লুকোচুরি,পর্ব:৬+৭

“লুকোচুরি”
পর্ব- ৬
(নূর নাফিসা)
.
.
সন্ধ্যায় মনমরা হয়ে বসে আছে নিজের রুমের বারান্দায়। কখনো নিচের পথঘাট দেখছে, কখনো বা অয়ন নিয়নের পড়াশোনা ও হৈচৈয়ের দিকে মনযোগ দিচ্ছে। আবার কখনো ভবনের ফাঁকে উঁকি দেওয়া রাতের মেঘাচ্ছন্ন আকাশ দেখছে। থোকা থোকা সাদাকালো মেঘ ভেসে যাচ্ছে দলবেঁধে। চাঁদের আলো আছে কিন্তু মেঘের খোলামেলার কারণে চাঁদ ঘোলাটে। কখনো স্পষ্ট হয়ে ভেসে উঠছে আবার কখনো বা অস্পষ্টতার সাথে ডুবে যাচ্ছে। হঠাৎই ইভানের বারান্দার লাইট জ্বলে উঠায় দৃষ্টি সেদিকে চলে গেলো। ইভান বাড়িতে এসেছে হয়তো কিছুক্ষণের মধ্যেই। লাইট জ্বেলে বারান্দার দরজা খুলে এক কদম এগিয়ে এসেই আবার পিছিয়ে যেতে দেখা গেলো তাকে। তার মুখের বিরক্তির ছাপ স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে রিজোয়ানা। বারান্দার এই বিশ্রী হাল দেখে ইভান এদিকেই তাকিয়েছে। রিজোয়ানার বারান্দা অন্ধকার হলেও আশেপাশের আলোতে তাকেও দেখতে পেয়েছে সে। কোনোরকম অপেক্ষা না করে সে হনহনিয়ে চলে এলো অয়ন নিয়নের বারান্দায়। এসেই জিজ্ঞাসা,
“বারান্দার এই হাল করেছো কেন?”
রিজোয়ানা জবাব না দিয়ে গোমড়ামুখু হয়ে তাকাচ্ছে শুধু। সারাদিনের চাপা কষ্ট যেন এবার বের হতে চাইছে ইভানের সামনে। বিষয়াদি জটিল না হলেও মাঝে মাঝে অনুভূতিগুলো একটু বেশিই জটিল রূপে প্রকাশ পায়। অনেকসময় ভেঙে পড়া মুহূর্তেও স্ট্রং ভাব চলে আসে, আবার কখনো কখনো সামান্য বিষয়েই ছিচকাদুনে ভাব এসে হানা দেয়। এই মুহুর্তেও ঠিক সেটাই ঘটছে। ইভান আবার বললো,
“চুপ করে আছো কেন? ছাদে নাকি আবার ইটা মেরেছো? ভাড়াটিয়া এসে মায়ের কাছে বলে গেছে। ঘরে পা রাখতে না রাখতে এখনই এসব বিচার-আচার শুনি। বউ শ্বাশুড়ির সংসার এক হলে তো বিচারের লিস্টের উপর লিস্ট পড়ে যাবে!”
মুহুর্তেই রিজোয়ানার চোখ থেকে টুপটাপ পানি পড়তে শুরু করে দিলো। ইভান বললো,
“এই মুহূর্তে ছাদে আসবে। কিভাবে আসবে তা আমি জানি না। পাঁচ মিনিটের বেশি কিন্তু আমি অপেক্ষা করবো না, এটুকু বলে দিচ্ছি।”
গম্ভীরমুখে কথাগুলো বলে ইভান চলে গেলো হনহন করে। রিজোয়ানা চোখ মুছে সোজা বেরিয়ে গেলো। মা কোনদিকে তা আর দেখার প্রয়োজন মনে করলো না। নিজের মতো করে বেরিয়ে দরজা লক করে চলে গেলো ছাদে। এখানে এসে ইভানকে তাদের ছাদে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলো। ঘনঘন পা ফেলে সিড়ি অতিক্রম করলেও ইভানকে দেখে তার পায়ের গতি একেবারেই কমে গেছে। ইভান এগিয়ে এসে তার হাত ধরে তাদের ছাদের দিকে টেনে নিয়ে যেতে যেতে বললো,
“এখন আমার বারান্দা পরিষ্কার করে দিয়ে যাবে। এসো। এসো…!”
রিজোয়ানা হাত টেনে মেজাজী গলায় বললো,
“পারবো না।”
“কেন পারবে না? এগুলো এখন পরিষ্কার করবে কে শুনি? চলো। ময়লা যেহেতু তুমি করেছো, পরিষ্কারও তুমিই করবে।”
“এহ! এখান দিয়ে যাবো কেন? পারলে বউ সাজিয়ে দরজা দিয়ে নিয়ে যান!”
“কেন? ময়লা করার সময় কি দরজা দিয়ে প্রবেশ করে তারপর করেছিলে? তোমার মতো নোংরা মেয়েকে বউ সাজিয়ে ঘরে তুলবে কে, শুনি?”
রিজোয়ানা আবারও কাঁদতে লাগলো। তা দেখে ইভান বললো,
“কাঁদছো কেন আবার? তোমার তো ভাগ্য ভালো, মা যে বারান্দায় গিয়ে এসব দেখেনি।”
ইভানের হাতের বাঁধন হালকা হয়ে এলে রিজোয়ানা হাত টেনে নিয়ে চোখ মুছতে লাগলো। ইভান হাত বাড়িয়ে চোখ মুছে দিতে গেলে ঝাড়ি মেরে হাত সরিয়ে দিলো। তাই আবারও শক্ত করে হাত ধরে কাছে এসে চোখ মুছে দিতে দিতে এবার স্বাভাবিক গলায় বললো,
“এখন এতো ঢং কেন দেখানো হচ্ছে? আমিও তো কাল বলে গিয়েছিলাম ফোনটা যেন সুইচ অন থাকে। শুনেছিলে আমার কথা? নিজে মাত্রাতিরিক্ত করবে আর আমি একটুখানি করলেই দোষ?”
তবুও রিজোয়ানা তার হাত ছুটিয়ে নিতে চাইলে ইভান হাত ছেড়ে দিয়ে তাকে দু’হাতে জড়িয়ে ধরে বললো,
“রাগ করার সময় করবে, তবে সেটা বেশিক্ষণ স্থায়ী কেন হবে? অল্প সময়ে ডিশমিশ করা যায় না?”
জোরাজুরি, রাগারাগি একদিকে ফেলে এবার রিজোয়ানা লজ্জায় দুহাত গুটিয়ে নিয়েছে। এ ছিলো প্রথমবারের মতো ইভানের এতোটা কাছে আসা। এর আগে হাতে হাত রেখে হেটেছে কতশত বার, কিন্তু এভাবে জড়িয়ে ধরার অনুভূতিটা আজ প্রথম। লজ্জা লাগছে ভীষণ। এই মুহুর্তে নিজেকে গুটিয়ে রাখতে পারলে যেন বেঁচে যায় সে। ইভান কিছুটা আন্দাজ করতে পেরে বললো,
“কোন সমস্যা?”
রিজোয়ানা গুটানো হাত দ্বারা তাকে হালকা ধাক্কিয়ে সরাতে গেলে ইভান এক গালে হেসে মাথায় মাথা ঠুকে বললো,
“কি সমস্যা? হুম?”
বিপরীতে লজ্জাময়ী রিজোয়ানাও নিচু শব্দে খিলখিলিয়ে হেসে উঠলো। ইভান হাতের বাঁধন আরও শক্ত করে বললো,
“এখন গিয়ে শ্বাশুড়ি মায়ের কাছে বিচার দিয়ে আসি? উনারও জানার দরকার আছে উনার মেয়ে কেমন নোংরা। আমার মা যে ঝগড়ার সময় বলে, ভুল বলে না তো!”
“এহ!”
“এহ কি আবার? এসব যে করেছো, এখন আমার বারান্দা পরিষ্কার করবে কে?”
“তুমি।”
“এতো ঠেকা কেন আমার?”
“নিজের কাজ নিজে করবে, সেখানে ঠেকাঠেকির কি আছে!”
“নিজের কাজ নিজে? ময়লা তো আমি করিনি। করেছো তুমি।”
“ভালো করেছি। পুরুষলোকদের টাইট না দিলে চলে না। এরপর থেকে স্ট্রং থাকবে।”
“ওহহো! মুখে মুখে এতো দূর? তা কাজেকর্মে টাইটটা কে কাকে দিলো শুনি? আপনার কাজ তো টাইট দেওয়ার মধ্যে পড়লো না। মাথা ভর্তি গোবর নিয়ে এসে আমার বারান্দায় ঢেলে দিয়েছেন।”
রিজোয়ানা মুখ টিপে হেসে অন্যদিকে চোখ ফিরিয়ে নিলো। ইভান তার হাসির বিপরীতে মুচকি হেসে তাকিয়ে রইলো কয়েক সেকেন্ড। এরপর ফিসফিসিয়ে বললো,
“ইদানীং রোমান্টিক বায়ু একটু বেশিই বইছে মনে হচ্ছে।”
“ষ্টুপিড।”
ইভান তাকে ছেড়ে দিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে বললো,
“ওকে, নিচে যাও। প্রেমের বাতাস বেশি লেগে গেলে আবার সমস্যা আছে।”
“এই রাতের বেলা এদিক দিয়ে যাওয়ার প্রয়োজন নেই। পায়ের সিগন্যাল মিস হয়ে গেলে পালস মিস হয়ে যাবে। সিড়ি দিয়ে চলো।”
“কিছু হবে না। যাও।”
“সিড়ি দিয়ে নামতে বলেছি না! কেউ দেখবে না, এসো। আর দেখলে দেখুক।”
“সিড়ির দরজায় তালা লাগাতে হবে। যাও তুমি।”
ইভান এদিক দিয়েই চলে গেলো নিজেদের ছাদে। তবে সে ছাদ অতিক্রম করার পরেই রিজোয়ানা ফ্ল্যাটের উদ্দেশ্যে নেমে এলো।
পরদিন দুপুরে রিজোয়ানা গোসল করতে যাওয়ার সময় জানালার বাইরে তাকাতেই অয়ন নিয়নের রুমের বারান্দায় শিহানকে দেখে বাথরুমে যাওয়া ক্যান্সেল করে বারান্দায় চলে এলো শিহানের সাথে গল্প করতে।
শিহান ইভানের ছোট। দ্বাদশ শ্রেণিতে অধ্যয়নরত। আর অয়ন নিয়ন যমজ। তারা ষষ্ঠ শ্রেণিতে অধ্যয়নরত। ইভানের কোনো বোন নেই। চার ভাই ও তার মা নিয়ে তাদের পরিবার। বাবা মারা গেছেন বছর তিনেক হলো। সংসার চলছে বাবার পেনশন ও বাড়ি ভাড়ায়। এখন নতুন করে দায়িত্ব নিতে শুরু করেছে ইভান।
রিজোয়ানা বারান্দায় এসে বললো,
“হেই, শিহান। কত্তো দিন পর! কি খবর তোমার?”
শিহান ফোন থেকে চোখ সরিয়ে মুচকি হেসে বললো,
“এইতো ভালো। কেমন আছো তুমি?”
“আলহামদুলিল্লাহ। কখন ফিরলে বাসায়?”
“গতরাতে। ঘুম থেকে উঠেই তো তোমাকে খুঁজছিলাম। পেলাম না।”
“ওহ্, এদিকে ছিলাম না হয়তো। আচ্ছা, বলো কেমন কাটলো তোমার ট্রাভেলিং টাইম?”
“ফিরতে ইচ্ছে করছিলো না। বুঝো এবার।”
“অনেক এনজয় করেছো নিশ্চয়ই। তুমি নাকি দু সপ্তাহের আগে ফিরবে না। দু সপ্তাহের তো মেবি এখনো দুএক দিন বাকি! রমজানের জন্য চলে এলে নাকি?”
“হুম, কাল থেকে রোযা না। মা তো ফোনেই ঝাটা মারতে প্রস্তুত!”
“হিহিহি! যাক, আস্তে ধীরে শখ মেটাও। একত্রে খেতে গেলে আবার বদহজম হয়ে যাবে।”
“তাই নাকি? কিন্তু আমার যে হজম শক্তি বেশ ভালো। তা তোমরা হানিমুনে যাচ্ছো কবে?”
“হুহ্! শ্বশুর বাড়িতেই যাওয়ার সৌভাগ্য হয়নি আবার হানিমুন!”
“হা হা হা! চলে এসো। কাছেই তো। দরজাও খোলাই আছে।”
“আমি কেন চলে আসবো, হু? নিয়ে যেতে পারো না!”
“ওকে, দরজা খুলো। আসছি আমি নিতে, আসবে তো?”
“এহ! এভাবে কেন যাবো? আমার কি কোনো সম্মান নেই নাকি? নেওয়ার হলে আনুষ্ঠানিকভাবে নিয়ে যাও।”
“তাহলে বসে থাকো। আর আসা লাগবে না।”
“আসবোও না।”
“এ বাড়িতে বোধহয় আর ভাবি আসবেও না। মাও চাইবে না তুমি আসো, ভাইয়াও চাইবে না একাধিক বিয়ে করতে।”
রিজোয়ানার মুখটা সামান্য মলিন হয়ে গেলো। সে জিজ্ঞেস করলো,
“কেন, মামি বুঝি বলেছে তোমার ভাইকে বিয়ে করে নিতে?”

“লুকোচুরি”
পর্ব- ৭
(নূর নাফিসা)
.
.
“কেন, মামি বুঝি বলেছে তোমার ভাইকে বিয়ে করে নিতে?”
“হুম, গত রাতে বলছিলোই তো এমন কিছু। ভাইয়া বলছিলো তোমার কথা। দ্যান মা বললো, বিয়ে করলে বল বউ দেখি।”
“আর তোমার ভাইয়া কি বললো?”
“ভাইয়া বলেছে, যাকে বিয়ে করেছি তাকে আগে ঘরে তুলো।”
“আচ্ছা, যাই। গোসল করবো।”
রিজোয়ানার মুখের মলিনতা বিলীন করতে শিহান বললো,
“ওসব বাদ দাও, ভাইয়াকে ফুসলে হানিমুন সেড়ে আসো। ভাইয়ার কাছে কিন্তু টাকা আছে। বের করতে চায় না, বুঝেছো? ভাইয়ার বেতন টেতন কিন্তু মা জমা নেয় না। ঘরের খরচে যা যায় আরকি।”
“ঘরের খরচই বা কম কিসে, হুম? আর পরিবারের বড় ছেলে, পরিবারের দায়িত্ব নিতে না পারলে কেমন হবে!”
“ধুর! আমি অনুপ্রেরণা দিচ্ছি, আর তুমি পাশ কাটিয়ে যাচ্ছো! বিশ্বাস করো, দেশের আনাচে কানাচে এতো এতো সুন্দর জায়গা! ওফ্ফ! মন বসে গেলে, ঘরে ফেরানো দায়! মুগ্ধ না হয়ে পারবে না। তোমাকে কিছু ছবি পাঠাবো। দেখলে যাওয়ার ইচ্ছে জাগবে হান্ড্রেড পার্সেন্ট। সুযোগ কাজে লাগাও, ভাবিজী। আমাকেও সাথে নিতে চাইলে মাইন্ড করবো না! শুধু একটা নক দিবে। তোমাদের ডিস্টার্ব করবো না, আমি আমার মতো হারিয়ে যাবো। থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা তোমাদের।”
“হিহিহি। আচ্ছা? এতো মুগ্ধতায় জড়িয়ে গেছো? কাউকে রেখে আসোনি তো আবার, বারবার ছুটে যাওয়ার জন্য?”
“ধুর! তোমার সাথে কথা বলা মানেই লাইন ক্রস করা! যাও, যাও, গোসল করো৷ ক্ষুধা লেগেছে আমার। আজই তো মাসের শেষ লাঞ্চ। পেট পুড়ে নেই।”
এমনি লুবনা এলো রুমে। রিজোয়ানার উদ্দেশ্যে বললো,
“কি রে! এখনো গোসল করতে যাসনি!”
“হ্যাঁ, যাচ্ছি।”
ওপাশে থেকে শিহান লুবনার উদ্দেশ্যে বললো,
“আসসালামু আলাইকুম, ফুপি। ভালো আছো তুমি?”
“ওয়া আলাইকুমুস সালাম। আছি ভালোই। তুই কেমন আছিস?”
“তোমাদের দোয়ায় আলহামদুলিল্লাহ, অনেক ভালো। ইফতারের দাওয়াত টাওয়াত পাবো নাকি? রোযা রাখি তো।”
লুবনা হেসে বললেন,
“পাবি না কেন৷ চলে আসিস। ত্রিশ দিনেরই দাওয়াত।”
“কি মুশকিল! রোযা উনত্রিশটা হলে ঈদের দিনও আমাকে ইফতারিই খাওয়াবা!”
“ধুর, ফাজিল! যতদিন ইফতার, ততদিনেরই দাওয়াত। হয়েছে এবার?”
“আচ্ছা, ঠিক আছে।”
লুবনা রুম ছেড়ে যেতে যেতে বললো,
“অয়ন নিয়নকেও সাথে নিয়ে আসিস।”
“নিজে বাঁচলে বাপের নাম।”
বলতে বলতে শিহান বারান্দা ছেড়ে চলে গেলো। রিজোয়ানাও হাসতে হাসতে ত্যাগ করলো নিজ বারান্দা। দুপুরে মায়ের সাথে খেতে বসলে লুবনা বিড়বিড় করতে লাগলো,
“শিহান ছেলেটা একেবারেই ভিন্ন। যেমন মুখে মধু, তেমনই আচার-ব্যবহারে। দেখলেই সালাম দিবে, এটা সেটা জিজ্ঞেস করবে। আর বাকি ছেলেগুলো পুরো মায়ের স্বভাব পাইছে। আরেক মেয়ের জামাই তো পাইছিই। মাশাল্লাহ! কথা তো বলবে দূরে থাক! দেখলে সালাম পর্যন্ত দেয় না। দৌড়ে পালায়। ফুপির সাথে সম্পর্ক তো নাই ই, শ্বশুর শ্বাশুড়িও মানে না। আবার বউ বউ করতে আসে! মানুষের মুখের কথায় কি না হয়! সম্পর্ক টিকিয়ে রাখতে মানুষের আচার-ব্যবহারই যথেষ্ট। জীবনে নিয়েছে কোনো খবরাখবর? সবই আমার কপালের দোষ। উছিলায় আমার বাপ! না একূল, না ওকূল, কোনো কূলেই ফেলে যায়নি!”
রিজোয়ানা কিছুই বললো না। চুপচাপ শুনে গেলো শুধু। সন্ধ্যার পরে ইভান কল করলে রিজোয়ানা বললো,
“আসসালামু আলাইকুম।”
“ওয়ালাইকুমুস সালাম। কোথায় তুমি? রুমের লাইট অফ, বারান্দার লাইট অফ!”
“রুমেই। অন্ধকার রুমে শুয়ে আছি। বাসায় ফিরেছো?”
“হ্যাঁ, ফিরেছি একটু আগে। ফ্রেশ হয়েই তোমাকে কল করলাম। এসময় শুয়ে আছো কেন? শরীর খারাপ?”
“তা জেনে তোমার কি লাভ?”
“এটা কেমন কথা বললে?”
“কেমন আবার। যেমন শুনেছো তেমনই। এতো বউ বউ করে পাগল, শ্বশুর শ্বাশুড়ির খবর নিয়েছো ক’দিন? হুম?”
“কেন, কি হয়েছে শ্বশুর শ্বাশুড়ির?”
“এখন কেন বলতে যাবো কি হয়েছে না হয়েছে? আমার সাথে তো খুব মধুমাখা আলাপ জমাতে পারো। বাবামাকে দেখলে কি একটা সালাম পর্যন্ত দেওয়া যায় না?”
“আমার সাথে দেখাই হয় না, সালাম দিবো কিভাবে!”
“দেখা হয় না? নাকি দেখা দাও না? হুম? দেখা হবে কি করে, ছায়া দেখলেই দৌড়ে চলে যাও।”
ইভান আর প্রত্যুত্তর না করে হাসলো শুধু। রিজোয়ানা তার হাসির প্রতি বিরক্ত হয়ে বললো,
“হাসো আবার? জানো, মা আজ কি বলেছে? কপালের দোষে তোমার মতো একজন জামাই পেয়েছে যে কি না দেখা হলে সালাম পর্যন্ত দেয় না। খোঁজখবর নেওয়া তো দুরেই থাক! আর শিহানের কতটা প্রশংসা করলো, সে দেখলেই ফুপির সাথে কত গল্প জুড়ে দেয়। আর তুমি কিসের ভাতিজা আর কিসের জামাই হয়েছো, হ্যাঁ? আমার বাবা-মা কি খুব বেশি কিছু প্রত্যাশা করে তোমার কাছে? দেখলে কথা বলবে, একটু ভালোমন্দের খবরাখবর নিবে, শ্বশুর শ্বাশুড়ির আগে তো তারা তোমার ফুপা-ফুপি। এসব কি তোমার দায়িত্বের মধ্যে পড়ে না? বাসায় ছোটখাটো একটা আয়োজন হলেও তোমাকে স্মরণ করে করে আফসোস করে, সব ভালো থাকলে তো কোনো আয়োজনেই মেয়ের জামাইকে বাদ রাখতো না। আর সেখানে তুমি সেই সুযোগটাই দাও না তাদের।”
রিজোয়ানা থামতেই ইভান বললো,
“ফুপি কি সত্যিই বলেছে এমন কিছু?”
“তোমার কি মনে হয়, আমি বানিয়ে বলছি?”
“তা না। মানে বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে।”
“শুনো, জামাইয়ের কাছ থেকে একটু ভালো আচরণ সব শ্বশুর শ্বাশুড়িই প্রত্যাশা করবে। তুমি যেমন আচরণ করবে তারাও তোমাকে তেমন ভাবেই বরণ করে নিবে। বউ বউ করে পাগল হলে বউ পর্যন্তই সম্মান আটকে থাকবে, শ্বশুর শ্বাশুড়ির আদর স্নেহ তোমার ভাগ্যে জুটবে না।”
“সত্য বলতে, আমি একটু ভয় পাই উনাদের সাথে কথা বলতে।”
“কিসের ভয়? আমার বাবা মা কি বাঘ না ভাল্লুক যে তোমাকে খেয়ে ফেলবে?”
“আহা, খেয়ে ফেলবে তেমন কিছু না। আমার সম্পর্কটা তো এখন শুধু ফুপু ভাতিজার না। জামাই হওয়া সত্ত্বে আমার মানটা একটু বেশি। শুধু আমার ক্ষেত্রে না, প্রত্যেকটা ছেলের ব্যাপারটাই এমন। ফুপি একটা কটু কথা বললে ভাতিজা সেটা সহজে গায়ে মাখবে না। কিন্তু জামাইয়ের মাইন্ডে লেগে যাবে৷ ধরো আমি নিজ থেকে কথা বলতে গেলাম আর ফুপি মুখ ফিরিয়ে নিলো, তখন আমার সম্মানটা কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে? সেই ভয়টাই পাই। দ্বিতীয়বার যাওয়ার উৎসাহ কি হারিয়ে ফেলবো না? তাছাড়া এরপর যদি আমাকে ডাকেও তা-ও তো যেতে পারবো না অপমানবোধের কারণে। তারচেয়ে কি ভালো নয় দূরেই থাকি। সেই ভেবে আর এগোতে চাই না। যেদিন নিজ থেকে ডাকবে সেদিনই যাবো। কারণ সেদিন তো আর অপমানবোধের শংকা থাকবে না।”
“হ্যাঁ, দূরে থেকে থেকে তো বেশি বেশি ভাবা ছাড়া আপনার কাজ নেই। চেষ্টা করে দেখেছেন কখনো, আমার মা মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে কি না?”
“ওইযে, ভয় ছিলো মনে। এখন যেহেতু জেনেছি মনোভাব, তো এখন থেকে করবো চেষ্টা।”
“হুহ্! শিহান কত কথা বলে, তার থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়নি কখনো আর উনার সাথে যেন আমার মায়ের চরম শত্রুতা!”
“বললাম তো করবো চেষ্টা। তোমার মাকে বলো, সকাল সন্ধ্যা কয়েকবার তোমার রুমের বারান্দা পরিদর্শন করতে। প্রতিদিন কথা বলবো। ওকে?”
“আহা! খুব ঠেকা পড়েছে তো আমার মায়ের। ঠেকা পড়েছে না তোমার সাথে কথা বলতে বারান্দায় অপেক্ষা করার?”
ইভান শব্দযোগে হেসে বললো,
“খুব তো ঝগড়া করলে, এবার একটু প্রেমে সাড়া দাও। সারাটাদিন পরিশ্রম করার পর বউয়ের কাছ থেকে তো একটু প্রেমালাপ প্রত্যাশা করতেই পারি। তাই না? মিষ্টি মিষ্টি কথা বললে মনটাও একটু ফ্রেশ ফ্রেশ লাগে। বুঝতে পেরেছো?”
রিজোয়ানা মলিনতার কণ্ঠে বললো,
“মামী নাকি অন্য মেয়ে দেখে বিয়ে করে নিতে বলেছে তোমাকে?”
“কে বলেছে এসব?”
“শুনলাম কারো কাছে।”
“রিজু, আমি মাইন্ড ফ্রেশ রাখতে চাইলাম আর তুমি খারাপ করে দিতে চাইছো?”
“জানতে চাইলাম শুধু।”
“রিজু, আমি শুধুমাত্র তোমাকে ভালোবাসি আর তোমাকেই প্রত্যাশা করি জীবনে। অন্য কাউকে জড়ানোর কথা দ্বিতীয়বার ভাবার প্রত্যাশাও রাখি না। সুতরাং কে কি বললো সেদিকে তোমার কান না দিলেও চলবে। তুমি কি কাঁদছো?”
“না।”
“কন্ঠ ভারি হয়ে গেছে। শুনো, ভবিষ্যতে এসব ফালতু ব্যাপারে বলে বলে আমাকে দূরে সরিয়ে দিয়ো না বলে দিলাম। তাহলে কিন্তু সতীনের সংসার করতে হবে।”
“ইশ! করে দেখুন না বিয়ে। আপনাকে আমি আস্ত রাখবো নাকি? ফোনে একদিন কথা না বলার কারণেই আপনার বারান্দার কি হাল হয়েছে, আর বিয়ে করলে আপনার কি হাল করবো আমি ভাবতে পারছেন?”
“হা হা হা… ভাবা দরকার। বাই দ্যা ওয়ে, অলসো লাভ ইউর জেলাসি এন্ড কিউটনেস।”

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here