লুকোচুরি,পর্ব:৫

“লুকোচুরি”
পর্ব- ৫
(নূর নাফিসা)
.
.
রিজোয়ানা তার কথা শোনার জন্য আর দাঁড়িয়ে নেই। তাকে চলে আসতে দেখে ওদিকে ইভানও দ্রুত চলে যেতে লাগলো। রুমে গিয়ে আবার অনলাইনে কল করলো৷ রিজোয়ানা বাথরুমে ছিলো, এসে দেখে ফোন বাজছে। রিসিভ করে বললো,
“আবার কি হলো?”
“একটা কথা ভাবছিলাম।”
“তো ভাবতে থাকো।”
“না, কি ভাবছি সেটা তোমাকে জানাতে হবে তো!”
“কি?”
“ধরো আমার যদি একটা বোন থাকতো কিংবা শিহান যদি মেয়ে হতো তাহলে তো দাদাজান তাকে লিসানের সাথে বিয়ে দিয়ে দিতো তাই না?”
“তোমার এসব ফালতু ভাবনা কবে শেষ হবে শুনি?”
“যেদিন লিসান বিয়ে করে ফেলবে সেদিন। শুনো না, লিসানের জন্য অনলাইনে ‘পাত্রী চাই’ বিজ্ঞপ্তি দিলে কেমন হয়? তুমি আমি মিলে নাহয় জাজমেন্ট করে ফেলবো।”
“ষ্টুপিড! তোমার জন্য লাগলে বলো খুঁজে দেই।”
ইভান শব্দযোগে হেসে বললো,
“আমার জন্য? তাহলে অয়ন নিয়নের টিচার কেমন হয়?”
এমনিতেই মনটা খারাপ ছিলো তারউপর ইভানের ফাজলামো বিরক্ত করে তুলেছে। আর এখন কান্নাই পাচ্ছে এমনকি কল কাটতে কাটতে ফুপিয়ে কাঁদতেও শুরু করে দিয়েছে রিজোয়ানা। ইভান বোধহয় একটু শব্দ পেয়েছে তাই সাথে সাথেই টেক্সট করলো,
“তুমি কি সত্যি সত্যি কাঁদছো নাকি এমনিতেই অভিনয় করতে শুরু করেছো?”
রিজোয়ানা ফোন সুইচ অফ করে বসে বসে দুই মিনিট কাঁদলো কিন্তু কোনো শব্দ হলো না। এই কান্নায় কোনো কষ্ট অনুভূত হয়নি তার। মাত্রাতিরিক্ত রাগে শুধু যন্ত্রণা অনুভূত হয়েছে। কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থাকায় রাগ কমে গেছে। এরপরই ঘুমানো সম্ভব হয়েছে।
ঘুম থেকে জাগার পর আবার মনটা ফ্রেশ। কিন্তু ইভানের সাথে কথা বলবে না। গতরাতে তার বলা কথা ভুলেনি সে। ফজরের নামাজ পড়ে আর না ঘুমিয়ে মাকে সাহায্য করতে চলে এলো। আজ রুটি আর সবজি সকালের নাস্তা। তাই রান্নার কাজকর্ম দ্রুতই শেষ হয়ে গেছে। বাবার জন্য আদা চা করেছিলো৷ নিজেরও খেতে ইচ্ছে হওয়ায় সেখান থেকে এক কাপ চা এবং শরৎচন্দ্রের বই হাতে চলে এলো বারান্দায়। চেয়ারে বসে চায়ে চুমুক দিতে দিতে বই পড়ছে রিজোয়ানা। মাথার সামনের দিকের ছোট চুলগুলো বাতাসে উড়ছে। বারবার গুজে দিচ্ছে কানের পেছনে। তবুও বিরক্ত হচ্ছে না। কারণ সে এখন বই পড়ায় মনযোগী। কিছুক্ষণ পর ইভান নিজের বারান্দায় এসে আড়মোড়া ভাঙতে দু’হাত মেলে হাই তুলতে তুলতে বললো,
“ম্যাম সাহেবা, আপনার ফোন বন্ধ কেন?”
রিজোয়ানা ঘাড় ঘুরিয়ে ইভানের রুমের বারান্দার দিকে তাকালো। কোনো প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত না করে আবার বই পড়ায় মনযোগ দিলো। একটু পর ইভান ফ্রেশ হয়ে কফি কাপ হাতে এপাশে অয়ন নিয়নের বারান্দায় চলে এলো। শব্দযোগে কফিতে চুমুক দিয়ে বললো,
“আহ! তাজা সকাল তাজা মন! শরৎচন্দ্র পাঠিকার ঝলমলে চুল! তরুণী, সুন্দর লাগছে করুণ।”
রিজোয়ানার কাপের অবশিষ্ট চা ঠান্ডা হয়ে গেছে। সে এক চুমুকে বাকিটুকু শেষ করে কাপটা টুলে রাখলো। ইভানের দিকে একবার তাকালোও না। ইভান বললো,
“আহা! রেগে আছো নাকি? রাতে এক সকালে এক, এ কোন রঙের গিরগিটি?”
রিজোয়ানা রেগেমেগে তাকালে ইভান ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটিয়ে বললো,
“কি? শেষ? কাপ এগিয়ে ধরো, ঢেলে দেই।”
রিজোয়ানা এবার বই বন্ধ করে কাপ হাতে নিয়ে হনহনিয়ে চলে এলো বারান্দা ছেড়ে। মন ফ্রেশ থাকলেও আজ তার প্রতি রাগ দেখিয়ে শাস্তি দিবে তাকে। কোনো কথাই বলবে না তার সাথে। ছুটির দিন হওয়ায় ইভান বাড়িতেই আছে। কিন্তু সকালের পর থেকে রিজোয়ানাকে আর দেখতে পায়নি। ফোনও সুইচ অফই রেখেছে। গলা বাড়িয়ে যে ডাকবে সেই সুযোগও নেই। দুপুরে তৈরি হয়ে বাড়ি থেকে বের হতে যাওয়ার সময় রিজোয়ানাকে দেখতে পেলো রুমে। ফ্যানের নিচে দাঁড়িয়ে চুল নেড়েচেড়ে শুকাচ্ছে। সে বারান্দায় এসে বললো,
“এই, বাইরে যাচ্ছি। যাবে? লাঞ্চের দাওয়াত আছে।”
রিজোয়ানা রুমে থেকেই জানালার বাইরে তাকালো। ইভান মৃদু হেসে বললো,
“আচ্ছা, জোর করবো না। দাওয়াতটা আসলে আমার একার। ফ্রেন্ডদের সাথে যাচ্ছি আরকি। সব ছেলে ফ্রেন্ড। তাই তোমাকে নিবো না। কিছু খেতে ইচ্ছে হলে বলো, নিয়ে আসবো।”
রিজোয়ানা বিনা প্রতিক্রিয়ায় নিজের কাজ করতে লাগলে ইভান বললো,
“যাচ্ছি তাহলে। ফোনটা সুইচ অন রেখো। হুম…নেক্সট টাইম কল করে যেন সুইচ অন পাই।”
বললেই হলো! করবে না সুইচ অন। তার শাস্তি যে এখনও শেষ হয়নি। সন্ধ্যার দিকেই ইভানকে বাড়িতে ফিরতে দেখলো। পরক্ষণে ভাবলো সুইচ অন করা যাক। অনেক তো হলো শাস্তি। কিন্তু সুইচ অন করার পর থেকে রাতে ঘুমাতে যাওয়ার পূর্ব পর্যন্ত ইভান একবারও কল করলো না। এমনকি অনলাইনেও নক করেনি। যা করেছিলো, গতকাল ও সকালে। এরপর আর না। বাইরে থেকে ফিরে এসে সে কি ক্লান্ত? নাকি ফোন করে তাকে পায়নি বলে আবার রেগে আছে? কোনটা? প্রশ্নগুলো বারবার মাথায় ঘুরছে রিজোয়ানার। ঘুমাতে গিয়েও ঘুম নামছে না চোখে। নেমে আসছে শুধু ইভানের ব্যাপারটা! ভাবতে ভাবতে সে নিজেই এবার কল দিয়ে ফেললো। বিপরীতে রিসিভ হলো না। আবার দিতেই সাথে সাথে কেটে গেলো। ইভানের কেটে দেওয়া কল রিজোয়ানাকে আরও বেশি ভাবাতে লাগলো। সে অনলাইনে ইনবক্সে হায় জানালে এক্টিভ পেলো কিন্তু রিপ্লাই পেলো না৷ এমনকি টেক্সট সিনও হলো না। অনবরত হায় লিখতে লিখতে পঞ্চাশের অধিক টেক্সট করে ফেলেছে। অধিকাংশ এক্টিভ পেলেও শেষ কয়েকটায় অফ লাইন দেখতে পেলো৷ আর তাই টেক্সট করা বন্ধ করে দিলো৷ রিজোয়ানার মনে হচ্ছে সে রাগ করেছে। তাই শেষে “স্যরি” লিখে একটা টেক্সট করে চোখ বন্ধ করে রাখলো। সকালে ঘুম থেকে উঠে চেক করে দেখলো ইভান কোনো কল কিংবা রিপ্লাই করেছে কি না৷ কিন্তু না, করেনি। তবে মেসেজ সিন করে রেখে দিয়েছে। রিজোয়ানার মুডটা সকালের শুরুতেই বিষন্ন হয়ে গেলো। সাথে সাথেই সে কল করলো। এখনও রিসিভ হলো না। কাজকর্ম সেরে বারান্দার ধারে অপেক্ষায় রইলো কারণ ইভানের অফিস যাওয়ার সময় হয়েছে। এখন নিশ্চয়ই বলতে আসবে। কিন্তু সেই প্রত্যাশাও পূর্ণ হলো না। ইভান এদিকে আসেইনি। বরং কান পেতে থাকায় একটুখানি শব্দ শুনতে পেলো তার মায়ের কাছে বিদায় নিয়ে সে বেরিয়ে যাচ্ছে অফিসের জন্য। ব্যাপারটা বেশ কষ্ট অনুভব করতে বাধ্য করলো। সাথে সাথেই চোখদুটো ভিজে উঠেছে। কষ্ট হচ্ছে, প্রচুর কান্না পাচ্ছে আবার রাগও হচ্ছে। এতোটাই রাগ হচ্ছে যে, এই মুহুর্তে ইভানকে কাছে পেলে চিবিয়ে খেয়ে ফেলতো ফেলতো মনোভাব।
সারাটাদিন রিজোয়ানার এই কাণ্ড মনে হচ্ছে আর রাগ জোয়ারভাটা খেলা করছে। বিকেলে ছাদে গিয়েছিলো। সেখানেও ভালো লাগছিলো না। বারবার চোখ যাচ্ছিলো ইভানদের ছাদের দিকে। অবশেষে রেগেমেগে নিজেদের ছাদ থেকে পরপর দুইটা আস্ত ইট নিয়ে সজোরে ইভানদের ছাদে মারলো। আরও নিক্ষেপ করার ইচ্ছে ছিলো কিন্তু দ্বিতীয়বার ইট নিক্ষেপ করতে দেখে ফেললো এক ভাড়াটিয়া মহিলা। তিনি ছাদ থেকে কাপড় নিতে এসেছিলেন। ভাড়াটিয়া দেখে ফেলায় রিজোয়ানা ইচ্ছেকে দাবিয়ে রেখে নিচে নেমে এলো। ফ্ল্যাটে প্রবেশ করবে এমন সময় দেখা মিললো পাশের ফ্ল্যাটের ভাড়াটিয়ার ছেলের। ছেলেটার নাম সুমন। বয়স দশ বছর। রিজোয়ানা তাকে দেখে বললো,
“সুমন রে, একটা কাজ করতে পারবি?”
“কি?”
“একটা পলিথিন নিয়ে যা। ছাদে ইটের কণাগুলো আছে না? সেখান থেকে কতগুলো ইটের কণা তুলে তোদের রুমে নিয়ে যাবি। ওইযে, এপাশের রুমে। যেটাতে তুই আর তোর দাদু থাকিস।”
“আমি এগুলা দিয়ে কি করবো!”
“তোর কিছু করা লাগবে না। আমার কাজ আছে। তারাতাড়ি আয়। আমি যাচ্ছি তোদের রুমে।”
রিজোয়ানা নিজেদের ফ্ল্যাটে প্রবেশ না করে পাশের ফ্ল্যাটে এসে সুমনের মায়ের সাথে গল্প করতে লাগলো। সুমন লুকিয়ে লুকিয়ে ইটের কণা নিয়ে এলে রিজোয়ানা সুমনদের বারান্দায় চলে এলো। এই বারান্দা আর ইভানের রুমের বারান্দা মুখোমুখি। সে এখানে দাঁড়িয়ে সবগুলো ইটের কণা নিক্ষেপ করলো ইভানের রুমের বারান্দায়। দরজা লাগানো বিধায় রুমের দিকে ছুড়তে পারলো না। তবুও রাগ অনেকটা কমে এসেছে। শুধু এতেই শেষ নয়। গ্লাসে পানি ঢেলে ঢেলে পুরো এক জগ পানি নিক্ষেপ করলো। নিশ্চয়ই এবার পুরো বারান্দা ইটের কণা ও পানিতে মাখামাখি হয়েছে! কাজ সম্পন্ন করে তারপর সে নিজেদের ফ্ল্যাটে চলে এলো।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here