজ্জ বেহায়া মেয়ে আমি জন্ম দিয়েছি ভাবতেই অবাক লাগে!”
“মা, তুমি একটু বেশিই করো। আমি কি পরপুরুষের সাথে বেরিয়েছি?”
“এই বেহায়ী, যে ছেলে স্ত্রীর মর্যাদা দিয়ে তোকে ঘরে তুলতে পারে না তার সাথে তুই কেন যাবি দেখা করতে? যে মহিলা তোকে পুত্র বধূ হিসেবে মানতে চায় না, অযথা গালাগালি করে তুই কেন যাবি তার দুয়ারে ঘুরতে? আত্মসম্মান বলে কিছু নেই? এই শিক্ষা নিয়েছিস পড়াশোনা করে?”
লিসান তার রুমে চলে গিয়েছিলো। শার্ট খুলে সে আবার বেরিয়ে এসে নরম গলায়ই রিজোয়ানার উদ্দেশ্যে বললো,
“রিজু, সবকিছু জেনেও তার সাথে এভাবে মেলামেশা কি ঠিক? তোকে তো তারা মেনে নিচ্ছে না। মায়ের সাথে মামীর সম্পর্ক ভালো না। নিত্যদিন গান গেয়ে যাচ্ছে তোকে ঘরে তুলবে না। এসব জেনেশুনে কোন প্রত্যাশায় তুই তার সাথে যোগাযোগ রাখার চেষ্টা করছিস? হবে না তো সেই ঘরে তোর সংসার। ইভান যদি তোকে ঘরে তোলেও, তবুও কি তুই সুখে সংসার করতে পারবি এমন একজন মহিলা ঘরে থাকা সত্ত্বে? তুই দুঃখে থাক, তা তো কেউ চাইছি না আমরা তাই না? তোর ভালোটাই প্রত্যাশা করছি সবাই। ভুলে যা কোনো সম্পর্ক আছে তাদের সাথে। এভাবে মেলামেশাও বন্ধ কর। তারা মেনে নিতো তাহলে এক কথা ছিলো। কিন্তু তা তো হচ্ছে না৷ হওয়ার সম্ভাবনাও দেখছি না। দুদিন পর দেখবি ডিভোর্স পেপার পাঠিয়ে ছেলেকে বিয়ে করিয়ে দিচ্ছে।”
লুবনা চেয়ারে বসে টেবিলে কনুই ভর করে হাতে মাথা রেখে বললো,
“আমি বুঝি না, মেয়ে কি একটুও বুঝে না কিছু? একটু বুঝ মাথায় নেওয়ার মতো কি বয়স এখনো হয়নি!”
রিজোয়ানা নিশ্চুপ চলে গেলো রুমে। যা-ই বাইরে থেকে মুডটা ফ্রেশ করে এসেছিলো, আর থাকতে পারলো না ফ্রেশ মুডে! বই নিয়ে বসে বসে উপন্যাস পড়তে লাগলো। বাবা এলে সবাই মিলে ডিনার করলো। ঘুমানোর জন্য বিছানা গুছিয়ে এসে বসে রইলো অন্ধকার বারান্দায়। ওপাশে অয়ন নিয়নের হৈচৈ শোনা যাচ্ছে। সারাক্ষণ দুইটা লেগেই থাকে। একটু পর ইভান নিজের রুমের বারান্দায় এসে রিজোয়ানাকে দেখে হালকা কাশি দিলো৷ কিন্তু এপাশে হৈচৈ এর কারণে রিজোয়ানার কান পর্যন্ত পৌঁছায়নি। অতঃপর ইভান অয়ন নিয়নকে ধমকাতে ধমকাতে চলে এলো তাদের রুমে। যদিও উদ্দেশ্য ছিলো রিজোয়ানা। আবার তার পিছু পিছু হাতে বেত নিয়ে চলে এলো ইয়াসমিন। দুইটাকে দুইটা লাগিয়ে দিয়ে বলতে লাগলো,
“ফাজিলের দল! শান্তিতে নামাজটা পর্যন্ত পড়তে পারলাম না তাদের জ্বালায়! এই তুই কোথায় ছিলো এতোক্ষণ?”
ইভান বললো,
“এলামই তো থামাতে।”
“এতোক্ষণে কেন আসবি! এখন থেকে এমন করছে দুইটা! পোলাপান জ্বালিয়ে কয়লা বানিয়ে ফেলছে জীবন।”
“যাও তুমি। ভাত খাও। এই, ঘুমা! সকালে কোচিং আছে না, স্কুল আছে না!”
মাকে পাঠিয়ে দিয়ে অয়ন নিয়নকে শাসাতে লাগলো ইভান। নিজেই মশারী টানিয়ে দিলো। গোমড়া মুখু হয়ে খাটের দু’প্রান্তে শুয়ে আছে দুজন। ইভান রুমের লাইট অফ করে ভেতর থেকে দরজা চাপিয়ে চলে এলো বারান্দায়। এবার রিজোয়ানার মুখোমুখি। রিজোয়ানা সেই যে গ্রিলে হেলান দিয়ে বসে ছিলো, এখনো সেভাবেই আছে। ইভান এসে বললো,
“মন খারাপ কেন? লিসান কিছু বলেছে?”
“নাম ধরে কেন ডাকেন? ভাইয়া বলতে পারেন না? চার মাসের হলেও বড় তো বড়-ই!”
“আহা! অভ্যাসটা চেঞ্জ করার জন্য আবার ছোট হতে হবে। আচ্ছা, মন খারাপ কেন সেটা বলো।”
“মা এবং ভাইয়ার আদেশ, আপনি আর আমার সাথে দেখা করবেন না, কথা বলবেন না। মোট কথা কোনো যোগাযোগই রাখবেন না। আপনি আমার কেউ না, আমি আপনার কেউ না৷ দুদিন পর তো আমাকে ডিভোর্স পেপার পাঠিয়ে নতুন বউ ঘরে আনবেনই। তো কি প্রয়োজন অযথা মায়া বাড়ানোর?”
“মাইর দিবো একটা। তোমার ভাইটা এমন বলদ কেন হ্যাঁ? সিঙ্গেল একটা ছেলে হয়ে এভাবে মিঙ্গেলের পেছনে পড়ে আছে! নিজের মধ্যে কি কোনো ফিলিংস জাগে না? আমাদের পেছনে না পড়ে থেকে তো নিজের বউটাকেও খুজতে পারে। বিয়ে করার বয়সে বোনের সংসার তছনছ করতে লেগে পড়েছে একেবারে! একটা মেয়ে ধরে বিয়ে করিয়ে দাও। বুঝুক, বউয়ের প্যারা কি জিনিস!”
“কি! আমি তোমাকে প্যারা দেই?”
“না, মানে সংসারের প্যারা। স্যরি, প্যারা না। মানে দায়িত্ব। বউ, বাচ্চা, সংসারের প্রতি টান টান উত্তেজনা।”
“একদম কথা ঘুরানোর চেষ্টা করবে না এখন! আর গুড্ডু শুড্ডুর জন্য মেয়ে টিচার কেন রেখেছো বাসায়? ছেলে টিচারের অভাব পড়েছে দুনিয়ায়?”
“ওমা! টিচার আবার কি করলো! আর টিচার কি আমি সিলেক্ট করেছি? মা নিয়োগ দিয়েছে।”
“কেন, মামীর কি খুব পছন্দ তাকে? তাহলে বিয়ে করে ফেলো।”
“কি বলো এসব!”
“ভুল বলিনি তো কিছু। আর ওই মেয়েটা তোমাকে এতো ভাইয়া ভাইয়া ডাকে কেন?”
“কি আশ্চর্য! তার সাথে তো আমার দেখাই হয় না তেমন। কথাবার্তা তো দূরেই থাক!”
“কেন, আজ সন্ধ্যায় হয়নি? আমি দেখিনি রুমে বসে!”
“আরে! মেয়েটা যাওয়ার সময় আমাকে দেখে সালাম দিলো আর আমি কেবল তার জবাব দিয়ে জিজ্ঞেস করলাম কেমন আছে। এই তোমার শুরু হয়ে গেলো! কোথায় আমি কোথায় সে, তুমি কি রেখে কি ভাবলে! আমি যে বিবাহিত সেটাও তো তার অজানা নয়।”
“অজানা কেন হতে যাবে। এতো শত গল্পে তো জানিয়েছো সবই, তাহলে অজানা থাকার কথা?”
“শুধু শুধু মনে সন্দেহ জাগাও।”
“হ্যাঁ, আমি সব শুধু শুধুই করি। তালে যোগে সব দোষ আমারই থাকবে৷ থাকুক।”
ওদিক থেকে নিয়নের কণ্ঠে ভেসে এলো,
“আমাদের ঘুমাতে বলে তুমি আপুর সাথে কথা বলো? আম্মুকে বলছি দাঁড়াও! আম্মু…”
নিয়ন হাক ছেড়েও দিলো চিৎকার করে। ইভান বললো,
“আম্মুর বাচ্চা, চুপচাপ ঘুমা!”
এদিকে আবার নিয়নের উদ্দেশ্যে অয়ন বলে উঠলো,
“সকালেও ছাদে গেছে, আর আমি দরজা খুলে দিয়ে এসেছি। ওইটাও আম্মুকে বলবি, নিয়ন।”
ইভান রিজোয়ানার দিকে তাকিয়ে বললো,
“নবাবের রাজ্যে মীরজাফর ছিলো একটা। আর আমার রাজ্যে দুইটা। বুঝতেই পারছো আমি নবাবের চেয়ে দ্বিগুণ যন্ত্রণায় আছি।”

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here