লুকোচুরি,পর্ব:৮+৯

“লুকোচুরি”
পর্ব- ৮
(নূর নাফিসা)
.
.
রাতে ফেসবুক গ্রুপের এক পোস্টে ছেলে বাবুর ছবি দেখলো রিজোয়ানা। বাবুটির মাথায় সাহেবি টুপি, চোখে সানগ্লাস, পরনে জিন্স ও টিশার্ট, মুখে ঝুলে আছে মিষ্টি হাসি। তার ভালো লাগায় সে পোস্টে কমেন্ট করলো, “মাশাআল্লাহ, সো কিউট বেবি!😍”
তার ঠিক কিছুক্ষণ পরেই কমেন্টের রিপ্লাই এলো, “রিয়েলি?😍 আমাদের বেবিরা আরও বেশি কিউট হবে।😌”
ইভান করেছে কমেন্টের রিপ্লাই! রিজোয়ানা এংরি রিয়েক্ট দিয়ে রিপ্লাই করলো, “তুমি এখানে কি করছো!😤”
“তুমি যেখানে, আমি সেখানে। সে কি জানো না…?🤗”
“প্রয়োজন নেই তো জানার। আরেকবার দেখলে ঠ্যাং কেটে রেখে দিবো।😒”
ইভান হাহা রিয়েক্ট দিলো। এর পরপরই কমেন্ট ডিলিট করে দিলো রিজোয়ানা। ইভানের জন্য যত্রতত্র কমেন্ট করাও দুষ্কর হয়ে উঠেছে তার। লোকটা যেখানে সেখানে লজ্জায় ফেলতে প্রস্তুত! কমেন্ট ডিলিট করে সারতে পারেনি, এদিকে ইভান কল করে বসলো। রিজোয়ানা রিসিভ করে বললো,
“কি হয়েছে আবার?”
“কমেন্ট ডিলিট করলে কেন?”
“আপনি রিপ্লাই করলেন কেন?”
“তোমাকে জানাতে, আমাদের বেবিরাও সো মাচ কিউট কিউট হবে যে।”
“শাট আপ!”
“আচ্ছা, বেবিদের নাম কি রাখবে?”
“আযব তো! সমস্যা কি আপনার?”
“আচ্ছা, এমন নাম রাখবে যেটা দুজনেই ডাকতে পছন্দ করবো।”
“ফোন রাখলাম আমি। জরুরি কোনো কথা আছে?”
“এতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে কথা বলছি, সেটা কি তোমার কাছে জরুরি মনে হচ্ছে না?”
“না হচ্ছে না। আমার ঘুম পাচ্ছে। আমি ঘুমাবো।”
“রিজু, ডু ইউ নো? তোমাকে ইদানিং বাচ্চার মা, বাচ্চার মা লাগে।”
রিজোয়ানা খিলখিলিয়ে হেসে বললো,
“লাগুক। আমি বুড়ি, আপনি বুড়ো। হয়েছে?”
বিপরীতে ইভান হেসে বললো,
“ওকে, ঘুমাও। সেহেরিতে ডেকে তুলো।”
“পারবো না।”
“কথায় কথায় না বলার অভ্যাস বর্জন করো। আল্লাহ পাপ দিবে।”
“আল্লাহ, আমার সব পাপ তোমার উপর ঢেলে দেক।”
“কি বউরে বাবা! তুমি তো দেখছি যত্রতত্র আমাকে ফাসিয়ে দিয়ে চলে আসবে!”
“প্রয়োজন হলে দিবো না আবার! হিহিহি…”
.
প্রথম রমজানে মায়ের সাথে ইফতার তৈরি করে বেশ আনন্দিত রিজোয়ানা। তারপর বাবামা ও ভাইয়ার সাথে একত্রে ইফতার করে উপভোগ করলো তার সার্থকতা। নিজের জন্য আলাদা করে চপ তুলে রাখা, ভাইয়ার জন্য আলাদা করে চপ বাটিতে তুলে রাখা বরাবরই চলে। এবারও ব্যতিক্রম কিছু না। ইফতারের পর অবসরে তারা সেই চপ খায়। মাঝেমধ্যে কাড়াকাড়িও চলে৷
দ্বিতীয় রমজানে, সকালবেলা অয়ন নিয়নের রুমে থেকেই এদিকে রিজোয়ানার মুখ নড়তে চড়তে দেখে ইভান বড় বড় চোখ করে তাকালো। রিজোয়ানা তখন বারান্দার দরজার পাশে হাটছিলো। ইভানকে দেখে সে-ও চুপসে গেছে। ইভান ঘন ঘন পলক ফেলে বারান্দায় এসে বললো,
“এসব কি হচ্ছে? হ্যাঁ?”
“কি হচ্ছে?”
“রমজান মাস, আর তুমি কি না! মা যদি দেখে তার বউ মা এসব করে বেড়ায় তো কি ভাববে বলো তো! এতো বড় মেয়ে রোজা রাখে না, সেই জবাবদিহিতা কি আমাকে দিতে বলবে না?”
“আপনার মা যদি মুর্খ হয়ে থাকে, তবে বলবে।”
“শ্বাশুড়ি মায়ের অপমান করো মেয়ে?”
“আমি কোথায় অপমান করলাম? বরং আপনি নিজের বউকে অপমান করছেন।”
ইভান একগাল হেসে বললো,
“খাবে ভালো কথা। অন্যদিকে থেকেও তো খেতে পারো। মা নাহয় দেখেও কিছু বলবে না। তোমার গুড্ডু সুড্ডুও তো রোজা রাখে। তাদের নজরে যদি পড়ে যাও সারাদিন গান গাইবে তোমায় নিয়ে।”
“আমি ওদিকেও খেতে পারবো না, বাবা ভাইয়ের সামনে পড়ে যাওয়ার লজ্জায়, নিজের রুমে এসেও খেতে পারবো না তোমাদের লজ্জায়। তো আমার খাওয়াদাওয়াই বন্ধ করে দেওয়া উচিত। খাবোই না আর।”
“আহা! তোমাকে খেতে নিষেধ করছে কে! খাও, নিজের রুমেই খাও। পর্দা টেনে দিয়ে খাও।”
“না, খাবোই না। পর্দাও টানার দরকার নেই। তখন আবার দেখা যাবে কেউ পর্দার আড়াল থেকে বেরিয়ে এসে বলবে এভাবেও খেয়ো না।”
“হা হা হা! ভালোর জন্য বললাম, ভালো লাগে না। যেভাবে ইচ্ছে খাও। তুমি লজ্জায় পড়লে তো আর আমার কিছু না।”
“হু, তোমার কিছুই না।”
“দেখো, ঘটনা ঘটে গেলে আমি কিন্তু কোনো সামাল দিতে পারবো না।”
“চুপ থাকো। এতো সেজেগুজে কোথায় যাচ্ছো এখন?”
“অফিসে।”
“হাফ টাইম করেছে?”
“হাফ না। দুই ঘন্টা সময় কমিয়েছে। আসি। বেশি বেশি খাওয়াদাওয়া করো। একটু পরপরই খেয়ো। যেভাবে ইচ্ছে সেভাবে খেয়ো। ভুলে আবার কাউকে খাওয়ার জন্য ডেকে বসো না যেন। ঠিক আছে?”
“হুহ্!”
ইভান মুচকি হেসে চলে গেলো বিপরীতে রিজোয়ানা ভেঙচি কাটলো। দুপুরের দিকে মেহমান এলো বাড়িতে। লুবনার এক স্কুল ফ্রেন্ড এসেছে তার স্কুল পড়ুয়া ছেলেকে নিয়ে। রিজোয়ানা প্রথমে মিটিমিটি হাসছিলো তার মায়ের বান্ধুবীর এইটুকু বাচ্চা দেখে। মায়েরা মায়েরা তো সমবয়সী অথচ তারা ভাই বোন এদিকে কত বড়! আর উনার ছেলের বয়স মাত্র নয় বছর! তবে পিচ্চিটাকে দেখে রিজোয়ানার ভালো লেগেছে। খুবই মিষ্টি চেহারা। আর তাদের দেখে কি লজ্জা! রিজোয়ানা তার সাথে কথা বলার চেষ্টা করলে সে তার মায়ের পেছনে লুকানোর চেষ্টা করে। রিজোয়ানা তার হাত ধরে টেনে সামনে এনে বললো,
“ভয় পাও আপুকে? নাম কি তোমার?”
পিচ্চিটা এক আঙুল মুখের ভেতর দিয়ে বিড়বিড় করে বললো,
“ইয়াশ।”
“বাহ! সুন্দর নাম। মুখে হাত দেয় না। কিসে পড় তুমি?”
“থ্রিতে।”
সাথে সাথেই রিজোয়ানা বিস্মিত হয়ে উঠলো মিষ্টি চেহারার ভেতরের ইষ্টি দেখে! সে চমকে উঠে বললো,
“ওমা! তোমার দাত দেখি সব পোকায় খাওয়া!”
“আমি পোকা খাই না তো। আমি শুধু চকলেট খাই।”
“ও…! এজন্যই তো পোকা তোমাকে খায়। আর চকলেট খেয়ো না। ঠিক আছে?”
বাচ্চাটা মাথা নেড়ে হ্যাঁ সূচক জবাব দিলো। রিজোয়ানা তার হাত ধরে লিসানের রুমের দিকে গেলো লিসান ঘুম থেকে উঠেছে কি না দেখার জন্য। আজ তার অফিসের ছুটি তাই বাসায়ই আছে সে। রুমে এসে দেখলো লিসান মাত্র উঠেছে ঘুম থেকে। গোসল করবে তাই কাপড়চোপড় নিচ্ছে। তাদের দেখে বললো,
“এইটা আবার কে?”
“মায়ের বান্ধুবীর ছেলে। কিউট না ভাইয়া?”
“দাত কই?”
রিজোয়ানা খিলখিলিয়ে হেসে বললো,
“ছিনতাই হয়ে গেছে।”
“আহারে! বাবু, তোমার বাবাকে বলবে তারাতাড়ি পুলিশকে জানাতে। হুম?”
“আচ্ছা।”
রিজোয়ানা বললো,
“ভাইয়া, এ নাকি মায়ের স্কুল ফ্রেন্ডের বাচ্চা। আর দেখো, আমরা মায়ের কত বড় বাচ্চা! ভাবছিলাম আইন নির্ধারিত বয়সের শুরুতে যদি তুমি বিয়ে করে নিতে আজ তোমারও এই বয়সী একটা বাচ্চা থাকতো।”
“এটাকেই রেখে দে।”
বলতে বলতে লিসান বাথরুমে চলে গেলো। রিজোয়ানা হাসতে হাসতে পিচ্চিকে নিয়ে তার রুমের দিকে চলে গেলো।

“লুকোচুরি”
পর্ব- ৯
(নূর নাফিসা)
.
.
রুমে প্রবেশ করতে করতে রিজোয়ানা ইয়াশকে বললো,
“আমাদের বাসায় থাকবে তুমি?”
“হ্যাঁ, থাকবো।”
রিজোয়ানা হাত ছাড়তেই পিচ্চিটা ড্রেসিং টেবিলের পেছন থেকে ঝাড়ু বের করে ফ্লোরে আছড়াতে লাগলো। রিজোয়ানা ঝাড়ু নিয়ে বললো,
“এই, এই! ঝাড়ু দিতে হবে না তোমার। এমনিতেই আমাদের বাসায় রাখবো। কাজ করার প্রয়োজন নেই।”
“আমি ঝাড়ু দিতে পারি।”
“থাক, আমি তো ঝাড়ু দিয়েছি। এখন আর দিতে হবে না।”
পিচ্চিটা ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে শোপিচের দিকে আঙুল তাক করে বললো,
“এটা কি?”
“এটা, শোপিচ।”
“আমাকে দাও…”
“তুমি কি করবে এটা দিয়ে?”
“খেলা করবো।”
“এটা তো খেলনা না, বাবু। দাড়াও তোমাকে খেলনা দিচ্ছি।”
রিজোয়ানা লিসানের রুমে এসে নষ্ট সাউন্ডবক্সট খুঁজে নিয়ে আবার নিজের রুমে এলো। এসে দেখে পিচ্চিটা ড্রেসিং টেবিল থেকে তার লোশন নিয়ে নিজের শরীরে মাখতে শুরু করেছে। দুহাত আর মুখ মাখামাখি! শরীরে যতটুকু না মেখেছে, তার চেয়ে বেশি মেখেছে ফ্লোরে। এইটুকু কাজ করতে তার তিন মিনিট সময়ই যথেষ্ট ছিলো! কেননা সাউন্ড বক্স খুজতে রিজোয়ানার তিন মিনিটের বেশি লাগেনি সে নিশ্চিত। রিজোয়ানা দৌড়ে এসে লোশনের কৌটা নিয়ে দেখলো একটুখানি অবশিষ্ট আছে মাত্র! অথচ এটার মাত্র একপঞ্চমাংশ সে ব্যবহার করেছিলো! প্রচুর রাগ হলেও সে তেমন কিছুই বললো না। তার হাত ধরে বাথরুমে নিয়ে যেতে যেতে বললো,
“এসব কি করেছো তুমি! আমি বলছিলাম না তোমার জন্য খেলনা নিয়ে আসছি। হাত ধোও।”
হাত মুখ ধুয়িয়ে নিজেই মুছে দিলো রিজোয়ানা। অতঃপর সাউন্ডবক্স হাতে দিয়ে খাটে বসালে পিচ্চি বললো,
“এটা কি?”
“এটা সাউন্ড বক্স। তুমি এটা দিয়ে খেলা করো।”
“এটা দিয়ে কিভাবে খেলা করে? বড় গাড়ি নেই?”
“আমাদের বাসায় তো তোমার মতো বাবু নেই। তাই বড় বড় গাড়িও নেই।”
“তোমাদের বাসায় শুধু এইসব খেলনা আছে?”
“হ্যাঁ।”
“আমাদের বাসায় বড় বড় গাড়ি আছে। তুমি যেয়ো, তোমাকে খেলতে দিবো।”
“আচ্ছা, যাবো। তুমি এখানে বসে খেলা করো, নিচে নেমো না। ঠিক আছে?”
“আচ্ছা।”
মিনিটখানেকও পাড় হয়নি, রিজোয়ানার বিছানা আর বিছানা নেই! বালিশ, কুশনসহ বিছানার চাদর লণ্ডভণ্ড! রিজোয়ানা ধমকে ছোটখাটো এক আছাড় মেরে তাকে ফ্লোরে নামিয়ে দিলো। বিছানা ঠিক করতে যাবে, এমনি পিচ্চি চিৎকার দিয়ে সাউন্ডবক্স আছাড় মেরে আম্মুকে ডেকে কাঁদতে শুরু করলো। রিজোয়ানা বিছানা একদিকে ফেলে দৌড়ে এসে তার মুখ চেপে ধরে বললো,
“কাঁদে না ইয়াশ! তুমি তো ভালো ছেলে। ভালো ছেলেদের কাঁদলে তো পঁচা দেখায়। তোমাকে খাটে বসিয়ে দিবো আমি। চকলেট খাবে?”
গোমড়ামুখো পিচ্চি দুহাতে চোখ মুছে নিলো। ট্রলির উপর থেকে রিজোয়ানা একটা চকলেট এনে হাতে দিলো। পিচ্চি পুরো বক্সই নেওয়ার জন্য জেদ করতে লাগলো। তিনশো টাকা দিয়ে বারো পিসের এক বক্স চকলেট এনে দিয়েছিলো লিসান। মাত্র দুইটা খেয়েছে সে। বাকি দশটা এখন পিচ্চির দখলে! কি সুন্দর একহাতে চকলেট বক্স, অন্য হাতে সাউন্ড বক্স নিয়ে বেরিয়ে গেলো রুম ছেড়ে। রিজোয়ানার কান্না করতে ইচ্ছে করছিলো, কিন্তু কাঁদলো না। গলা টিপে মেরে ফেললে বোধহয় এই মুহুর্তে একটু শান্তি অনুভব করতে পারতো। রাগ চাপা রেখে সে বিছানা ঠিক করে রুমের দরজা লাগিয়ে বেরিয়ে এলো। যাতে দ্বিতীয়বার এই পিচ্চি রুমে প্রবেশ করতে না পারে। ড্রয়িং রুমে মা ও আন্টির পাশে সোফায় বসে বসে চকলেট খাচ্ছে ইয়াশ। রিজোয়ানা কিচেনে যেতে যেতে মনে মনে বললো,
“ভদ্রের বাচ্চা! তোর জ্বিভ কেন পোকায় খেলো না!”
বিরক্তি নিয়ে সে ইফতারের আয়োজন করতে লাগলো। একটু পরেই লিসানের ডাক পড়লে রিজোয়ানা ছুটে গেলো তার রুমে। এসে দেখলো লিসান ঘাড়ে তোয়াল ফেলে দু’হাতে দুইটা সাউন্ডবক্স নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। পাশে হুলোবেড়ালের মতো দাঁড়িয়ে আছে ইয়াশ! কম্পিউটারের নিচ দিক থেকে ক্যাবল এলোমেলোভাবে টেনে ফ্লোরে নামানো। নতুন থেকে একটা সাউন্ড বক্সের ক্যাবল ছেড়া! যেটা লিসানের হাতে ঝুলছে! লিসান দাত কিড়মিড়িয়ে বললো,
“এইটা এখানে কি করে এলো?”
“এর তো পা আছে, তাহলে পায়ে হেটে হেটেই হয়তো!”
“তুই কোথায় ছিলি? এই-যে ক্যাবলটা যে ছিড়ে ফেললো, দেখবি না!”
“আমি তো কাজ করছিলাম। এটাকে না দেখলাম সোফায় বসে আছে! এখানে চলে এলো কখন!”
“সেটা আমি জানি? মনটা চাইছে এখন কি করতে!”
বলতে বলতে লিসান বক্স দুটো রেখে মাথা মুছতে লাগলো। চেহারায় বিরক্তি ফুটে আছে। রিজোয়ানা পিচ্চিকে হালকা ধাক্কা দিয়ে বললো,
“আম্মুর কাছে যাও। এখানে আর আসবে না।”
“আমার খেলনা দাও।”
“খেলনা দিতে হবে না। বাসায় গিয়ে প্রাণ ভরে খেলো। বের হও।”
বিড়বিড় করে বলতে বলতে মাথায় ঠুসে ঠুসে রুমে থেকে বের করলো। যদিও আস্তে আস্তে দিয়েছে৷ নিজেদের পরিবারের কেউ হলে মাথা লাল করে ফেলতো। একে দিলে তো ভ্যা করে উঠবে। আস্তে আস্তে দেওয়ায় বোধহয় বুঝতে পারেনি তাকে মারছে৷ সে হয়তো ভেবেছে তাকে ঠেলছে। এতেই শেষ নয়! রুম থেকে বের হতেই ছো মেরে দৌড় দিয়ে ড্রয়িংরুমে এসে ভেস রেকের সাথে ধাক্কা খেলো। সাথে সাথেই টপার ভেসটা ফ্লোরে পড়ে ভেঙে টুকরো টুকরো! সবাই বিস্মিত! পিচ্চির মা এসে তাকে টেনে তুলতে তুলতে বললো,
“এভাবে দৌড় কেন দিলে! ফুলদানিটা যে ভেঙে ফেললে, এখন?”
লুবনা বলছে,
“আরে দেখ ব্যাথাট্যাথা পেয়েছে কি না!”
এইদিকে রিজোয়ানা ব্যাথার নিমকুচি করছে। এই মুহুর্তে এর চুলের মুঠি ধরে কয়েকটা আছাড় দিতে পারলে শান্তি লাগতো! সে চুপচাপ ভাঙা ভেস তুলে চলে গেলো। দশ মিনিট পরেই তারা চলে যাচ্ছে। লুবনা বলছিলো ইফতার করে যেতে। কিন্তু তাদের তাড়া আছে। পিচ্চিটা অবশিষ্ট চকলেট গুলোও নিয়ে গেলো সাথে। রিজোয়ানা প্রকাশ্যে আন্টিকে আবার আসার জন্য বললেও মনে মনে বললো,
“দ্বিতীয় বার না এলেই খুশি। এলেও দয়া করে এই বাঁদরকে ছাড়া আসবেন আন্টি।”
তারা বেরিয়ে যেতেই বড়সড় নিশ্বাস ফেলে মায়ের উদ্দেশ্যে বললো,
“তোমার ফ্রেন্ডের ছেলেও একখান! বাবাগো বাবা! এমন জল্লাদ পোলাপান জীবনে দেখিনি। এতো দুষ্টুমি মানুষ করে!”
“আজকালকার বাচ্চারা একটু দুষ্টুমি করেই।”
“একটু দুষ্টুমি করেছে? আমার রুমের বারোটা বাজিয়েছে, লোশন সব ফ্লোরে মেখেছে, ঝাড়ু ধরে এমন আছাড় দিচ্ছিলো আর দুতিন ঘা পড়লে ভেঙেই যেতো। ভাইয়ার কম্পিউটারের নতুন সাউণ্ডবক্স নষ্ট করে ফেলেছে। অবশেষে ফুলদানি শেষ! এগুলোকে একটু দুষ্টুমি বলো? এমন বাচ্চা তোমার ফ্রেন্ড পালন করে কিভাবে! আমার ছেলে হলে আছাড় দিয়ে কবেই মেরে ফেলতাম!”
“হু, মুখ এমন কত কিছুই বলে। সময় হলে দেখা যায়। যার যার সন্তান তার তার কাছেই আদরের। হোক যতই দুষ্ট, ফেলে দেয় কেউ!”
রিজোয়ানা রুমে এসে ফোন হাতে নিয়ে দেখলো ইভান কয়েকবার কল করেছে। সে কল ব্যাক করতেই ইভান রিসিভ করে বললো,
“ব্যস্ত নাকি? রান্না বান্না বসিয়ে দিয়েছো? আসবো ইফতারে?”
“কথা কম বলো। কীজন্য কল দিয়েছিলে সেটা বলো। মাথার চান্দী এমনিতেই গরম হয়ে আছে।”
“তাই নাকি! চান্দী গরম হওয়ার কারণ কি? খাওয়াদাওয়া সত্যিই হয় নি!”
“শাট আপ।”
“হা হা হা! আচ্ছা কি হয়েছে বলো?”
“আরে, বাসায় মেহমান এসেছিলো। মায়ের ফ্রেন্ড। এমন জল্লাদ এক পিচ্চি এনেছে সাথে, কয়েক মিনিটে ঘর লণ্ডভণ্ড করে ফেলেছে! মন চাইছিলো আছাড় দিয়ে মেরে ফেলি।”
“কয়েক মিনিটেই এই অবস্থা, নিজের বাচ্চাকাচ্চাদের কেয়ার করবে কিভাবে! তখন তো মাথাই খুঁজে পাওয়া যাবে না তোমার।”
“চুপ থাকো তো। মেজাজ আর খারাপ করো না। আজ এসময় হঠাৎ ফোন দিয়েছো যে?”
“বউয়ের একটু খোজখবর নিতে।”
“ইশ! যেন অফিস নয়, পার্কে গিয়েছে ঘুরতে! এই, তুমি সত্যি সত্যিই অফিসের নাম করে পার্কে যাওনি তো? সাথে কে?”
“এই হলো নারী জাতের সমস্যা। সন্দেহ করা ছাড়া যেন আর কোনো কাজই নেই। কাজের ফাঁকে তোমার খবর নেওয়াও এখন আমার দোষ হয়ে গেছে।”
রিজোয়ানা মৃদু হেসে বললো,
“আচ্ছা, করলাম না সন্দেহ। বলো কি বলবে, রান্না বসাতে হবে আমাকে।”
“মেহমান চলে গেছে?”
“হুম।”
“খেয়েছো দুপুরে? মানে খাওয়ার সুযোগ পেয়েছো।”
“তুমি না সবসময় বেশি বেশি।”
“বেশি কি করলাম। জানতে চাইলাম মাত্র।”
“হ্যাঁ, খেয়েছি।”
“আচ্ছা, একটু পরপর খেয়ে নিয়ো। এজন্যই কল করে যাচ্ছিলাম বারবার। আবার সত্যি সত্যিই না খেয়ে বসে আছো কি না!”
“না, খেয়েছি। তুমি খেয়েছো?”
“হ্যাঁ, এটাই তো মহা সমস্যা! নিজে খাবে, আবার যাকে তাকে সেধেও বসবে। আবার নাকি তুমি লজ্জা পাও! ওয়ার্কিং টাইম। রাখছি এখন।”
রিজোয়ানা ফোন রেখে খিলখিলিয়ে হেসে উঠলো। এক পাগলের জন্য মেজাজ খারাপ হলেও তার এই পাগলটার জন্য মনটা সম্পূর্ণ ভালো হয়ে গেলো।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here